খোরাসানের মার্ভ অঞ্চল তথা বর্তমান তুর্কমেনিস্তানের বাশিন্দা আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (১১৮-১৮১ হি.) ছিলেন একাধারে মুহাদ্দিছ, ফক্বীহ, মুজতাহিদ এবং একজন সাহসী বীর মুজাহিদ। তিনি ‘আমীরুল মু’মিনীন ফিল হাদীছ’ উপাধিতে ভূষিত হন। একজন মানুষের মাঝে সম্ভাব্য যত রকমের সদগুণ থাকা দরকার, তার সবই আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহঃ)-এর মাঝে বিদ্যমান ছিল। ইমাম যাহাবী (রহঃ) বলেন, ‘একদিন ইবনুল মুবারকের সাথীগণ বললেন, চল! আজ আমরা আমাদের বন্ধু আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারকের চরিত্রের কি কি ভালো দিক আছে তার একটা তালিকা বানিয়ে ফেলি’। আর সেদিন তারা তালিকায় যা পেল তা হ’ল- ‘ইলম, ফিক্বহ, সাহিত্য, ব্যাকরণ, ভাষাজ্ঞান, যুহদ, বাগ্মিতা, কাব্যপ্রতিভা, তাহাজ্জুদ, ইবাদতগুযার, হজ্জ, জিহাদ, বীরত্ব, প্রেরণা, শক্তিমত্তা, ধনাঢ্যতা, সততা, অনর্থক বিষয়ে চুপ থাকা এবং সাথীদের সাথে কখনোই মতবিরোধে না জড়ানো প্রভৃতি’ (সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৭/৩৯৭; তারিখু দিমাশক্ব ৩৭/৩৩৫)

তাঁর পরহেযগারিতা সম্পর্কে কাসিম বিন মুহাম্মাদ বলেন, একবার আমরা আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারকের সাথে সিরিয়া সফরে ছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, লোকটার মাঝে কি এমন গুণ আছে যে- তিনি এতটা জনপ্রিয়? তিনি যদি ইবাদতগুযার হন, তাহলে আমরাও তো ইবাদত করি। তিনি যদি ছিয়াম রাখেন, জিহাদে অংশগ্রহণ করেন, হজ্জ করেন, এর সবই তো আমরা করি। তাহ’লে আমাদের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? পথিমধ্যে আমরা এক বাড়ীতে রাত কাটালাম। হঠাৎ ঘরের বাতিটা নিভে গেল, এতে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ জেগে উঠল। এরূপ অবস্থায় কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক নিভে যাওয়া বাতিটা বাইরে নিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ঘরে ফিরে আসলেন। প্রদীপের আলোয় হঠাৎ আমার চোখ পড়ল তাঁর চেহারার দিকে। দেখলাম চোখের পানিতে তাঁর দাঁড়ি ভিজে গেছে। মনে মনে বললাম, ‘এই সেই আল্লাহভীতি, যা আমাদের সবার থেকে তাঁর মর্যাদাকে পৃথক করে দিয়েছে’। কারণ যখন ঘরে আলো নিভে গিয়ে চারদিকে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, ইবনুল মুবারক তখন আখেরাতের অন্ধকারের কথা ভেবে অঝোর নয়নে কাঁদছিলেন’ (ছিফাতুছ ছাফওয়াহ ৪/১৪৫-১৪৬)। আজ আমরা যুগশ্রেষ্ঠ পরহেযগার এই মনীষীর যবানে আরেক পরহেযগার কৃষ্ণকায় ক্রীতদাসের বিস্ময়কর কাহিনী শুনব-

আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন, ‘একবার আমি মক্কায় আসলাম। সেখানে দেখলাম অনাবৃষ্টির কারণে মানুষ বেশ কষ্টে আছে। তারা মসজিদুল হারামে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করছে। বনু শায়বা দরজার দিকে বসে আমিও তাদের সাথে দো‘আয় শামিল হ’লাম। হঠাৎ দেখলাম জোড়াতালি দেওয়া দু’খন্ড কাপড় পরিহিত এক নিগ্রো দাস সেখানে প্রবেশ করল। এক ফালি কাপড় সে লুঙ্গি হিসাবে পরিধান করেছে। আরেক ফালি তার কাঁধে জড়িয়ে রেখেছে। আমার পাশেই নিরিবিলি জায়গা দেখে সে অবস্থান নিল। একটু পরেই আমি তাকে দো‘আ করতে শুনলাম, ‘প্রভু হে! অত্যধিক গুনাহ ও পাপাচারের কারণে মানুষের মুখগুলো জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে গেছে। তাদের সংশোধনের জন্য আপনি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দিয়েছেন। হে পরম সহনশীল আল্লাহ! বান্দারা আপনার কাছে কেবলই সুন্দর কিছুর প্রত্যাশা করে। কাজেই আমি আপনার নিকট ফরিয়াদ জানাচ্ছি, আপনি এখনই বৃষ্টি দান করুন।

‘আপনি এখনই বৃষ্টি দান করুন’ বলে সে বারবার ভীত-বিহবল চিত্তে দো‘আ করতে থাকল। তারপর দেখি, আকাশ বড় বড় মেঘে ছেয়ে গেছে। মেঘে গুড়গুড় আওয়ায শোনা যাচ্ছে। একটু পরেই প্রবল বৃষ্টি শুরু হ’ল। এদিকে সে নিজের জায়গায় বসে তাসবীহ পাঠ করতে থাকল। এসব দেখে আমি কাঁদতে শুরু করলাম। তারপর সে যখন উঠে গেল তখন আমিও তার পিছু পিছু গেলাম এবং তার বাসস্থান চিনে আসলাম।

এরপর আমি ফুযাইল বিন ইয়ায-এর কাছে গেলাম। তিনি আমাকে দেখে বললেন, আপনাকে বিষণ্ণ মনে হচ্ছে। কি হয়েছে আপনার? বললাম, আমাদের পরাজিত করে অন্য কেউ আমাদের চেয়েও আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী হয়ে গেছে। তিনি বললেন, কে? কীভাবে? আমি তাকে ঘটনা খুলে বললাম। তিনি চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন এবং বললেন, এ কি বলছ, ইবনুল মুবারক! আমাকে এখনই তার কাছে নিয়ে চল। আমি বললাম, এখন সময় কম। আমি তার বিষয়ে আরোও জানার চেষ্টা করছি।

পরদিন ফজরের ছালাত আদায় করে আমি তার বাসস্থানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। দেখলাম বাড়ির দরজায় একজন বয়স্ক ব্যক্তি বসে আছেন। আমাকে দেখে চিনতে পেরে তিনি আনন্দিত কণ্ঠে বললেন, খোশ আমদেদ আবু আব্দুর রহমান! কোন প্রয়োজন আছে কি? আমি বললাম, আমার একজন কালো দাস প্রয়োজন। তিনি বললেন, আমার কাছে বেশ কয়েকজন দাস আছে। এদের মধ্যে আপনার পসন্দমতো কাউকে বেছে নিন। এ বলে তিনি একজন দাসকে ডাকতে লাগলেন। বললেন, এ ভালো দাস। আপনার জন্যই আমি একে বাছাই করেছি। আমি বললাম, না, আমি একে নিব না।

এভাবে একে একে সব দাস তিনি দেখালেন। অবশেষে সেই দাসটিও বেরিয়ে এলো। তাকে দেখে আমার চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরতে লাগল। তিনি বললেন, আপনি একে চাচ্ছেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাকে বিক্রি করার তো কোন সুযোগ নেই। আমি বললাম, কেন? বৃদ্ধ বললেন, তার কারণেই এই ঘর বরকতময় হয়েছে। সে আসার পর থেকে আমার ঘরে কখনো বিপদ বা দুর্যোগ আসেনি। আমি বললাম, তার খাবারের ব্যবস্থা কিভাবে হয়? তিনি বললেন, সে রশি পাকিয়ে অর্ধ দীনার বা তার কম-বেশী আয় করে। এ থেকেই তার খাবারের সংস্থান হয়। যেদিন রশি বিক্রি করতে পারে, সেদিন খায়। যেদিন পারে না, সেদিন ছবর করে।

