মানব
জীবনে আদব বা শিষ্টাচার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আদবকে ইসলামের সারবস্ত্ত
বললেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না। আদর্শ ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে শিষ্টাচারের
গুরুত্ব অপরিসীম। উত্তম চরিত্র, ভাল ব্যবহার ও সুসভ্য জাতি গঠনের সর্বোত্তম
উপায় ও উপকরণ রয়েছে পবিত্র কুরআন ও হাদীছে নববীতে। আহার-পানীয় গ্রহণে,
অন্যের সঙ্গে কুশল বিনিময়ে, সালাম আদান-প্রদানে, অনুমতি গ্রহণে, ওঠাবসা,
কথা বলা, আনন্দ ও শোক প্রকাশ প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুমিনের আচরণ কিরূপ হবে তার
সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। কোন মুসলিম কাঙ্ক্ষিত মানের ও সুসভ্য
মানুষ রূপে গড়ে উঠবে এবং নিজেকে অন্যান্য জাতি অপেক্ষা ভিন্ন
বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করতে সক্ষম হবে তখনই, যখন ইসলামী শিষ্টাচারের সুষমাকে
ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও পার্থিব জীবনের সকল দিক ও বিভাগে ফুটিয়ে
তুলতে পারবে। তাই মানব জীবনে শিষ্টাচার অতি গুরুত্বপূর্ণ।
শিষ্টাচারের
গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ الْهَدْىَ الصَّالِحَ،
وَالسَّمْتَ الصَّالِحَ، وَالاِقْتِصَادَ جُزْءٌ مِنْ خَمْسَةٍ
وَعِشْرِيْنَ جُزْءًا مِنَ النُّبُوَّةِ- ‘নিশ্চয়ই উত্তম চরিত্র, ভাল
ব্যবহার ও পরিমিত ব্যয় বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা নবুঅতের পঁচিশ ভাগের এক
ভাগ’।[1]
আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ)
বলেন,اُطْلُبِ الْأَدَبَ فَإِنَّهُ زِيَادَةٌ فِي الْعَقْلِ، وَدَلِيلٌ
عَلَى الْمُرُوْءَةِ، مُؤْنِسٌ فِي الْوَحْدَةِ، وَصَاحِبٌ فِي
الْغُرْبَةِ، وَمَالٌ عِنْدَ الْقِلَّةِ- ‘তুমি আদব অন্বেষণ কর। কারণ আদব
হ’ল বুদ্ধির পরিপূরক, ব্যক্তিত্বের দলীল, নিঃসঙ্গতায় ঘনিষ্ঠ সহচর,
প্রবাসজীবনের সঙ্গী এবং অভাবের সময়ে সম্পদ’।[2]
আহনাফ আল-কায়েস বলেন,الأدب نور العقل كما أن النار نور البصر ‘আদব বা শিষ্টাচার বিবেকের জ্যোতি যেমন আগুন দৃষ্টিশক্তির জ্যোতি’।[3]
কোন কোন দার্শনিক বলেন,لاَ أَدَبَ إلاَّ بِعَقْلٍ، وَلاَ عَقْلَ إلاَّ بِأَدَبٍ ‘জ্ঞান-বুদ্ধি ছাড়া শিষ্টাচার হয় না; আার আদব ছাড়া জ্ঞানও হয় না’।[4] অর্থাৎ একটি আরেকটির পরিপূরক।
রুওয়াইম ইবনু আহমাদ আল-বাগদাদী তার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেন, اجْعَلْ عَمَلَك مِلْحًا وَأَدَبَك دَقِيْقًا ‘তুমি তোমার আমলকে লবণ ভাববে, আর তোমার আদবকে মনে করবে ময়দা’।[5] অর্থাৎ তুমি আমলের চেয়ে আদবকে এত অধিক গুরুত্ব দিবে, লবণ ও ময়দার স্বাভাবিক মিশ্রণে উভয়ের অনুপাত যেভাবে কম-বেশী হয়। সুতরাং মানব জীবনে আদব শিষ্টাচার অতি গুরুত্বপূর্ণ।
দৈনন্দিন জীবনে শিষ্টাচার :
জীবনের প্রতিটি কাজ একটি নীতি-আদর্শ অনুসারে পরিচালিত হওয়াকে আদব বা শিষ্টাচার বলে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সেই আদব বা শিষ্টাচার অনুযায়ী চলতে হয়। শৃঙ্খলা অনুসারে চললে সমাজে ভারসাম্য বজায় থাকে। নির্দেশনা অনুসারে কাজ করা না হ’লে সে কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন হয় না এবং তাতে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় না। শিষ্টাচারের সর্বোত্তম উদাহরণ হ’লেন মহানবী (ছাঃ)। আল্লাহ্ বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيْمٍ ‘তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী (ক্বলম ৬৮/৪)।
