عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ نَهَى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ بَيْعَتَيْنِ فِى بَيْعَةٍ، رَوَاهُ مَالِكٌ وَالتِّرْمِذِيُّ وَأَبُو دَاؤُدَ وَالنَّسَائِيُّ-

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক বিক্রয়ের মধ্যে দুই বিক্রয় নিষেধ করেছেন’।[1] অর্থাৎ এক ব্যবসায়ে দুই ধরনের বিক্রয়।

ইমাম তিরমিযী বলেন, এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ বিন আমর, আব্দুল্লাহ বিন ওমর ও আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ থেকে হাদীছ রয়েছে। আবু হুরায়রা বর্ণিত অত্র হাদীছ ‘হাসান ছহীহ’। এর উপরে আমল রয়েছে বিদ্বানগণের মধ্যে। কোন কোন বিদ্বান ব্যাখ্যা করেছেন, ‘এক বিক্রয়ে দুই বিক্রি নিষিদ্ধ’ অর্থ যেমন কেউ বলল, আমি তোমার নিকট কাপড়টি বিক্রি করলাম নগদে ১০ টাকায় এবং বাকীতে ২০ টাকায়। অতঃপর তারা যদি কোন একটির উপর সিদ্ধান্ত নিয়ে পৃথক হয়, তাহ’লে তাতে কোন দোষ নেই’।

এখানে ইমাম তিরমিযীর ব্যাখ্যায় প্রশ্ন রয়েছে। কেননা যেকোন একটির উপরে নয়, বরং কম মূল্যটির উপর সিদ্ধান্ত হ’তে হবে, বাকীতে বেশী মূল্যের উপর নয়। কেননা সেটি সূদ হবে। যা আবু হুরায়রা বর্ণিত অন্য হাদীছ (আবুদাঊদ হা/৩৪৬১) দ্বারা প্রমাণিত।

উপরোক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় আব্দুল ওয়াহহাব ইবনু আত্বা আল-বাগদাদী (মৃ. ২০৪ হি./৮২০ খৃ.) বলেন, ‘এটি তোমার জন্য নগদে দশ ও বাকীতে বিশ’। ইমাম ইবনু কুতায়বা দীনাওয়ারী বলেন, ‘নিষিদ্ধ ব্যবসা সমূহের অন্যতম হ’ল, এক বিক্রিতে দুই শর্ত। সেটি এই যে, কোন ব্যক্তি একটি মাল কিনবে দুই মাসের বাকীতে দুই দীনারে এবং তিন মাসের বাকীতে তিন দীনারে। আর এটা হ’ল এক বিক্রির মধ্যে দুই বিক্রি’।[2]

উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় অন্যান্যগণ বলেন, বিক্রেতা যদি ক্রেতাকে বলে, আমি তোমার নিকট এই কাপড়টি বিক্রয় করলাম নগদে ১০০ টাকায় এবং বাকীতে ১২০ টাকায়। এতে যদি ক্রেতা বলে ‘আমি কবুল করলাম’। অতঃপর ঐ অবস্থায় স্থান ত্যাগ করে ও পৃথক হয়ে যায়। অথচ নগদ না বাকী সেটা নির্দিষ্ট না করে, তাহ’লে এই অজ্ঞতার কারণে ব্যবসাটি বাতিল হবে। কিন্তু যদি দু’টি মূল্যের কোন একটিতে মূল্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। যেমন ক্রেতা বলল, আমি অধিক মূল্যে বাকীতে মাল খরীদ করতে রাযী হ’লাম, তাহ’লে উক্ত ব্যবসা সিদ্ধ হবে। কারণ এখানে অজ্ঞতা থাকবে না।

মিশকাতের বাংলা অনুবাদক নূর মুহাম্মাদ আ’জমী উক্ত হাদীছের (হা/২৭৪৪ (৩৫) ব্যাখ্যায় বলেন, এর অর্থ নগদ দামে পাঁচ টাকা মূল্য, আর বাকী নিলে ছয় টাকা, একদিক নির্ধারিত না করিয়া ক্রয়-বিক্রয় সাব্যস্ত করা নিষিদ্ধ (পৃ. ৬/৫৮)

জবাব : উক্ত ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ উক্ত হাদীছে অজ্ঞতা বা মূল্য নির্ধারিত না করে ক্রয়-বিক্রয় সাব্যস্ত করার কিছু নেই। বরং এর ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট। তাছাড়া আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ بَاعَ بَيْعَتَيْنِ فِى بَيْعَةٍ فَلَهُ أَوْكَسُهُمَا أَوِ الرِّبَا ‘যে ব্যক্তি একটি ব্যবসায়ে দু’টি বিক্রয় করে সে কম মূল্যেরটা নিবে অথবা সূদ নিবে’।[3]

এখানে ক্রেতাকে এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে দু’টির যেকোন একটি গ্রহণ করার। হয় সে নগদে কম মূল্যে খরীদ করবে, যা সিদ্ধ। নয় বাকীতে বেশী মূল্যে খরীদ করবে, যা সূদ এবং যা নিতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিষেধ করেছেন। এর মধ্যে অজ্ঞতার কিছু নেই।

বস্ত্ততঃ মূল্য স্থির করায় অজ্ঞতা থাক বা না থাক এবং এক সাথে হৌক বা কিস্তিতে হৌক বাকীতে বেশী মূল্য নিলেই সেটা সূদ হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,الرِّبَا فِى النَّسِيئَةِ ‘সূদ হয় বাকীতে’।[4]  

তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক ব্যবসায়ে নগদে এক বিক্রি ও বাকীতে আরেক বিক্রি নিষেধ করেছেন’ মর্মে হাদীছের (আহমাদ হা/৩৭৮৩) রাবী সিমাক বিন হারব, যিনি একজন বিখ্যাত তাবেঈ এবং যিনি ৮০ জন ছাহাবীর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন, বিরোধের কারণে যার ব্যাখ্যাই এখানে গ্রহণযোগ্য হবে। তিনি বলেন, এর অর্থ হ’ল,الرَّجُلُ يَبِيعُ الْبَيْعَ فَيَقُولُ هُوَ بِنَسَاءٍ بِكَذَا وَكَذَا وَهُوَ بِنَقْدٍ بِكَذَا وَكَذَا-  ‘বিক্রেতা বলবে, বস্ত্তটি বাকীতে অত টাকায় এবং নগদে এত টাকায়’।[5] এরূপ স্পষ্ট ব্যাখ্যার পরেও যদি কেউ অস্পষ্টতার দোহাই দেন, তবে সেটা কিভাবে গ্রহণযোগ্য হবে?

আমর ইবনু শু‘আইব তার পিতার মাধ্যমে তার দাদা হ’তে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘ঋণ ও ক্রয়-বিক্রয় একসঙ্গে করা হালাল নয়। এক ব্যবসায়ে দুই শর্ত জায়েয নয়। যাতে লোকসানের ঝুঁকি নেওয়ার দায়িত্ব নেই, তাতে লাভ দাবী করার অধিকার নেই এবং যে বস্ত্ত তোমার হাতে নেই, তা বিক্রি করা হালাল নয়’।[6] অর্থাৎ ব্যবসায়ে লাভ-লোকসান দু’টিরই ঝুঁকি আছে। কিন্তু সূদে লোকসানের ঝুঁকি নেই। প্রচলিত বায়‘এ মুআজ্জালে উক্ত নিষিদ্ধ বিষয়গুলির অধিকাংশ রয়েছে। বড় কথা এতে লোকসানের কোন ঝুঁকি নেই।

হীলা-বাহানা করা পাপ :

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,لاَ تَرْتَكِبُوا مَا اِرْتَكَبَ الْيَهُود فَتَسْتَحِلُّوا مَحَارِم الله بِأَدْنَى الْحِيَل ‘তোমরা ঐরূপ পাপ করোনা যেরূপ পাপ করেছিল ইহূদীরা। তোমরা ন্যূনতম কৌশলের মাধ্যমে আল্লাহকৃত হারাম সমূহকে হালাল করো না’।[7]

উক্ত হাদীছে মুসলিম উম্মাহকে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিভিন্ন কৌশলে হারামকে হালাল করতে নিষেধ করা হয়েছে। সব জাতির মধ্যেই কমবেশী এটা আছে। কিন্তু এখানে ইহূদীদের কথা উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হ’ল এই যে, ধোঁকা ও প্রতারণায় বাড়াবাড়ি করার কারণে ইহূদী জাতি দৃষ্টান্তমূলকভাবে আল্লাহর গযবে পতিত হয়েছে এবং তারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত অভিশপ্ত জাতি হিসাবে নিন্দিত হয়েছে।[8] আল্লাহর হুকুমে নবী দাঊদ (আঃ) তাদেরকে তাদের সাপ্তাহিক ইবাদতের দিন শনিবারে সাগরে মাছ ধরতে নিষেধ করেছিলেন এবং ঐ দিন তাদেরকে ইবাদতে রত থাকতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আল্লাহ তাঁদের ঈমানের পরীক্ষা নিলেন এবং ছুটির দিন অধিকহারে কিনারায় মাছের আগমন ঘটতে লাগল। এতে শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে তারা কৌশল করল যে, তারা শনিবার দিনের বেলায় নদীর নালাতে মাছ প্রবেশ করিয়ে সন্ধ্যায় নালার মুখ বন্ধ করে দিত এবং পরদিন রবিবার সকালে মাছ ধরত। তাদের এই হারামকে হালাল করার অপকৌশল দেখে ঈমানদারগণ তাদের নিষেধ করেন। কিন্তু তারা তা অমান্য করলে মাঝখানের দেওয়াল খাড়া করে তারা তাদের থেকে পৃথক হয়ে যান। এরপর একদিন তাদের কোন সাড়া-শব্দ না পেয়ে ঈমানদারগণ উপর থেকে তাকিয়ে দেখেন যে, তারা সব আল্লাহর গযবে বানরে পরিণত হয়ে গেছে। অতঃপর তিনদিনের মধ্যে তারা মরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ক্বাতাদাহ বলেন, যুবকগুলি বানরে ও বৃদ্ধগুলি শূকরে পরিণত হয়।[9] সেই থেকে এই জাতি أصحاب القردة والخنازير ‘বানর ও শূকরের জাতি’ বলে ইতিহাসে পরিচিত হয়।