অন্য দাসগুলো আমাকে জানিয়েছে, গতকাল সে রাতভর ঘুমায়নি। তাদের কারো সাথে দেখা হয়নি তার।

উদ্দেশ্য হাছিল না হওয়ায় আমি ফুযাইল বিন ইয়ায ও সুফিয়ান ছাওরী-এর উদ্দেশ্যে বের হ’লাম। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এসে দাসটি বিক্রির জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলাম। তখন তিনি বললেন, ঠিক আছে। তার মর্যাদা তো আমার কাছে অনেক। কিন্তু আপনি যতটুকু বিনিময় দিয়ে ইচ্ছা নিয়ে যান।

তিনি তাকে ক্রয় করে তাকে সাথে নিয়ে ফুযাইল বিন ইয়ায-এর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লেন।

কিছুক্ষণ পর দাসটি বলল, মনিব! আপনি কী চান? আমি বললাম, লাববাইক (আমি উপস্থিত)। সে বলল, আপনি ‘লাববাইক’ বলবেন না। মনিবের চেয়ে দাসের মুখেই এটা বেশী মানায়। বললাম, প্রিয় ভাই! তুমি কী চাও? সে বলল, আমি তো দুর্বল মানুষ। খেদমত করার ক্ষমতা আমার নেই। সেখানে তো ক্রয় করার মত আরো অনেক দাস ছিল। যারা আমার চেয়ে অনেক শক্তিশালী। (আপনি আমাকে না কিনে তাদেরকে কিনতে পারতেন)। আমি বললাম, তোমাকে সেবা করার জন্য আল্লাহ আমাকে সুযোগ দিয়েছেন। তোমাকে আমি সন্তানের মর্যাদা দেওয়ার জন্য ক্রয় করেছি। আমি তোমাকে বিয়ে দিব এবং আমি নিজেই তোমার সেবা করব।

একথা শুনে দাসটি কাঁদতে লাগল। বললাম, তুমি কাঁদছ কেন? সে বলল, আপনি আমাকে এজন্যই ক্রয় করেছেন যে, আল্লাহর সাথে আমার কোন সম্পর্কের বিষয় হয়তো আপনি প্রত্যক্ষ করেছেন। অন্যথায় অন্যসব দাসের মধ্য থেকে আপনি কেন আমাকে বেছে নিলেন? আমি বললাম, এতো কিছু তোমার জানার প্রয়োজন নেই। সে বলল, আল্লাহর দোহাই আমাকে বলুন! বললাম, আল্লাহ তোমার দো‘আয় সাড়া দিয়েছেন তাই।

সে বলল, আশা করি আপনি একজন সৎ মানুষ। আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি থেকে উত্তমদের বাছাই করেন। তিনি তাঁদের মর্যাদা কেবল তাঁর প্রিয় বান্দাদের নিকটেই প্রকাশ করেন। এরপর সে আমাকে বলল, আপনি আমার জন্য একটু অপেক্ষা করুন! গত রাতের কয়েক রাক‘আত ছালাত বাকী আছে আমার। সেগুলো আদায় করে নেই।

আমি বললাম, ফুযাইল-এর বাড়ী তো নিকটেই, সেখানে গিয়েই আদায় করো! সে বলল, না, এই জায়গাটাই আমার বেশী পসন্দ। আল্লাহর আদেশ তাড়াতাড়ি বাস্তবায়ন করতে চাই। এই বলে সে মসজিদে ঢুকল। কিছুক্ষণ পর ছালাত আদায় করে ফিরে এল। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, হে আবু আব্দুর রহমান! আমার কাছে কি আপনার কোন প্রয়োজন আছে?