কুরআনের আলোকে শিষ্টাচার : শিষ্টাচারের বিভিন্ন দিক কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। শিষ্টাচারের শিক্ষা দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন,خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِيْنَ ‘তুমি ক্ষমার নীতি গ্রহণ কর। লোকদের সৎকাজের আদেশ দাও এবং মূর্খদের এড়িয়ে চল’ (আ‘রাফ ৭/১৯৯)। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ আরো বলেন,
وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِيْ بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيْمٌ، وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِيْنَ صَبَرُوْا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيْمٍ-
‘ভাল ও মন্দ কখনো সমান হ’তে পারে না। তুমি উত্তম দ্বারা (অনুত্তমকে) প্রতিহত কর। ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে যেন (তোমার) অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে। এই গুণের অধিকারী কেবল তারাই হ’তে পারে, যারা ধৈর্যধারণ করে এবং এই গুণের অধিকারী কেবল তারাই হ’তে পারে, যারা মহা ভাগ্যবান’ (ফুছছিলাত/হামিম সাজদাহ ৪১/৩৪-৩৫)। মুমিনদের প্রশংসায় আল্লাহ আরো বলেন,الَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِيْنَ الْغَيْظَ وَالْعَافِيْنَ عَنِ النَّاسِ وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِيْنَ- ‘যারা সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা সর্বাবস্থায় (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় করে, যারা ক্রোধ দমন করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৩৪)।
হাদীছের আলোকে শিষ্টাচার :
ইসলাম মানুষকে সর্বোত্তম আদব বা শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার জন্য এসেছে।
রাসূল (ছাঃ) বলেন,بُعِثْتُ لأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الأَخْلاقِ ‘আমি উত্তম
চরিত্রের পূর্ণতা প্রদানের জন্য প্রেরিত হয়েছি’।[6] আয়েশা (রাঃ)-কে রাসূল
(ছাঃ)-এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি উত্তরে বলেন, كَانَ
خُلُقُهُ الْقُرْآنَ‘তার চরিত্র হ’ল কুরআন’।[7]
আব্দুল্লাহ
বিন ওমর (রাঃ) বর্ণনা করেন, নবী করীম (ছাঃ) চারিত্রিক ও মৌখিক অশ্লীলতা
হ’তে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন,لَمْ يَكُنِ
النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم سَبَّابًا وَلاَ فَحَّاشًا وَلاَ لَعَّانًا،
كَانَ يَقُوْلُ لأَحَدِنَا عِنْدَ الْمَعْتَبَةِ مَا لَهُ، تَرِبَ
جَبِيْنُهُ- ‘নবী করীম (ছাঃ) কাউকে গালি দিতেন না, অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ
করতেন না এবং কাউকে অভিশাপ দিতেন না। কাউকে তিরস্কার করতে হ’লে শুধু এটুকু
বলতেন, তার কী হয়েছে। তার কপাল ধুলায় ধূসরিত হোক’।[8]
তিনি
আরো বলেন,خَدَمْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم عَشْرَ سِنِيْنَ، فَمَا
قَالَ لِىْ أُفٍّ وَلاَ لِمَ صَنَعْتَ وَلاَ أَلاَّ صَنَعْتَ. ‘আমি দীর্ঘ
দশ বছর রাসূল (ছাঃ)-এর সেবায় নিয়োজিত ছিলাম। তিনি আমার ব্যাপারে কখনো ‘উহ’
শব্দটি উচ্চারণ করেননি। আর তিনি কখনো বলেননি, তুমি কেন এটা করেছ কিংবা এটা
কেন করনি’?[9]
রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ مِنْ أَخْيَرِكُمْ أَحْسَنَكُمْ خُلُقًا ‘তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম, যাদের চরিত্র উত্তম’।[10]
অন্যত্র তিনি বলেন, إِنَّ مِنْ أَحَبِّكُمْ إِلَيَّ أَحْسَنَكُمْ خُلُقًا
‘তোমাদের মধ্যে আমার নিকটে সর্বাধিক প্রিয় সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র উত্তম’।[11]
তিনি আরো বলেন,إِنَّ مِنْ أَحَبِّكُمْ إِلَيَّ وَأَقْرَبِكُمْ مِنِّيْ
مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَحَاسِنَكُمْ أَخْلَاقًا- ‘তোমাদের যে
ব্যক্তির চরিত্র ও আচরণ সর্বোত্তম, তোমাদের মধ্যে সে-ই আমার নিকটে সর্বাধিক