আল্লাহকৃত হারামকে হালাল করার অপকৌশল করার জন্যই তাদের এই চরম পরিণতি হয়েছিল। আজও কোন জাতি তাদের অনুকরণ করলে আল্লাহ একই শাস্তি বা তার চাইতে কঠিন কোন শাস্তি দুনিয়াতে প্রেরণ করতে পারেন। যাকে রুখবার ক্ষমতা মানুষের নেই। এইডস, ক্যান্সার, ইবোলা, জিকা ভাইরাস ইত্যাদি নিত্য নতুন মরণ ব্যাধির ভাইরাস বা আবহাওয়া পরিবর্তনের গযব কি এ যুগের মানুষের জন্য কঠিনতম দুনিয়াবী শাস্তি নয়? আখেরাতে জাহান্নামের কঠোর শাস্তি তো আছেই।

আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সূদকে হারাম করেছেন। কিন্তু মক্কার নেতারা ব্যবসা ও সূদের পার্থক্য না বুঝে বলেছিল, إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا ‘ব্যবসা তো সূদেরই মতো’ (বাক্বারাহ ২/২৭৫)। কেননা মালের বিনিময়ে টাকা পেলে যদি ব্যবসা হয়, তবে টাকার বিনিময়ে টাকা পেলে সেটা সূদ হবে কেন? দু’টি তো সমানই। অথচ মাল বেচা-কেনায় সম্পদের প্রবৃদ্ধি হয়। নিত্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। অর্থনীতির চাকা গতিশীল হয়। সমাজের সর্বত্র সম্পদের প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে টাকা কোন সম্পদ নয়। বরং সম্পদ ক্রয়-বিক্রয়ের একটা মাধ্যম মাত্র। যার নিজস্ব কোন মূল্য নেই। এই মৌলিক পার্থক্য না বুঝে শয়তানী কুমন্ত্রণায় পড়ে আমরা ব্যবসায়ের নামে অনেক ক্ষেত্রে সূদী কারবার করে চলেছি। যার অন্যতম হ’ল বায়‘এ মুআজ্জাল(البيع المؤجل)। যার অর্থ বাকীতে অধিক মূল্য আদায়ের ব্যবসা। অর্থাৎ একটা বস্ত্ত নগদে কিনলে কম দাম এবং বাকীতে কিনলে বেশী দাম। চাই সেটা কিস্তিতে হৌক বা এক সাথে হৌক। এটা তো পরিষ্কার সূদ। কেউ নগদে ১০০ টাকা ঋণ নিলে এবং পরবর্তীতে কিস্তিতে বা একসাথে ঋণ পরিশোধের সময় টাকা বেশী দিলে সেটা সূদ হয়। এতে কোন মতভেদ নেই। তাহ’লে মাল বিক্রির সময় নগদে একদাম ও বাকীতে বেশী দাম নিলে সেটা সূদ হবে না কেন? অথচ ব্যবসার নামে এটাই এখন চলছে সর্বত্র। ব্যাংক ও এনজিও ঋণের সূদের কিস্তি আদায়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে মানুষ। তাছাড়া একে ভিত্তি করে চালু হয়েছে আরও বহু কিছু অন্যায় প্রথা। ফলাফল দাঁড়িয়েছে এই যে, সর্বশেষ হিসাব মতে পৃথিবীর ৯৯ ভাগ মানুষের সম্পদ  এক  ভাগ  মানুষের  হাতে  জমা  হয়েছে। এমনকি মর্মান্তিক খবর এই যে, মাত্র ৮ জন মানুষের হাতে এই সম্পদ রয়েছে। একেই আমরা বলছি, অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতি বা গণতান্ত্রিক অর্থনীতি। যা স্রেফ প্রতারণা বৈ কিছুই নয়। এই রাক্ষুসী অর্থনীতির হাত থেকে বাঁচতে চাইলে দলমত নির্বিশেষে সকলকে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রেরিত ইসলামী অর্থনীতির কাছে মাথা নত করতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই।

যুক্তি সমূহ :

বায়‘এ মুআজ্জালকে হালাল করার জন্য বিভিন্ন যুক্তি দেওয়া হয়। যেমন (১) ক্রেতাকে সময় দেওয়ার প্রতিদান হিসাবে বিক্রেতাকে কিছু বেশী অর্থ দেওয়াটা যুক্তির দাবী।

জবাব : সময়ের প্রতিদান একা বিক্রেতা পাবে কেন? ক্রেতাকেও পেতে হবে। বিলম্বিত সময়ে ক্রেতার কোন ক্ষতি হ’লে এবং কিস্তি সময়মত এবং যথাযথভাবে দিতে সক্ষম না হলে বিক্রেতা তখন বর্ধিত মূল্যে কোনরূপ ছাড় দিবেন কি? অতএব সময়ের সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়ে সমান। কেবল বিক্রেতাই একচেটিয়া সুবিধা ভোগ করবেন এবং তার জন্য বাড়তি মূল্য দাবী করবেন, এটা অত্যাচার এবং এটাই সূদ। অতএব ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি নগদ হ’তে হবে। বাকীতে পরিশোধ করলে কোন পক্ষই বাড়তি সুবিধা চাইতে পারবেন না। বিশেষ করে বিক্রেতা বাড়তি মূল্য দাবী করতে পারবেন না। এ সময় বাড়তি মূল্যে উভয়ে সম্মত হয়ে চুক্তিবদ্ধ হ’লেও ঐ চুক্তি বাতিল হবে। কেননা ওটা অত্যাচারমূলক চুক্তি। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যে কোন শর্ত যা আল্লাহর কিতাবে নেই তা বাতিল। যদিও সেখানে একশত শর্ত থাকে’।[10]

তিনি বলেন, ‘মুসলমানদের মধ্যে সন্ধি জায়েয। তবে ঐ সন্ধিচুক্তি নয়, যা হালালকে হারাম করে অথবা হারামকে হালাল করে। আর মুসলমানেরা থাকবে তাদের শর্ত সমূহের উপরে। কেবল ঐ শর্ত ব্যতীত, যা হালালকে হারাম করে অথবা হারামকে হালাল করে’।[11]

একই অবস্থা ঋণ দানের ক্ষেত্রে। কাউকে ঋণ দিলে তার বিনিময়ে বাড়তি টাকা দেওয়াটাই সূদ। চাই সেটা কিস্তিতে হৌক বা একত্রে হৌক। কেননা যেকোন ঋণ যা লাভ নিয়ে আসে সেটাই সূদ।[12] কোন কোন বিদ্বান বলেন, সহনীয় মাত্রায় নিলে সেটা জায়েয হবে। কিন্তু উচ্চ মাত্রায় নিলে সেটা যুলুম হবে, যা নিষিদ্ধ’।[13] এ এক আজব ফৎওয়া। অল্প সূদ জায়েয এবং বেশী সূদ হারাম, এটা কোন নিয়মে পড়ে? অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, وَمَا أَسْكَرَ كَثِيرُهُ فَقَلِيلُهُ حَرَامٌ ‘যার বেশীতে মাদকতা আনে, তার কমটাও হারাম’।[14] মদ্যপান কম হৌক বেশী হৌক দু’টিই হারাম। একইভাবে সূদের হার কম হৌক বা বেশী হৌক দু’টিই হারাম।

(২) আর যাই হৌক এটি একটি ব্যবসা তো বটে। যা সমাজের মানুষ মেনে নিয়েছে। অতএব এটি হালাল।

জবাব : ইসলাম আসার পর আরব জাতির মধ্যে সে সময়ে প্রচলিত ৩০-এর অধিক ব্যবসাকে হারাম করা হয়। যেমন মুহাক্বালাহ, মুখাযারাহ, মুনাবাযাহ, মুলামাসাহ, মুযাবানাহ, মু‘আওয়ামাহ, ঈনাহ, হিছাত, ছুনিয়া, গারার, কালী, উরবান ইত্যাদি। অতএব ব্যবসার নামে সমাজে চালু হ’লেই সেটা হালাল হবে, এটা আবশ্যিক নয়। বরং এসব ব্যবসা স্বার্থবাদীদের ও পুঁজিপতিদের স্বার্থে তাদের দ্বারাই সৃষ্ট। যা গরীবের প্রতি এবং ঋণ গ্রহিতার প্রতি অত্যাচার করে মাত্র। যেমন বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আমাদের দেশে চালু হয়েছে ‘মূল্য সংযোজন কর’ বা ভ্যাট প্রথা। অথচ ইসলামী অর্থনীতির মূল কথা হ’ল অত্যাচার করো না এবং অত্যাচারিত হয়ো না (বাক্বারাহ ২/২৭৯)। ফলে ব্যবসার নামে চালু হওয়া সকল প্রকার শোষণ ও অত্যাচার মূলক অর্থনৈতিক বিধি-বিধান ইসলাম বাতিল করেছে। যাতে সমাজের সকল মানুষ সমভাবে ও ন্যায়ানুগভাবে কল্যাণপ্রাপ্ত হয়।

(৩) ব্যবসায়ী ইচ্ছামত দ্রব্যমূল্য বাড়াতেও পারে কমাতেও পারে। বিশেষ করে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে রাযী হ’লে যেকোন চুক্তি তারা করতে পারে। অতএব সমস্যা কোথায়?

জবাব : এটা হ’ল ফটকাবাজ ব্যবসায়ীদের কথা। যা ব্যবসায়িক শিষ্টাচারের পরিপন্থী। কেননা দ্রব্যমূল্য উঠানামা করে মূলতঃ চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে এবং দ্রব্যের মান বিচারে। এরপরেও এটা সাময়িকভাবে মেনে নিলেও মূল বিষয়টি থাকছে অন্যখানে। আর তা হ’ল মূল্য দেরীতে পরিশোধ করলে তাকে অধিক মুনাফা দিতে হবে সময়ের মূল্য হিসাবে। এটাতো ঠিক ঐ সূদী কারবারীর মত যে ১০০ টাকা ঋণ দিয়ে পরে পরিশোধের সময় ১১০ টাকা আদায় করে তার ঋণের মুনাফা হিসাবে।

(৪) বায়‘এ মুআজ্জাল তো বায়‘এ সালামের মত। যা ইসলাম জায়েয করেছে।

জবাব : দু’টি সম্পূর্ণভাবে পরস্পরের বিপরীত। কারণ (ক) বায়‘এ সালামে আগে মূল্য পরিশোধ করা হয় এবং মাল পরে নেওয়া হয়। পক্ষান্তরে বায়‘এ মুআজ্জালে মাল আগে নেওয়া হয়। মূল্য পরে দেওয়া হয়। অতএব একটির উপর অপরটির ক্বিয়াস বাতিল। (খ) বায়‘এ সালাম সিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট দলীল রয়েছে। অথচ বায়‘এ মুআজ্জালে এরূপ কোন দলীল নেই। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করার পর দেখলেন যে, তারা এক বছর বা দু’বছর মেয়াদে নগদ টাকায় আগাম ফল বিক্রি করে। তখন তিনি বললেন, যে ব্যক্তি বাকীতে ফল বিক্রি করবে, সে যেন নির্দিষ্ট মাপ, নির্দিষ্ট ওযন ও নির্দিষ্ট মেয়াদে তা বিক্রি করে।[15] (গ) বায়‘এ সালামে মাল দেরীতে দেওয়ার কারণে মূল্য বৃদ্ধি করার সুযোগ নেই। অথচ বায়‘এ মুআজ্জালে মাল হাতে থাকা সত্ত্বেও কেবল মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। দু’টি সম্পূর্ণ বিপরীত এবং শেষেরটি অত্যাচারমূলক।...