- কেন?        

- আমি চলে যেতে চাই।

- কোথায়?    

- আখেরাতের পানে।

- এমনটা করো না। আমি তোমার মাধ্যমে উপকৃত হ’তে চাই।

সে বলল, দুনিয়াটা আমার জন্য বেশ ভালো ছিল। আল্লাহ ও আমার মাঝে যে মু‘আমালাত ছিল, তা কেউ জানত না। কিন্তু আপনি যেহেতু তা জেনে গেছেন, সেহেতু অন্যরা জানতেও বাকী থাকবে না। এর কোনই প্রয়োজন নেই আমার।

এই কথা বলে সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। বলতে থাকল, হে আমার প্রভু! আমাকে এখনই উঠিয়ে নিন। আমি তার কাছে গিয়ে দেখলাম, সে মরে গেছে।

আল্লাহর কসম! এরপর থেকে যখনই তার কথা আমার মনে পড়ে, তখনই আমার দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়, দুনিয়া আমার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। নিজের আমল একেবারেই নগণ্য মনে হয়। আল্লাহ তার এবং আমাদের প্রতি রহম করুন’ (ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়াহ, তাহকীক: আহমাদ বিন আলী (কায়রো: দারুল হাদীছ, ২০০০ খৃ.) ১/৪৪৪-৪৪৬ পৃঃ; ঐ, বাহরুদ দুমূ‘, তাহকীক: জামাল মাহমূদ মুছতফা (মিসর: দারুল ফজর, ১ম প্রকাশ, ২০০৪ খৃ.), পৃ. ৪৬-৪৮)

শিক্ষা:

১. মুখলিছ বান্দারা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যেই যাবতীয় ইবাদত-বন্দেগী সম্পাদন করেন। ফলে তারা সর্বদা আমলের গোপনীয়তা বজায় রাখায় সচেষ্ট থাকেন এবং প্রকাশ পাওয়াকে অপসন্দ করেন।

২. তাক্বওয়াই মানুষের প্রকৃত মর্যাদার মাপকাঠি; চেহারা বা ধন-সম্পদ নয়।

৩. প্রকৃত দ্বীনদাররাই কেবল পরহেযগার মানুষের মর্যাদা বুঝতে পারেন।

৪. আল্লাহভীরুদের দো‘আ আল্লাহ কখনো ফিরিয়ে দেন না।

৫. তাক্বওয়ার মাধ্যমে পরিবারে ও সমাজে বরকত নেমে আসে এবং যাবতীয় বিপদাপদ থেকে নিরাপত্তা লাভ করা যায়।

-সংকলনে : আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ

 নশিপুর, গাবতলী, বগুড়া।






খলীফা ওমর (রাঃ)-এর অনুশোচনা
সুলতান মাহমূদের আহলেহাদীছ হওয়ার বিস্ময়কর কাহিনী - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ইবনুল মুবারক (রহঃ)-এর জীবনী থেকে কতিপয় শিক্ষণীয় ঘটনা - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
বিরোধীদের প্রতি ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ)-এর ক্ষমাসুন্দর আচরণ - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
খলীফা হারূনুর রশীদের নিকটে প্রেরিত ইমাম মালেক (রহঃ)-এর ঐতিহাসিক চিঠি - ইহসান ইলাহী যহীর
তাতারদের আদ্যোপান্ত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ইসলামী শাসনের একটি নমুনা - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
তাতারদের আদ্যোপান্ত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
পরিবর্তনের জন্য চাই দৃঢ় সংকল্প - নাজমুন নাঈম
তাতারদরে আদ্যোপান্ত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
অভাবী গভর্ণরের অনুপম দানশীলতা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আবু দাহদাহ (রাঃ)-এর দানশীলতা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আরও
আরও
.