প্রিয় এবং ক্বিয়ামত দিবসেও আমার খুবই নিকটে থাকবে’।[12]
ইসলামী শিষ্টাচারের কতিপয় দিক :
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। এতে মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগের নিদের্শনা নিহিত আছে। শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত জীবনের সকল সমস্যার সুষ্ঠু-সুন্দর সমাধান রয়েছে ইসলামে। নিম্নে কিছু দিক উল্লেখ করা হ’ল।-
সালাম বা সম্ভাষণ :
শিষ্টাচার সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে সর্বাগ্রে আসে পারস্পরিক সম্ভাষণের
বিষয়টি। এই সালামের ব্যাপারে প্রত্যেককে অগ্রণী হ’তে হবে এবং
স্বতঃস্ফূর্তভাবে সালামের উত্তর দিতে হবে। ইসলামে পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে
সালাম দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[13] সম্ভবপর মুছাফাহা করা এবং কুশল
বিনিময় করা যায়। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِاللهِ مَنْ
بَدَأَهُمْ بِالسَّلَامِ ‘যে ব্যক্তি প্রথমে সালাম দেয়, আল্লাহর নিকট
লোকদের মধ্যে সেই উত্তম’।[14]
উপহার-উপঢৌকন :
হাদিয়া বা উপহার আদান-প্রদান করা শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত। এতে পরস্পরের
মধ্যে সম্প্রীতি-সদ্ভাব গড়ে ওঠে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,تَهَادُّوْا تَحَابُّوْا
‘তোমরা একে অপরকে উপঢৌকন দাও এবং ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হও’।[15]
দৈনন্দিন কর্মকান্ড :
মানুষের সাথে ওঠা-বসা, পানাহার, বসবাস ও সহাবস্থান সমাজ জীবনের মৌলিক কাজ।
এসব প্রাত্যহিক কর্মকান্ডে শিষ্টাচারের প্রমাণ পাওয়া যায় রাসূল (ছাঃ)-এর
জীবনচরিতে। যেমন হাঁচি দেওয়া ও হাই তোলার ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) নির্দেশনা
দিয়ে গেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه
وسلم إِذَا عَطَسَ وَضَعَ يَدَهُ أَوْ ثَوْبَهُ عَلَى فِيهِ وَخَفَضَ أَوْ
غَضَّ بِهَا صَوْتَهُ- ‘যখন নবী করীম (ছাঃ) হাঁচি দিতেন, তিনি তাঁর
মুখমন্ডলে হাত বা কাপড় দ্বারা আবৃত করতেন এবং তদ্বারা তাঁর স্বর বন্ধ
করতেন’।[16] বিকট আওয়াজে অট্টহাসি হাসা, চিৎকার ও হৈ হুল্লোড় ইত্যাদি করা
কোন শালীন মানুষের কাজ নয়। পক্ষান্তরে মৃদু বা মুচকি হাসি অপরের মনে
বিরক্তির উদ্রেক করে না। বরং আনন্দ দেয় ও ভালোবাসা পয়দা করে। আয়েশা (রাঃ)
থেকে বর্ণিত,مَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم ضَاحِكًا
حَتَّى أَرَى مِنْهُ لَهَوَاتِهِ، إِنَّمَا كَانَ يَتَبَسَّمُ- ‘আমি রাসূল
(ছাঃ)-কে অট্টহাসি করতে দেখিনি, যাতে তাঁর জিহবার তালু দেখা যায়। তিনি মৃদু
হাসতেন’।[17]
পরিপাটি থাকা : ইসলাম মানুষকে সদা পরিপাটি থাকতে শিখায়। আতা বিন ইয়াসার থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْمَسْجِدِ فَدَخَلَ رَجُلٌ ثَائِرَ الرَّأْسِ وَاللِّحْيَةِ فَأَشَارَ إِلَيْهِ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِيَدِهِ أَنْ اخْرُجْ كَأَنَّهُ يَعْنِي إِصْلَاحَ شَعَرِ رَأْسِهِ وَلِحْيَتِهِ فَفَعَلَ الرَّجُلُ ثُمَّ رَجَعَ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَلَيْسَ هَذَا خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْتِيَ أَحَدُكُمْ ثَائِرَ الرَّأْسِ كَأَنَّهُ شَيْطَانٌ-
‘রাসূল (ছাঃ) মসজিদে অবস্থানকালে একটি লোক মাথা ও দাড়ির
কেশ অবিন্যস্ত অবস্থায় সেখানে প্রবেশ করল। রাসূল (ছাঃ) হাত দ্বারা তার দিকে
ইশারা করলেন যেন সে তার মাথা ও দাড়ির কেশ বিন্যাস করে। সে ব্যক্তি তা করে
ফিরে এলো। রাসূল (ছাঃ) বললেন, শয়তানের মতো তোমাদের কোন ব্যক্তির এলোকেশে
আসার চেয়ে এটা কি উত্তম নয়?[18]
পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা : পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা শিষ্টাচারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللهَ يُحِبُّ التَّوَّابِيْنَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِيْنَ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদের ভালবাসেন ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’ (বাক্বারাহ ২/২২২)। অন্যত্র তিনি বলেন, فِيْهِ رِجَالٌ يُحِبُّوْنَ أَنْ يَتَطَهَّرُوْا وَاللهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِيْنَ- ‘সেখানে এমন সব লোক রয়েছে, যারা উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হওয়াকে ভালবাসে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’ (তওবা ৯/১০৮)।
লাজুকতা : লজ্জাশীলতা
সভ্যতা ও মার্জিত রুচির পরিচায়ক। রাসূল (ছাঃ) ছিলেন লজ্জাশীলতার মূর্ত
প্রতীক। তিনি বলেন, الْحَيَاءُ مِنَ الإِيْمَانِ ‘লজ্জাশীলতা ঈমানের অঙ্গ’।[19]
জনসাধারণের সাথে উত্তম ব্যবহার : জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার সাথে সুন্দর আচরণ করা ও ভাল কথা বলা, ভদ্র ও মার্জিত রুচির পরিচায়ক। সদাচরণ মানুষকে কাছে টানে। সদাচরণের বাস্তব উদাহরণ ছিলেন নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। এ ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা,فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ- ‘আর আল্লাহর রহমতেই তুমি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমলহৃদয় হয়েছ। যদি তুমি কর্কশভাষী ও কঠোর হৃদয়ের হ’তে তাহ’লে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)।
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও প্রার্থনাকারীকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়া শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ। উম্মু বুজাইদ (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ভিক্ষুক আমার দরজায় দাঁড়ায়, আমার বাড়িতে কিছু না থাকায় আমি তার হাতে কিছু দিতে পারি না, এতে আমি লজ্জাবোধ করি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, কিছু হ’লেও দাও’।[20] এছাড়া আল্লাহ তা‘আলা সাহায্যপ্রার্থীকে ধমকাতে নিষেধ করেছেন (যোহা ৯৩/১০)। অন্য আয়াতে অপারগ অবস্থায় কিছু দিতে না পারলে তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বলার নির্দেশনা এসেছে (বনী ইস্রাঈল ১৭/২৮)।
ছোটদের
আদর-স্নেহ করা ও বড়দের সম্মান-শ্রদ্ধা করা ইসলামী শিষ্টাচার। আল্লাহর
রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا وَيَعْرِفْ حَقَّ
كَبِيْرِنَا فَلَيْسَ مِنَّا- ‘যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের
সম্মান বোঝে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়’।[21]
নবী করীম (ছাঃ) বলেন, كُلُّ كَلِمَةٍ طَيِّبَةٍ صَدَقَةٌ- ‘প্রত্যেক ভালো কথাও ছাদাক্বা’।[22]
তিনি আরো বলেন,اتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ، فَإِنْ لَمْ
تَجِدْ فَبِكَلِمَةٍ طَيِّبَةٍ- ‘তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাকো,
একটি খেজুর দিয়ে হ’লেও। আর যদি তুমি সেটাও না পাও তাহ’লে উত্তম কথা দ্বারা
হ’লেও (আগুন থেকে নিজেকে রক্ষা কর)।[23]
সর্বোত্তম
মানুষ সেই, যার দ্বারা মানবকল্যাণ সাধিত হয়। আর সেই প্রকৃত মানুষ যে তার
ভাইকে উপস্থিত-অনুপস্থিত সর্বাবস্থায়ই রক্ষা করে। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে
ইবাদতের জন্য। আর মানবসেবা ও সৃষ্টির খেদমতও ইবাদত। নবী করীম (ছাঃ)
বলেন,ارْحَمُوا مَنْ فِى الأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِى السَّمَاءِ ‘যমীনে