(ঘ) বায়‘এ সালামে ক্রেতা ও কৃষক উভয়ে লাভবান হয়। কৃষক আগাম ও দ্রুত ফসলের মূল্য পাওয়ায় তা কৃষিতে ব্যয় করতে পারে। অন্যদিকে ক্রেতা মৌসুমের সময় ফসল পায়। এতে উভয়ে লাভবান হয়। এমন নয় যে, মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে তাকে অধিক মূল্য দিতে হয়।

(৫) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি উটের বিনিময়ে দু’টি ছাদাক্বার উট খরীদ করেছেন (আহমাদ হা/৬৫৯৩)। অতএব বাকীতে মাল বিক্রয়ে দ্বিগুণ মূল্য নেওয়া যাবে।

জবাব : এটি নগদ ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয়। বাকীতে বিক্রয়ের কারণে দু’টি উট নয়। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, অনেক সময় দু’টি উটের চাইতে একটি উট উত্তম হয়ে থাকে।[16] তাছাড়া এটি উট-ছাগল ইত্যাদির ব্যাপারে খাছ হ’তে পারে। কিন্তু এর উপর ক্বিয়াস করে স্বর্ণ-রৌপ্য সহ অন্যান্য সকল ব্যাপারে বেশী নেওয়া যাবে না। কেননা তাহ’লে সেটা রিবা-আল-ফযল বা ‘অতিরিক্ত নেবার সূদ’-এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। যা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ।

(৬) বায়‘এ মুআজ্জালের মধ্যে উভয় পক্ষের সুবিধা আছে। এখানে ক্রেতা তার মাল আগেই পেয়ে যান কোনরূপ অগ্রিম না দিয়েই। তাছাড়া কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ তার পক্ষে সহজ হয়। অন্যদিকে বিক্রেতা কিস্তিতে মাল বিক্রি করে অধিক লাভবান হন।

জবাব : এই যুক্তি অচল, কয়েকটি কারণে। যেমন এই যুক্তিই তো সূদের বেলায় দেওয়া হয়। সেখানে সূদ গ্রহিতা নগদ টাকা পেয়ে উপকৃত হয়। অন্যদিকে সূদদাতা দেরীতে টাকা পরিশোধের বিনিময়ে অধিক টাকা পায়। এতে উভয়ে লাভবান হয়। ফলে বায়‘এ মুআজ্জাল ও সূদী কারবারে কোনই পার্থক্য রইল না।

(৭) দেরীতে অধিক মূল্যে মাল বিক্রেতা শর্তাধীনে এটা করে থাকেন। কেননা তিনি পুরাপুরি ভরসা পান না যে, ক্রেতা যথাসময়ে মূল্য পরিশোধ করবে। সেকারণ তিনি বিক্রয় করেন এভাবে যে, মূল্য পরিশোধ যত দেরী হবে, তত অধিক মূল্য দিতে হবে নির্দিষ্ট হারে।

জবাব : এটাই তো সূদী ঋণের পক্ষে প্রধান যুক্তি। ঋণদাতা ঋণ দিয়ে টাকা বসিয়ে রাখবে। অথচ তার বিনিময়ে কোন লাভ পাবে না এটাতো হ’তে পারে না। বায়‘এ মুআজ্জালে তো সেটাই যুক্তি হ’ল।

(৮) জমহূর বিদ্বানগণ বায়‘এ মুআজ্জালের পক্ষে মত দিয়েছেন।

জবাব : এ দাবী সঠিক নয়। কেননা পরবর্তী বিদ্বানগণের অনেকে উক্ত বিষয়ের পক্ষে মত প্রকাশ করলেও প্রথম যুগের মুজতাহিদ বিদ্বানগণ এর বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। তাছাড়া ছাহাবী ও তাবেঈগণ এর বিরোধিতা করেছেন। আর ছাহাবী ও তাবেঈগণের ব্যাখ্যা পাওয়ার পর পরবর্তী বিদ্বানগণের ব্যাখ্যা ধর্তব্য নয়। বরং এটাই সত্য যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবীগণের যামানায় যেটা দ্বীন ছিল না, পরবর্তী যামানায় সেটা দ্বীন হিসাবে গ্রাহ্য হবে না। আর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল আহলে সুন্নাত বিদ্বান এ বিষয়ে একমত যে, ‘কোন বিষয়ে যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কোন ছহীহ হাদীছ পাওয়া যাবে, তখন তা অন্য কারু কথায় পরিত্যাগ করা হালাল নয়, তাই সেটা যার কথাই হৌক না কেন’।[17] ‘এক ব্যবসায়ে দুই বিক্রয় নিষিদ্ধ’ মর্মের হাদীছ (তিরমিযী হা/১২৩১) এবং সেটা কেউ করলে কম মূল্যেরটা সিদ্ধ হবে; বেশীটা ‘রিবা’ বা সূদ হবে’ (আবুদাঊদ হা/৩৪৬১) মর্মের হাদীছ দু’টি ছহীহ। এতে সকল বিদ্বান একমত। অতএব উক্ত ব্যবসা হারাম হওয়ার বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

এক্ষণে আমরা উক্ত বিষয়ে প্রথমে ছাহাবীগণের ব্যাখ্যা পেশ করব।-

ছাহাবীগণের ব্যাখ্যা :

(১) আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,إِذَا اسْتَقَمْتَ بِنَقْدٍ، وَبِعْتَ بِنَقْدٍ، فَلا بَأْسَ بِهِ، وَإِذَا اسْتَقَمْتَ بِنَقْدٍ، فَبِعْتَ بِنَسِيئَةٍ، فَلا، إِنَّمَا ذَلِكَ وَرِقٌ بِوَرِقٍ ‘যখন তুমি নগদে এক দাম নির্ধারণ করবে এবং নগদে এক দামে বিক্রি করবে, তাতে কোন দোষ নেই। আর যখন তুমি নগদে এক দাম ও বাকীতে আরেক দাম নির্ধারণ করবে, সেটা হবে না। কেননা ওটা রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য বিক্রয় মাত্র’।[18] অর্থাৎ যদি বলা হয়, এই মালটি ১০০ টাকায় নগদ বিক্রি হবে। কিন্তু এক বছরের বাকীতে ১২০ টাকা দিতে হবে। তখন সেটা হারাম হবে অপেক্ষার বিনিময় দাবীর কারণে। আর এটাই হ’ল বায়‘এ মুআজ্জাল।

(২) আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন,صَفْقَتَانِ فِي صَفْقَةٍ رِبًا، إِلاَّ أَنْ يَقُولَ الرَّجُلُ : إِنْ كَانَ بِنَقْدٍ فَبِكَذَا، وَإِنْ كَانَ بِنَسِيئَةٍ فَبِكَذَا ‘এক ব্যবসায়ের মধ্যে দুই বিক্রি হ’ল সূদ। আর তা হ’ল, বিক্রেতা বলবে, নগদে এত টাকা এবং বাকীতে এত টাকা’।[19]

ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,إذَا قَالَ : هَذَا يُسَاوِي السَّاعَةَ كَذَا وَكَذَا وَأَنَا أَبِيعُكَهُ بِكَذَا أَكْثَرُ مِنْهُ إلَى أَجَلٍ، فَهَذَا رِبًا. كَمَا قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- ‘যখন কেউ বলে, এই মালটি এখন এত দরে বিক্রি হবে। তবে আমি তোমার নিকট এ মাল বাকীতে বিক্রি করব অধিক দামে, তাহ’লে এটি হবে ‘রিবা’ বা সূদ। যেমন ইবনু আববাস (রাঃ) বলেছেন। অতঃপর তিনি ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত উপরের উদ্ধৃতিটি পেশ করেন। এ ব্যাপারে কারু মধ্যে কোন মতভেদ আছে বলে তিনি উল্লেখ করেননি। থাকলে তিনি তাঁর নীতি অনুযায়ী বলতেন যে, এ বিষয়ে দু’টি মত রয়েছে(فيه قولان)।[20]

(৩) আবুল মিনহাল (রাঃ) বলেন,

عَنْ أَبِى الْمِنْهَالِ : أَنَّ زَيْدَ بْنَ أَرْقَمَ وَالْبَرَاءَ بْنَ عَازِبٍ كَانَا شَرِيكَيْنِ فَاشْتَرَيَا فِضَّةً بِنَقْدٍ وَنَسِيئَةٍ فَبَلَغَ ذَلِكَ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- فَأَمَرَهُمَا أَنَّ مَا كَانَ بِنَقْدٍ فَأَجِيزُوهُ وَمَا كَانَ بِنَسِيئَةٍ فَرُدُّوهُ-

যায়েদ বিন আরক্বাম ও বারা বিন আযেব (রাঃ) দু’জন একটি ব্যবসায়ে শরীক ছিলেন। তাঁরা রূপা কিনলেন নগদে ও বাকীতে। এ খবর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে পৌঁছলে তিনি তাদেরকে নির্দেশ দেন যে, যেটা নগদে, ওটা বহাল রাখো এবং যেটা বাকীতে ওটা বাতিল করো’।[21]

অত্র হাদীছে বুঝানো হয়েছে যে, একই মালে কেবল নগদে বেচা-কেনা জায়েয। কিছু অংশ নগদে ও কিছু অংশ বাকীতে নয়। অত্র হাদীছে এটাও বুঝা যায় যে, সমান টাকায় বা সমান সম্পদে শরীকানা ব্যবসা জায়েয।[22]

তাবেঈগণের ব্যাখ্যা :

(১) মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (৩৩-১১০ হি./৬৫৩-৭২৯ খৃ.) :

