আবু ইবরাহীম আল-মাযানী বলেন, আমাকে ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন, আমি ইমাম মালেক (রহঃ)-এর নিকট হাদীছ শুনতাম তখন আমার বয়স ছিল ১৪ বছর। একবার ইমাম মালেক (রহঃ)-এর মজলিসে সুফিয়ান ইবনু উয়ায়না, মুসলিম ইবনু খালিদ আয-যানজী (রহঃ) প্রমুখ ইমামগণ উপস্থিত ছিলেন। ইত্যবসরে সেখানে দু’জন ব্যক্তি আসল এবং তাদের একজন বলল, আমি একজন টিয়া পাখি বিক্রেতা। আমি এ লোকটির নিকটে একটি টিয়া পাখি বিক্রি করেছি এবং আমার স্ত্রীর তালাকের শপথ করে বলেছি যে, পাখিটির ডাক কখনো বন্ধ হবে না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর লোকটি এসে জানাল যে, পাখিটি নীরব হয়ে আছে, ডাকছে না। বলে সে পাখিটা ফেরত দিল। সুতরাং আমার শপথ তো ভেঙ্গে গেল। এখন আমি (স্ত্রীর ব্যাপারে) কী করতে পারি? এ কথা শুনে ইমাম মালেক (রহঃ) বললেন, তোমার স্ত্রী তালাক হয়ে গেছে।

ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, ঐ দু’জন লোক বের হয়ে গেলে আমি উক্ত পাখি বিক্রেতাকে ডেকে বললাম, আপনি কিভাবে শপথ করেছিলেন? বিক্রেতা বলল, তুমি যেমনটা শুনেছ। এরপর আমি বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কথার উদ্দেশ্য কি ছিল? পাখিটার ডাক কখনই বন্ধ হবে না, নাকি পাখিটি বেশীর ভাগ সময়েই ডাকবে? লোকটি বলল, পাখিটির ডাক কখনোই বন্ধ হবে না- এটা নয়; বরং আমার কথার উদ্দেশ্য ছিল, পাখিটি বেশির ভাগ সময় ধরে ডাকবে। কারণ আমি তো জানি যে, সে খাবে, পান করবে, ঘুমাবে।

এ কথা শুনে তিনি বললেন, مر فإن امرأتك لك حلال ‘তুমি তোমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নাও। নিশ্চয়ই সে তোমার জন্য হালাল’। (বিস্মিত হয়ে) বিক্রেতা বলল, কিভাবে এটা সম্ভব যেখানে ইমাম মালেক (রহঃ)-এর বিপরীত ফৎওয়া দিয়েছেন! তখন আমি বললাম, তুমি ফিরে যাও এবং তাঁকে বলবে, আপনার মজলিসে একজন ব্যক্তি বলেছে আমার স্ত্রী হালাল। তারপর আমার দিকে ইঙ্গিত করবে।

লোকটি ফিরে গেলে ইমাম মালেক (রহঃ) বিক্রেতাকে বললেন, এ ব্যাপারে আমি তো তোমাকে ফৎওয়া দিয়েছি! বিক্রেতা বলল, আপনার মজলিসের একজন ব্যক্তি বলেছেন, আমার স্ত্রী হালাল। আমার মজলিসের কেউ বলেছে! লোকটি তখন আমার দিকে ইঙ্গিত করলে ইমাম মালেক (রহঃ) বললেন, তুমি এটা কেমন ফৎওয়া দিলে?

