(১) মরক্কোর রাষ্ট্রীয় শিক্ষা বিভাগের সাবেক সদস্য ও বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বপালনকারী প্রফেসর আব্দুল হাদী আত-তাযী (১৯২১-২০১৫ খ্রি.) বলেন, ‘শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী যখন মরক্কো সফরের ইচ্ছা করলেন, তখন আমি তাঁকে রাষ্ট্রীয় আতিথ্য দানের ব্যাপারে বাদশাহ হাসান (২) -এর সাথে আলাপ করলাম। তাঁর নিকটে আলবানীর মর্যাদা ও ইলমী অবস্থান তুলে ধরলাম। ফলে বাদশাহ তাঁর জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় তিনটি গাড়ির বহর ও পাঁচ তারকা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় গ্রন্থ সংরক্ষণাগারে সংরক্ষিত পান্ডুলিপির ভান্ডার তাঁর ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করার নির্দেশ দিলেন। আমি অত্যন্ত খুশী হয়ে বাদশাহকে এরূপ ব্যবস্থা করার জন্য ধন্যবাদ জানালাম। তারপর আলবানীর সাথে যোগাযোগ করে তাঁকে এই সুসংবাদ শুনালাম।

কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে তিনি এতে অসন্তুষ্ট ও রাগান্বিত হ’লেন এবং রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগার ব্যবহারের বিষয়টি ব্যতীত সকল রাষ্ট্রীয় মর্যাদা গ্রহণে অস্বীকার করলেন। অতঃপর বললেন, যদি আপনি আমাকে সম্মান জানাতে চান, তবে আপনার নিজস্ব গাড়িটি আমাকে দিবেন। আর আমি সফরকালে শহরের কয়েকজন শায়খের সান্নিধ্যে অবস্থান করব।

প্রফেসর তাযী বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। বাদশাহর নিকটে এখন আমি কি ওযর পেশ করব? কি বলব তাঁকে? তারপর বাদশাহর সাথে যোগাযোগ করে বললাম যে, আলবানী আপনার প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আতিথেয়তা গ্রহণে ওযর পেশ করেছেন। বাদশাহ বিস্মিত হয়ে বললেন, অস্বীকৃতি জানিয়েছেন! আমি বললাম, অস্বীকৃতি নয়, তবে...। বাদশাহ আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, না কোন অসুবিধা নেই। তিনি সত্যিই একজন ঈমানদার আলিম। এ ঘটনার ফলে আলবানীর প্রতি আমার ভালোবাসা যোজন যোজন বৃদ্ধি পায়’।[1]

(২) একবার আলবানী জর্দানের মাফরাক শারকী শহরের শুওয়াইকা এলাকায় আয়োজিত একটি শিক্ষা সেমিনারে আলোচনা পেশ করার জন্য গমন করলে তাঁর বক্তব্যের পূর্বে স্থানীয় বিদ্বান প্রফেসর ইবরাহীম স্বাগত ভাষণে বলেন, ‘...এক্ষণে আমরা আমাদের শায়খ, আলিম ও মহান শিক্ষাগুরু মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানীর সাথে মিলিত হব এবং সুন্দর একটি সময় অতিবাহিত করব। আমি শুওয়াইকা এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বিশেষত এখানকার শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে তাঁকে স্বাগত জানাচ্ছি। যাদের সকলেই আজকের এ দিনটি সম্মানিত উস্তাদের সাথে কাটাতে এবং তাঁর ‘ইলম ও হিকমতের মণি-মুক্তা থেকে কিছু শ্রবণের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে’। 

