ভূমিকা :
ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (১৯৪২-২০০৬ খ্রি.) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ইলমী জগতের এক অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ছিলেন ‘মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ হিন্দ’-এর সাবেক আমীর, বিশিষ্ট গবেষক, বিদগ্ধ আলেম, আধুনিক মুসলিম বিশ্বে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক সীরাত চর্চার অগ্রপথিক ও দিশারী। তিনি বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগানো সীরাতগ্রন্থ ‘আর-রাহীকুল মাখতূম’-এর রচয়িতা। আরবী ভাষাভাষী না হয়েও তিনি আরবীতে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অনন্য জীবনীগ্রন্থ ‘আর-রাহীকুল মাখতূম’ রচনা করে ১১৮২টি পান্ডুলিপির মধ্যে প্রথম পুরস্কার লাভ করে সীরাত সাহিত্যের ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে আছেন।
এই বিশ^বরেণ্য সীরাতবিদের জীবনের পরতে পরতে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় মওজুদ রয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা তাঁর জীবনী থেকে কতিপয় শিক্ষণীয় ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।-
(১) ছফিউর রহমান মুবারকপুরী ছোট বেলা থেকেই খুব মেধাবী ছিলেন। পাঁচ বছর বয়সে দাদা আকবর ও চাচা আব্দুছ ছামাদের নিকট কুরআন মাজীদ পাঠের মাধ্যমে তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। তারপর তিনি ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে মুবারকপুরের ‘দারুত তা‘লীম’ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি দীর্ঘ ছয় বছর যাবৎ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। অতঃপর ১৯৫৪ সালের জুন মাসে মুবারকপুরের ‘এহইয়াউল উলূম’ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে দু’বছর অবস্থান করে আরবী ভাষা ও সাহিত্য, নাহু, ছরফ এবং অন্যান্য বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন। এ প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নকালে তিনি তাঁর সহপাঠীদের মাঝে বিশেষ মেধার স্বাক্ষর রাখেন। শিক্ষকরা তাঁর লেখাপড়ার উন্নতি, মুখস্থশক্তি ও মেধার প্রখরতায় খুবই মুগ্ধ হন। ফলে পরীক্ষায় তিনি ৫০ নম্বরের মধ্যে ৫১ নম্বর পান। এ ব্যাপারে শিক্ষকদের ভাষ্য ছিল, ‘এই ছেলেটি অতিরিক্ত নম্বরের উপযুক্ত’।[1]
(২) মুবারকপুরী উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ১৩৭৫ হিজরী মোতাবেক ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে মাতৃভূমি মুবারকপুর শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে আযমগড় যেলার মৌনাথভঞ্জন এলাকায় অবস্থিত আহলেহাদীছ জামা‘আতের প্রাচীন মাদ্রাসা ‘ফায়যে আম’-এ ভর্তি হন। এখানে তিনি পাঁচ বছর অবস্থান করতঃ আরবী ভাষা, সাহিত্য ও ব্যাকরণ ছাড়াও তাফসীর, হাদীছ, উছূলে হাদীছ, ফিক্বহ, উছূলে ফিক্বহ প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। এ মাদ্রাসায় অবস্থানরত আবাসিক ছাত্ররা ছুটির সময় বাড়ীতে যেত। কিন্তু মুবারকপুরীর অবস্থা ছিল একটু ভিন্ন। তিনি পরিবারের সাথে দেখা করতে গিয়ে মাঝে-মধ্যে তাঁর ফিরতে বিলম্ব হ’ত। মাদ্রাসায় ফিরে আসার পর প্রিন্সিপাল বা নির্দিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক তাঁকে এ বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করলে তিনি বলতেন, ‘আমাকে আধা ঘণ্টা সময় দিন, যাতে আমি পাঠ দেখে নিতে পারি। অতঃপর আপনি আমাকে পরীক্ষা করবেন’। অতঃপর মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে তিনি সেই পাঠ মুখস্থ করে ফেলতেন।[2]
