(১) এ পৃথিবীতে আল্লাহ মানুষকে
বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে থাকেন। কাউকে রোগ-শোক, দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন দিয়ে।
আবার কাউকে সম্পদের প্রাচুর্য, বিলাস বহুল জীবন ও সুখ-সমৃদ্ধি দান করে।
সেকারণ মানুষের উচিত বিপদাপদে আল্লাহর নিকটেই পরিত্রাণ প্রার্থনা করা এবং
সুখে-শান্তিতেও মহান আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করা। কেননা আল্লাহ বলেছেন,
‘যদি তোমরা আমার নে‘মতের কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তাহ’লে আমি অধিক পরিমাণে
প্রদান করব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও তাহ’লে জেনে রেখ আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন’ (ইবরাহীম ৭)।
সুতরাং মানুষকে পূর্বের অবস্থা স্মরণ রেখে আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মতের শুকরিয়া
আদায় করতে হবে। অন্যথা অকৃতজ্ঞ হওয়ার কারণে দুনিয়াতেই আল্লাহ শাস্তি দিতে
পারেন। এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীছি প্রণিধানযোগ্য :
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ)-কে তিনি বলতে শুনেছেন যে, বনী ইসরাঈলের মাঝে তিনজন ব্যক্তি ছিল; কুষ্ঠরোগী, টেকো ও অন্ধ। মহান আল্লাহ তাদেরকে পরীক্ষা করতে চাইলেন এবং তাদের নিকট একজন ফেরেশতা পাঠালেন। অতঃপর কুষ্ঠরোগীর কাছে এসে তিনি বললেন, তোমার সবচেয়ে পসন্দের জিনিস কোনটি? সে বলল, সুন্দর চামড়া এবং সেই রোগ থেকে আরোগ্য লাভ, লোকেরা যার কারণে আমাকে ঘৃণা করে। ফেরেশতা তার শরীর মুছে দিলেন। এতে তার রোগ দূর হ’ল এবং তাকে সুন্দর বর্ণ দান করা হ’ল। অতঃপর তিনি প্রশ্ন করলেন, তোমার নিকট কোন সম্পদ সবচেয়ে বেশী পসন্দনীয়? সে বলল, উট অথবা গরু (বর্ণনাকারীর সন্দেহ)। তাকে তখন দশ মাসের গর্ভবতী একটি উটনী দেয়া হ’ল। ফেরেশতা বললেন, আল্লাহ এতে তোমায় বরকত দিন। তারপর তিনি টেকো ব্যক্তির কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, তোমার সবচেয়ে পসন্দের জিনিস কোনটি? সে বলল, সুন্দর চুল এবং এই টাক হ’তে মুক্তি, লোকেরা যার কারণে আমাকে ঘৃণা করে। তিনি তার মাথা মুছে দিলেন। এতে তার টাক ভাল হয়ে গেল এবং তাকে সুন্দর চুল দান করা হ’ল। তিনি প্রশ্ন করলেন, কোন মাল তোমার নিকট অধিক প্রিয়? সে বলল, গরু। তখন তাকে একটি গর্ভবতী গাভী দেয়া হ’ল। তিনি বললেন, আল্লাহ এতে তোমাকে বরকত দিন। তারপর ফেরেশতা অন্ধ ব্যক্তির কাছে এসে প্রশ্ন করলেন, তোমার অধিক পসন্দের জিনিস কি? সে বলল, আল্লাহ আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিন, আমি যাতে মানুষকে দেখতে পারি। ফেরেশতা তার চোখ স্পর্শ করলেন। এতে তার চোখের দৃষ্টি আল্লাহ ফিরিয়ে দিলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, কোন