যে আছে তার প্রতি তোমরা দয়া কর, আসমানে যিনি আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া
করবেন’।[24]
প্রতিটি সৎকাজই ছাদাক্বা : নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,كُلُّ مَعْرُوفٍ صَدَقَةٌ ‘প্রতিটি সৎ কাজই ছাদাক্বা’।[25]
তিনি আরো বলেন,عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ صَدَقَةٌ. فَقَالُوْا يَا نَبِىَّ
اللهِ فَمَنْ لَمْ يَجِدْ قَالَ يَعْمَلُ بِيَدِهِ فَيَنْفَعُ نَفْسَهُ
وَيَتَصَدَّقُ. قَالُوْا فَإِنْ لَمْ يَجِدْ قَالَ يُعِيْنُ ذَا الْحَاجَةِ
الْمَلْهُوْفَ. قَالُوْا فَإِنْ لَمْ يَجِدْ. قَالَ فَلْيَعْمَلْ
بِالْمَعْرُوْفِ، وَلْيُمْسِكْ عَنِ الشَّرِّ فَإِنَّهَا لَهُ صَدَقَةٌ-
‘প্রত্যেক মুসলিমের ছাদাক্বা করা উচিত। ছাহাবীগণ আরয করলেন, হে আল্লাহর নবী
(ছাঃ)! কেউ যদি ছাদাক্বা দেওয়ার মত কিছু না পায়? তিনি বললেন, সে ব্যক্তি
নিজ হাতে কাজ করবে এতে নিজেও লাভবান হবে, ছাদাক্বাও করতে পারবে। তারা
বললেন, যদি এরও সামর্থ্য না থাকে? তিনি বললেন, কোন বিপদগ্রস্তকে সাহায্য
করবে। তারা বললেন, যদি এতটুকুরও সামর্থ্য না থাকে? তিনি বললেন, এ অবস্থায়
সে যেন নেক আমল করে এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকে। এটা তার জন্য ছাদাক্বা
বলে গণ্য হবে’।[26]
হাসিমুখে কথা বলা ও রাগ না করা : মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলা উচিত। রাসূল (ছাঃ) সর্বদা মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন।[27]
একজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষের সাথে যে কেউ কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সেই
সাথে রাগ পরিহার করবে। কেননা ক্রোধান্বিত হয়ে মানুষ অধিক ভুল করে থাকে।
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,أَنَّ رَجُلاً قَالَ لِلنَّبِىِّ صلى الله
عليه وسلم أَوْصِنِى. قَالَ لاَ تَغْضَبْ. فَرَدَّدَ مِرَارًا، قَالَ لاَ
تَغْضَبْ. ‘জনৈক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট আরয করল, আমাকে উপদেশ দিন।
তিনি বললেন, তুমি রাগ করো না। লোকটি কয়েকবার কথাটা পুনরাবৃত্তি করলে নবী
করীম (ছাঃ) প্রত্যেকবারই বললেন, রাগ করো না’।[28]
সুন্দর কথা বলা : পৃথিবীতে যত আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা সুন্দর কথা দিয়েই হয়েছে। অসুন্দর কথা ও খারাপ ভাষা প্রয়োগ করে কোন আদর্শ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভাল কথা দিয়ে সহজেই মানুষের মন জয় করা যায়। শ্রেষ্ঠ মনীষীরা সুভাষী ছিলেন। একটি সুন্দর কথা ভালো গাছের মতো, মাটিতে যার শিকড় বদ্ধমূল, আকাশে যার শাখা বিস্তৃত, যে গাছ অফুরন্ত ফল দান করে। তাই সুস্পষ্ট ভাষায় সুন্দরভাবে কথা বলতে হবে।
প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করা : প্রতিবেশীর
সাথে সদাচরণ ও ভাল ব্যবহার করা একজন মুসলমানের অন্যতম কর্তব্য। সামাজিক
শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে প্রতিবেশীর
সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করা ও সদ্ভাব বজায় রাখা অপরিহার্য। রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন,مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُحِبَّ اللهَ وَرَسُولَهُ، أَوْ يُحِبَّهُ
اللهُ وَرَسُولُهُ فَلْيَصْدُقْ حَدِيثَهُ إِذَا حَدَّثَ، وَلْيُؤَدِّ
أَمَانَتَهُ إِذَا ائْتُمِنَ، وَلْيُحْسِنْ جِوَارَ مَنْ جَاوَرَهُ- ‘যে
ব্যক্তি এটা পসন্দ করে যে, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল তাকে ভালোবাসুক, সে যেন
কথা বললে সত্য বলে, আমানত রাখা হলে তা পূর্ণ করে এবং স্বীয় প্রতিবেশীর সাথে
ভাল ব্যবহার করে’।[29] রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَا زَالَ يُوصِينِى جِبْرِيلُ