أَنَّهُ كَانَ يَكْرَهُ أَنْ يَقُولَ : أَبِيعُكَ بِعَشَرَةِ دَنَانِيرَ نَقْدًا، أَوْ بِخَمْسَةَ عَشَرَ إِلَى أَجَلٍ ‘তিনি একথা বলা অপসন্দ করতেন যে, আমি তোমার নিকট নগদে ১০ দীনারে বিক্রি করলাম অথবা বাকীতে ১৫ দীনারে বিক্রি করলাম’।[23] তিনি এটাকে অপসন্দ করতেন এজন্য যে, তিনি এটা করতে নিষেধ করতেন।

(২) তাঊস বিন কায়সান (মৃ. ১০৬ হি./৭২৪ খৃ.) :

إِذَا قَالَ هُوَ بِكَذَا وَكَذَا إِلَى كَذَا وَكَذَا، وَبِكَذَا وَكَذَا إِلَى كَذَا وَكَذَا، فَوَقَعَ الْبَيْعُ عَلَى هَذَا فَهُوَ بِأَقَلِّ الثَّمَنَيْنِ إِلَى أَبْعَدِ الْأَجَلَيْنِ ‘যদি কেউ বলে যে, মালটি এত এত দরে এত এত মেয়াদে, অতঃপর তার উপর নির্ধারিত হয়, তাহ’লে সেটা কম মূল্যেরটাতে নির্ধারিত হবে দীর্ঘতর মেয়াদ পর্যন্ত’।[24] উল্লেখ্য যে, তাঊস থেকে সাঈদ সূত্রে উদ্ধৃত উক্ত বর্ণনাটি যা মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক (হা/১৪৬২৬) ও মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ-তে এসেছে সংক্ষিপ্তভাবে এবং শেষে বলা হয়েছে فَبَاعَهُ عَلَى أَحَدِهِمَا قَبْلَ أَنْ يُفَارِقَهُ فَلاَ بَأْسَ بِهِ ‘অতঃপর (নগদে কম অথবা বাকীতে বেশী) যে কোন একটির উপর যদি মাল বিক্রয় হয় ক্রেতা-বিক্রেতা পৃথক হওয়ার পূর্বেই তাতে কোন দোষ নেই’। এ বর্ণনাটি ছহীহ নয়।[25]

(৩) সুফিয়ান ছওরী (৯৭-১৬১ হি./৭১৬-৭৭৭ খৃ.) : তিনি বলেন, ‘যখন তুমি বলবে যে, আমি এই মালটি তোমার কাছে নগদে এত দামে এবং বাকীতে এত দামে বিক্রি করব, এ অবস্থায় ক্রেতা চলে যায়। তখন যেকোন একটির উপর যদি ব্যবসা নির্ধারিত হয়, তবে সেটা হবে মাকরূহ। এটি হবে এক ব্যবসায়ের মধ্যে দুই বিক্রয়। যা মারদূদ বা প্রত্যাখ্যাত। এটি নিষিদ্ধ। যদি তোমার মাল যথাযথভাবে পেয়ে যাও, তাহ’লে তা নিয়ে নিবে। আর যদি বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়, তাহ’লে দু’টি মূল্যের মধ্যে অধিকতর কম মূল্যে এবং অধিকতর বেশী মেয়াদে মাল বিক্রয় করা তোমার জন্য করণীয় হবে’।[26]

(৪) ইমাম আওযাঈ (৮৮-১৫৭ হি./৭০৭-৭৭৪ খৃ.) : ইনিও সংক্ষেপে অনুরূপ বলেছেন এবং তার মধ্যে আরও আছে, ‘যদি তাকে বলা হয়, যদি উক্ত দু’টি শর্তের উপর ক্রেতা মাল নিয়ে চলে যায়? জওয়াবে তিনি বলেন,هِيَ بِأَقَلِّ الثَّمَنَيْنِ إِلَى أَبْعَدِ الْأَجَلَيْنِ- ‘তাহ’লে দু’টি মূল্যের মধ্যে অধিকতর কম মূল্যে এবং অধিকতর বেশী মেয়াদে মাল বিক্রয় হবে’।[27]

মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণের ব্যাখ্যা :

(১) ইমাম নাসাঈ (২১৫-৩০৩ হি./৮২৯-৯১৫ খৃ.) : ‘এক ব্যবসায়ে দুই বিক্রয়’ অনুচ্ছেদ-এর সাথে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, أَبِيعُكَ هَذِهِ السِّلْعَةَ بِمِائَةِ دِرْهَمٍ نَقْدًا وَبِمِائَتَىْ دِرْهَمٍ نَسِيئَةً ‘এটি হ’ল এই যে, বিক্রেতা বলবে, আমি এই মালটি তোমার নিকট বিক্রয় করব নগদে ১০০ দিরহামে এবং বাকীতে ২০০ দিরহামে’।[28] একই ব্যাখ্যা এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ)-এর হাদীছে, لاَ يَحِلُّ شَرْطَانِ فِى بَيْعٍ ‘এক বিক্রয়ে দুই শর্ত হালাল নয়’।[29] 

(২) ইবনু হিববান (২৭০-৩৫৪ হি./৮৮৪-৯৬৫ খৃ.) : তিনি স্বীয় ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৯৭৩-এ আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত ‘এক ব্যবসায়ে দুই বিক্রয় নিষিদ্ধ’ মর্মে বর্ণিত হাদীছের পূর্বের অনুচ্ছেদে বলেন,ذِكْرُ الزَّجْرِ عَنْ بَيْعِ الشَّيْءِ بِمِئَةِ دِينَارٍ نَسِيئَةً وَبِتِسْعِينَ دِينَارًا نَقْدًا ‘কোন বস্ত্ত বাকীতে ১০০ দীনার ও নগদে ৯০ দীনার বিক্রয়ের উপর ধমকির বর্ণনা’।

(৩) ইবনুল আছীর (৫৫৫-৬৩০ হি./১১৬০-১২৩৩ খৃ.) : তিনি স্বীয় غريب الحديث কিতাবে ‘এক ব্যবসায়ে দুই বিক্রয় নিষিদ্ধ’ মর্মে উপরে বর্ণিত দু’টি হাদীছের ব্যাখ্যায় একই কথা বলেছেন, যা উপরে বলা হয়েছে।[30]

(৪) ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪ হি./৭৬৭-৮২০ খৃ.) : ‘এক ব্যবসায়ে দুই বিক্রয় নিষিদ্ধ’ হাদীছের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, بِأَنْ يَقُولَ: بِعْتُكَ بِأَلْفٍ نَقْدًا أَوْ أَلْفَيْنِ إلَى سَنَةٍ، فَخُذْ أَيَّهُمَا شِئْت أَنْتَ وَشِئْت أَنَا- ‘এটি এই যে, বিক্রেতা বলবে, আমি তোমাকে মালটি বিক্রয় করব নগদে ১০০০ টাকায় অথবা এক বছরের বাকীতে ২০০০ টাকায়। এখন তুমি গ্রহণ কর যেটা তুমি চাও ও যেটি আমি চাই’।[31]

(৫) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হি./৭৮০-৮৫৫ খৃ.) : ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত صَفْقَتَيْنِ فِي صَفْقَةٍ ‘এক ব্যবসায়ে দুই বিক্রয় নিষিদ্ধ’ মর্মের হাদীছটি তিনিই স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন (আহমাদ হা/৩৭৮৩) এবং তিনি এর সঙ্গে একমত।[32] উক্ত বিষয়ে পুত্র আব্দুল্লাহ বিন আহমাদের প্রশ্নের উত্তরে ইমাম আহমাদ বলেন, هَذَا بَيْعٌ فَاسِدٌ ‘এটি বাতিল ব্যবসা’ (আল-ক্বাওলুল ফাছল ৩০ পৃ.)

(৬) ক্বাযী শুরাইহ (মৃ. ৭৮ হি.) এর ব্যাখ্যায় বলেন, এর অর্থ হ’ল দুই মূল্যের কমটিতে নগদে এবং দুই মেয়াদের বেশীটিতে অথবা সূদে (أقل الثمنين وأبعد الأجلين او الربا) নিষিদ্ধ।[33]

এভাবে ইবনু আববাস, ইবনু মাসঊদ, ইবনু সীরীন, ক্বাযী শুরাইহ, ইমাম শাফেঈ, আহমাদ, ইবনু হাযম, ইবনু তায়মিয়াহ প্রমুখ সকল বিদ্বান কম মূল্যে নগদে ক্রয়-বিক্রয় জায়েয এবং দূরবর্তী মেয়াদে বেশীতে ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ বলেছেন (যেটি বর্তমানে কিস্তির ব্যবসায়ে চলছে)। যা হাদীছের ও প্রকাশ্য ক্বিয়াসের অনুকূলে। যারা এর বিপরীত বলেন এবং বিক্রয় মূল্যে অজ্ঞতার অজুহাত দেন, তাদের নিকটে স্পষ্ট কোন দলীল নেই (আল-ক্বাওলুল ফাছল ৩১ পৃ.)।  

সবচেয়ে বড় কথা, চার ইমামের প্রত্যেকে বলেছেন, إِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهبُنَا ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাওয়া যাবে, সেটাই আমাদের মাযহাব’।[34] ইমাম শাফেঈ বলেছেন, আমার কোন ফৎওয়া ছহীহ হাদীছের বিরোধী হ’লে আমি তা থেকে প্রত্যাবর্তন করছি আমার জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে’ (ছালেহ ফুল্লানী, ‘ঈকাযু হিমাম’ ১০৪ পৃ.)