মাল তোমার নিকট অধিক প্রিয়? সে বলল, ছাগল। তাকে তখন এমন ছাগী দেয়া হ’ল, যা অধিক সংখ্যক বাচ্চা দেয়। তারপর উট, গাভী ও ছাগলের বাচ্চা হ’ল এবং উট দিয়ে একটি ময়দান, গরু দিয়ে আরেকটি ময়দান এবং ছাগল দিয়ে অন্য একটি ময়দান ভরে গেল। তারপর ফেরেশতা কুষ্ঠরোগীর কাছে তাঁর প্রথম রূপ ধারণ করে এসে বললেন, আমি একজন মিসকীন। সফরে আমার সবকিছু নিঃশেষ হয়ে গেছে। আজ আল্লাহ ব্যতীত কেউ নেই যার সাহায্যে আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছতে পারি, তারপর তোমার সহায়তায়। যে আল্লাহ তোমাকে সুন্দর বর্ণ, সুন্দর ত্বক ও সম্পদ দিয়েছেন, সে আল্লাহর নামে তোমার নিকট আমি একটা উট চাচ্ছি, যার সাহায্যে আমি গন্তব্যে পৌঁছতে পারি। সে বলল, (আমার উপর) অনেকের অধিকার রয়েছে। তিনি বললেন, তোমাকে বোধহয় আমি চিনি। তুমি কুষ্ঠরোগী ছিলে না? লোকেরা তোমাকে কি ঘৃণা করত না? তুমি না নিঃস্ব ছিলে? আল্লাহ তোমাকে সম্পদ দিয়েছেন। সে বলল, এই সম্পদ তো আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পূর্বপুরুষ থেকে পেয়েছি। তিনি বললেন, তুমি যদি মিথ্যাবাদী হও তাহ’লে তোমাকে যেন আল্লাহ আগের মতো করে দেন।
এরপর তিনি টেকো ব্যক্তির কাছে তাঁর প্রথম রূপ ধারণ করে এসে অনুরূপ বললেন, প্রথম লোকটিকে যা বলেছিলেন এবং সে সেই উত্তরই দিল, যা পূর্বের লোকটি দিয়েছিল। ফেরেশতা একেও বললেন, তুমি যদি মিথ্যাবাদী হয়ে থাক তাহ’লে আল্লাহ যেন তোমাকে পুনরায় আগের মতো করে দেন। এরপর ফেরেশতা অন্ধ ব্যক্তির কাছে তাঁর আগের রূপ ধারণ করে এসে বললেন, আমি একজন মিসকীন ও পথিক। আমার সবকিছু সফরে নিঃশেষ হয়ে গেছে। এখন গন্তব্যে পৌঁছতে আল্লাহ ব্যতীত আর কোন উপায় নেই, তারপর তোমার সহায়তায়। সেই আল্লাহর নামে তোমার কাছে একটি ছাগল সাহায্য চাচ্ছি, যিনি তোমাকে তোমার চোখ ফেরত দিয়েছেন। লোকটি বলল, আমি অন্ধ ছিলাম। আমাকে আমার দৃষ্টিশক্তি আল্লাহ ফেরত দিয়েছেন। কাজেই তোমার যত ইচ্ছা মাল তুমি নিয়ে যাও, আর যা ইচ্ছা রেখে যাও। আল্লাহর শপথ! মহান আল্লাহর ওয়াস্তে আজ তুমি যা কিছু নিবে তাতে আমি তোমাকে বাঁধা প্রদান করব না। ফেরেশতা বললেন, তোমার সম্পদ তোমার কাছেই রাখ। তোমাদেরকে শুধুমাত্র পরীক্ষা করা হয়েছে। তোমার প্রতি আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট এবং তোমার অপর দু’জন সাথীর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন (বুখারী হা/৩৪৬৪; মুসলিম হা/২৯৬৪)। আল্লাহ যে মানুষকে পরীক্ষা করেন উপরোক্ত হাদীছ তার বাস্তব প্রমাণ। সুতরাং দুনিয়ার মোহমায়ায় ও এর প্রাচুর্যে আবিষ্ট হয়ে আল্লাহর নে‘মতকে ভুলে না গিয়ে, আল্লাহর নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করাই যথার্থ মুমিনের পরিচয়।