(৩) ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ও ১৮ই জুন বেনারসের বাজরডিহায় অবস্থিত ‘মাদ্রাসা এহইয়াউস সুন্নাহ’-এর আরবী বিভাগের প্রতিষ্ঠা ও লাইব্রেরী উদ্বোধন উপলক্ষে স্থানীয় জমঈয়তে আহলেহাদীছ কর্তৃক দু’দিনব্যাপী এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সে সমাবেশে উপস্থিত আলোচকগণ সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন দিকের উপর দলীলভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন। দ্বিতীয় দিন উক্ত সমাবেশে মাওলানা আব্দুস সালাম আসলাম কানপুরী ‘কবরবাসীদের নিকট কিছু চাওয়া এবং বিপদের সময় তাদের নিকট ফরিয়াদ করা শিরক’ বিষয়ে শরী‘আতের দৃষ্টিতে প্রামাণ্য বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদীছের আলোকে শ্রোতাদের সামনে সত্য বিষয়টি তুলে ধরেন।
এই বক্তব্য ব্রেলভী আলেমদের অন্তঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা সাধারণ জনগণকে বছরের পর বছর বোকা বানিয়ে তারা তাদের সম্পদ ও নযর-নেয়ায গ্রহণ করে আসছিলেন। ফলে তারা প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেন। অতঃপর ২৫ ও ২৬শে জুন ব্রেলভী আলেমগণ সেখানে একটি সমাবেশের আয়োজন করেন। সেই সমাবেশে তারা আহলেহাদীছদেরকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।
আহলেহাদীছগণ ব্রেলভীদের এ ধরনের কার্যক্রম দেখে ২৯শে জুন সেখানে আরেকটি সমাবেশের আয়োজন করেন। এতে ছফিউর রহমান মুবারকপুরী ও মাওলানা শামসুল হক সালাফী উপযুক্ত দলীলসহ বক্তব্য পেশ করেন। বিশেষ করে ছফিউর রহমান মুবারকপুরী কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকে দলীলভিত্তিক জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করে ব্রেলভী হানাফীদের অসীলা বিষয়ক ভ্রান্ত আক্বীদা দূর করতঃ তাদেরকে লা জওয়াব করে দেন। ফলে ব্রেলভীগণ আত্মসমর্পণ করেন। মুবারকপুরীর বক্তব্য শুনে ৪৯ জন ব্রেলভী আহলেহাদীছ হন। এদের মধ্যে তিনজন স্বপরিবারে আহলেহাদীছ হওয়ার ঘোষণা প্রদান করেন।[3]
(৪) প্রাথমিক জীবনে মুবারকপুরীর অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। কিন্তু এই অর্থনৈতিক দুর্বলতা তাঁর জ্ঞানার্জনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। রিয়াদের ‘দারুস সালাম’ প্রকাশনা সংস্থার গবেষক রিযওয়ানুল্লাহ রিয়াযী বলেন, ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল যখন আমি ছফিউর রহমান মুবারকপুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘মুহাদ্দিছ’ পত্রিকার কিছু সংখ্যা খোঁজ করতে বেনারসের জামে‘আ সালাফিইয়াহতে গিয়েছিলাম, তখন মাওলানা হানীফ মাদানী আমাকে বলেন, ‘ফায়যে আম’ মাদ্রাসায় পাঠদানকালে (১৯৬৩-১৯৬৫ খ্রি.) মুবারকপুরী আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতীর ‘আল-মাছাবীহ কী মাসআলাতিত তারাবীহ’-এর অনুবাদ করেছিলেন। তখন আমরা ঐ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিলাম। অর্থনৈতিক সংকট থাকায় মুবারকপুরী অনূদিত কপিটি ছাপিয়ে প্রকাশ করার জন্য আমাদের নিকট সহযোগিতা চেয়েছিলেন। আমরা প্রত্যেক ক্লাসের ছাত্রদের নিকট থেকে চার আনা করে জমা করেছিলাম। আর আমি একাই পাঁচ রূপী প্রদান করেছিলাম। সেই অর্থের বিনিময়ে তাঁর কিতাব ছাপানো হয়েছিল। কিতাবটি ছাপানোর পর তিনি আমাকে পঞ্চাশ কপি হাদিয়া প্রদান করেছিলেন’।[4]