অতঃপর আলবানী তাঁর বক্তব্য শুরু করেন এবং হামদ ও ছানা পাঠের পর বলেন, ‘প্রিয় ভাই প্রফেসর ইবরাহীমকে তাঁর বক্তব্য ও স্ত্ততিবাদের জন্য ধন্যবাদ। এরূপ ক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ)-এর পর ইসলামের প্রথম খলীফা আবূ বকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর অনুসরণ ব্যতীত আমার কিছুই বলার নেই। যখন তিনি কাউকে তাঁর উত্তম প্রশংসা করতে শুনতেন। আমার মনে হয় বিশেষত যখন কেউ তাঁর ব্যাপারে প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করে ফেলত, যদিও তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর যথার্থ প্রতিনিধি ছিলেন, এতদসত্ত্বেও... (একথা বলে আলবানী কেঁদে ফেলেন এবং ক্রন্দনের আধিক্যে অল্পক্ষণের জন্য বক্তব্য বন্ধ হয়ে যায়) তিনি বলতেন,اللَّهُمَّ لَا تُؤَاخِذْنِيْ بِمَا يَقُوْلُوْنَ وَاغْفِرْ لِيْ مَا لَا يَعْلَمُوْنَ ‘হে আল্লাহ তারা যা বলছে সে ব্যাপারে তুমি আমাকে পাকড়াও করো না। তুমি আমাকে তাদের ধারণার চেয়ে উত্তম বানাও এবং আমার যেসব পাপ সম্পর্কে তারা জানে না, তা ক্ষমা করে দাও’।[2] আলবানী বলেন মহান সত্যবাদী আবূবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) যখন এমনটি চলতেন তখন আমরা কিইবা বলতে পারি? 

আমি সত্যিই বলছি। একটু আগে আমার সম্মানিত ভাই ইবরাহীমের নিকট থেকে যা শুনলাম, আমি সে গুণের অধিকারী নই। আমি কেবল ইলম অন্বেষণকারী। এর বেশী কিছু নই। আর প্রত্যেক অন্বেষণকারীর উচিত রাসূল (ছাঃ)-এর ঐ বাণীর অনুসারী হওয়া, যেখানে তিনি বলেছেন, ‘তুমি আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হ’লেও তা প্রচার কর’।[3]

(৩) রিয়াদের দারুছ ছুমাই‘ঈর প্রধান আব্দুল্লাহ ইবনু হাসান আছ-ছুমাই‘ঈ বলেন, ‘শায়খ আলবানী বাদশাহ ফয়ছাল পুরস্কার লাভের পর আমি খুবই আনন্দিত হয়ে তাকে স্বাগত জানানোর জন্য গেলাম। তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহ আপনাকে আরো কল্যাণের সুসংবাদ দিন! আপনি আল্লাহর নিকটে দো‘আ করুন! তিনি যেন আমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশের সুসংবাদ দান করেন’।[4]

(৪) শায়খ ঈদ আববাসী বলেন, ‘দাওয়াতী সফর, শিক্ষাদান বা কারো সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সঊদী আরব ও জর্দানের বিভিন্ন শহরে আমরা তাঁর সাথী হয়েছি। সেক্ষেত্রে গাড়ির প্রয়োজন হ’লে তিনি তাতে গ্যাস ভরে নিতেন এবং নিজে তাঁর মূল্য পরিশোধ করতেন। আমরা তাঁর আগেই তা পরিশোধের চেষ্টা করলে তিনি অনুমতি দিতেন না। বরং বলতেন, যানবাহনের খরচ আমার উপরেই ছেড়ে দাও। এ সফরটি যেন শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য ও তাঁর দ্বীনের খিদমতে কবুলযোগ্য হয়’।[5] 