بِالْجَارِ حَتَّى ظَنَنْتُ أَنَّهُ سَيُوَرِّثُهُ ‘জিবরীল আমাকে
প্রতিবেশীর সাথে ভাল ব্যবহার করার জন্য এত বেশী উপদেশ দিতে থাকেন যে, আমি
ভেবেছিলাম হয়তো প্রতিবেশীকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে দিবেন’।[30] তিনি
আরো বলেন,لِلْمُؤْمِنِ عَلَى الْمُؤْمِنِ سِتُّ خِصَالٍ: يَعُودُهُ إِذَا
مَرِضَ، وَيَشْهَدُهُ إِذَا مَاتَ، وَيُجِيبُهُ إِذَا دَعَاهُ، وَيُسَلِّمُ
عَلَيْهِ إِذَا لَقِيَهُ، وَيُشَمِّتُهُ إِذَا عَطَسَ، وَيَنْصَحُ لَهُ
إِذَا غَابَ أَوْ شَهِدَ- ‘এক মুমিনের উপর অপর মুমিনের ছয়টি অধিকার রয়েছে।
যথা- অসুস্থ হ’লে তাকে দেখতে যাওয়া, মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযায় অংশগ্রহণ
করা, দাওয়াত দিলে তা কবুল করা, সাক্ষাৎ হ’লে তাকে সালাম দেওয়া, হাঁচি দিলে
জবাব দেওয়া এবং উপস্থিতিতে ও অনুপস্থিতিতে তার কল্যাণ কামনা করা’।[31]
পারস্পরিক দোষ-ত্রুটি সংশোধন করে দেওয়া :
কোন লোকের মধ্যে দোষ-ত্রুটি পরিলক্ষিত হ’লে সংশোধনের উদ্দেশ্যে তাকে
ব্যক্তিগতভাবে বলতে হবে। যাতে সে সংশোধন হয়ে যায়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
الْمُؤْمِنُ مِرْآةُ الْمُؤْمِنِ وَالْمُؤْمِنُ أَخُو الْمُؤْمِنِ يَكُفُّ
عَلَيْهِ ضَيْعَتَهُ وَيَحُوْطُهُ مِنْ وَرَائِهِ- ‘এক মুমিন অপর মুমিনের
জন্য আয়না স্বরূপ। এক মুমিন অপর মুমিনের ভাই। তারা একে অপরকে ক্ষতি থেকে
রক্ষা করে এবং তার অনুপস্থিতিতে তাকে রক্ষা করে’।[32]
কু-ধারণা না করা : অন্য মুসলিম ভাইয়ের প্রতি সুধারণা পোষণ করতে হবে। তার প্রতি অযথা কু-ধারণা পোষণ করা যাবে না। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اجْتَنِبُوْا كَثِيْرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিক ধারণা করা থেকে বেঁচে থাক। কেননা কোন কোন ধারণা পাপ’ (হুজুরাত ৪৯/১২)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِيَّاكُمْ
وَالظَّنَّ، فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيثِ، وَلاَ تَحَسَّسُوا،
وَلاَ تَجَسَّسُوا، وَلاَ تَحَاسَدُوا، وَلاَ تَدَابَرُوا، وَلاَ
تَبَاغَضُوا، وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا- ‘তোমরা অনুমান করা থেকে
সাবধান হও। কেননা অনুমান অবশ্যই সর্বাপেক্ষা বড় মিথ্যা। আর তোমরা অন্যের
দোষ অন্বেষণ করো না, গুপ্তচরবৃত্তি করো না, পরস্পরের সাথে ঝগড়া-বিবাদ করো
না এবং পরস্পরের সাথে হিংসা করো না। পরস্পরের ক্ষতি করার জন্য পেছনে লেগে
থেকো না। আর তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে যাও’।[33]
সবার জন্য কল্যাণ কামনা করা : এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য কল্যাণ কামনা করবে। আল্লাহ বলেন,
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ-
‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানুষের কল্যাণের জন্য তোমাদের আবির্ভাব, তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে’ (আলে ইমরান ৩/১১০)। এখানে একজন মুসলমানকে সকল মানুষের কল্যাণ কামনার জন্য বলা হয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,الدِّيْنُ النَّصِيْحَةُ قُلْنَا لِمَنْ قَالَ لِلَّهِ وَلِكِتَابِهِ وَلِرَسُوْلِهِ وَلأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِيْنَ وَعَامَّتِهِمْ- ‘সদুপদেশ দেয়াই দ্বীন। আমরা আরয করলাম, কার জন্য উপদেশ? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর কিতাবের, তাঁর রাসূলের, মুসলিম শাসক এবং মুসলিম জনগণের’।[34] সুতরাং মানুষের কল্যাণ কামনায় তাকে উপদেশ দিতে হবে।
অপর ভাইকে সাহায্য-সহযোগিতা করা : এক মুসলিম অপর মুসলিম ভাইকে সাধ্যমত সহযাগিতা করবে এটা ইসলামের শিক্ষা। এর ফলে সে আল্লাহর সাহায্যের হকদার হয়ে যাবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