(৫) ছাত্রদের প্রতি ছফিউর রহমান মুবারকপুরীর অগাধ ভালবাসা ছিল। অর্থাভাবে কোন ছাত্রের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে জানতে পারলে তিনি উদারহস্তে তাকে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করতেন এবং বইপত্র কিনে দিতেন। ছাত্ররা যেকোন সময় তাঁর সাথে দেখা করে যে কোন বিষয়ে সমাধান নিতে পারত। তাঁর দরজা সর্বদা ছাত্রদের জন্য উন্মুক্ত থাকত। এমনকি তাঁর বিশ্রামের সময়ও যদি কোন শিক্ষার্থী তাঁর সাথে সাক্ষাতের অনুমতি চাইত, তাহ’লে তিনি বিনা দ্বিধায় তাকে অনুমতি দিতেন। এ কারণেই জামে‘আ সালাফিইয়াহ থেকে শুরু করে মদীনা মুনাওয়ারা পর্যন্ত একদল ছাত্র সর্বদা তাঁর আশেপাশে ভির জমাতো। বেনারসের জামে‘আ সালাফিইয়াহতে অবস্থানকালে আছরের ছালাতের পর তিনি হাঁটতে বের হ’তেন, তখন একদল ছাত্রও তাঁর সাথে বের হ’ত। ঐ সময় তিনি ছাত্রদের সাথে মজার মজার গল্প করতেন। ছাত্ররা বিভিন্ন বিষয়ে তাঁকে প্রশ্নণ করত। আর তিনি সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতেন। সঊদী প্রবাসী দাঈ আবু ওসামা নিয়ায আহমাদ সালাফী বলেন, আমরা জামে‘আ সালাফিইয়াহ-এর ছাত্র থাকাকালে আছর ছালাতের পর আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ছফিউর রহমান মুবারকপুরীর সাথে রাস্তায় হাঁটতে বের হ’তাম। তিনি তখন বিভিন্ন প্রকারের ঘটনা শুনিয়ে আমাদের বলতেন, ‘এগুলো নযীরবিহীন ঘটনা’।[5]
(৬) মুবারকপুরী জামে‘আ সালাফিইয়াহ থেকে যখন মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যান তখনও ছাত্ররা তাঁর পাশে একত্রিত হ’ত।
কখনো কখনো দল বেঁধে তারা তাঁর কক্ষে হাযির হ’ত এবং তাঁর থেকে ইলমী ফায়েয লাভ করত। মাগরিবের ছালাতের পর তিনি মসজিদে নববীর দরজা ‘বাবুর রহমতে’ গিয়ে বসতেন। তখন মদীনা ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাঁর নিকট এসে বসত। তিনি তাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন। ছাত্ররা তাঁকে যখন কোন বিষয়ে প্রশ্ন করত, তখন তিনি দলীলসহ আলোচনার মাধ্যমে তাদের অন্তরকে প্রশান্ত করে দিতেন। ছাত্রদের মাঝে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল অতুলনীয়। ছাত্রদের সাথে তিনি ক্লাসে ছিলেন খুব ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ এবং ক্লাসের বাইরে ছিলেন খুবই মিশুক। আরব বিশে^র প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক সাধারণত এ রকম হয়ে থাকে। যদিও তিনি আরব বিশে^র প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া শিখেননি তবুও তাঁর মধ্যে আরব বিশে^র প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মত উত্তম আচরণ ও উদারতা বিদ্যমান ছিল।[6]