(৫) একদিন জনৈক ছাত্র শায়খ আলবানীর একটি ভুল ধরিয়ে দিলে তিনি তার জন্য দো‘আ করে বললেন, ‘এর জন্য আল্লাহ তোমাকে উত্তম জাযা দান করুন এবং আমাদের পারস্পরিক মহববতকে এমন মহববতে পরিণত করুন, যা পরস্পরকে উপদেশ প্রদান এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম হয়। কেননা অনেক মানুষ অপরকে বলে থাকে যে, আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। কিন্তু যখনই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সে কোন দোষ-ক্রটি করে ফেলে, তখন তাকে দূরে ঠেলে দেয় ও তার মর্যাদাহানি করে। এটা কখনোই ‘আল্লাহর জন্য ভালোবাসা’র নিদর্শন নয়। বরং যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পরকে উপদেশ দেওয়া হবে তখনই তা প্রকৃত ভ্রাতৃত্ব বলে গণ্য হবে। সুতরাং যখন তুমি আমার কোন ভুল-ত্রুটি দেখবে, তখন অবশ্যই আমাকে সংশোধন করে দিবে’।[6] তিনি বলতেন,السَّعيد من وُعظ بغيره ‘সৌভাগ্যবান সেই যে অন্যের দ্বারা উপদেশ প্রাপ্ত হয়’।

(৬) জনৈক ব্যক্তি শায়খ আলবানীকে তাখরীজের ক্ষেত্রে তাঁর যেসব ভুল হয়েছে এবং পরবর্তীতে সংশোধন করেছেন সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘যদি তুমি জিজ্ঞেস কর যে, আলবানী কি তাঁর কোন কিতাবে ভুল করেছেন এবং পরে তা শুদ্ধ করেছেন? তাহ’লে আমি স্বীকার করব যে, সেখানে আমি কিছু ভুল করেছিলাম। পরে তা শুদ্ধ করেছি। কেননা ইমাম শাফেঈ বলেছেন, أبي الله أن يتم إلا كتابه، بس كتاب الله هو التمام- ‘আল্লাহ তাঁর নিজের কিতাব ব্যতীত অন্য কোন কিতাব পূর্ণাঙ্গ হওয়াকে অস্বীকার করেছেন। সুতরাং কেবলমাত্র আল্লাহর কিতাবই পূর্ণাঙ্গ’।

(৭) আরেকদিন এক যুবক তাঁকে সালাম দিয়ে বলল, হে শায়খ! আমি শরী‘আ অনুষদের ছাত্র। আমাদের কয়েকজন ডক্টরেট ডিগ্রীধারী শিক্ষক আপনার সমালোচনা করেন ও কটূ কথা বলেন। বিশেষত অমুক অমুক ব্যক্তি। জবাবে আলবানী বললেন, ‘হে ভাই! কোন ব্যক্তির মিথ্যা বলার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে যাই শ্রবণ করে, তাই সে মানুষের নিকট বলে বেড়ায়। অতএব জ্ঞানার্জনের সুযোগ পেলে তা কাজে লাগাও এবং তোমার দ্বীনী উপকারে আসতে পারে এমন কিছু জানার থাকলে প্রশ্ন কর!’ [7]

(৮) হিন্দুস্থানী বিদ্বান শায়খ হাবীবুর রহমান আ‘যমী শায়খ আলবানীর বিরুদ্ধে ‘আল-আলবানী : শুযূযুহূ ওয়া আখত্বাউহূ’ নামে একটি বই রচনা করেছিলেন। যেখানে আলবানীর বিরুদ্ধে অনেক অসত্য বিবরণ ও নিন্দাবাদ করা হয়েছে। একবার শায়খ আ‘যমী সিরিয়া সফরে এসে দামিশকে গমন করেন এবং আলবানীর আতিথেয়তায় তাঁর বাসায় কয়েকদিন অবস্থান করেন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আলবানী (রহঃ) মেহমানের সম্মান, বয়োজ্যেষ্ঠতা এবং তাঁর প্রতি সুধারণাবশত উক্ত বইয়ের ব্যাপারে কিছুই বলেননি। অতঃপর শায়খ আ‘যমী সিরিয়ার হালবে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে আলবানী নিজ গাড়ীতে তাঁকে রেখে আসেন। এসময় শায়খ ঈদ আববাসী ও প্রফেসর আলী খাশানও তাদের সাথী হন। চলার পথে তাঁরা শায়খ আ‘যমীর নিকটে বিরোধপূর্ণ বিভিন্ন মাসআলা সম্পর্কে জানতে চান। কিন্তু সকল প্রশ্নে তাঁর উত্তর ছিল, শায়খ আলবানীকে জিজ্ঞেস করুন। অতঃপর এক পর্যায়ে বললেন, ইমাম মালিক তো মদীনায় উপস্থিত, তাই তিনি ফৎওয়া দিবেন না (অর্থাৎ আলবানী যেখানে উপস্থিত রয়েছেন, সেখানে তাঁর জন্য ফৎওয়া দেয়া ঠিক হবে না)। অতঃপর আলবানী সেগুলোর জবাব দেওয়া শুরু করলেন। আর তিনি প্রত্যেক উত্তরে কেবল মাথা নাড়িয়ে বলছিলেন, হ্যাঁ তিনি সঠিক বলেছেন।[8] 