আমি বললাম, আমি তো আপনার নিকটে ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে ফাতেমা বিনতু কায়েস (রাঃ) সম্পর্কে একটি হাদীছ শুনেছি। সে হাদীছের আলোকেই আমি এই ফৎওয়া দিয়েছি। যেখানে এসেছে ফাতেমা তার স্বামী আবূ আমর ইবনু হাফস (রাঃ) কর্তৃক তালাক্বপ্রাপ্তা হ’লে রাসূল (ছাঃ) তাকে ইদ্দত পালনের নির্দেশ দিলেন। সে ইদ্দত পালন শেষে রাসূল (ছাঃ)-কে জানাল আমাকে মু‘আবিয়া ও আবু জাহম বিবাহের পয়গাম পাঠিয়েছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ফাতিমা বিনতে কায়স (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,أَمَّا أَبُو جَهْمٍ، فَلَا يَضَعُ عَصَاهُ عَنْ عَاتِقِهِ، وَأَمَّا مُعَاوِيَةُ فَصُعْلُوكٌ لَا مَالَ لَهُ، انْكِحِي أُسَامَةَ بْنَ زَيْدٍ ‘আবু জাহম তো তার কাঁধ থেকে লাঠিই নামায় না। মু‘আবিয়া সে তো অভাবী। তার কোন সম্পদ নেই। তুমি বরং উসামা বিন যায়েদকে বিবাহ করো’।[1]

হাদীছটি শুনে ইমাম মালেক বললেন, তাতে কী হয়েছে? এতে তোমার ফৎওয়ার প্রমাণ কোথায়? তখন আমি বললাম, ‘আবু জাহম তাঁর কাঁধ থেকে লাঠি নামান না’- এ কথার অর্থ বেশির ভাগ সময় তিনি সফর করে। তিনি অবশ্যই এর মাঝে কোথাও না কোথাও ঘুম ও বিশ্রাম নিতেন। কাজেই যেহেতু তাঁর বেশীর ভাগ সময় সফরেই অতিবাহিত হয়, তাই বলা হয়েছে যে, তিনি লাঠিই নামান না। আর আরবদের মধ্যে এ ধরনের কথার ব্যবহার বহুলভাবে প্রচলিত।

সুতরাং পাখিটি যদি দিনের বেশির ভাগ সময়ে ডাক দিয়ে থাকে, তবে অবশ্যই ধরে নিতে হবে যে, পাখিটি সব সময়ই ডাকে। এ কথা শোনে ইমাম মালেক (রহঃ) আশ্চর্যান্বিত হ’লেন এবং মুচকি হেসে বললেন, القول قولك ‘তোমার কথাই সঠিক’। মুসলিম ইবনু খালিদ আয-যানজী (রহঃ) আমার দুই কাঁধের মাঝখানে হাত রেখে বললেন,أفت فقد آن لَك أَن تفتى ‘তুমি ফৎওয়া দাও। তোমার ফৎওয়া দেওয়ার সময় হয়েছে’।[2] এ সময় ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর বয়স ছিল ১৪ বছর আর ইমাম মালেক (রহঃ)-এর বয়স ছিল ৭১।

শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কোন বিষয়ে ফৎওয়া দেয়ার পর পরবর্তীতে তা ভুল প্রমাণ হ’লে বা তার চেয়ে অধিকতর গ্রহণযোগ্য কোন ফৎওয়া পাওয়া গেলে তা নির্দ্বিধায় মেনে নিতে হবে। এতে কোন প্রকার গোঁড়ামি করা যাবে না। এটাই সালাফদের নীতি।

২. ফৎওয়া প্রদানের ক্ষেত্রে কেবল বয়স ও অভিজ্ঞতা শর্ত নয়। আল্লাহ তা‘আলা যে কারোর মধ্যে যে কোন বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ইলহাম করতে পারেন।

৩. একজন মানুষ তার পসন্দমত একাধিক বিদ্বানের নিকটে ফৎওয়া নিয়ে আমল করতে পারেন। নির্দিষ্ট ইমামের সব মাসআলা অনুসরণ করতে হবে বলে যে ধারণা সমাজে প্রচলিত আছে, উপরোক্ত ঘটনাটি তার অসারতা প্রমাণ করে।

৪. বিদ্বানদের মধ্যে হাদীছের ব্যাখ্যাগত বা বুঝগত মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক।


[1]. মুসলিম হা/১৪৮০

[2]. ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশক ৫১/৩০৪; সালাহুদ্দীন খলীল ছাফাদী, আল-ওয়াফী বিল ওয়াফিয়াত ২/১২২।






আরও
আরও
.