ভূমিকা :
তাক্বদীরের ফায়ছালার প্রতি সন্তুষ্ট হওয়া ঈমানের অঙ্গ। প্রশান্তিময় পবিত্র জীবন লাভের অন্যতম হাতিয়ার। এই সন্তুষ্টি বান্দার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত এক অমূল্য নে‘মত। বিপদাপদে ও বালা-মুছীবতে প্রশান্তির ডালি নিয়ে এই সন্তুষ্টি নাযিল হয় বান্দার হৃদয় কাননে। ফলে বান্দা সেই বিপদে বিচলিত হয় না, পেরেশান হয় না; বরং এটা তাক্বদীর হিসাবে গ্রহণ করে নেয় এবং এটাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ছওয়াব লাভের একটি মাধ্যম মনে করে। তাক্বদীরে সন্তুষ্ট ব্যক্তি জীবনের সকল পর্যায়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তে খুশি হয়ে অযুত প্রশান্তি লাভ কয়ে। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা তাক্বদীরের ফায়ছালায় সন্তুষ্ট থাকার কতিপয় ফলাফল আলোকপাত করব ইনশাআল্লাহ।
(১) ঈমানের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করা যায় :
তাক্বদীরের ফায়ছালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকার সবচেয়ে বড় ফলাফল হচ্ছে এর মাধ্যমে বান্দা ঈমানের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। আল্লাহর সিদ্ধান্তকে খুশি মনে মেনে নেওয়ার মাধ্যমে হৃদয়জুড়ে যে অপার্থিব প্রশান্তি পাওয়া যায়, তা অন্য কোন মাধ্যমে লাভ করা সম্ভব নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,ذَاقَ طَعْمَ الْإِيمَانِ مَنْ رَضِيَ بِاللهِ رَبًّا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا، وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولًا، ‘সে ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করতে পেরেছে, যে আল্লাহকে ‘রব’ হিসাবে, ইসলামকে ‘দ্বীন’ হিসাবে এবং রাসূলকে ‘নবী’ হিসাবে পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছে’।[1] ইবনু রজব হাম্বলী (রহঃ) বলেন, فإذا ذاق العبد حلاوة الإيمان ووجد طعمه وحلاوته ظهر ثمرة ذلك على لسانه وجوارحه فاستحلى اللسان ذكر الله وما والاه وسرعت الجوارح إلى طاعة الله، ‘বান্দা যখন ঈমানের স্বাদ পেয়ে যায় এবং এর মিষ্টতা অনুভব করতে পারে, তখন তার জিহবা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এর প্রভাব প্রকাশ পায়। তার জিহবায় আল্লাহর স্মরণ এবং তাঁর সন্তুষ্টি মূলক কথা মিষ্টি লাগে, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহর আনুগত্যের পানে দ্রুত ছুটে চলে’।[2] আব্দুল আযীয বিন রাওয়াদ (রহঃ)-এর একটি চোখ বিশ বছর যাবৎ নষ্ট ছিল। কিন্তু তার সন্তান ও পরিবারের কেউ এটা জানত না। একদিন তার এক ছেলে বিষয়টি টের পেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আববা! আপনার চোখে কি সমস্যা?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, বেটা! সেই সত্তার প্রতি আমি সন্তুষ্ট- যিনি তোমার আববার চোখ বিশ বছর আগে নষ্ট করে দিয়েছেন’।[3]
(২) আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম :
তাক্বদীরের ফায়ছালায় সন্তুষ্ট থাকার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে ধন্য হ’তে পারে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إنَّ عِظَمَ الجزاءِ مَع عِظَمِ البَلاء، وإنَّ الله تعالى إذَا أَحَبَّ قَوْماً ابْتَلاَهُمْ، فَمنْ رَضِيَ فلَهُ الرِّضَا، وَمَنْ سَخِطَ فَلَهُ السَّخَطُ، ‘নিশ্চয়ই বড় পরীক্ষায় বড় পুরস্কার রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন জাতিকে ভালবাসেন, তখন তাদের পরীক্ষায় ফেলেন। ফলে তাতে যে সন্তুষ্ট হবে, তার জন্য (আল্লাহর) সন্তুষ্টি রয়েছে। আর যে (আল্লাহর পরীক্ষায়) অসন্তুষ্ট হবে, তার জন্য রয়েছে আল্লাহর অসন্তুষ্টি’।[4]
