মহানবী (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে প্রথম খলীফা আবূবকর (রাঃ)-এর আপোসহীন ভূমিকার জন্য তিনি ইসলামের ত্রাণকর্তা হিসাবে খ্যাত। অত্যন্ত নরম দিলের অধিকারী এই মানুষটি দায়িত্বের ব্যাপারে যেমন সজাগ-সচেতন ও কঠোর ছিলেন তেমনি হাদীছ তথা রাসূলের নির্দেশ পালনে অত্যন্ত দৃঢ় হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি কোন ব্যক্তি বিশেষ এমনকি রাসূলের নিকটাত্মীয়দেরও তোয়াক্কা করতেন না। এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীছ।
আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ)-এর কন্যা ফাতেমা (রাঃ) আবূ বকর (রাঃ)-এর নিকট রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পরিত্যক্ত সম্পত্তি মদীনা ও ফাদাক-এ অবস্থিত ফাই (বিনা যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ) এবং খায়বারের খুমুসের (পঞ্চমাংশ) অবশিষ্টাংশ থেকে মিরাছী স্বত্ব চেয়ে পাঠান। তখন আবূ বকর (রাঃ) উত্তরে বললেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলে গেছেন, আমাদের (নবীদের) কোন ওয়ারিছ হয় না, আমরা যা ছেড়ে যাব তা ছাদাকাহ হিসাবে গণ্য হবে। অবশ্য মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর বংশধরগণ এ সম্পত্তি থেকে ভরণ-পোষণ চালাতে পারবেন। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাদাকাহ তাঁর জীবদ্দশায় যে অবস্থায় ছিল আমি সে অবস্থা থেকে এতটুকুও পরিবর্তন করব না। এ ব্যাপারে তিনি যেভাবে ব্যবহার করে গেছেন আমিও ঠিক সেভাবেই ব্যবহার করব। এ কথা বলে আবূ বকর (রাঃ) ফাতেমা (রাঃ)-কে এ সম্পদ থেকে কিছু দিতে অস্বীকার করলেন। এতে ফাতেমা (রাঃ) (মানবীয় কারণে) আবূ বকর (রাঃ)-এর উপর নাখোশ হ’লেন এবং তাঁর থেকে সম্পর্কহীন থাকলেন। মৃত্যু অবধি তিনি আবূ বকর (রাঃ)-এর সঙ্গে কথা বলেননি। নবী করীম (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর তিনি ছয় মাস জীবিত ছিলেন। তিনি মৃত্যুবরণ করলে তাঁর স্বামী আলী (রাঃ) রাতের বেলা তাঁকে দাফন করেন। আবূ বকর (রাঃ)-কে এ খবরও দিলেন না এবং তিনি তার জানাযার ছালাত আদায় করে নেন। ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবিতাবস্থায় লোকজনের মনে আলী (রাঃ)-এর মর্যাদা ছিল। ফাতেমা (রাঃ) মৃত্যুবরণ করলে আলী (রাঃ) লোকজনের চেহারায় অসন্তুষ্টির চিহ্ন দেখতে পেলেন। তাই তিনি আবূ বকর (রাঃ)-এর সঙ্গে সমঝোতা ও তাঁর কাছে বায়‘আতের ইচ্ছা করলেন। এ ছয় মাসে তাঁর পক্ষে বায়‘আত গ্রহণের সুযোগ হয়নি। তাই তিনি আবূ বকর (রাঃ)-এর কাছে লোক পাঠিয়ে জানালেন যে, আপনি আমার কাছে আসুন। (এটা জানতে পেরে) ওমর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! আপনি একা একা তাঁর কাছে যাবেন না। আবূ বকর (রাঃ) বললেন, তাঁরা আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করবে বলে তোমরা আশঙ্কা করছ?
আল্লাহর কসম! আমি তাঁদের কাছে যাব। তারপর আবূ বকর (রাঃ) তাঁদের কাছে গেলেন। আলী (রাঃ) তাশাহহুদ পাঠ করে বললেন, আমরা আপনার মর্যাদা এবং আল্লাহ আপনাকে যা কিছু দান করেছেন সে সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। আর যে কল্যাণ (অর্থাৎ খিলাফাত) আল্লাহ আপনাকে দান করেছেন সে ব্যাপারেও আমরা আপনার উপর হিংসা পোষণ করি না। তবে খিলাফাতের ব্যাপারে আপনি আমাদের উপর নিজস্ব মতামতের প্রাধান্য দিচ্ছেন অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটাত্মীয় হিসাবে খিলাফাতের কাজে আমাদেরও কিছু পরামর্শ দেয়ার অধিকার আছে। এ কথায় আবূ বকর (রাঃ)-এর চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ল। এরপর তিনি যখন আলোচনা আরম্ভ করলেন তখন বললেন, সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ! আমার কাছে আমার নিকটাত্মীয়দের চেয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আত্মীয়গণ অধিক প্রিয়। আর এ সম্পদগুলোতে আমার এবং আপনাদের মধ্যে যে মতবিরোধ হয়েছে সে ব্যাপারেও আমি কল্যাণকর পথ অনুসরণে পিছপা হইনি। বরং এক্ষেত্রেও আমি কোন কাজ পরিত্যাগ করিনি যা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে করতে দেখেছি। তারপর আলী (রাঃ) আবূ বকর (রাঃ)-কে বললেন, যোহরের পর আপনার হাতে বায়‘আত গ্রহণের ওয়াদা রইল। যোহরের ছালাত আদায়ের পর আবূ বকর (রাঃ) মিম্বারে বসে তাশাহহুদ পাঠ করলেন, তারপর আলী (রাঃ)-এর বর্তমান অবস্থা এবং বায়‘আত গ্রহণে তার দেরী করার কারণ ও তাঁর পেশকৃত আপত্তিগুলো তিনি বর্ণনা করলেন। এরপর আলী (রাঃ) দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাশাহহুদ পাঠ করলেন এবং আবূ বকর (রাঃ)-এর মর্যাদার কথা উল্লেখ করে বললেন, তিনি যা কিছু করেছেন তা আবূ বকর (রাঃ)-এর প্রতি হিংসা কিংবা আল্লাহ প্রদত্ত তাঁর মর্যাদাকে অস্বীকার করার জন্য করেননি। (তিনি বলেন) তবে আমরা ভেবেছিলাম যে, এ ব্যাপারে আমাদেরও পরামর্শ দেয়ার অধিকার থাকবে। অথচ তিনি আমাদের পরামর্শ ত্যাগ করে স্বাধীন মতের উপর রয়ে গেছেন। তাই আমরা মানসিকভাবে কষ্ট পেয়েছিলাম। মুসলিমগণ আনন্দিত হয়ে বললেন, আপনি ঠিকই করেছেন। এরপর আলী (রাঃ) আমর বিল মারূফ-এর পানে ফিরে আসার কারণে মুসলিমগণ আবার তাঁর নিকটবর্তী হ’তে শুরু করলেন’ (বুখারী হা/৪২৪০-৪২৪১)।
আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ পালনে ছাহাবায়ে কেরাম যেমন ছিলেন আপোসহীন ও দৃঢ়চিত্তের অধিকারী আমাদেরকেও তেমনি হওয়া দরকার। আল্লাহ আমাদের সকলকে কুরআন ও হাদীছ মানার ক্ষেত্রে আপোসহীন হওয়ার তাওফীক দিন-আমীন!