(৭) জীবনের শুরু থেকেই পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছভিত্তিক দাওয়াত ও তাবলীগের ময়দানে ছফিউর রহমান মুবারকপুরীর বহু মেহনত ছিল। ১৯৬১ সালে ‘ফায়যে আম’ মাদ্রাসা থেকে ফারেগ হওয়ার পর তিনি অন্যান্য ছাত্রের ন্যায় জীবিকা উপার্জনের চিন্তায় নিজের সময় নষ্ট করেননি। বরং ফারেগ হওয়ার পরপরই পাঠদান ও দাওয়াতী কাজে নিজেকে উৎসর্গ করে দেন। প্রথমে ভারতের মধ্য প্রদেশের সিউনীতে অবস্থিত ‘ফায়যুল উলূম’ মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করার সাথে সাথে আশপাশের এলাকাগুলোতে তাঁর দাওয়াতী কার্যক্রম ছিল সরগরম। মাদ্রাসার নিকটবর্তী এলাকার জুম‘আ মসজিদে খুৎবা প্রদান এবং মাঝে মাঝে লোকদের সমবেত করে তাদের সামনে সমাজ সংস্কারমূলক বক্তব্য প্রদান তাঁর সাধারণ অভ্যাস ছিল। ফায়যুল উলূম মাদ্রাসা থেকে বেনারসের জামে‘আ সালাফিইয়াতে আগমন করার পরেও তাঁর দাওয়াতী ও তাবলীগী কার্যক্রম যথারীতি অব্যাহত ছিল।
১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে যখন তিনি প্রিয় জন্মভূমি ভারত হ’তে মদীনা ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের ‘মারকাযু খিদমাতিস সুন্নাহ ওয়াস সীরাহ আন-নাবাবিইয়াহতে’ চলে আসেন, তখন এখানেও তিনি তাঁর দাওয়াতী কার্যক্রম নিয়মিত চালু রাখেন। মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থানকালে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সঊদী আরব শাখার একাধিক অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি হিসাবে নছীহতমূলক বক্তব্য পেশ করেন। বিশেষ করে রিয়াদের ইমাম মুহাম্মাদ বিন সঊদ বিশ^বিদ্যালয়ে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন সঊদী আরব’ শাখা আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি কর্মীদের উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য প্রদান করেন এবং প্রবাসে ‘আন্দোলন’-এর কার্যক্রম যোরদার করার প্রতি সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। বিভিন্ন প্রবাসী দাওয়াহ সেন্টারে তাঁকে সম্মানিত আলোচক হিসাবে আহবান করা হ’ত। তিনি সেসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে প্রবাসী ভাইদের উদ্দেশ্যে বিষয়ভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করতেন। ১৯৯৯ সালে যখন মুবারকপুরী মদীনা থেকে রিয়াদের মাকতাবা দারুস সালামে আসেন তখন এখানেও দাওয়াত ও তাবলীগের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন।[7]
(৮) ছফিউর রহমান মুবারকপুরী ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের মানুষ। তাঁর হৃদয় ছিল অত্যন্ত কোমল। রিযওয়ানুল্লাহ রিয়াযী তাঁর নম্র্তা ও ভদ্রতার একটি ঘটনা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, একবার রামাযানের সময় রিয়াদের দারুস সালাম প্রকাশনা সংস্থার অফিসের নির্ধারিত কাজ শেষে আমার গাড়িতে চড়ে মুবারকপুরী তাঁর জামাইয়ের বাসায় যাচ্ছিলেন। আছরের ছালাতের সময় হয়ে এসেছিল। আমরা এক জায়গায় আছরের ছালাত আদায় করলাম। অতঃপর আমি তাঁকে বললাম, আমি এক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করতে যাব। তিনি বললেন, কোন সমস্যা নেই। আমি সেই ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলাম। তিনি আমার গাড়ীতেই বসেছিলেন। আমার ফিরে আসতে বেশ দেরী হ’ল। যদিও তাঁর জামাইয়ের বাসা খুব দূরে ছিল না। কিন্তু আমার কাঙ্খিত ব্যক্তির সাথে দেখা করে ফিরে আসতে দেরী হওয়ায় তাঁর জামাইয়ের বাসায় পৌঁছতে বেশ দেরী হয়ে গেল। তবুও তিনি আমাকে বকাঝকা করলেন না। ধৈর্যধারণ করে গাড়ীতেই বসে থাকলেন।[8]