ছালেহ আল-উছায়মীন (রহঃ) বলেন,بشرى للمؤمن، إذا ابتلى بالمصيبة فلا يظن أن الله سبحانه يبغضه، بل قد يكون هذا من علامة محبة الله للعبد، يبتليه سبحانه بالمصائب، فإذا رضي الإنسان وصبر واحتسب فله الرضى، وإن سخط فله السخط، ‘মুমিনের জন্য সুসংবাদ! কেননা যখন সে বালা-মুছীবতের মাধ্যমে পরীক্ষায় নিপতিত হয়, তখন এটা মনে করে না যে- আল্লাহ তার প্রতি রাগান্বিত হয়েছেন (এজন্য তাকে বিপদ দিয়েছেন)। বরং (সে বিশবাস করে যে,) বানদার প্রতি আল্লাহর ভালোবাসার আলামত হ’ল এই সকল বিপদাপদ। তিনি বিপদাপদ দিয়ে বানদাকে পরীক্ষা করেন। ফলে মানুষ যখন (বালা-মুছীবতে) খুশি থেকে ধৈর্যধারণ করে এবং ছওয়াবের আশা করে, তখন তার জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি নির্ধারিত হয়। আর সে যদি এতে অসন্তুষ্ট হয়, তাহ’লে তার জন্য আল্লাহর অসন্তুষ্টি বরাদ্দ হয়’।[5] ইয়াহইয়া ইবনে মু‘আয (মৃ. ২৫৮হি.) বলেন, إذا كنت لا ترضى عن الله كيف تسأله الرضا عنك؟ ‘যদি তুমি আল্লাহর (ফায়ছালার প্রতি) সন্তুষ্ট থাকতে না-ই পার, তবে কিভাবে তার সন্তুষ্টি চাইতে পার’?[6]
(৩) বান্দা বিপদকে নে‘মত হিসাব গ্রহণ করে :
বান্দা যখন তাক্বদীরের ফায়ছালাকে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়, তখন জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে সকল বিপদাপদ ও দুঃখ-দুর্দশাকে সহজভাবে নিতে শিখে। কষ্টের আতিশয্যে তিনি কখনো হতাশ হন না এবং ভেঙ্গে পড়েন না। ফলে কোন আঘাতই তাকে কাবু করতে পারে না। বরং তিনি আল্লাহর প্রতিটি সিদ্ধান্তে কল্যাণ দেখতে পান এবং বিপদাপদকে আল্লাহর নে‘মত হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত হন। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জরাক্রান্ত হয়ে পড়লে আমি তাঁকে দেখতে গেলাম এবং আলাপচারিতার ফাঁকে তাঁকে বললাম,
يَا رَسُولَ اللهِ أَيُّ النَّاسِ أَشَدُّ بَلَاءً؟ قَالَ:্রالْأَنْبِيَاءُগ্ধ، قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: ثُمَّ الصَّالِحُونَ، إِنْ كَانَ أَحَدُهُمْ لَيُبْتَلَى بِالْفَقْرِ، حَتَّى مَا يَجِدُ أَحَدُهُمْ إِلَّا الْعَبَاءَةَ يَحُوبُهَا، وَإِنْ كَانَ أَحَدُهُمْ لَيَفْرَحُ بِالْبَلَاءِ، كَمَا يَفْرَحُ أَحَدُكُمْ بِالرَّخَاءِ،
‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! মানুষের মধ্যে সর্বাধিক বিপদগ্রস্থ কে? তিনি বললেন, ‘নবীগণ’। আমি বললাম, তারপর কে? তিনি বললেন, ‘সৎকর্মশীল বান্দাগণ। তাদের কেউ কেউ এতটা দারিদ্র পীড়িত হয়ে পড়ত যে, শেষ পর্যন্ত তার কাছে পরিধেয় বস্ত্র ছাড়া আর কিছু থাকে না। তবুও তাদের কেউ বিপদে এতটা প্রশান্ত ও উৎফুল্ল থাকে, যেমন তোমাদের কেউ ধন-সম্পদ প্রাপ্তিতে আনন্দিত হয়ে থাকে’।[7]
সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন,لَيْسَ بِفَقِيهٍ مَنْ لَمْ يَعُدَّ الْبَلَاءَ نِعْمَةً، وَالرَّخَاءَ مُصِيبَةً، ‘সেই ব্যক্তি প্রকৃত জ্ঞানী নয়, যে বিপদকে নে‘মত মনে করে না এবং প্রাচুর্যকে মুছীবত হিসাবে গণ্য করে না’।[8] ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,ارض عن الله في جميع ما يفعله بك، فإنه ما منعك إلا ليعطيك، ولا ابتلاك إلا ليعافيك، ولا أمرضك إلا ليشفيك، ولا أماتك إلا ليحييك، فإياك أن تفارق الرضى عنه طرفة عين، فتسقط من عينه، ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে আরোপিত সকল বিষয়ের প্রতি তুমি সন্তুষ্ট থাক। কেননা তোমাকে বিশেষ কিছু প্রদান করার জন্যই তিনি কোন কিছু পাওয়া থেকে তোমাকে বিরত রাখেন। তোমাকে উদ্ধার করার জন্যই কোন পরীক্ষায় নিপতিত করেন। তোমাকে সুস্থ করার জন্য তিনি তোমাকে রোগ-ব্যাধিকে আক্রান্ত করেন। তোমাকে নতুন জীবন প্রদানের জন্যই তোমাকে মৃত্যু দান করেন। সুতরাং সাবধান! অল্পক্ষণের জন্য হ’লেও আল্লাহর সন্তুষ্টির সীমানা থেকে পৃথক হয়ো না, তাহ’লে তুমি তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে ছিটকে পড়বে’।[9]
তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ যখন কোন মুমিন বান্দার ব্যাপারে ফায়ছালা করেন, তখন তাকে কিছু না দেওয়াটাই হয়ে যায় দান। তার উপর আপতিত বিষয়টা নে‘মত রূপে ধরা দেয়, যদিও সেটা পরীক্ষার ছূরতে আসে। তার উপর আপতিত বিপদটা সুরক্ষা স্বরূপ, যদিও সেটা বিপদের ছূরতে আসে। অজ্ঞতা ও পাপাচারের কারণে বান্দা করুণা, নে‘মত, সুস্থতা বলতে সেটাই বোঝে যেটা তার কাছে তৎক্ষণাৎ আসে এবং তার স্বভাবের সাথে মিলে যায়। বস্তুতঃ তার যদি যথেষ্ট জ্ঞান থাকত, তাহ’লে না দেওয়াটাকেই নে‘মত মনে করত এবং বিপদকেই সে রহমত মনে করত’।[10]
(৪) হৃদয়ের ইবাদত সম্পাদিত হয় :
তাক্বদীরের ফায়ছালাতে সন্তুষ্ট থাকা হৃদয়ের ইবাদত। কেননা ভাল-মন্দ ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস রাখা ঈমানের অপরিহার্য অংশ। এটাকে অন্তরের ঈমান বলা হয়। এই বিশ্বাসের পারদ যখন নিম্নগামী হয়, তখন ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে তাক্বদীরের ফায়ছালায় সন্তুষ্ট থাকা কষ্টকর হয়ে যায় এবং ঈমানের স্বাদ আস্বাদনও দুরূহ হয়ে পড়ে। সুতরাং বান্দাকে এ মর্মে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ তার ভাগ্যে যা কিছু নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তা-ই সে পেয়েছে, পাচ্ছে এবং পাবে। তার রিযিকের সর্বশেষ দানাটি গ্রহণ না করা পর্যন্ত সে মৃত্যুবরণ করবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ نَفْسًا لَنْ تَمُوْتَ حَتَّى تَسْتَوْفِيَ رِزْقَهَا وَإِنْ أَبْطَأَ عَنْهَا، ‘কোন প্রাণীই তার জন্য নির্ধারিত রিযিক পূর্ণরূপে না পাওয়া পর্যন্ত মরবে না। যদিও তার রিযিকপ্রাপ্তিতে কিছুটা বিলম্ব হয়’।[11]
তিনি বলেন,لَا يُؤْمِنُ عَبْدٌ حَتَّى يُؤْمِنَ بِالقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ، حَتَّى يَعْلَمَ أَنَّ مَا أَصَابَهُ لَمْ يَكُنْ لِيُخْطِئَهُ، وَأَنَّ مَا أَخْطَأَهُ لَمْ يَكُنْ لِيُصِيبَهُ، ‘কোন বান্দা মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না সে তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপর ঈমান আনবে। এমনকি তার নিশ্চিত বিশ্বাস থাকতে হবে যে, যা কিছু ঘটেছে তা কিছুতেই অঘটিত থাকত না এবং যা কিছু ঘটেনি তা কখনোও তাকে স্পর্শ করার ছিল না’।[12]
অর্থাৎ মানবজীবনের যাবতীয় বিষয় আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত তাক্বদীর অনুযায়ী পরিচালিত হয়। তাক্বদীরে যা আছে, মানুষ চাইলেও তা ঘটবে এবং না চাইলেও তা ঘটবে। সেকারণ বান্দা যখন তাক্বদীরের ফায়ছালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, তখন সে বড় ধরনের ইবাদত সম্পাদন করে ফেলে। ইবনে ইয়াযীদ আল-বাছরী (মৃ. ১৭৭ হি.) বলেন, مَا أَحْسِبُ أَنَّ شَيْئًا مِنَ الْأَعْمَالِ يَتَقَدَّمُ الصَّبْرَ إِلَّا الرِّضَا، وَلَا أَعْلَمُ دَرَجَةً أَشْرَفَ وَلَا أَرْفَعَ مِنَ الرِّضَا، وَهُوَ رَأْسُ الْمَحَبَّةِ، ‘আমার মনে হয় না (আল্লাহর বিধানের ওপর) সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য কোন আমল ধৈর্যের ওপর অগ্রগামী হ’তে পারে। আমি সন্তুষ্টির চেয়ে উন্নত মর্যাদার এবং এর চেয়ে উন্নত স্তরের কথা জানি না। এটাই রবকে ভালোবাসার মূল মাধ্যম’।[13]
