১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে কথিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল জনাব আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। সুপ্রীমকোর্টে চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর গত ২২শে নভেম্বর রবিবার রাত ১২-টা ৫৫ মিনিটে (শনিবার দিবাগত রাতে) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাশাপাশি একই সঙ্গে তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।

মুজাহিদকে দাফন করা হয় ফরিদপুর শহরের পশ্চিম খাবাসপুরে তাঁর নিজ বাসভবনের অনতিদূরে অবস্থিত তাঁর প্রতিষ্ঠিত আইডিয়াল ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট মাদ্রাসার প্রাঙ্গণে। আর সালাউদ্দীন কাদেরকে দাফন করা হয় চট্টগ্রামের রাউজান উপযেলার গহিরা গ্রামে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে।

চট্টগ্রামের রাউজানের অধিবাসী সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরী (৬৭) বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে (২০০১-২০০৬) প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। এরশাদ সরকারের আমলে ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ তিনটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। আর ফরিদপুরের অধিবাসী জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদ (৬৮) ছিলেন বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী।

১৯৭১ সালে কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ ২০১৩ সালে আলী আহসান মুজাহিদ ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়। ঐ রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করলে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। এরপর আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলে গত ১৮ই নভেম্বর আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেন। ফলে মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল থাকে। মুজাহিদ ও সালাহউদ্দিন কাদেরের পক্ষে রিভিউ আবেদনের শুনানি করেন তাদের প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবূব হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানী করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবূবে আলম।

উল্লেখ্য, ফাঁসির পূর্বে উভয়ের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির নিকটে প্রাণভিক্ষা চাওয়া নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে উভয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে তা সরকারের মিথ্যা প্রোপাগান্ডা বলে জানানো হয়।

ফাঁসি কার্যকরের পর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুমাম কাদের চৌধুরী এক সংবাদ সম্মেলনে পিতাকে নির্দোষ দাবী করে বলেন, আমার পিতাকে হত্যা করা হয়েছে। সরকার প্রাণভিক্ষা চেয়েছে বলে নাটক করছে। অথচ কারাগারে তার সাথে শেষ সাক্ষাতে তিনি বলেন, ‘প্রাণভিক্ষা চাইলে আল্লাহ কাছে চাইব। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি তোমার বাবা, কারও কাছে মাথা নত করে না।  এ সরকার অনেক কাগজ বানাতে পারে’। হুমাম বলেন, ‘আমরা নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করছি। দেশের এখন এমন পরিস্থিতি যে প্রতিনিয়ত খুন-গুম হচ্ছে। অনেকে আপনজনের মরদেহ খুঁজে পাচ্ছে না। আমরা ভাগ্যবান যে সম্মানের সঙ্গে বাবাকে দাফন করতে পেরেছি’।

একই দাবী করেছেন মুজাহিদের ছেলে আলী আহমাদ মাবরূর। তিনি বলেন, ‘প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়টি ভিত্তিহীন, বোগাস এবং প্রশাসনের একটি সাজানো নাটক। দেশের মানুষের কাছে তাকে হেয় করার জন্য ও কাপুরুষ বানানোর জন্য তারা এ মিথ্যা অপপ্রচারের নাটক সাজিয়েছে।

উল্লেখ্য, সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরী দেশের অন্যতম প্রভাবশালী ‘চৌধুরী’ বংশের সন্তান। সারাদেশের আনাচে-কানাচে শেকড়ের মতো ছড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের এই বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারের আত্মীয়তা। পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি, পাকিস্তানের স্পিকার ও পরবর্তীতে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টর দায়িত্ব পালন করেন। নানা শ্বশুর সাবেক কংগ্রেসের নেতা ও আইয়ুব খানের খাদ্যমন্ত্রী ফরিদপুরের জমিদার আব্দুল্লাহ যহীরুদ্দীন লাল মিয়া। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ তার মামা শ্বশুর। চাচা শ্বশুর হলেন জাতীয় পার্টির সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা জাহাঙ্গীর মুহাম্মাদ আদেল। আবার জাহাঙ্গীর মোহাম্মাদ আদেলের শ্বশুর ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর আব্দুল মোনয়েম খান। ছোট ভাই বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক গিয়াসুদ্দীন কাদের চৌধুরীর শ্বশুর হলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিরক্ষা সচিব ও ভাষাসৈনিক মুজিবুল হক। আরেক ছোটভাই প্রয়াত সাইফুদ্দীন কাদের চৌধুরীর নানা শ্বশুর হলেন মুসলিম লীগের নেতা ও দার্শনিক আবুল হাশেম। আর আবুল হাশেমের পুত্র হলেন কট্টর বামপন্থী রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন ওমর। সব ছোটভাই জামালুদ্দীন কাদের চৌধুরী হলেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদার নাতি জামাই। ছালাহুদ্দীন কাদের চৌধুরীর আপন চাচাতো ভাই হলেন আওয়ামী লীগের এমপি ফযলে করীম চৌধুরী। আপন খালাতো ভাই হলেন প্রখ্যাত শিল্পপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। সালমান এফ রহমানের নিকটাত্মীয় হলেন বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ও আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। আবার সালাউদ্দীন কাদেরের অপর দুই খালাতো ভাই হ’লেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধান দুই বিচারপতি মাইনুর রেজা চৌধুরী ও সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেন। তাঁর আপন ফুফাতো ভাই হলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী।

[আমরা আল্লাহ কাছে যথার্থ বিচার কামনা করছি। মৃতদের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি এবং তাঁদের শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি ও ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিচ্ছি। একই সাথে ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের প্রতি ইসলামী পথে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগের আহবান জানাচ্ছি (স.স.)]






আরও
আরও
.