(৯) মুবারকপুরীর একটি বড় গুণ ছিল যে, সুখে-দুঃখে তিনি সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল থাকতেন। মুচকি হাসি তাঁর ব্যক্তিত্বের দর্পণ ছিল। তাঁর মাথায় কোন নতুন চিন্তা আসলে ঠোঁটে মুচকি হাসির ঝিলিক দেখা দিত। তিনি যে অফিসে কাজ করতেন বা যে পরিবেশে থাকতেন, সেখানে নিজেও খোশ মেযাজে থাকতেন এবং অপরকেও রাখতেন। তিনি কাজের ফাঁকে এবং অবসর সময়েও আশ-পাশের দায়িত্বশীলদের মজাদার গল্প শুনিয়ে পরিবেশ সরগরম রাখতেন। দারুস সালামে দায়িত্ব পালনের সময় যারা তাঁর সাথে চাকুরী করতেন তাঁদের মধ্যকার জনৈক ব্যক্তি বলেন, ‘যখন আমরা তাঁর সাথে কাজে মশগূল থাকতাম, তখন এক ঘণ্টা বা আধা ঘণ্টা পর তিনি থেমে যেতেন এবং যোরে আওয়ায দিয়ে বলতেন, ‘চুপ থাকার কি মৌসুম শুরু হয়েছে? কিছু কথা হওয়া উচিত’। এরপর তিনি কোন ঘটনা বা কোন মজাদার গল্প শুনাতেন’।[9]
(১০) ছফিউর রহমান মুবারকপুরী ছিলেন খুব সরল ও উদার মনের মানুষ। তিনি রসিকতাও পসন্দ করতেন। একবার দারুস সালাম, রিয়াদের অন্যতম গবেষক ও মুহাক্কিক হাফেয আব্দুল মতীন রাশেদী মুবারকপুরীকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি আপনার জন্য চায়ের অর্ডার করব? হাফেয আব্দুল মতীন রাশেদী কিন্তু তেমন চা পান করতেন না। মুবারকপুরী তাঁর মুখে চায়ের অর্ডার শুনে রসিকতা করে বললেন, ‘যে জিনিস আপনি নিজের জন্য পসন্দ করেন না, তা অন্যের জন্য কেন পসন্দ করেন? চা আপনি নিজে পান করেন না অথচ অন্যকে পান করাতে চান কেন?[10] ঐ শুনুন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাণী, لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ ‘তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার ভাইয়ের জন্য তাই পসন্দ করে, যা নিজের জন্য পসন্দ করে’।[11]
(১১) সিন্ধু প্রাদেশিক জমঈয়তে আহলেহাদীছ-এর সাধারণ সম্পাদক ও করাচী দারুল হাদীছ রহমানিয়ার মুদীর প্রফেসর আব্দুল্লাহ নাছের রহমানী বলেন, ‘আমি ১৯৯৪ সালে হজ্জ পালন করতে গিয়ে মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থানকালে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করার জন্য টেলিফোনে মুবারকপুরীর সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা ব্যক্ত করি। তিনি দ্রুত আমি যে হোটেলে অবস্থান করছিলাম সেখানে চলে আসেন। এ সময় তাঁকে একটি বড় গ্লাসে শরবত পান করতে দেই এবং আমি একটি ছোট গ্লাসে পান করতে শুরু করলে তিনি রসিকতা করে কুরআনের ভাষায় বলতে শুরু করেন,تِلْكَ إِذًا قِسْمَةٌ ضِيزَى ‘এটা তো খুবই অসঙ্গত বণ্টন’ (ছাফ্ফাত ৩৭/২২)।[12]
(১২) মুবারকপুরী ভালো কাজে সুফারিশের ব্যাপারে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। সুফারিশের নিয়ম-নীতির প্রতি দৃষ্টি রেখে যারা তাঁর কাছে সুফারিশের জন্য আসত তাদের সুফারিশের ব্যাপারে তিনি পিছপা হ’তেন না। কোন মাদ্রাসা বা মসজিদ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বা ব্যক্তিগত ব্যাপারে কেউ তাঁর নিকট আসলে তিনি সুফারিশপত্র প্রদান করতেন। শেষ জীবনে যখন তিনি প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন, তখন তিনি নিজের নামসহ সীল মোহর পকেটে রাখতেন। অতঃপর লেটার প্যাডে সুফারিশপত্র লেখা হ’লে তিনি বিশেষভাবে সীল মোহর মেরে স্বাক্ষর করে দিতেন। তাঁর কাছে কেউ তাযকিয়া নিতে আসলে তিনি সেটা পড়ে সংশোধন করতঃ তাতে সীল মেরে স্বাক্ষর করে দিতেন। তিনি ছওয়াবের আশায় ভাল কাজের ব্যাপারে সুফারিশ করতেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিমেণাক্ত হাদীছের প্রকৃত বাস্তবায়নকারী ছিলেন।[13] যেখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,اشْفَعُوا تُؤْجَرُوْا ‘তোমরা সুফারিশ কর, তাহ’লে প্রতিদান লাভ করবে’।[14]