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,أَنَّ مَنْ مَلَأَ قَلْبَهُ مِنَ الرِّضَا بِالْقَدَرِ: مَلَأَ اللهُ صَدْرَهُ غِنًى وَأَمْنًا وَقَنَاعَةً، ‘যে ব্যক্তি তাক্বদীরের প্রতি সন্তুষ্টির মাধ্যমে তার হৃদয়কে পূর্ণ করে, আল্লাহ তার বক্ষকে প্রাচুর্য, নিরাপত্তা ও অল্পেতুষ্টি দিয়ে ভরে দেন’।[14] তিনি আরো বলেন,أساس كل خير أَن تعلم أَن مَا شَاءَ الله كَانَ وَمَا لم يَشَأْ لم يكن، ‘সকল কল্যাণের মূল হ’ল তোমার এ কথা জানা যে, আল্লাহ যা চান, তা-ই হয়। আর তিনি যা চান না, তা হয় না’।[15]
(৫) বান্দাকে আল্লাহর প্রতি আগ্রহী করে তোলে :
যারা সর্বদা আল্লাহর প্রতি বিনীত থাকেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য পাগলপারা থাকেন, তারা তাক্বদীরের সকল ফায়ছালাকে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নিতে পারেন। ফলে তাদের হৃদয় স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি আরো আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই গুণ থাকার কারণে আবূবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তোষভাজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরে বসে ছাহাবায়ে কেরামের সামনে বক্তব্য দিলেন এবং বললেন, إِنَّ عَبْدًا خَيَّرَهُ اللهُ بَيْنَ أَنْ يُؤْتِيَهُ مِنْ زَهْرَةِ الدُّنْيَا مَا شَاءَ، وَبَيْنَ مَا عِنْدَهُ، فَاخْتَارَ مَا عِنْدَهُ، ‘আল্লাহ্ তাঁর এক বান্দাকে দু’টি বিষয়ের একটি বেছে নেওয়ার অধিকার দিয়েছেন। তার একটি হ’ল, তার ইচ্ছা অনুযায়ী দুনিয়ার ভোগ-বিলাস, আর একটি হ’ল, আল্লাহর নিকট যা রক্ষিত রয়েছে, তা। তখন সে বান্দা আল্লাহর কাছে যা রয়েছে, তাই পসন্দ করলেন (অর্থাৎ বিপদ-আপদের ঝাপটা ও রোগ-শোকের কষ্টের বিনিময়ে ছওয়াব লাভ করাকে তিনি পসন্দ করলেন)।
একথা শুনে আবূবকর (রাঃ) কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, আমাদের পিতা-মাতাকে আপনার জন্য কুরবানী করলাম। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, তাঁর অবস্থা দেখে আমরা বিস্মিত হ’লাম। লোকেরা বলতে লাগল, এ বৃদ্ধের অবস্থা দেখ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক বান্দা সম্বন্ধে খবর দিলেন যে, তাকে আল্লাহ ভোগ-সম্পদ দেওয়ার এবং তার কাছে যা রয়েছে, এ দু’য়ের মধ্যে বেছে নিতে বললেন, আর এই বৃদ্ধ বলছে, আপনার জন্য আমাদের পিতামাতা উৎসর্গ করলাম। তখন আবূবকর (রাঃ)-এর প্রতি ইঙ্গিত করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ইনি তো সেই ইখতিয়ারপ্রাপ্ত বান্দা। আর আবূবকরই হ’লেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ أَمَنَّ النَّاسِ عَلَىَّ فِى صُحْبَتِهِ وَمَالِهِ أَبُو بَكْرٍ، ‘যে ব্যক্তি তার সঙ্গ ও সম্পদ দিয়ে আমার প্রতি সবচেয়ে বেশী দয়া করেছেন, তিনি হ’লেন আবূবকর (রাঃ)। যদি আমি আমার উম্মতের কোন ব্যক্তিকে অন্তরঙ্গ হিসাবে গ্রহণ করতাম, তাহ’লে আবূবকরকেই করতাম। তবে তার সঙ্গে আমার ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক রয়েছে। মসজিদের দিকে আবূবকর (রাঃ)-এর দরজা ছাড়া অন্য কারো দরজা খোলা থাকবে না’।[16]
(৬) বান্দাকে ধৈর্যশীল হ’তে শেখায় :
তাক্বদীরের ফায়ছার প্রতি সন্তুষ্টি বান্দাকে ধৈর্যশীল হ‘তে শেখায়। জীবনের সকল ঘাত-প্রতিঘাতে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের দীক্ষা দেয়। ইউনুস ইবনে ইয়াযী (রহঃ) বলেন, আমি রবী‘আ বিন আবূ আব্দুর রহমানকে জিজ্ঞেস করলাম, مَا مُنْتَهَى الصَّبْرِ؟ ‘ধৈর্যের চূড়ান্ত সীমানা কী’? জবাবে তিনি বলেন, أَنْ يَكُونَ يَوْمَ تُصِيبُهُ الْمُصِيبَةُ مِثْلَهُ قَبْلَهَا ‘তোমার বিপদে আক্রান্ত হওয়ার দিনটি বিপদে আক্রান্ত হওয়ার আগের দিনের মতো হওয়া’।[17] ছালেহ আদ-দাহহান (মৃ. ১৫০হি.) বলেন, জাবের ইবনে যায়েদ (২১-৯৩হি.)-এর কয়েকজন মেয়ে ছিল। তন্মধ্যে একটি মেয়ে ছিল অন্ধ। কিন্তু কখনো তার থেকে এই মেয়ের মৃত্যু কামনা করার কথা শোনা যায়নি; বরং তিনি এই মেয়ের মাধ্যমে ছওয়াবের আশা করতেন।[18] আবূ হাফস আল-ফাল্লাস (রহঃ) বলেন, ইয়াহইয়া ইবনে সা‘ঈদ (রহঃ) একবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আল্লাহ আপনাকে সুস্থ করে দিবেন ইনশাআল্লাহ। তিনি বললেন, أحبّه إِلَيّ أحبّه إِلَى الله ‘আমার কাছে তা-ই প্রিয়, যা আল্লাহর কাছে প্রিয়’।[19]