(৮) মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আক্বীদা বিভাগের সাবেক প্রধান শায়খ ছালিহ আস-সুহাইমী একদা বাদ ফজর মসজিদে নববীতে দরস প্রদানকালে বলেন, শায়খ আলবানীর মৃত্যুর দু’মাস পূর্বে আমি তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। এসময় প্রতি দু’সপ্তাহ অন্তর তাঁর রক্ত কণিকা পরিবর্তন করতে হ’ত। তবে তাঁর মস্তিস্ক সতেজ ছিল। আমাকে দেখে আলবানী বললেন, সে কি ঐ ব্যক্তি যে আমার সাথে শনিবারে ছিয়াম পালন ও মসজিদে একাধিক জামা‘আত বিষয়ে বিতর্ক করেছিল? আমি বললাম, হ্যঁা শায়খ! তবে আমি এখনো ঐ দু’টি বিষয়ে আমার সিদ্ধান্তের উপরেই রয়েছি। তখন আলবানী আমার হাত ধরলেন। আজো পর্যন্ত আমি তার সেই ধরা হাতটির কথা স্মরণ করি। (ঘটনা এ পর্যন্ত বলে শায়খ সুহাইমী কেঁদে ফেলেন)। অতঃপর আলবানী আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, জ্ঞানান্বেষীরা এরূপই হয়ে থাকে। তুমি কখনো আমার বা অন্য কারো তাক্বলীদ করো না।[9]  


[1]. শায়খ হানী আল-হারেছীর নিকট সংরক্ষিত প্রফেসর আব্দুল হাদী আত-তাযীর রেকর্ডকৃত বক্তব্য থেকে গৃহীত। ওয়েবলিংক-http://alqaryooti.com/?p=833.

[2]. আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৭৬১।

[3]সিলসিলাতুল হূদা ওয়ান নূর, ৬৪০-৬৪২ নং টেপ, আবূ লাইলা আছারী কর্তৃক রেকর্ডকৃত।

[4]আল-আলবানী, ছহীহ মাওয়ারিদিয যামআন ইলা যাওয়াইদি ইবনি হিববান, পৃ. ৩।

[5]. নূরুদ্দীন তালিব, মাক্বালাতুল আলবানী, পৃ. ১৭৬।

[6]. সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, অডিও রেকর্ড নং ৮২/৩:৭, https://live.islamweb.net/audio/index.php?page=audioinfo&audioid=117570.

[7]. ইছাম মূসা হাদী, মুহাদ্দিছুল ‘আছর ইমাম মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আল-আলবানী কামা ‘আরাফতুহূ, পৃ. ২০।

[8]মুহাম্মাদ বাইয়ূমী, আল-ইমাম আল-আলবানী হায়াতুহু, দা‘ওয়াতুহু ওয়া জুহূদুহু ফী খিদমাতিস সুন্নাহ, পৃ. ১৮৪-৮৫।

[9]https://www.ajurry.com/vb/showthread.php?t=22996





আরও
আরও
.