(১৩) ছফিউর রহমান মুবারকপুরী কাউকে উৎসাহ দিতে কার্পণ্য করতেন না। ভাল কাজের ব্যাপারে তিনি অপরকে আন্তরিকতার সাথে উৎসাহ প্রদান করতেন। নতুন লেখকদের মধ্যে এমন আশা থাকে যে, কোন যোগ্য আলেম যেন তার বইয়ের ভূমিকা লিখে দেন বা তাতে বাণী প্রদান করেন। যাতে তার কিতাবের গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। এসব উৎসাহ প্রদানমূলক কাজে মুবারকপুরী ছিলেন অগ্রগামী। রিযওয়ানুল্লাহ রিয়াযী বলেন, একবার আমি ‘গায়রাত কা ফুকদান আওর উসকা ইলাজ’ নামক একটি বই লিখে এতে বাণী প্রদানের জন্য মুবারকপুরীকে অনুরোধ করলাম। তখন তিনি বললেন, ‘কিতাবের একটি পান্ডুলিপি আমাকে দিন। আমি তা পড়ে তাতে কিছু লিখে দেব। তখন আমি একটি পান্ডুলিপি তাঁকে প্রদান করলাম। কিছুদিন পর তিনি মান অনুযায়ী আমার কিতাবে বাণী প্রদান করেছিলেন। যা উক্ত কিতাবের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে।[15]
(১৪) মুবারকপুরী তাঁর নিকট আগত মেহমানদের আপ্যায়নে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। একবার দারুস সালামের তৎকালীন দায়িত্বশীল ক্বারী মুহাম্মাদ ইকবাল মসজিদে নববী যিয়ারতের জন্য মদীনা মুনাওয়ারায় আসেন। তিনি মসজিদে নববীর বাইরে কারো অপেক্ষায় ছিলেন। হঠাৎ সেখান দিয়ে মুবারকপুরী অতিক্রম করেন। তখন তিনি ক্বারী মুহাম্মাদ ইকবালকে দেখে বললেন, আজ আপনাকে অবশ্যই আমার দাওয়াত কবুল করতে হবে। ক্বারী ছাহেব পরিবারসহ ছিলেন। তিনি মুবারকপুরীর দাওয়াত গ্রহণ না করতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মুবারকপুরী তাঁকে সপরিবারে নিজ বাসস্থানে নিয়ে গেলেন এবং খুব ভালোভাবে মেহমানদারী করলেন। সাথে সাথে রাত্রি যাপনেরও সুন্দর ব্যবস্থা করে দিলেন।[16]
(১৫) একবার এক ছাত্র তাঁর মেহমান হয়। হজ্জের সফরে সে তাঁর বাসস্থানে আসে। সফরের কারণে ঐ ছাত্রের কাপড় দুর্গন্ধ থেকে ছড়াচ্ছিল। সে ঘুমালে মুবারকপুরী তার কাপড় ধুয়ে শুকাতে দেন। সকালে ঐ ছাত্র নিজের কাপড়কে ধৌত করা ও শুকনো অবস্থায় পেয়ে হতবাক হয়ে যায়।[17]
(১৬) রিযওয়ানুল্লাহ রিয়াযী বলেন, আমার এক সাথী জনাব জালাল মুহাম্মাদ ক্বাদেরী আমাকে বলেছেন, আমি একবার আমার সাথী মুহাম্মাদ রফীক (কলিকাতা)-কে সাথে নিয়ে মুবারকপুরীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলাম। ঐ সময় তিনি রিয়াদের দারুস সালামে কর্মরত ছিলেন। আমরা তাঁর নিকট পৌঁছলে তিনি আমাদের খুব সম্মান করলেন এবং আমাদের মেহমানদারীর জন্য চা বানাতে লাগলেন। আমরা বললাম, আমরাতো চা পান করি না এবং এর উপর আমরা খুব যিদও করলাম। তখন তিনি বললেন, আজ আপনাদের যিদ ছেড়ে আমাদের চা পানে শরীক হ’তেই হবে। তখন আমি চা তৈরী করতে চাইলে তিনি অনুমতি না দিয়ে নিজেই চা তৈরী করলেন। আমি চায়ের পাত্র ধৌত করলাম। এ কাজ দেখে তিনি নারায হয়ে বললেন, এ কাজ তো আমার, আপনি কেন এটা করলেন? মুবারকপুরীর এমন আচরণে আমরা দু’জন খুবই প্রভাবিত হ’লাম এবং তাঁর মহববতে আমাদের চক্ষু অশ্রুসিক্ত হ’ল। আজ প্রথমবার আমরা কোন আলেমে দ্বীনের
এমন বিনয় ও নিজ হাতে মেহমানদারী দেখলাম।[18]