তাছাড়া তাক্বদীরের প্রতি সন্তুষ্টি বান্দার যাবতীয় হতাশা, দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা দূরীভূত করে দেয়। কারণ সে যখন মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে যে, আমার এই বিপদটি আকাশ-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে ভাগ্যে নির্ধারণ হয়ে আছে এবং এই বিপদের মধ্যেই আমার কল্যাণ আছে। তখন তার হতাশা ও দুশ্চিন্তা মুহূর্তেই উবে যাবে। যেমন তাক্বদীরের ফায়ছালায় সন্তুষ্ট কোন বান্দা যদি ব্যবসায় পাঁচ লক্ষ টাকা লস করে, তবে সে কখনোই ভেঙ্গে পড়বে না; বরং তাঁর এই ক্ষতির মধ্যেই সে কল্যাণ খোঁজার চেষ্টা করবে এবং ধৈর্যধারণ করবে, ফলে কোন দুশ্চিন্তা তাকে কাবু করতে পারবে না। কিন্তু তাক্বদীরের প্রতি দুর্বল বিশ্বাসী ব্যবসায়ী হা-হুতাশ করতে থাকবে, হয়তোবা খানাপিনা ও ঘুম পরিত্যাগ করে বসবে, দুশ্চিন্তা মুষড়ে পড়বে এবং তার এই ক্ষতির জন্য বিভিন্ন উপলক্ষ ও ব্যক্তিকে দোষারোপ করতে থাকবে। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) উল্লেখ করেছেন,من قرت عينه بالله تعالى قرت به كل عين، ومن لم تقر عينه بالله تقطع قلبه على الدنيا حسرات، ‘আল্লাহর (ফায়ছালার) ব্যাপারে যার চোখ শীতল থাকবে, তাতে তার চোখ শীতল থাকবে। আর আল্লাহর ব্যাপারে যার দৃষ্টি শীতল হবে না, দুনিয়ার ব্যাপারে তার দৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্থ অবস্থায় বিক্ষিপ্ত থাকবে’।[20]
(৭) দো‘আ কবুলের সম্ভাবনা তৈরী হয় :
বালা-মুছীবতে ও বিভিন্ন প্রয়োজনে আমরা আল্লাহর কাছে দো‘আ করে থাকি। কিন্তু দো‘আ কবুল হ‘তে বিলম্ব হ’লে বিচলিত হ’য়ে বলি যে, এতো এতো দো‘আ করলাম। কিন্তু কবুল হ’ল না। এমন করা তাক্বদীরের ফায়ছালায় খুশি থাকার পরিপন্থী। আর যখন বুক ভরা আশা নিয়ে দো‘আ করা হয় এবং দো‘আ কবুলে দেরী হ’লে তাতেই কল্যাণ নিহিত থাকার বিশ্বাস পোষণ করা হয়, তখন সেই দো‘আ কবুলের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন, ‘আমি এক বিস্ময়কর ব্যাপার দেখেছি যে, কোন মুমিনের উপর বিপদ নেমে আসার পর সে দো‘আ করে। অনেক বেশী করে আল্লাহর কাছে চাইতে থাকে। কিন্তু কবুলের কোন লক্ষণ দেখতে না পেলে প্রায় আশা ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম হয়, তখন আল্লাহ তার অন্তরের দিকে দৃষ্টি দেন। যদি সে আল্লাহর ফায়ছালায় সন্তুষ্ট থাকে, তার অনুগ্রহের ব্যাপারে নিরাশ না থাকে, তাহ’লে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আল্লাহ তৎক্ষণাৎ তার ডাকে সাড়া দেন’।[21] তিনি আরো বলেন,من يريد تعجيل الإجابة، ويتذمر إن لم تتعجل، فذاك ضعيف الإيمان، ويرى أن له حقًّا في الإجابة، وكأنه يتقاضى أجرة عمله ‘যে ব্যক্তি দ্রুত দো‘আ কবুল হওয়ার প্রত্যাশা করে। আর দ্রুত কুবল না হ’লে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে, এটা তার দুর্বল ঈমানের অন্তর্ভুক্ত। সে মনে করে দো‘আ কবুল হওয়া যেন তার অধিকার। যেন সে তার আমলের প্রতিদানের জন্য (আল্লাহর কাছে) পাওনা আদায় করছে’।[22]
(৮) অল্পেতুষ্টির গুণ অর্জিত হয় :
আল্লাহর নির্ধারিত ভাগ্যকে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেওয়ার যত উপকারিতা আছে, তন্মধ্যে অন্যতম উপকারিতা হচ্ছে- এর মাধ্যমে জীবনের সকল পর্যায়ে অল্পেতুষ্ট থাকার মহান গুণ অর্জন করা। অনেক ধনী ব্যক্তি, দালান-কোঠার মালিক জীবনে সুখের ঠিকানা খুঁজে পায়নি একটি মাত্র কারণে, সেটা হ’ল অল্পেতুষ্টি। আর বহু দরিদ্র ব্যক্তি দুনিয়াতে প্রশান্তিময় জীবনের অধিকারী হ’তে পেরেছে, কেবল অল্পেতুষ্টির কারণে। মূলতঃ তাক্বদীরের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের মাধ্যমে বান্দা অল্পেতুষ্টির চূড়ায় উপনীত হয় এবং আল্লাহর রুবূবিয়াতের স্বীকৃতি দেয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,وَارْضَ بِمَا قَسَمَ اللهُ لَكَ تَكُنْ أَغْنَى النَّاسِ، ‘আল্লাহ তোমার তাক্বদীরে যা বণ্টন করেছেন তাতেই তুমি সন্তুষ্ট থেকো, তাহ’লে মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ধনী বলে গণ্য হবে’।[23] প্রখ্যাত তাবেঈ আবূ হাযেম আল-আশজাঈ (মৃ. ১০০ হি.) বলেন,ثلاث من كن فيه كمل عقله: من عرف نفسه، وحفظ لسانه، وقنع بما رزقه الله عز وجل، ‘যার মধ্যে তিনটি গুণ রয়েছে, তার জ্ঞান পূর্ণতা লাভ করেছে। (১) যে নিজেকে চিনতে পেরেছে, (২) নিজের জিহবাকে সংযত রেখেছে এবং (৩) আল্লাহ তাকে যে রিযিক দিয়েছেন, তাতেই সন্তুষ্ট থেকেছে’।[24]
(৯) পাপরাশি ক্ষমা হয় ও রহমত বর্ষিত হয় :
জীবনে মন্দ তাক্বদীরের সম্মুখীন হয়ে যারা ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে পারে এবং তাক্বদীরের ফায়ছালাকে সজহভাবে গ্রহণ করতে পারে, আল্লাহ তাদের রহমত ও হেদায়াতের সুসংবাদ দিয়েছেন এবং তার জন্য এমন ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছেন, যার মাধ্যমে সে সদ্য ভূমিষ্ট শিশুর মতো নিষ্পাপ হ’তে পারে। আল্লাহ বলেন,وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ، الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ، أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ ‘আর তুমি সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের। যাদের উপর কোন বিপদ আসলে তারা বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁর দিকেই ফিরে যাব। তাদের উপর তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে রয়েছে অফুরন্ত দয়া ও করুণা এবং তারাই হ’ল সুপথপ্রাপ্ত’ (বাক্বারাহ ২/১৫৫-১৫৭)। মুতাররিফ (রহঃ)-এর ছেলে আব্দুল্লাহ মারা গেলে তিনি তেল মেখে সুন্দর পোষাক পরিধান করে লোকজনের সামনে আসলেন। এতে লোকেরা রেগে গিয়ে বলল, আব্দুল্লাহ মারা গেছে, অথচ আপনি এই কাপড় পরিধান করে তেল মেখে বের হয়েছেন? তখন তিনি বললেন, আরে! আমি কি এজন্য বিনয়ী হব না? অথচ আমার রব এজন্য আমাকে বৈশিষ্ট্যের ওয়াদা করেছেন। আর প্রতিটি বৈশিষ্ট্য আমার কাছে দুনিয়া ও দুনিয়ার মাঝে থাকা সকল কিছুর চাইতে উত্তম। অতঃপর তিনি সূরা বাক্বাহর উক্ত আয়াত সমূহ তেলাওয়াত করলেন।[25]
শাদ্দাদ ইবনে আওস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُولُ: إِذَا ابْتَلَيتُ عَبْدًا مِنْ عِبَادِي مُؤْمِنًا، فَحَمِدَنِي وَصَبَرَ عَلَى مَا ابْتَلَيْتُهُ بِهِ، فَإِنَّهُ يَقُومُ مِنْ مَضْجَعِهِ ذَلِكَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ مِنَ الْخَطَايَا، وَيَقُولُ الرَّبُّ عَزَّ وَجَلَّ لِلْحَفَظَةِ: إِنِّي أَنَا قَيَّدْتُ عَبْدِي هَذَا وَابْتَلَيْتُهُ، فَأَجْرُوا لَهُ مَا كُنْتُمْ تُجْرُونَ لَهُ قَبْلَ ذَلِكَ وَهُوَ صَحِيحٌ ‘মহামহিম আল্লাহ বলেন, আমি যখন আমার কোন মুমিন বান্দাকে মুছীবতে নিক্ষেপ করি, আর সে আমার প্রশংসা করে এবং আমার পক্ষ থেকে আরোপিত বিপদের কষ্টে ধৈর্যধারণ করে, তাহ’লে সে তার বিছানা থেকে ঐ দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে উঠে, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল। অতঃপর আল্লাহ হেফাযতকারী ফেরেশতাদের বলেন, আমি আমার এই বান্দাকে আবদ্ধ করে রেখেছি এবং মুছীবতে ফেলেছি, সুতরাং তোমরা তার ঐ আমলগুলোর নেকী জারী রাখ, সে সুস্থ থাকা অবস্থায় যে আমলের নেকীগুলো তোমরা জারী রাখতে’।[26]