وَمَنْ كَانَ فِى حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللهُ فِى حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ،
‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে নিয়োজিত
থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণে ব্যস্ত থাকেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের
একটি সমস্যা দূর করবে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার সমস্যাগুলির একটি সমস্যা
দূর করে দিবেন’।[35] তিনি আরো বলেন, انْصُرْ أَخَاكَ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُوْمًا ‘তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য কর, সে অত্যাচারী হোক অথবা অত্যাচারিত হোক’।[36]
অর্থাৎ প্রতিবেশী যদি অত্যাচারী হয় তবে তাকে অত্যাচার থেকে বিরত রাখার
মাধ্যমে সাহায্য করতে হবে। আল্লাহ বলেন,وَتَعَاوَنُوْا عَلَى الْبِرِّ
وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ‘তোমরা
সৎকর্ম ও আল্লাহভীতির কাজে পরস্পরকে সাহায্য কর এবং পাপ ও সীমা লংঘনের কাজে
একে অপরকে সাহায্য করো না’ (মায়েদাহ ৫/২)। সাহায্য ও ঋণ চাইলে
দিতে হবে। প্রতিবেশী পরামর্শ চাইলে সুপরামর্শ দিতে হবে। রাসূল (ছাঃ)
বলেন,إِذَا اسْتَنْصَحَ أَحَدُكُمْ أَخَاهُ فَلْيَنْصَحْ لَهُ- ‘যখন
তোমাদের কেউ তার ভাইয়ের নিকট উপদেশ চাইবে, তখন সে যেন তাকে উপদেশ দান করে’।[37]
অফিস-আদালতে শিষ্টাচার : অনেক অফিস-আদালতে কর্তাব্যক্তি ছোটখাট কোন কারণে অধীনস্থদের হুমকি-ধমকি দিয়ে দমিয়ে রাখতে পসন্দ করে। ফলে অধঃস্তনদের মনে সবসময় একটি অজানা ভীতি তাড়া করে ফিরে। কোন দোষ নেই, অপরাধ নেই তথাপিও অধীনস্থরা তাদের বড় ছাহেবের ভয়ে সর্বদা তটস্থ হয়ে থাকে। এতে কর্তাব্যক্তির ভুলের সংশোধন হওয়ার সুযোগ থাকে না। তাই প্রতিষ্ঠানও তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হয় না। অথচ প্রতিষ্ঠান প্রধান যদি তার অধঃস্তনের সাথে উত্তম ব্যবহার করতেন তাহ’লে অধীনস্থরা প্রাণ খুলে আল্লাহর কাছে তাঁর জন্য দো‘আ করত। সবাই মিলেমিশে প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য কাজ করতে পারত।
মুমিনের জীবনাচার : ইসলামে শিষ্টাচারকে ঈমানের অংশ বলা হয়েছে। ইসলাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং জীবন যাপনের বিভিন্ন পর্যায়ে সার্বজনীন শিষ্টাচার বা আদব-কায়দা মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছে। মানুষের সেবা করা আমাদের দায়িত্ব। সুতরাং আমাদেরকে সাধ্যমত জনসেবা করা উচিত। সর্বোত্তম ব্যবহার, বিনয়ী আচরণ, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সুসম্পর্কের মাধ্যমে সেবাদান নিশ্চিত করতে হবে। নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে সদা সচেতন থাকতে হবে।
মুসলমানের পরিচয় : উত্তম মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র সুন্দর। সেই পূর্ণ মুসলমান যার আচরণ সর্বোত্তম। যে ব্যক্তি লেনদেন ও কাজ-কারবারে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত, ওয়াদা পূর্ণ করে ও দায়িত্ব পালন করে; মানুষকে ধোঁকা দেয় না, আমানতের খেয়ানত করে না, মানুষের হক নষ্ট করে না, ওযনে কম দেয় না, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং সূদ-ঘুষসহ যাবতীয় অবৈধ উপার্জন থেকে বিরত থাকে, সেই প্রকৃত মুসলমান। খাঁটি মুসলিম সেই ব্যক্তি যার জিহবা ও হাত থেকে অপর মানুষ নিরাপদে থাকে। কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্যে যা পসন্দ করে তার ভাইয়ের জন্যও তা পসন্দ করবে।
উপসংহার : রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদের সাথে ও তাঁর অধীনস্থদের সাথে উত্তম ব্যবহার করতেন।[38] আর মহান আল্লাহ রাসূলের অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন (আহযাব ৩৩/২১)। সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের উচিত জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ও অনুকরণ করা। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহপাঠী, কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী, যানবাহনে সহযাত্রী সহ ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সবার সাথে ভাল ব্যবহার করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে শিষ্টাচার তথা উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
[1]. আবুদাঊদ হা/৪৭৭৬; মিশকাত হা/৫০৬০; ছহীহুল জামে‘ হা/১৯৯২-৯৩।
[2]. ইছবাহানী, মুনতাখাব; সাফারিঈনী, গিযাউল আলবাব, ১/৩৬-৩৭।
[3]. ঐ, ফৎওয়া আল-মিছরিয়া, ১০/৩৫৯, ‘আদব’ অধ্যায়।
[4]. ইবনু আব্দিল বার্র, আদাবুল মাজালিসাহ ওয়া হামদুল লিসান, (দারুছ ছাহাবাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪০৯হিঃ/১৯৮৯খ্রিঃ), পৃঃ ৫৫; আল-মাওয়ারদী, আল-আদাবুল ওয়াযীর, (কায়রো : মাকতাবুল খানজী, (১৪১৪হিঃ/১৯৯৩খ্রিঃ), পৃঃ ৩১।
[5]. ড. আলী আব্দুল হামীদ, আত-তাহযীলুদ দিরাসী বিল ক্বাইয়েমিল ইসলামিয়াহ, (বৈরূত : ১ম প্রকাশ, ১৪৩০হিঃ/২০১০খ্রিঃ), পৃঃ ১৫৪; আল-কুরাফী, আল-ফুরূক্ব, ৩/৯৬।
[6]. শরহুস সুন্নাহ, মিশকাত হা/৫০৯৬; ছহীহাহ হা/৪৫; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/২৭৩।
[7]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৩০৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৮১১।
[8]. বুখারী হা/৬০৩১; মিশকাত হা/৫৮১১।
[9]. বুখারী হা/৬০৩৮; মুসলিম হা/২৩০৯; মিশকাত হা/৫৮০১।
[10]. বুখারী হা/৬০২৯।
[11]. ছহীহাহ হা/৭৯২।
[12]. তিরমিযী হা/২০১৮; ছহীহাহ হা/৭৯১; ছহীহুল জামে‘ হা/২২০১।
[13]. বুখারী হা/১২; মুসলিম হা/৩৯; মিশকাত হা/৪৬২৯।
[14]. আবুদাঊদ হা/৫১৯৭; মিশকাত হা/৪৬৪৬; ছহীহাহ হা/৩৩৮২।
[15]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৯৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৩০০৪; ইরওয়া হা/১৬০১।
[16]. আবুদাঊদ হা/৫০২৯; তিরমিযী হা/২৭৪৫; মিশকাত হা/৪৭৩৮।
[17]. বুখারী হা/৪৮২৮; মিশকাত হা/১৫১২।
[18]. মুওয়াত্ত্বা মালেক; ছহীহাহ হা/৪৯৩।
[19]. বুখারী হা/২৪; মুসলিম হা/৩৬; মিশকাত হা/৫০৭৭।
[20]. আহমাদ হা/২৭১৯২; আবুদাঊদ হা/১৬৬৭; তিরমিযী হা/৬৬৫; মিশকাত/১৮৭৯।
[21]. আবুদাঊদ হা/৪৯৪৩; তিরমিযী হা/১৯২০; ছহীহ আত-তারগীর হা/১০০।
[22]. ছহীহাহ হা/৫৭৬; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৪২২।
[23]. বুখারী হা/৬০২৩, ৬৫৪০, ৬৫৬৩; মুসলিম হা/১০১৬; মিশকাত হা/৫৮৫৭।
[24]. আবুদাঊদ হা/৪৯৪১; তিরমিযী হা/১৯২৪; মিশকাত হা/৪৯৬৯।
[25]. বুখারী হা/৬০২১; মুসলিম হা/১০০৫; মিশকাত হা/১৮৯৩।
[26]. বুখারী হা/১৪৪৫; মুসলিম হা/১০০৮; মিশকাত হা/১৮৯৫।
[27]. বুখারী হা/৩০৩৬; মুসলিম হা/২৪৭৫; তিরমিযী হা/৩৬৪১।
[28]. বুখারী হা/৬১১৬; তিরমিযী হা/২০২০; মিশকাত হা/৫১০৪।
[29]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/১৪৪০; মিশকাত হা/৪৯৯০, সনদ ছহীহ।
[30]. বুখারী হা/৬০১৪-১৫; মুসলিম হা/২৬২৫; মিশকাত হা/৪৯৬৪।
[31]. তিরমিযী হা/২৭৩৭; নাসাঈ হা/১৯৩৮; মিশকাত হা/৪৬৩০।
[32]. আবুদাঊদ হা/৪৯১৮; মিশকাত হা/৪৯৮৫; ছহীহাহ হা/৯২৬।
[33]. বুখারী হা/৬০৬৪, ৬০৬৬; মুসলিম হা/২৫৬৩; মিশকাত হা/৫০২৮।
[34]. বুখারী তা‘লীক; মুসলিম হা/৫৫; মিশকাত হা/৪৯৬৬।
[35]. বুখারী হা/২৪৪২; মুসলিম হা/২৫৮০; মিশকাত হা/৪৯৫৮।
[36]. বুখারী হা/২৪৪৩-৪৪; তিরমিযী হা/২২৫৫; মিশকাত হা/৪৯৫৭।
[37]. বুখারী তা‘লীক; গায়াতুল মারাম হা/৩৩৩।
[38]. বুখারী হা/৬০৩৮; মুসলিম হা/২৩০৯; মিশকাত হা/৫৮০১।