(১৭) মুবারকপুরী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত পূর্ণরূপে অনুসরণের চেষ্টা করতেন। রিযওয়ানুল্লাহ রিয়াযী বলেন, একবার আমি মুবারকপুরীর জামাতা এনামুল হক রহমানীকে জিজ্ঞেস করলাম, মাওলানা (মুবারকপুরী) খানাপিনায় কী পসন্দ করেন? তিনি জবাবে বললেন, তিনি কদু (লাউ) খেতে খুব পসন্দ করেন। অর্থাৎ যখন থেকে তিনি এ হাদীছ পড়েছেন যে, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কদু খেতে পসন্দ করতেন’[19] তখন থেকে তিনি সুন্নাতের মহববতে কদু খুব পসন্দ করতেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিষ্টি পসন্দ করতেন।[20] এজন্য তিনিও সুন্নাতে নববীর মহববতে খাওয়ার পর মিষ্টি খাওয়া পসন্দ করতেন।[21]
উপসংহার :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবন চরিত রচনা, প্রচার ও বাস্তব জীবনে তা প্রতিষ্ঠার জন্য যারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে বিশ^বরেণ্য আহলেহাদীছ ব্যক্তিত্ব ছফিউর রহমান মুবারকপুরী অন্যতম। তাঁর জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরকে দুনিয়াবী কোন মানুষের আদর্শে নয়, বরং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর স্বচ্ছ জীবন চরিতের আলোকে জীবন গড়তে হবে। তবেই আমরা দোজাহানে সফলতার স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করতে পারব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ার তাওফীক দান করুন- আমীন!
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
[1]. ফাদাওয়া ইয়াসীন ওছমান, জুহূদুশ শায়খ ছফিউর রহমান মুবারকপুরী ফী তাকরীরিল আক্বীদাহ ওয়াদ দিফায়ে আনহা, অপ্রকাশিত মাস্টার্স থিসিস, গাযা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৪৩০ হি./২০০৯ খ্রি., পৃ. ৩-৪।
[2]. আমের মুবারকপুরী, শায়খ ছফিউর রহমান মুবারকপুরী ওয়া মুসাহামাতুহু ফিদ দিরাসাতিল আরাবিইয়াহ, অপ্রকাশিত মাস্টার্স থিসিস, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়, নয়াদিল্লী, ২০০৯ খ্রি., পৃ. ৮৪-৮৫।
[3]. রিযওয়ানুল্লাহ রিয়াযী, আল্লামা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী ইয়াদুঁ কে সফর মেঁ, পৃ. ৫৫, ৫৯-৬০; নূরুল ইসলাম, ‘ছফিউর রহমান মুবারকপুরী’, মাসিক আত-তাহরীক (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১০ম বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা, মার্চ ২০০৭ খ্রি.), পৃ. ২৩।
[4]. আল্লামা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী ইয়াদুঁ কে সফর মেঁ, পৃ. ৬৩।
[5]. ঐ, পৃ. ৫৪।
[6]. ঐ, পৃ. ৫৪।
[7]. ঐ, পৃ. ৯০-১০০; মাসিক আত-তাহরীক, মার্চ ২০০৭, পৃ. ২৩।
[8]. আল্লামা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী ইয়াদুঁ কে সফর মেঁ, পৃ. ৮৪-৮৫।
[9]. ঐ, পৃ. ৮৫।
[10]. ঐ, পৃ. ৮৬।
[11]. বুখারী হা/১৩।
[12]. আল্লামা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী ইয়াদুঁ কে সফর মেঁ, পৃ. ২৮৭; মাসিক আত-তাহরীক, মার্চ ২০০৭, পৃ. ২৬।
[13]. আল্লামা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী ইয়াদুঁ কে সফর মেঁ, পৃ. ৮৭-৮৮।
[14]. বুখারী হা/১৪৩২; মুসলিম হা/২৬২৭।
[15]. আল্লামা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী ইয়াদুঁ কে সফর মেঁ, পৃ. ৮৯।
[16]. ঐ, পৃ. ৯৮।
[17]. ঐ।
[18]. ঐ, পৃ. ৯৮-৯৯।
[19]. মুসলিম হা/২০৪১, ‘পানীয় বস্ত্ত’ অধ্যায়।
[20]. বুখারী হা/৫২৬৮ ।
[21]. আল্লামা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী ইয়াদুঁ কে সফর মেঁ, পৃ. ১১৩।