ইয়াযী ইবনে মাইসারা (রহঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই বান্দা অসুস্থ হয়ে পড়ে; কিন্তু আল্লাহর কাছে তার কোন নেক আমল থাকে না, ফলে আল্লাহ তাকে অতীতের কিছু পাপের কথা স্মরণ করিয়ে দেন, তখন আল্লাহর ভয়ে তার চোখ থেকে মাছির মাথা পরিমাণ অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। এরপর আল্লাহ যদি তাকে সুস্থ করে দেন, তাহ’লে তাকে পাপ থেকে পবিত্র করে তোলেন। আর যদি তিনি তাকে নিয়ে যান (অর্থাৎ মৃত্যু দান করেন), তবে পবিত্র অবস্থায় তাকে গ্রহণ করেন।[27]
(১০) জান্নাতের সুসংবাদ :
যারা তাক্বদীরের ফায়ছালায় সন্তুষ্ট থাকে, তাদের জান কবযের সময় মৃত্যুর ফেরেশতাগণ তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দান করেন। আল্লাহ বলেন, يَاأَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ، ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً، فَادْخُلِي فِي عِبَادِي، وَادْخُلِي جَنَّتِي، ‘হে প্রশান্ত আত্মা! ফিরে চলো তোমার প্রভুর পানে, সন্তুষ্ট চিত্তে ও সন্তোষভাজন অবস্থায়। অতঃপর প্রবেশ কর আমার বান্দাদের মধ্যে এবং প্রবেশ কর আমার জান্নাতে’ (ফজর ৮৯/২৭-৩০)। ইমাম মুজাহিদ (রহঃ) বলেন,الرَّاضِيَةُ بِقَضَاءِ اللهِ، الَّتِي عَلِمَتْ أَنَّ مَا أَخْطَأَهَا لَمْ يَكُنْ لِيُصِيبَهَا، وَأَنَّ مَا أَصَابَهَا لَمْ يَكُنْ لِيُخْطِئَهَا، ‘প্রশান্ত আত্মা হ‘ল আল্লাহর ফায়ছালায় সন্তুষ্ট আত্মা। যে আত্মা জানে- যা তার ভাগ্যে লেখা হয়নি, তা সে কখনই পাবে না। আর যা তার ভাগ্যে লেখা আছে, তা কখনই বাদ পড়বে না’।[28]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِذَا مَاتَ وَلَدُ العَبْدِ قَالَ اللهُ لِمَلَائِكَتِهِ: قَبَضْتُمْ وَلَدَ عَبْدِي، فَيَقُولُونَ: نَعَمْ، فَيَقُولُ: قَبَضْتُمْ ثَمَرَةَ فُؤَادِهِ، فَيَقُولُونَ: نَعَمْ، فَيَقُولُ: مَاذَا قَالَ عَبْدِي؟ فَيَقُولُونَ: حَمِدَكَ وَاسْتَرْجَعَ، فَيَقُولُ اللهُ: ابْنُوا لِعَبْدِي بَيْتًا فِي الجَنَّةِ، وَسَمُّوهُ بَيْتَ الحَمْدِ، ‘কোন বান্দার কোন সন্তান মারা গেলে আল্লাহ্ তার ফেরেশতাদের প্রশ্ন করেন, তোমরা আমার বান্দার সন্তানকে কি ছিনিয়ে আনলে? তারা বলে, হ্যাঁ। পুনরায় আল্লাহ প্রশ্ন করেন, তোমরা তার হৃদয়ের টুকরাকে ছিনিয়ে আনলে? তারা বলে, হ্যাঁ। পুনরায় তিনি প্রশ্ন করেন, তখন আমার বান্দা কি বলেছে? তারা বলে, সে আপনার প্রশংসা করেছে এবং ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি‘ঊন পাঠ করেছে। তখন আল্লাহ বলেন, জান্নাতের মধ্যে আমার এই বান্দার জন্য একটি ঘর তৈরী কর এবং তার নাম রাখ ‘বাইতুল হামদ‘ বা প্রশংসালয়।[29]
উপসংহার :
আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত তাক্বদীরের সকল ফায়ছালাতে বান্দার জন্য কল্যাণ নিহিত থাকে। সুতরাং তাঁর সকল ফায়ছালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকাই প্রকৃত ঈমানের পরিচায়ক। জুবায়ের ইবনে নুফায়ের (রহঃ) বলেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবী মিক্বদাদ ইবনে আসওয়াদ (রাঃ)-এর কাছে বসে ছিলাম। এমন সময় এক লোক এসে তার সাথে সাক্ষাত করল এবং বলল, ‘ধন্য এ চক্ষুদ্বয়, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে দেখেছে। আল্লাহর কসম! যদি আমিও তা দেখতাম, যা আপনি দেখেছেন! যদি আমিও সেখানে উপস্থিত থাকতাম, যেখানে আপনি উপস্থিত ছিলেন!’ লোকটির কথা শুনে মিক্বদাদ (রাঃ) ক্রদ্ধ হ’লেন। আমি বিস্মিত হ’লাম যে, লোকটি তো ভাল কথাই বলেছে। অতঃপর তিনি লোকটিকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘মানুষ কেন এমন স্থানে উপস্থিত থাকার আকাঙ্ক্ষা করে, যেখান থেকে আল্লাহ তাকে অনুপস্থিত রেখেছেন? সে তো জানে না, যদি সে ওখানে উপস্থিত থাকত, তাহ’লে কি করত? আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে এমন অনেক লোক উপস্থিত ছিল, যারা তাঁর ডাকে সাড়া দেয়নি এবং তাকে সত্য বলে বিশ^াস করেনি। ফলে আল্লাহ তাদেরকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। সুতরাং তোমরা শুকরিয়া আদায় কর যে, আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর প্রতি এবং তাঁর নবীর প্রতি ঈমান আনার তাওফীক্ব দান করেছেন।[30] মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাক্বদীরের ভাল-মন্দ সকল ফায়ছালায় সন্তুষ্ট থাকার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এম.ফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও শিক্ষক,
আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
[1]. মুসলিম হা/৩৪; তিরমিযী হা/৯; মিশকতা হা/২৬২৩।
[2]. ইবনু রজব হাম্বলী, লাত্বায়েফুল মা‘আরেফ, পৃ. ২২৬।
[3]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া ১/৪২৩; আবূ নু‘আইম ইস্পাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া ৮/১৯১।
[4]. ইবনু মাজাহ হা/৪০৩১; ছহীহুত তারগীব হা/৩৪০৭; মিশকাত হা/১৫৬৬।
[5]. উছায়মীন, শারহু রিয়াযিছ ছালেহীন ১/২৫৯।
[6]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া (কায়রো : দারুল হাদীছ, ১৪২১হি./২০০০খৃ.) ২/২৯৩।
[7]. ইবনু মাজাহ হা/৪০২৪; ‘ফিতান’ অধ্যায়-৩০, ‘বিপদে ধৈর্য ধারণ’ অনুচ্ছেদ-২৩, সনদ ছহীহ।
[8]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৭/৫৫।
[9]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন ২/২১৬।
[10]. মাদারিজুস সালেকীন ২/২১৫।
[11]. ইবনু মাজাহ হা/২১৪৪; ছহীহুত তারগীব হা/১৬৯৮, সনদ ছহীহ।
[12]. তিরমিযী হা/২১৪৪; ইবনু মাজাহ হা/৮১, সনদ ছহীহ।
[13]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৪৭৫।
[14]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন ২/২০২।
[15]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ, পৃ. ৯৭।
[16]. বুখারী হা/৪৬৬, ৩৯০৪; মিশকাত হা/৬০১০।
[17]. ইবনু আবিদ্দুনয়া, আছ-ছাবরু ওয়াছ ছাওয়াব, পৃ. ৮৫; আবূ নু‘আইম, হিলয়াতুল আওলিয়া ৩/২৬২।
[18]. ইবনু আবিদ্দুনয়া, আন-নাফাক্বাতু আলাল ইয়াল ১/২৫১।
[19]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৯/১৮২।
[20]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ইগাছাতুল লাহফান ১/৭২।
[21]. ইবনুল জাওযী, ছায়দুল খাত্বির পৃ. ১৩৮।
[22]. ছায়দুল খাত্বের, পৃ. ৪৩৯।
[23]. তিরমিযী হা/২৩০৫; মিশকাত হা/৫১৭১, সনদ হাসান।
[24]. ইবনু কুদামা, মুখতাছার মিনহাজুল ক্বাছেদীন, পৃ. ১৯৯।
[25]. মুখতাছার মিনহাজুল ক্বাছিদীন, পৃ. ২২৯।
[26]. তাবারাণী, মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৪৭০৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২০০৯; মিশকাত হা/১৫৭৯, সনদ হাসান।
[27]. ইবনুল ক্বাইয়িম, উদ্দাতুছ ছাবিরীন ওয়া যাখীরাতুশ শাকিরীন, পৃ. ৮৭।
[28]. তাফসীরে কুরতুবী ২০/৫৭; শাওকানী, ফাৎহুল কাদীর ৫/৫৩৬।
[29]. তিরমিযী হা/১০২১; ছহীহাহ হা/১৪০৮, সনদ হাসান, রাবী আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ)।
[30]. ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশক্ব ২৫/৪৮৫। (সংক্ষেপায়িত)।