(২) পৃথিবীতে মানুষ পিতা-মাতার মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করে। মা দশ মাস অবধি সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন, সীমাহীন কষ্ট সহ্য করে প্রসব করেন এবং অসীম ধৈর্য ধারণ করে তাকে লালন-পালন করেন। তাই মায়ের মর্যাদা অত্যধিক। সন্তানের জন্য মায়ের দো‘আ আলাহ সাথে সাথে কবুল করেন। এজন্য মায়ের আদেশ-নিষেধের প্রতি সকল সন্তানকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। অন্যথা মায়ের বদ দো‘আর ফলে সন্তান বিপদাপদের সম্মুখীন হ’তে পারে। এ সম্পর্কেই নিম্নোক্ত হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, (বানী ইসরাঈলের) তিন জন ব্যতীত আর কেউই দোলনায় কথা বলেননি। (ক) ঈসা ইবনু মারিয়াম এবং (খ) ছাহেবে জুরায়জ। জুরায়জ একজন আবেদ বান্দা ছিলেন। নিজের জন্য একটি ইবাদতখানা তৈরী করে তিনি সেখানেই বসবাস করছিলেন। তার মা সেখানে আসলেন। তিনি এই সময় ছালাত পড়ছিলেন। তার মা বললেন, হে জুরায়জ! তখন তিনি (মনে মনে) বললেন, হে রব! আমার ছালাত ও আমার মা। জুরায়জ ছালাতেই মগ্ন থাকলেন। তার মা চলে গেলেন। তার মা পরের দিন আসলেন। তিনি এবারও ছালাতে রত ছিলেন। তাকে তার মা ডাকলেন, হে জুরায়জ! তিনি (মনে মনে) বললেন, হে রব! আমার মা ও আমার ছালাত। তিনি ছালাতেই মগ্ন থাকলেন। পরের দিন এসেও মা তাকে ছালাতে মগ্ন দেখলেন। তিনি ডাকলেন, হে জুরায়জ! জুরায়জ বলেন, হে আল্লাহ! আমার মা ও আমার ছালাত। তিনি তার ছালাতেই রত থাকলেন। তার মা বললেন, হে আল্লাহ! তুমি একে ব্যভিচারী নারীর চেহারা না দেখা পর্যন্ত মৃত্যু দিও না। বানী ইসরাঈলের মাঝে জুরায়জ ও তার ইবাদতের চর্চা হ’তে লাগল। এক যিনাকারী নারী ছিল। সে উলেখযোগ্য রূপ-সৌন্দর্যের অধিকারিণী ছিল। সে বলল, যদি তোমরা বল তবে তাকে (জুরায়জকে) আমি বিভ্রান্ত করতে পারি। সে তাকে বিরক্ত করতে লাগল, কিন্তু সেদিকে তিনি (জুরায়জ) লক্ষ্যই করলেন না। তারপর মহিলাটি তার ইবাদতখানার নিকটবর্তী এলাকায় এক রাখালের নিকট আসল। নিজের উপর তাকে সে অধিকার দিল এবং উভয়ে ব্যভিচারে লিপ্ত হ’ল। এতে করে সে গর্ভধারণ করল। সে সন্তান জন্ম দিয়ে বলল, এটা জুরায়জের সন্তান। বানী ইসরাঈলরা (রাগান্বিত হয়ে) জুরায়জের নিকট এসে তাকে ইবাদতখানা থেকে বাইরে নিয়ে আসল, ইবাদতখানাটি ধ্বংস করে দিল এবং তাকে মারধর করতে লাগল। জুরায়জ বললেন, তোমাদের কি হয়েছে? তারা বলল, এই নারীর সাথে তুমি ব্যভিচার করেছ। ফলে একটি শিশু জন্ম নিয়েছে। তিনি বললেন, শিশুটি কোথায়? তারা শিশুটিকে নিয়ে আসল। জুরায়জ বললেন, আমাকে একটু সুযোগ দাও, ছালাত পড়ে নেই। অতঃপর তিনি ছালাত পড়লেন। ছালাত শেষে তিনি শিশুটির নিকট এসে তার পেটে খোঁচা মেরে প্রশ্ন করলেন, হে শিশু! তোমার জন্মদাতা কে? সে বলল, অমুক রাখাল আমার পিতা। তখন উপস্থিত ব্যক্তিরা জুরাইজের দিকে আকৃষ্ট হ’ল এবং তাকে চুমু দিতে লাগল। তারা বলল, আমরা এখন তোমার ইবাদতখানাটি স্বর্ণ দিয়ে তৈরী করে দিচ্ছি। তিনি বললেন, প্রয়োজন নেই, বরং আগের মতো মাটি দিয়েই তৈরী করে দাও। তারপর তার ইবাদতখানাটি তারা আবার নির্মাণ করে দিল।