বিষ্ময়ের ব্যাপার এই যে, খাত্ত্বাবী (মৃ. ৩৮৮ হি.) বলেছেন, لاَ أَعْلَمُ أَحَدًا قَالَ بِظَاهِرِ الْحَدِيثِ وَصَحَّحَ الْبَيْعَ بِأَوْكَسِ الثَّمَنَيْنِ إلاَّ مَا حُكِيَ عَنْ الْأَوْزَاعِيِّ وَهُوَ مَذْهَبٌ فَاسِدٌ ‘এমন কাউকে আমি জানি না, যিনি হাদীছের প্রকাশ্য অর্থ অনুযায়ী বলেছেন এবং অধিকতর কম মূল্যে বিক্রয়কে সঠিক বলেছেন আওযাঈ ব্যতীত। আর যেটি হ’ল বাতিল মাযহাব’। এর জবাবে ইমাম শাওকানী বলেন,وَلاَ يَخْفَى أَنَّ مَا قَالَهُ هُوَ ظَاهِرُ الْحَدِيثِ؛ لِأَنَّ الْحُكْمَ لَهُ بِالْأَوْكَسِ يَسْتَلْزِمُ صِحَّةَ الْبَيْعِ بِهِ ‘এটা গোপন নয় যে, আওযাঈ যেটা বলেছেন সেটাই হাদীছের প্রকাশ্য অর্থ এবং অধিকতর কম মূল্যে নির্ধারণ করাই সঠিক’।[35] অতএব জমহূর বিদ্বানগণ উক্ত হাদীছের বিরোধী, এ দাবী বাতিল।

এক্ষণে যদি দেরীতে মাল বিক্রেতা খরিদ্দারকে সুবিধা দিতেই চান, তাহ’লে সময়ের বিনিময়ে অধিক লাভ না নিয়ে তাকে কর্যে হাসানা দিন। বিনিময়ে আপনি আখেরাতে বহু গুণ বেশী পাবেন। আর এটাই হ’ল ইসলামী রূহ। সূদী অর্থনীতিতে ইসলামী রূহকে হত্যা করা হয় ও বস্ত্তবাদী চিন্তাধারাকে উদ্দীপিত করা হয়। অতএব মুসলিম ভাই-বোনদের উচিত সূদী ঋণদান পদ্ধতির বিরুদ্ধে ইসলামী ঋণদান পদ্ধতি চালু করা। ইনশাআল্লাহ সমাজে আমূল পরিবর্তন আসবে। মানুষের অভাব ও দারিদ্র্য ক্রমে অন্তর্হিত হবে। গাছ তলা ও পাঁচ তলার বৈষম্য শেষ হয়ে যাবে। এভাবে সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য ও ন্যায়বিচার কায়েম হবে ইনশাআল্লাহ।

কর্যে হাসানাহ (القرض الحسن) :

কর্যে হাসানাহ অর্থ উত্তম ঋণ। এতে মানুষ দুনিয়াতে উপকৃত হয় এবং পরস্পরে ভালোবাসা বৃদ্ধি পায় ও সামাজিক ঐক্য দৃঢ় হয়। এর পরকালীন পুরস্কার সীমাহীন। কেননা আল্লাহ বলেন, مَنْ ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ أَضْعَافًا كَثِيرَةً وَاللهُ يَقْبِضُ وَيَبْسُطُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ ‘কোন সে ব্যক্তি যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিবে, অতঃপর তিনি তার বিনিময়ে তাকে বহুগুণ বেশী দান করবেন? বস্ত্ততঃ আল্লাহ্ই রূযী সংকুচিত করেন ও প্রশস্ত করেন। আর তাঁরই দিকে তোমরা ফিরে যাবে’ (বাক্বারাহ ২/২৪৫)

এর বিরুদ্ধে আপত্তি হ’ল এই যে, ‘ঋণের টাকা ফেরৎ আসে না’। এটা তো সূদী ঋণের ব্যাপারেও প্রযোজ্য। ২০১৬ সালে কৃষি ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে বর্তমানে ৯ লাখ মামলা রয়েছে। অন্যান্য ব্যাংক সমূহ ঋণখেলাপীদের ভারে জর্জরিত। অবশেষে শত শত কোটি টাকার সূদী ঋণ মওকূফ করে দিতে তারা বাধ্য হচ্ছে। অতএব ঋণের টাকা ফেরৎ পাওয়ার জন্য প্রশাসনিক, সামাজিক, নৈতিক ও সর্বোপরি আখেরাতভীতির চাপ প্রয়োগ করতে হবে। তাতে কর্যে হাসানাহ ফেরৎ দিতে মানুষ উৎসাহিত হবে। কিন্তু সূদের টাকা মেরে দিতেই গ্রাহক বেশী প্রলুব্ধ হবে। কেননা তিনি জানেন যে, এটি যুলুম। অতএব সূদের ঋণ ফেরৎ না দিলেও আখেরাতে কিছু যায় আসে না। তাছাড়া আজকাল সবাই জেনে গেছে যে, বড় বড় ঋণখেলাপীরা শাস্তির ঊর্ধ্বে থাকেন। অতএব চুনোপুঁটিরা সূদের টাকা মেরে দিলে কি যায় আসে? পক্ষান্তরে কর্যে হাসানার ঋণ ফেরৎ না দিলে সে মর্মপীড়ায় ভুগবে এবং আখেরাতে শাস্তির ভয়ে সদা কম্পবান থাকবে। এক পর্যায়ে সে তওবা করে ঋণ ফেরৎ দিবে অথবা তার ওয়ারিছরা দিবে ইনশাআল্লাহ।

সুতরাং মুসলমান পরিচালকগণ যদি কর্যে হাসানাহর মাধ্যমে ব্যাংকের ঋণদান নীতি পরিচালনা করতেন এবং সরকার তাতে পৃষ্ঠপোষকতা দিত, তাহ’লে দেশে দারিদ্র্য হ্রাস পেত। ধনী-গরীব সবার হাতে পয়সা থাকত। কর্যে হাসানাহ প্রদানের মাধ্যমে উপায়হীন মানুষের কিছু অবলম্বনের ব্যবস্থা করা যেত। গ্রাম্য সূদখোর ও এনজিও শোষণ থেকে মানুষ মুক্তি পেত। সেই সাথে আইএমএফ, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক সহ আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের অমানবিক শোষণ থেকে দেশ বেঁচে যেত।

কিস্তিতে বিক্রয়ের বিধান (حكم بيع التقسيط) :

এ বিষয়ে বিদ্বানগণ তিন দলে বিভক্ত হয়েছেন। ১. এটি বাতিল। ইবনু হযম এটি বলেন। ২. এটি জায়েয নয়। তবে কিস্তির উপর উভয়ে পৃথক হ’লে জায়েয। ৩. এটি জায়েয নয়। তবে কম মূল্যটির উপর সিদ্ধান্ত হ’লে এবং বাকীতে অধিক মূল্যের বিষয়টি ছেড়ে দিলে সেটি জায়েয।

প্রথম দলের দলীল হ’ল, এক ব্যবসায়ে দুই বিক্রি নিষিদ্ধের হাদীছ সমূহ। দ্বিতীয় দলের যুক্তি হ’ল, দু’টি মূল্যের মধ্যে কোন একটির ব্যাপারে অজ্ঞতা। যেমনটি খাত্ত্বাবী বলেন, যখন মূল্যে অজ্ঞতা থাকবে, তখন ক্রয়-বিক্রয় বাতিল হবে। কিন্তু যদি চুক্তির সময় কোন একটির উপর সিদ্ধান্ত হয়, তাহ’লে জায়েয’।

জবাব এই যে, অজ্ঞতার এই যুক্তি বাতিল। কেননা এটি স্রেফ ধারণা মাত্র। যা আবু হুরায়রা (তিরমিযী হা/১২৩১) ও ইবনু মাসঊদ (ইরওয়া হা/১৩০৭) বর্ণিত স্পষ্ট ছহীহ হাদীছের বিরোধী।

তৃতীয় দলের দলীল হ’ল দরসে বর্ণিত হাদীছ এবং ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর হাদীছ। দু’টি হাদীছই এ ব্যাপারে এক যে, এক বিক্রয়ের মধ্যে দুই বিক্রি নিষিদ্ধ এবং দূরবর্তী মেয়াদে অধিক মূল্য গ্রহণ করা স্পষ্টভাবে সূদ। তবে যদি কম মূল্যে নগদটা নেয়, তাহ’লে সেটি জায়েয। যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, ‘এক বিক্রয়ে দুই বিক্রি নিষিদ্ধ’ এর কারণ হিসাবে খাত্ত্বাবী মূল্যের অজ্ঞতাকে (الجهل بالثمن) দায়ী করেছেন। অথচ এটি কেবল ধারণা মাত্র। ইমাম আওযাঈ এর বিরোধিতা করে হাদীছের প্রকাশ্য অর্থের উপর আমল করেছেন এবং কম মূল্যটির উপর ব্যবসা সিদ্ধ বলে ফৎওয়া দিয়েছেন। ইমাম শাওকানী খাত্ত্বাবীর ‘অজ্ঞতা’র কারণটি অস্বীকার করেছেন এবং হাদীছের প্রকাশ্য অর্থের উপর আমল করায় আওযাঈকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি খাত্ত্বাবীর অজ্ঞতার কারণটিকে স্বীকার করে নিয়েছেন এবং নগদ ও বাকী মূল্যের  যেকোন একটির উপরে ক্রয়-বিক্রয় সিদ্ধ বলেছেন (নায়ল ৬/২৮৮)। আলবানী এতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন (ছহীহাহ ৫/৪২৫)

জানা আবশ্যক যে, হাদীছের প্রকাশ্য অর্থের উপরে কেবল তাঊস, ছওরী ও আওযাঈ আমল করেননি। বরং হাফেয ইবনু হিববানও একই কথা বলেছেন। যেমন তিনি শিরোনাম রচনা করেছেন,ذِكْرُ الْبَيَانِ بِأَنَّ الْمُشْتَرِيَ إِذَا اشْتَرَى بَيْعَتَيْنِ فِي بَيْعَةٍ عَلَى مَا وَصَفْنَا وَأَرَادَ مُجَانَبَةَ الرِّبَا كَانَ لَهُ أَوْكَسُهُمَا ‘এ কথার বর্ণনা যে, যখন ক্রেতা এক ব্যবসায়ে দুই বিক্রির মাল খরীদ করবে এবং সূদ থেকে বিরত থাকার ইচ্ছা করবে, তখন তার জন্য দু’টির মধ্যে কম মূল্যটি গ্রহণীয় হবে’। অতঃপর তিনি হাদীছ এনেছেন,مَنْ بَاعَ بَيْعَتَيْنِ فِي بَيْعَةٍ فَلَهُ أَوْكَسُهُمَا أَوِ الرِّبَا ‘যে ব্যক্তি একটি ব্যবসায়ে দু’টি বিক্রয় করে সে কম মূল্যেরটা নিবে অথবা সূদ নিবে’ (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৯৭৪, সনদ হাসান)

মোটকথা ‘এক ব্যবসায়ে দুই বিক্রি নিষিদ্ধ’ হাদীছের মধ্যে অজ্ঞতার যুক্তি, যেটি দ্বিতীয় দলের বক্তব্য, সেটি সবচাইতে দুর্বল কথা। যেখানে কোন দলীল নেই, কেবল ধারণা ব্যতীত। বরং এতে হাদীছের প্রকাশ্য বিরোধিতা রয়েছে। এরই কাছাকাছি হ’ল প্রথম দলের বক্তব্য। যেখানে ইবনু হযম আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত ‘এক ব্যবসায়ে দুই বিক্রি নিষিদ্ধ’ (তিরমিযী হা/১২৩১) হাদীছটির মাধ্যমে আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত ‘যে ব্যক্তি একটি ব্যবসায়ে দু’টি বিক্রয় করে সে কম মূল্যেরটা নিবে অথবা সূদ নিবে’ (আবুদাঊদ হা/৩৪৬১) হাদীছটি ‘মানসূখ’ বলেছেন। কিন্তু এ দাবী প্রত্যাখ্যাত। কেননা মানসূখ কেবল তখনই হয়ে থাকে, যখন দু’টি হাদীছের মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব না হয়। অথচ এখানে সেটি খুবই সহজ। কেননা শেষোক্ত হাদীছে কম মূল্যটির উপর ব্যবসা বৈধ এবং বেশী মূল্যটিকে ‘রিবা’ বা সূদ বলা হয়েছে। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটিও উপরোক্ত হাদীছের সহায়ক। কেননা সেখানে বর্ধিত মূল্যটি নিষিদ্ধের কারণ হিসাবে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ‘রিবা’ (ইরওয়া হা/১৩০৭)। বাকী রইল, তৃতীয় দলের বক্তব্য। যেখানে ‘এক বিক্রির মধ্যে দুই বিক্রয় নিষিদ্ধে’র কারণ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে সূদ। যেখানে বিদ্বানগণ নগদ কম মূল্যে খরীদ করা জায়েয বলেছেন এবং দূরবর্তী মেয়াদে অধিক মূল্যে খরীদ করা নিষিদ্ধ বলেছেন। তাঊস, ছওরী, আওযাঈ, ইবনু হিববান প্রমুখ বিদ্বানগণ যা সমর্থন করেছেন।

উপরোক্ত আলোচনা শেষে আলবানী (রহঃ) বলেন, ... যদি কোন ব্যক্তি ঋণে বা কিস্তিতে নগদ মূল্যের ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয় করে, এটিই তার জন্য অধিক লাভজনক হবে। এমনকি বস্ত্তগত দিক দিয়েও। কেননা মানুষ এটিই গ্রহণ করবে এবং ঐ ব্যক্তির সাথেই ক্রয়-বিক্রয় করবে। এতে তার রূযীতে বরকত হবে। আর এটিই হ’ল আল্লাহর বাণীর বাস্তবতা। যেখানে তিনি বলেছেন,وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا- وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِبُ ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য উপায় বের করে দেন’ ‘এবং তাকে এমনসব উৎস থেকে রূযী দেন, যা সে ধারণা করেনি’ (তালাক ৬৫/২-৩)

মুরাবাহা (المرابحة) :

رَبِحَ رِبْحًا ورَبَاحًا অর্থ লাভ করা। যেমন আল্লাহ মুনাফিকদের সম্পর্কে বলেন, فَمَا رَبِحَتْ تِجَارَتُهُمْ وَمَا كَانُوا مُهْتَدِينَ ‘কিন্তু তাদের এ ব্যবসা লাভজনক হয়নি এবং তারা সুপথ প্রাপ্ত হয়নি’ (বাক্বারাহ ২/১৬)। সেখান থেকে رَابَحَ مُرَابَحَةً অর্থ লাভ দেওয়া। رَابَحَهُ عَلَى سِلْعَتِهِ অর্থ أَعْطَاهُ رِبْحًا ‘সে তাকে লাভ দিয়েছে’ (আল-মুনজিদ)। অর্থাৎ মাল বিক্রয়ের বিনিময়ে মালিককে লাভ দেওয়া। মূলতঃ এটা হ’ল ব্যবসা। অথচ যখন ঋণের বিনিময়ে লাভ নেওয়া হবে, তখন সেটা হবে সূদ। যাতে ব্যবসায়ের লাভ-ক্ষতির কোন ঝুঁকি ঋণদাতা নেয় না। সবটাই ঋণগ্রহীতা বহন করে, যা স্পষ্ট যুলুম। এটাই সূদ। অতঃপর এটাকে যখন আল্লাহ হারাম করেন, তখন আরবের সূদী কারবারীরা বলে উঠল إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا ‘ব্যবসা তো সূদেরই মত’। জবাবে নাযিল হ’ল, أَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সূদকে হারাম করেছেন’ (বাক্বারাহ ২/২৭৫)। এ যুগে আমরাও সূদী কারবারীদের সাথে সূর মিলিয়ে সূদকেই ‘মুরাবাহা’ নাম দিয়ে ব্যবসা বলে হালাল করছি। যা পরিষ্কার ধোঁকা ব্যতীত কিছুই নয়।

যেমন একজন ক্রেতা টাকা ছাড়াই ব্যাংকে হাযির হয়ে কোন একটি বস্ত্ত ক্রয়ের জন্য টাকা চাইল। ব্যাংক তার সাথে চুক্তি করল যে, তারা তাকে মালটি কিনে দিবে। বিনিময়ে তাদেরকে উদাহরণ স্বরূপ বছরে শতকরা ১০ টাকা লাভ দিবে। যদি মেয়াদ বৃদ্ধি হয়, তাহ’লে ঐ হার অনুযায়ী প্রতি বছর লাভের অংক বৃদ্ধি পাবে। এভাবে ব্যাংক সমস্ত অর্থ যোগান দেয় এবং বস্ত্তটি কিনে দেয়। সেখানে নগদে ও কিস্তিতে মূল্য পরিশোধে লাভের অংকের পার্থক্য নির্দিষ্ট করা থাকে। যেটা স্পষ্ট সূদ। এভাবে ব্যাংক উক্ত সূদী লেনদেনের মাধ্যমে পরিণত হয়।

এখানে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হ’ল, নগদে কম দাম ও বাকীতে বেশীদামের সূদী লেনদেনকে ‘মুরাবাহা’ নামে ইসলামী লেনদেন  বলে চালিয়ে দেওয়া। নাম ও আচরণের বাহ্যিক পার্থক্য ছাড়া বিষয়বস্ত্ত ও ফলাফল একই। সূদী লেনদেনের সাথে এর কোন পার্থক্য নেই। এভাবে হারাম সূদকে হালাল ব্যবসার সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। যা উম্মতের অধঃপতনের অন্যতম কারণ। এর ফলে হালাল ব্যবসার ক্ষেত্র সমূহ সংকুচিত হচ্ছে এবং সূদী ব্যবসার ক্ষেত্র সমূহ প্রসারিত হচ্ছে। আর ইহূদী-খ্রিষ্টানদের অনুকরণে মুসলমানগণ এইসব ব্যাংক পরিচালনা করছেন। এইসব ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতার উচ্চ হার দেশের সকল বেতন হারের চেয়ে বহুগুণ বেশী। এছাড়াও রয়েছে গাড়ী-বাড়ী করার সহজলভ্য ঋণ সুবিধা। সবই হচ্ছে পুঁজিপতি ও শিল্পপতিদের স্বার্থে। যারা ব্যাংকে রক্ষিত জনগণের টাকায় ব্যবসা করেন। অতঃপর  ঋণখেলাপী হয়ে অবশেষে মাফ পেয়ে যান।  সরকারী প্রায় সকল ব্যাংকেরই এই দুর্দশা। বেসরকারী ব্যাংকগুলিও এথেকে খুব ভাল অবস্থায় নেই।

গত ৬ই ফেব্রুয়ারী’১৭ জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে অর্থমন্ত্রী এম.এ. মুহীত বলেন, বর্তমানে দেশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহে ঋণখেলাপী ব্যক্তি বা কোম্পানীর সংখ্যা ২ লাখ ১৩ হাযার ৫৩২। এদের কাছে মোট খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৬৩ হাযার ৪৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকের খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৫৮ হাযার ৮৭৭ কোটি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহে ৪ হাযার ৫৫ কোটি টাকা।[36] সেই সাথে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার (৯ শত কোটি টাকা) রিজার্ভ চুরির অবিশ্বাস্য ঘটনা। সবই জনগণের টাকা। যার হিসাব রাখা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্যই উচ্চ বেতনের কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়ে থাকে। অথচ সর্ষের মধ্যেই ভূত। যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে পূঁজিপতি ও শিল্পপতিদের স্বার্থ রক্ষাকারী সরকারী প্রশাসন।

এভাবে নানারূপ হীলা-বাহানার মাধ্যমে হারামকে হালাল করা হচ্ছে। অথচ আল্লাহর দৃষ্টি থেকে কিছুই লুকানো যাবে না। বনু ইস্রাইলরা যে কৌশলে আল্লাহর নিষেধকে বৈধ করার চেষ্টা করেছিল (বাক্বারাহ ২/৬৫), তার চাইতে বহু বহু গুণ কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে সূদী লেনদেনকে হালাল করার মাধ্যমে। কেননা মাছ ধরা ছিল মূলতঃ ‘মুবাহ’ কাজ। কিন্তু সূদী ব্যবসা হ’ল হারাম কাজ। বনু ইস্রাঈলরা কেবল অপকৌশল করায় অপরাধী ছিল। কিন্তু আমরা সূদের হারামকে হালাল করার অন্যায় কৌশলের অপরাধী। অতএব ইহূদীদের চাইতে আমাদের কৌশল অধিকতর নিন্দনীয়।

ব্যবসায়ে সূদকে হালাল করার কৌশলের বিরুদ্ধে ইমাম ইবনু তায়মিয়াহর যুগান্তকারী ফৎওয়া :

তিনি বলেন, আমার কাছে খবর পৌঁছেছে যে, কিছু ব্যবসায়ী কাপড় প্রস্ত্তত করে রেখেছে সূদকে হালাল করার জন্য। যখন কারু কাছে কেউ ১০০০ টাকা ঋণ নিতে আসে ১২০০ টাকার বিনিময়ে, তখন সে চলে যায় ঐ হালালকারী কাপড় ব্যবসায়ীর কাছে। অতঃপর ঋণদাতা তার নিকট থেকে কাপড় কিনে এবং সেটি ঋণগ্রহীতাকে দিয়ে দেয়। অতঃপর গ্রহীতা সেটি কাপড় ব্যবসায়ীকে ফেরৎ দিয়ে আসে। ঐ ব্যবসায়ী ঐ কাপড় সম্পর্কে আগে থেকেই অবহিত। কেননা সে জানে যে, এর মাধ্যমে সে সূদকে হালাল করছে। অবশ্যই এটি কোন ব্যবসা নয়’। হিল্লা বিবাহের নিন্দা করার পর ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ সূদের হিল্লার উক্ত ফৎওয়া প্রদান করেন।[37]   

(১) মুরাবাহা সম্পর্কে শায়খ আলবানী (রহঃ)-এর ফৎওয়া :

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি হিল্লা বিবাহের মত (نكاح التحليل)। কেননা এর মধ্যে ব্যবসায়ের সব শর্ত মওজূদ আছে। কিন্তু এর পিছনে উদ্দেশ্য হ’ল, সূদকে হালাল করা (هو استحلال الربا)। যেমন, যদি আমরা ব্যাংকের কোন ব্যক্তিকে কোন ধনী ব্যক্তির কাছে ছেড়ে দিই, তখন ধনী ব্যক্তিটি এসে তাকে বলবে, আমি এক টন লোহা কিনতে চাই। মূল্য ধরে নিন এক হাযার টাকা। আমি চাই আপনি আমাকে এক হাযার টাকা কর্য দিন এক মাসের জন্য। আপনাকে আমি এক হাযারের বিনিময়ে ১১০০ টাকা দিব। সঙ্গে সঙ্গে উনি বলবেন, না। এটি সূদ। অতিরিক্ত ১০০ টাকা সূদ যা হারাম এবং যা কখনোই সিদ্ধ নয়। প্রশ্নকারী বলল, তাহ’লে এখন উপায় কি? ব্যাংকের ব্যক্তিটি বললেন, উপায় আছে। আপনি যান দোকান থেকে এক টন লোহা নিন। আর আমাকে ১০০০-এর বিপরীতে ১১০০ টাকা দিন। এই দু’টিতে পার্থক্য কি? যেমন পার্থক্য হিল্লা বিবাহ ও হালাল বিবাহের মধ্যে(مثل الفرق بين نكاح الحلال ونكاح التحليل)। এতে আবার লাভের পরিমাণ দু’মাসে বাড়বে। বছরে আরও বাড়বে। এভাবে যত মেয়াদ বাড়বে, তত লাভ বৃদ্ধি পাবে। এটা কি স্পষ্ট সূদী কারবার নয়? যদি কেউ ঐ ব্যাংকে গিয়ে বলেন, আমাকে ১০০০ টাকা করযে হাসানাহ দিন, তারা আপনাকে তা দিবে না। তারা বলবেন, যাও একটন লোহা কেন। অতঃপর আমাকে হাযারে এগারোশত টাকা দাও। এটাকে বলা হচ্ছে ‘মুরাবাহা’। এ সময় যদি তাকে বলা হয়, আপনি লাভ করতে চাইলে ব্যবসায়ে নামুন? তখন তারা রাযী হবে না (কারণ তাতে লোকসানের ঝুঁকি আছে)।[38]    

(২) মুরাবাহা সম্পর্কে শায়খ উছায়মীন (রহঃ)-এর ফৎওয়া :

জনৈক ব্যক্তি ব্যাংকের কাছে ঋণের আবেদন করল একটা বাড়ী কেনার জন্য। ব্যাংক বলল, এই এক লাখ দীনার নিন ও বাড়ী ক্রয় করুন। এর বিনিময়ে আপনি এক বছর পরে আমাদের এক লাখ বিশ হাযার দীনার দিবেন। এখানে ব্যাংকের কোন উদ্দেশ্য নেই, কেবল অধিক মুনাফা করা ব্যতীত। সে ব্যবসায়ী নয়, বরং ব্যবসায়ী হওয়ার বাহানাকারী মাত্র। এরূপ উদাহরণ দিয়ে তিনি প্রশ্ন করেন, সূদ খাওয়ার এই বাহানা এবং ইহূদীদের হারামকে হালাল করার বাহানার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? যাদের উপর আল্লাহ গরু ও ছাগলের চর্বিকে হারাম করেছিলেন (আন‘আম ৬/১৪৬)। তখন তারা চর্বি গলিয়ে বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করে।[39] অতঃপর তিনি বলেন, এতে আমি কোনরূপ সন্দেহ পোষণ করি না যে, এটি হারাম। বরং এটি ইহূদীদের হারামকে হালাল করার বাহানার চাইতে আরও বড় বাহানা।... এক্ষণে ব্যাংকের নিকট যদি বাড়ী বা গাড়ী থাকে এবং সেটি ঋণ গ্রহিতার নিকট নির্দিষ্ট লাভে বিক্রি করে, যেখানে উদ্দেশ্য থাকে কেবল অধিক মুনাফা। সেটাও হবে কেবল টাকার ব্যবসা (مسئلة التورق)। এখানেও মতভেদ রয়েছে, যে ব্যক্তি উক্ত বাড়ী বা গাড়াী খরীদ করবে, সে ব্যক্তি পূর্ব থেকে তার প্রকৃত মূল্য জানে কি-না। দ্বিতীয়তঃ যদি ঐ ব্যক্তি দর কষাকষি করে, তাহ’লে ব্যাংক তার আবেদনের কাগজে কালো দাগ দিবে কি-না (কারণ ব্যাংক কখনোই লোকসানের ঝুঁকি নিবে না)।

আল্লাহর কসম! হে আমার ভাই আমি তোমাকে বলছি, আমরা ইসলামী উম্মাহ। আমাদের নবী বলেছেন, ‘তোমরা ঐরূপ পাপ করোনা যেরূপ পাপ করেছিল ইহূদীরা। তারা ন্যূনতম কৌশলের মাধ্যমে আল্লাহকৃত হারামকে হালাল করত’। আল্লাহর কসম! অতঃপর আল্লাহর কসম! যদি এর মধ্যে হালালের কিছু থাকত, তাহ’লে আমি অবশ্যই এটি হালালের ফৎওয়া দিতাম। কিন্তু কিভাবে আমি সম্মুখীন হব জগতসমূহের প্রতিপালকের, যিনি চোখের চোরা চাহনির এবং হৃদয়ের লুকানো বস্ত্ত সমূহের খবর রাখেন। ছেড়ে দাও ব্যাংকগুলিকে তারা মাটি, বাড়ী বা গাড়ী যা খুশী খরীদ করুক এবং বিক্রয়ের জন্য পেশ করুক। অতঃপর আমি তা নগদ খরীদ করতে আসি। সে বলুক নগদ মূল্য ১০০ টাকা। দ্বিতীয়জন আসুক এবং বলুক আমি এটা কিস্তিতে ১২০ টাকায় খরীদ করতে চাই। এতে কেউ নিষেধ করবে না। যা জায়েয ইনশাআল্লাহ। কিন্তু বর্তমানে যেটা হচ্ছে, স্রেফ খেলা ছাড়া কিছু নয়। অতএব ভেবে দেখ হে আমার ভাইয়েরা! রূহ তোমারকণ্ঠনালী অতিক্রম করা পর্যন্ত। কি হবে এর ফলাফল?[40]

এখানে শায়খ উছায়মীনের কিস্তিতে বেশী দামে বিক্রয়ের ফৎওয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা হাদীছে কিস্তিতে বেশী দামে বিক্রয়ের পক্ষে কিছুই নেই।

(৩) মুরাবাহা সম্পর্কে আব্দুর রহমান আব্দুল খালেক (কুয়েত)-এর ফৎওয়া :

بيع الأجل তথা অধিক মেয়াদে অধিক মূল্য গ্রহণের বিষয়ে প্রাচীন যুগ থেকে বিদ্বানদের মধ্যে মতভেদের কথা শুনে আসছি। এ বিষয়ে নিষেধের হাদীছ থাকার কারণে আমার মনে সব সময় দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল।  কিন্তু  যখন  আমার বিভিন্ন ওস্তাদকে এটি হালাল ফৎওয়া দিতে শুনেছি, তখন তাঁদের বিরোধিতা করাটাকে আমি অত্যন্ত বড় বিষয় বলে মনে করেছি। এভাবেই আমি গত বিশ বছর যাবৎ কাটিয়েছি। যতবার আমার নিকট এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে, ততবারই আমি এড়িয়ে গেছি। আলহামদুলিল্লাহ এখন আমি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, এটি জায়েয নয়। অতএব এ বিষয়ে মুসলিম ভাইদের সতর্ক করা আমার উপর অপরিহার্য দায়িত্ব মনে করছি। যাতে তারা ব্যবসার নামে সূদে পতিত না হয়’।

তাঁর সুলিখিত القول الفصل فى بيع الأجل বই-এর ভূমিকায় তিনি উপরোক্ত বক্তব্য পেশ করেন। অতঃপর বইটির উপসংহারে বলেন, এ বইটির মাধ্যমে আমরা আমাদের ভাইদের সতর্ক করছি, তারা যেন এক বিক্রয়ে নগদ ও বাকীতে দুই মূল্য নির্ধারণ না করেন। পুণ্যবান মুসলিম ব্যবসায়ী তিনি, যিনি একদরে ব্যবসা করেন। যদি বিক্রেতা মেয়াদের বিনিময়ে অধিক লাভের সূদ গ্রহণ না করেন, তাহ’লে সেটাই হবে তার জন্য সর্বোত্তম ভ্রাতৃত্ববোধ এবং তাতে তার ব্যবসায় বরকত বৃদ্ধি পাবে। যেটা আমরা চাক্ষুষ দেখেছি। আল্লাহ এসব ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়ে বরকত দান করেছেন এবং তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করে দিয়েছেন’।[41]  

পরিশেষে নিম্নোক্ত সাবধানবাণীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে শেষ করব।-

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মানুষের উপর এমন একটা যামানা আসছে, যখন তারা পরোয়া করবে না, কি তারা গ্রহণ করছে? সেটা কি হালাল, না হারাম?[42] নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘হালাল স্পষ্ট ও হারাম স্পষ্ট। উভয়ের মধ্যে রয়েছে অস্পষ্ট বিষয় সমূহ। যা বহু মানুষ জানে না। অতঃপর যে ব্যক্তি তা থেকে বেঁচে থাকে, সে তার দ্বীন ও সম্মানকে বাঁচালো। আর যে ব্যক্তি অস্পষ্টতার মধ্যে পতিত হ’ল সে হারামে পতিত হ’ল’।[43] অতএব ‘তুমি সন্দেহযুক্ত বিষয়কে ছেড়ে দাও ও নিঃসন্দেহ বিষয়ের দিকে ধাবিত হও’।[44] বস্ত্ততঃ প্রকাশ্য সূদী কারবারের চাইতে প্রতারণামূলক সূদী কারবার সবচাইতে ক্ষতিকর।

আমাদের প্রস্তাব :

ব্যাংকগুলিকে সত্যিকার অর্থে মুশারাকাহ ও মুযারাবাহ-এর ইসলামী পদ্ধতিতে পরিচালনা করুন এবং এর পক্ষে সরকারী ও সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করুন। কারণ বহু অলস টাকা পড়ে আছে, যার কোন সদ্ব্যবহার নেই। আবার অনেকে ব্যবসা জানলেও তাদের মূলধন নেই। এক্ষেত্রে ব্যাংক যদি আমানতদারগণের টাকায় লাভ-লোকসান চুক্তিতে সঠিক অর্থে ব্যবসা করে, যাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘মুযারাবাহ’ বলা হয়, তাহ’লে দেশের অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, অবসরভাতা ও পেনশনের সমস্ত টাকা ব্যাংকেই জমা হবে। এছাড়াও যেকোন হালাল উপার্জন পিয়াসী ব্যক্তি তাদের টাকা ব্যাংকে রাখবে। দেশের ধনিক শ্রেণী ও সরকার পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে এবং দেশের সত্যিকার অর্থনৈতিক কল্যাণের স্বার্থে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিবেন বলে আমরা আশা করি।


[1]. তিরমিযী হা/১২৩১; মুওয়াত্ত্বা হা/২৪৪৪; নাসাঈ হা/৪৬৩২; আহমাদ হা/৯৫৮২; মিশকাত হা/২৮৬৮, হাদীছ ছহীহ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়-১১ ‘নিষিদ্ধ ব্যবসা’ অনুচ্ছেদ-৫।

[2]. আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম ওরফে ইমাম ইবনু কুতায়বা বাগদাদী দীনাওয়ারী (২১৩-২৭৬ হি./৮২৮-৮৮৯ খৃ.), গারীবুল হাদীছ (বাগদাদ : আনী প্রেস, ১ম সংস্করণ ১৩৯৭ হি./১৯৭৭ খৃ.)  ১/১৯৮; ছহীহাহ হা/২৩২৬-এর ব্যাখ্যা ৫/৪২০ পৃ.।

[3]. আবুদাঊদ হা/৩৪৬১; হাকেম হা/২২৯২; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/১৪৬২৯; ছহীহাহ হা/২৩২৬; শিরোনাম : ‘অধিক মূল্যে বাকীতে বিক্রি’।

[4]. বুখারী হা/২১৭৯; মুসলিম হা/১৫৯৬; মিশকাত হা/২৮২৪ ‘সূদ’ অনুচ্ছেদ।

[5]. আহমাদ হা/৩৭৮৩, ১/৩৯৮ ‘ছহীহ লেগায়রিহী’ আরনাঊত্ব; ইরওয়া হা/১৩০৭-এর আলোচনা ৫/১৪৯; ছহীহাহ হা/২৩২৬-এর আলোচনা ৫/৪২০-২১ পৃ.।

[6]. তিরমিযী হা/১২৩৪; আবুদাঊদ হা/৩৫০৪; নাসাঈ হা/৪৬১১; আহমাদ হা/৬৬৭১; ইবনু মাজাহ হা/২১৮৮; মিশকাত হা/২৮৭০ ‘নিষিদ্ধ ব্যবসা সমূহ’ অনুচ্ছেদ।

[7]. ইবনু বাত্ত্বাহ (মৃ. ৩৮৭ হি.), ইবত্বালুল হিয়াল (তাহকীক : যুহায়ের শাবীশ, বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৩য় সংস্করণ, তাবি) ৪৭ পৃ.;  ইবনু তায়মিয়াহ ও ইবনুল ক্বাইয়িম, সনদ ‘হাসান’; আলবানী প্রথমে ‘হাসান’ পরে যঈফ (তারাজু‘আত হা/১১৪)

[8]. বাক্বারাহ ২/৬১; আলে ইমরান ৩/১১২; ফাতেহা ৭; তিরমিযী হা/২৯৫৪।

[9]. কুরতুবী; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ৬৫ আয়াত।

[10]. আহমাদ হা/২৫৫৪৩; ইবনু মাজাহ হা/২৫২১।

[11]. তিরমিযী হা/১৩৫২, হাদীছ ছহীহ; আবুদাঊদ হা/৩৫৯৪; ইবনু মাজাহ হা/২৩৫৩; মিশকাত হা/২৯২৩; ইরওয়া হা/১৩০৩-এর ব্যাখ্যা ৫/১৪৪।

[12]. كُلُّ قَرْضٍ جَرَّ نَفْعًا فَهُوَ رِبًا যঈফুল জামে‘ হা/৪২৪৪, মারফূ‘, মওকূফ উভয় সূত্রে সনদ যঈফ। তবে মর্ম সঠিক; ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কেঈন (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, ১ম সংস্করণ ১৪১১ হি./১৯৯১ খৃ.) ১/২৫১ পৃ.।

[13]. ওমর বিন আব্দুল আযীয আল-মাতরাক, আর-রিবা ওয়াল মু‘আমালাতিল মাছরাফিইয়াহ ২৫৫ পৃ.।

[14]. তিরমিযী হা/১৮৬৫; ইবনু মাজাহ হা/৩৩৯২-৯৪; মিশকাত হা/৩৬৪৫।

[15]. বুখারী হা/২২৪০; মুসলিম হা/১৬০৪; মিশকাত হা/২৮৮৩।

[16]. বুখারী ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়, ‘দাস-দাসী ও পশুর বিনিময়ে পশু বাকীতে বিক্রয়’ অনুচ্ছেদ (باب بَيْعِ الْعَبِيدِ وَالْحَيَوَانِ بِالْحَيَوَانِ نَسِيئَةً) অনুচ্ছেদ-১০৮।

[17]. ইমাম শাফেঈ, আর-রিসালাহ ৫৯৯ পৃ.; আলবানী, আল-হাদীছু হুজ্জিয়াতুন, কুয়েত ১৪০৬ হি./১৯৮৬ খৃ.।

[18]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/১৫০২৮; আল-ক্বাওলুল ফাছল ২৮-২৯ পৃ.।

[19]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/২০৪৫৪; ছহীহ ইবনু হিববান হা/১০৫৩, ৫০২৫; সনদ ছহীহ, ইরওয়া হা/১৩০৭, ৫/১৪৮।

[20]. ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হি./১২৬৩-১৩২৮ খৃ.), মজমূ‘ ফাতাওয়া ২৯/৩০৬-০৭; আল-ক্বাওলুল ফাছল ২৮-২৯ পৃ.।

[21]. আহমাদ হা/১৯৩২৬, সনদ ছহীহ, আরনাঊত্ব; বুখারী হা/২৪৯৭, ৩৯৩৯।

[22]. নায়লুল আওত্বার ‘শারিকাহ ও মুযারাবাহ’ অধ্যায় ৭/৪-৫ পৃ.। 

[23]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/১৪৬৩০; সনদ ছহীহ।

[24]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/১৪৬৩১; সনদ ছহীহ।

[25]. ছহীহাহ হা/২৩২৬-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য ৫/৪২১ পৃ.।

[26]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/১৪৬৩২।

[27]. খাত্ত্বাবী, মা‘আলিমুস সুনান ৫/৯৯ পৃ.।

[28]. নাসাঈ হা/৪৬৩২-এর পূর্বে ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়-৪৫, অনুচ্ছেদ-৭৩।

[29]. তিরমিযী হা/১২৩৪; আবুদাঊদ হা/৩৫০৪; ছহীহাহ হা/২৩২৬, ৫/৪২২; ইরওয়া হা/১৩০৫-০৬, ৫/১৪৬-৪৮।

[30]. ছহীহাহ হা/২৩২৬-এর আলোচনা দ্রঃ ৫/৪২২।

[31]. শাওকানী, নায়লুল আওত্বার (কায়রো : ১৩৯৮ হি./১৯৭৮ খৃ.) ৬/২৮৭ ।

[32]. শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৬/২৮৭ بَابُ بَيْعَتَيْنِ فِي بَيْعَةٍ।

[33]. ইবনু হাযম, মুহাল্লা ৯/১৬; মাসায়েলুল ইমাম আহমাদ পৃ. ২০২; আল-ক্বাওলুল ফাছল ৩০-৩১ পৃ.।

       তিনি ওমর (রাঃ)-এর যুগ থেকে পরবর্তী ৬০ বছর একটানা কূফার বিচারপতি ছিলেন এবং মৃত্যুর এক বছর পূর্বে ১০৭ বছর বয়সে অবসর নেন। আলী (রাঃ) তাঁকে أقضى العرب বা ‘আরবের শ্রেষ্ঠ বিচারপতি’ বলে অভিহিত করেন।  

[34]. শা‘রানী, আল-মীযানুল কুবরা ১/৭৩।

[35]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৮৭ ‘এক ব্যবসায়ে দুই বিক্রয়’ অনুচ্ছেদ।

[36]. দৈনিক প্রথম আলো ৭.২.১৭ পৃ. ১৩।

[37]. ইবনু তায়মিয়াহ, ইক্বামাতুদ দলীল ‘আলা ইবত্বালিত তাহলীল (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, তাবি) ২২১ পৃ.। 

[38]. আলবানী, সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, অডিও ক্লিপ নং ৩৩৫।

[39]. বুখারী হা/২২৩৬; মুসলিম হা/১৫৮১; মিশকাত হা/২৭৬৬।

[40]. উছায়মীন, সিলসিলাতু লিকাইল বাবিল মাফতূহ, অডিও ক্লিপ নং ১৮৫। 

[41]. আব্দুর রহমান আব্দুল খালেক, আল-ক্বাওলুল ফাছল ফী বায়‘ইল আজাল (কুয়েত : মাকতাবা ইবনু তায়মিয়াহ, ১ম সংস্করণ ১৪০৬ হি./১৯৮৫ খৃ.) মোট পৃ. সংখ্যা ৬২।   

[42]. বুখারী হা/২০৫৯; মিশকাত হা/২৭৬১।   

[43]. বুখারী হা/২০৫১; মুসলিম হা/১৫৯৯; মিশকাত হা/২৭৬২।

[44]. তিরমিযী হা/২৫১৮; নাসাঈ হা/৫৭১১; মিশকাত হা/২৭৭৩





কথা ও কাজ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হিংসা ও বিদ্বেষ : মানবতার হত্যাকারী - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আসমানী প্রশিক্ষণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে আখেরাত বিশ্বাসের ফলাফল - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
খাদ্যে ও ঔষধে ভেজাল - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পঞ্চস্তম্ভ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইসলাম বিশ্বজয়ী ধর্ম - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
তিনটি শপথ ও একটি বাণী - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হে মানুষ! আল্লাহকে লজ্জা কর - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
দ্বীন হ’ল নছীহত - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
জামা‘আত গঠন লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মূলনীতি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নিরাপদ সমাজ গড়ে তোল - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.