
১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই ফেব্রুয়ারীতে মোঙ্গল নেতা হালাকু খানের নেতৃত্বে আগ্রাসী তাতার বাহিনী বাগদাদে হামলা চালিয়ে ৪০ দিনে সর্বাধিক হিসাব মতে ৪০ লক্ষ মানুষকে হত্যার মাধ্যমে বাগদাদ ধ্বংস করেছিল। বিধ্বস্ত হয়েছিল সকল স্থাপনা। ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন বিশ্বের সেরা জ্ঞান কেন্দ্র বাগদাদের বৃহদায়তন লাইব্রেরীগুলিকে দজলা-ফোরাতের পানিরাশিতে। ছয়শত বছরের সঞ্চিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিমেষে হারিয়ে গিয়েছিল একদল মানুষরূপী হায়েনার হিংসার অনলকুন্ডে। উক্ত ঘটনার দীর্ঘ ৭৪৫ বৎসর পরে আগামী ফেব্রুয়ারী বা মার্চেই হয়ত বাগদাদে আমরা আবার সেই ধ্বংসস্তূপ অবলোকন করব। আর এবারেও নাকি নিহত হবে ৪০ লাখের মত বনু আদম। ধ্বংস হবে সবকিছু! হালাকুর স্থলে এবার আবির্ভূত হয়েছে শতাব্দী সেরা সন্ত্রাসী রাষ্ট্রনায়ক জর্জ বুশ (জুনিয়র)। সেদিনের হালাকু বাগদাদ ধ্বংস করে ফিরে গিয়েছিল নিজ দেশে। ফলে বাগদাদের ধ্বংসস্তূপের উপর প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল মামলূক মুসলিম সালতানাৎ। কিন্তু এবারের হালাকু ফিরে যাবে না। সে কেবল ভূপৃষ্ঠের মানুষগুলিকে শেষ করেই ক্ষান্ত হবে না। সে চায় ভূগর্ভের তৈল সম্পদ। গত শীতে আফগানিস্তান দখল করে সে উক্ত ভূখন্ডের উপর দিয়ে তেলের পাইপ লাইন টেনে নেবার রাস্তা অবাধ করে নিয়েছে। এবারের শীতে ইরাক দখল করে সে এশিয়ার তৈলভান্ডারে প্রবেশ করতে চায়। পরবর্তীতে ইরান, সঊদী আরব ও গোটা মধ্যপ্রাচ্য তার টার্গেটে রয়েছে। ৮১৬ বছর আগে ১১৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ঐতিহাসিক হিত্তীনের ময়দানে ক্রুসেড বিজেতা সেনাপতি গাযী ছালাহুদ্দীন আইয়ূবীর কাছে সম্মিলিত খ্রিষ্টান বাহিনীর লজ্জাকর পরাজয়ের প্রতিশোধ সে নেবে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল তৈল সম্পদ কুক্ষিগত করে মুসলমানদেরকে চিরদিন ইহূদী-খ্রিষ্টানের গোলামে পরিণত করে রাখবে, এটাই ইঙ্গ-মার্কিন সন্ত্রাসী চক্রের একান্ত বাসনা।
আল্লাহ তার রাসূলকে বলেন, ‘ইহূদী-নাছারারা কখনোই তোমার উপর সস্ত্তষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না তুমি তাদের ধর্মের অনুসরণ করবে। তুমি বল, নিশ্চয়ই আল্লাহর দেখানো পথই সঠিক পথ। আর যদি তুমি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ কর, তোমার নিকটে (অহি-র) জ্ঞান এসে যাওয়ার পরেও, তবে আল্লাহর কবল থেকে তোমাকে বাঁচাবার মতো কোন বন্ধু বা সাহায্যকারী নেই’ (বাক্বারাহ ২/১২০)। ইমাম কুরতুবী এই আয়াত নাযিলের কারণ হিসাবে বলেন যে, ইহূদী-নাছারাদের নেতারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে সন্ধি করতে চেয়েছিল এবং তাঁর নিকটে ইসলাম গ্রহণের ওয়াদা দিয়েছিল। তাদের এই প্রতারণা ও কুট-কৌশল সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে আল্লাহপাক অত্র আয়াত নাযিল করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে রাসূলকে জিহাদের নির্দেশ দেন’ (কুরতুবী)।
আমেরিকার ইতিহাসে সর্বাধিক মেধাহীন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের মগযে গত বছর পেসমেকার বসানো হয়। তার এক সপ্তাহ পূর্বে হার্টের রোগী তার ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনীর বুকে বসানো হয় ইমপ্লান্টেবল ডিভাইস। এই দুই রোগীর সঙ্গে যোগ হয়েছে অন্য দুই যুদ্ধরোগী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাম্স্ফেল্ড। এরা সবাই পরস্পরে তৈল ও অস্ত্র ব্যবসায়ী। এদের নিজস্ব ব্যবসায়ের স্বার্থে এরা সর্বত্র যুদ্ধ বাধায়। ডেমোক্র্যাট হৌক বা রিপাবলিকান হৌক আমেরিকার রাজনীতিকরা প্রায় সকলে একই চরিত্রের। আমেরিকা, বৃটেন, চীন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার অস্ত্র ভান্ডারে যে বিশাল মারণাস্ত্রের মওজুদ রয়েছে, তা দিয়ে এই ক্ষুদ্র পৃথিবীকে কয়েকবার ধ্বংস করা যাবে। তাদের ব্যাপারে কেন কিছুই বলা হচ্ছে না? বর্তমান বুশের পিতা সিনিয়র বুশ ১৯৯০ সালে কুয়েতের বিরুদ্ধে সাদ্দামকে লেলিয়ে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির নেতাদের মধ্যে সাদ্দামভীতি জাগ্রত করেন ও তার ফলে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে ২০০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে। একই ভয় দেখিয়ে কুয়েতে, সঊদী আরবে ও কাতারে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। ভূমধ্য সাগরের সর্বত্র তার নৌবাহিনী মোতায়েন হয়। ওদিকে ইসরাঈলকে রক্ষার নামে তাকে তার অস্ত্রভান্ডারে পরিণত করে। বর্তমানে ইসরাঈলে আমেরিকার সর্বশেষ ও সর্বাধুনিক ‘এ্যারো’ মারণাস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে, যা বিশ্বের অন্য কোন দেশকে আমেরিকা সরবরাহ করেনি।
গত ৮.১১.০২ইং তারিখে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে ইরাককে নিরস্ত্রীকরণের প্রস্তাব পাস হয়েছে। অথচ অন্যকে নিরস্ত্র করার আগে বৃহৎ শক্তিবর্গের নিজেদের অস্ত্র ভান্ডার ধ্বংস করা ছিল অধিক যরূরী। একটি সদস্য দেশকে নিরস্ত্র করার ও না মানলে সেখানে হামলা চালিয়ে ধ্বংস করার এমন ন্যাক্কারজনক সর্বসম্মত প্রস্তাব জাতিসংঘের ইতিহাসে ইতিপূর্বে গৃহীত হয়নি বলে বিশেষজ্ঞগণ মন্তব্য করেছেন। এর কারণ ছিল একটাই যে, সদস্য দেশগুলির অব্যাহত বিরোধিতার মুখে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল হুমকির সুরে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিগড়ে আবদ্ধ থাকবে না। সে একাই ইরাকে শক্তি প্রয়োগ করবে। ব্যস! তাতেই প্রস্তাব পাস। জাতিসংঘের ১৪৪১নং প্রস্তাবকে তাই প্রকারান্তরে ৩য় বিশ্বযুদ্ধের ও সেই সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারার অবাধ লাইসেন্স বলা যেতে পারে। গত একযুগ ধরে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক অবরোধের ফলে ইরাকের প্রায় ১৫ লাখ মানুষ ক্ষুধায় অনাহারে ও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছে। এভাবে ইরাককে সবদিক থেকে পঙ্গু করে এখন চূড়ান্ত হামলার মাধ্যমে তাকে তিন টুকরা করে সেখানে স্ব স্ব পুতুল সরকার বসিয়ে আজকের ঐক্যবদ্ধ ও সার্বভৌম ইরাককে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলাই বুশ-ব্লেয়ার-শ্যারণ চক্রের চূড়ান্ত লক্ষ্য। যেভাবে তারা ইতিপূর্বে গর্বাচেভকে দিয়ে এককালের বিশ্ব শক্তি সোভিয়েত রাশিয়াকে ১৬ টুকরায় বিভক্ত করে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বিদায় করেছে। গণতন্ত্রের এই বরকন্দাজরা ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুরে দারিদ্র্য বিমোচন ও ধর্মপ্রচারের মুখোশে ঢুকে সেখানে খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠতা সৃষ্টি করে। অতঃপর স্বাধীনতার ধুয়া তুলে একে ইন্দোনেশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়। অথচ এর অনতিদূরে দক্ষিণ ফিলিপাইনের মান্দানাও প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ নামে আখ্যায়িত করছে। একইভাবে কাশ্মীরের ও চেচনিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরকেও তারা ‘জঙ্গী’ বলে অভিহিত করছে। আমেরিকা তার জন্মের পর থেকে বিগত ২২৫ বছরে অন্যূন ১৭৫টি দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সন্ত্রাস চালিয়েছে। এরপরেও সে গণতন্ত্রী ও মানবাধিকারবাদী।
আজ থেকে ১০০ বছর পূর্বে ১৯০২ সালে ওছমানীয় খলীফা সুলতান আব্দুল হামীদ ২য়-এর কাছে ইহূদীরা ফিলিস্তীনে তাদের জন্য আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার অনুমতি প্রার্থনা করেছিল। সেদিন সুলতান দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, ওদের নেতা থিয়োডোর হার্জলকে জানিয়ে দাও, যতদিন পৃথিবীতে ওছমানী খেলাফত থাকবে, ততদিন যেন ফিলিস্তীনে ইহূদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিলাষ না করে। এটা কেবল তখনই সম্ভব হবে, যখন ওছমানী খেলাফত একটি অতীত ও স্বপ্ন হয়ে যাবে’। সুলতানের এই পরিষ্কার জবাব পেয়ে ইহূদীরা অন্য পথ ধরে এবং লেবাননের নাছিফ ইয়াযেজী, বুতরুস বুস্তানী প্রমুখ খ্রিষ্টান লেখক ও পন্ডিতদের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের তরুণ সমাজ ও মুসলিম নেতাদের মধ্যে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করতে থাকে ও সাথে সাথে তাদের মধ্যে পাশ্চাত্যের বিলাসী সংস্কৃতির বিষবাষ্প ছড়াতে থাকে। এতে দ্রুত ফল লাভ হয় এবং তুর্কী ও আরব জাতীয়তাবাদী চেতনার সংঘাতে বিশাল ওছমানী খেলাফত ছোট ছোট জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের থাবায় আবদ্ধ হয়ে যায়। অতঃপর ১৯২৪ সালে ওছমানী খেলাফত ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর খুব সহজে ১৯৪৮ সালে কথিত ‘ইসরাঈল’ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। অতএব আজকে যদি ইরাক বা মুসলিম বিশ্বকে বাঁচাতে হয়, তাহ’লে যেকোন মূল্যে মুসলমানদের ঐক্যের প্রতীক হারানো ‘খেলাফত’ পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং পাশ্চাত্যের সকল জাহেলী মতবাদ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ অহি-র বিধান পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর দিকে ফিরে যেতে হবে। ১৭ই রামাযানে বদরের যুদ্ধের দিন যেভাবে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কেবল আল্লাহর নিকটে সাহায্য চেয়ে প্রাণভরে প্রার্থনা করেছিলেন এবং তার ফলে আসমান থেকে হাযার হাযার ফেরেশতা নেমে এসে সংখ্যালঘু নিঃসম্বল মুসলিম বাহিনীকে বিজয়ী করেছিল, আজও তেমনি সকল বৃহৎ শক্তির আশ্রয় থেকে মুখ ফিরিয়ে স্রেফ আল্লাহর নিকটে আশ্রয় ভিক্ষার মাধ্যমে এবং মুসলিম বিশ্বের সকল শক্তি সমন্বিত করে সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে সার্বিক জিহাদের প্রস্ত্ততি গ্রহণের মাধ্যমেই কেবল প্রকৃত বিজয় ও মুক্তি লাভ সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন![1]
[1]. ৬ষ্ঠ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০০২।