(গ) একটি বাচ্চা তার মায়ের দুধ পান করছিল। একটি লোক এমন সময় সেখান দিয়ে দ্রুতগামী ও উন্নত মানের একটি জন্তুযানে সওয়ার হয়ে যাচ্ছিল। তার পোশাক-পরিচ্ছদও ছিল উন্নত মানের। শিশুটির মা বলল, হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে এই লোকের ন্যায় উপযুক্ত করো। দুধপান ছেড়ে দিয়ে শিশুটি লোকটির দিকে তাকাল, তারপর বলল, হে আল্লাহ! আমাকে এই লোকের মতো করো না? এই বলে সে পুনরায় দুধ পান করতে থাকল। (বর্ণনাকারী বলেন), আমি যেন এখনও দেখছি, শিশুটির দুধ পানের চিত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তুলে ধরছেন এবং নিজের তর্জনী (শাহাদাৎ অঙ্গুলি) মুখে দিয়ে চুষছেন। তিনি (নবী) বললেন, একটি দাসীকে মারতে মারতে লোকেরা নিয়ে যাচ্ছিল আর বলছিল, তুমি ব্যভিচার করেছ এবং চুরি করেছ। মহিলাটি বলছিল, আমার জন্য আল্লাহ যথেষ্ট এবং আমার জন্য তিনিই উত্তম অভিভাবক। শিশুটির মা বলল, হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে তুমি এই ব্যভিচারিণী মহিলার মতো করো না, দুধপান ছেড়ে দিয়ে শিশুটি মহিলাটির দিকে দৃষ্টিপাত করল, তারপর বলল, হে আল্লাহ! আমাকে তুমি এই মহিলার মতো করে গড়ে তুলো। মা ও শিশুর মাঝে এ সময় কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেলো। মা বলল, একজন সুঠাম ও সুন্দর লোক চলে যাবার সময় আমি বললাম, হে আল্লাহ! আমার ছেলেকে এমন উপযুক্ত করে দাও। তখন তুমি বললে, হে আল্লাহ! আমাকে এরকম করো না। আবার এই দাসীকে লোকেরা যখন মারধর করতে করতে নিয়ে যাচ্ছে এবং বলছে, তুমি ব্যভিচার করেছ এবং চুরি করেছ। আমি বললাম, হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে এর মতো করো না। আর তুমি প্রতিউত্তরে বললে, হে আল্লাহ! আমাকে এমন করো। শিশুটি এবার উত্তর দিল, প্রথম লোকটি ছিল স্বৈরাচারী অত্যাচারী। আমি সেজন্যই বললাম, হে আল্লাহ! আমাকে এই লোকের মতো করো না। আর এই নারীকে তারা বলে, তুমি যিনা করেছ। সে প্রকৃতপক্ষে যিনা করেনি। তারা বলে, তুমি চুরি করেছ, প্রকৃতপক্ষে সে চুরি করেনি। এ কারণেই আমি বললাম, হে আল্লাহ! আমাকে এ মহিলাটির মতো করো (বুখারী হা/৩৪৩৬; মুসলিম হা/২৫৫০)।
পরিশেষে বলব, অত্যাচারী স্বৈরাচারীকে কেউ পসন্দ করে না। পক্ষান্তরে আল্লাহভীরু নির্দোষ মানুষকে সকলেই পসন্দ করে। যেরূপ মাতৃক্রোড়ে দুধপানরত শিশুটি বিনাদোষে নির্যাতিত মহিলাটির মতো হওয়ার আকাংখা ব্যক্ত করেছিল। আল্লাহ আমাদেরকে তাক্বওয়াশীল হওয়ার তাওফীক দিন- আমীন!
মুসাম্মাৎ শারমীন আখতার
পিঞ্জুরী, কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ।