ভূমিকা :

মহান আল্লাহর নিকট মনোনীত দ্বীন হচ্ছে ইসলাম। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। এই প্রচার ও প্রসারের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে দাওয়াত। সুষ্ঠু সমাজ বিনির্মাণে দাওয়াতের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তা‘আলার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা-وَلْتَكُنْ مِّنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُوْنَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ- ‘আর তোমাদের মধ্যে একটা দল থাকা চাই, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করবে ও অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। বস্ত্ততঃ তারাই হ’ল সফলকাম’ (আলে ইমরান ৩/১০৪)

বর্তমান সমাজ ক্রমশঃ এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ অপসংস্কৃতি জেঁকে বসেছে। ন্যায়-নীতি এখানে বিলুপ্ত প্রায়। যুলুম-অত্যাচার, গুম, হত্যা, লুণ্ঠন প্রভৃতি পাপাচারের বিষবাষ্পে জাতি আজ দিশেহারা। এক্ষণে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির কোপানল থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হ’লে দাওয়াতের ব্যাপক প্রসারে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আলোচ্য নিবন্ধে দাওয়াতের গুরুত্ব ও দাঈ তথা দাওয়াত দানকারীর গুণাবলী সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করা হ’ল।-

দাওয়াতের সংজ্ঞা :

আরবীতে ‘দাওয়াত’ (اَلدَّعْوَةُ) শব্দটি মাছদার বা ক্রিয়ামূল। যার অর্থ ডাকা। যেমন-

النِّدَاءُ বা আহবান করা। আল্লাহ বলেন, يَوْمَ يَدْعُوْكُمْ فَتَسْتَجِيبُوْنَ بِحَمْدِهِ ‘সেদিন তিনি তোমাদেরকে আহবান করবেন, অতঃপর তোমরা তাঁর প্রশংসা করতে করতে চলে আসবে’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৫২)

তিনি আরো বলেন,أُجِيْبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ ‘যখন আমাকে ডাকা হয়, তখন আমি তার ডাকে সাড়া দেই’ (বাক্বারাহ ২/১৮৬)

দাওয়াতের পারিভাষিক অর্থ :

ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেন,الدعوة إلى الله هي الدعوة إلى الإيمان به وما جاءت به رسله بتصديقهم فيما أخبروا به وطاعتهم فيما أمروا- ‘আল্লাহর দিকে দাওয়াত হচ্ছে, আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসূলগণ যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি বিশ্বাস  স্থাপন,  তাঁরা  যেসব বিষয়ে সংবাদ দিয়েছেন সেসব

সত্য বলে স্বীকার এবং যেসব তাঁরা আদেশ দিয়েছেন সেসব বিষয়ে তাদের আনুগত্য করার দিকে আহবান জানানো।[1]

শায়খ খিজির হুসাইন বলেন, حث الناس على الخير والهدى والأمر بالمعروف والنهي عن المنكر ليفوزوا بسعادة العاجل والآجل- ‘মানুষকে কল্যাণ, হেদায়াত, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের প্রতি উৎসাহিত করা’।[2]

শায়খ মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন বলেন, هي دعوة إلى مكارم الأخلاق، ومحاسن الأعمال، وحفظ الحقوق، وإقامة العدل بين الناس بإعطاء كل ذي حق حقه وتنزيله من المنازل ما يستحقه، فترتفع العقائد الكاملة والأحكام الشرعية، وتزهق العقائد الباطلة والقوانين الجاهلية والأحكام الوضعية- ‘এটা হচ্ছে উত্তম চরিত্র, সৎ আমল, হক সংরক্ষণ এবং প্রাপকের যথাযথ হক ও যথোপযুক্ত মর্যাদা দানের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ইনছাফ বা ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠার দিকে আহবান জানানো। যাতে পূর্ণাঙ্গ আক্বীদা ও শরী‘আতের বিধি-বিধান উন্নত ও প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বাতিল আক্বীদা, জাহেলী নিয়ম-কানূন ও নিকৃষ্ট বিধান সমূহ দূরীভূত হয়’।

সমাজ সংস্কারে দাওয়াতের অপরিহার্যতা :

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবের সামাজিক জীবন যেমন অনাচার, পাপাচার, দুর্নীতি, কুসংস্কার, অরাজকতা, ঘৃণ্য আচার-অনুষ্ঠান এবং নিন্দনীয় কার্যকলাপে পরিপূর্ণ ছিল, তেমনি বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাও আমাদেরকে আইয়ামে জাহেলিয়াতের সেই বর্বর সমাজচিত্রের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই জাহেলিয়াতের মূলোৎপাটনের জন্যই আল্লাহ তা‘আলা মানবতার মুক্তির দূত হিসাবে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে প্রেরণ করেন। তিনি এসে মানব সমাজকে আল্লাহর নির্দেশিত পথের দিকে আহবান করেন এবং জাহেলিয়াতের ঘোর অমানিশা থেকে মানুষকে রক্ষা করেন। আল্লাহ বলেন, كَمَا أَرْسَلْنَا فِيْكُمْ رَسُوْلًا مِنْكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيْكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُمْ مَالَمْ تَكُوْنُوْا تَعْلَمُوْنَ- ‘যেমন আমরা তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য একজন রাসূল প্রেরণ করেছি, যিনি তোমাদের নিকটে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করে শুনান। আর যিনি তোমাদের পবিত্র করেন এবং তোমাদেরকে কিতাব ও সুন্নাহ শিক্ষা দেন। তোমাদেরকে এমন সব বিষয় শিক্ষা দেন, যা তোমরা জানতে না’ (বাক্বারাহ ২/১৫১)

দাওয়াত দানের নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, وَادْعُ إِلَى رَبِّكَ وَلاَ تَكُوْنَنَّ مِنَ الْمُشرِكِيْنَ- ‘তুমি তোমার পালনকর্তার দিকে (মানুষকে) আহবান করো। আর তুমি অবশ্যই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হবে না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৭)। তিনি আরো বলেন,قُلْ هَذِهِ سَبِيْلِيْ أدْعُو إلَى اللهِ عَلَى بَصِيْرَةٍ أنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِيْ وَسُبْحَانَ اللهِ وَمَا أنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ- ‘হে নবী বলুন! এটিই আমার পথ। আমি এবং আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর পথে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে (সুস্পষ্ট দলীল সহকারে)। আল্লাহ মহা পবিত্র। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (ইউসুফ ১২/১০৮)।

অন্যত্র আল্লাহ বলেন,يَأيُّهَا النَّبِيُّ إنَّا أرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَّمُبَشِّرًا وَّنَذِيْرًا وَّدَاعِيًا إلَى اللهِ بِإذْنِهِ وَسِرَاجًا مُّنِيْرًا- ‘হে নবী! আমরা তোমাকে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর পথে দাওয়াত দানকারী হিসাবে ও উজ্জ্বল প্রদীপ রূপে’ (আহযাব ৩৩/৪৪-৪৫)।

আমাদের সমাজও আজ জাহেলী যুগের ন্যায় অন্ধকারের অতল গহবরে নিমজ্জিত। মানব রচিত কোন তন্ত্র-মন্ত্র দিয়ে তমসাচ্ছন্ন এই সমাজকে রক্ষা করা আদৌ সম্ভব নয়। একমাত্র বিশ্ব সংস্কারক মুহাম্মাদ (ছাঃ) প্রদর্শিত পন্থায় দাওয়াত দানের মাধ্যমেই এই সমাজের উত্তরণের পথ উন্মোচিত হ’তে পারে। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নির্দেশিত পদ্ধতিতে মানবতাকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আহবান করতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,بَلِّغُوْا عَنِّىْ وَلَوْ آيَةً، وَحَدِّثُوْا عَنْ بَنِى إِسْرَائِيلَ وَلاَ حَرَجَ، وَمَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ- ‘আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত জানা থাকলেও তোমরা তা পৌঁছিয়ে দাও। আর বনী ইসরাঈলের কাহিনী বর্ণনা কর তাতে কোন দোষ নেই। তবে যে ব্যক্তি আমার উপর ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যারোপ করল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে নির্ধারিত করে নিল’।[3]

মুসলিম উম্মাহর উপর দাওয়াত দানের আবশ্যকতা :

পবিত্র কুরআনের অমিয় বাণী,يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ- ‘হে রাসূল! তোমার প্রতি তোমার প্রভুর পক্ষ হ’তে যা নাযিল হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন), তা মানুষের কাছে পৌঁছে দাও। যদি না দাও, তাহ’লে তুমি তাঁর রিসালাত পৌঁছে দিলে না’ (মায়েদাহ ৫/৬৭)

মহানবী (ছাঃ)-এর অবর্তমানে দাওয়াতের এই গুরুভার তাঁর উম্মতের উপর অর্পিত হয়েছে। সেকারণ এ মহান দায়িত্বে অবহেলা করা চলবে না, বরং তা পালন করতে হবে যথাযথভাবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَّمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَّمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيْمَانِ. ‘তোমাদের কেউ অন্যায় কাজ দেখলে সে যেন তা হাত দ্বারা প্রতিহত করে। যদি এটা তার দ্বারা সম্ভব না হয়, তাহ’লে মুখ দ্বারা বাধা দিবে, তাও সম্ভব না হ’লে অন্তর দ্বারা (তাকে ঘৃণা করবে)। আর এটাই হ’ল দুর্বলতম ঈমান’।[4]

আল্লাহর পথে দাওয়াতের গুরুত্ব ও ফযীলত :

আল্লাহর পথে দাওয়াতের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ বলেন,

وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلاً مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَّقَالَ إِنَّنِيْ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ، وَلاَ تَسْتَوِى الْحَسَنَةُ وَلاَ السَّيِّئّةُ ادْفَعْ بِالَّتِىْ هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِيْ بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيْمٌ.

‘ঐ ব্যক্তির কথার চেয়ে কার কথা উত্তম হ’তে পারে, যে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে যে, নিশ্চয়ই আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত। সৎকর্ম ও অসৎকর্ম কখনো সমান নয়। প্রত্যুত্তর নম্রভাবে দাও, দেখবে তোমার শত্রুও অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে পরিণত হয়েছে’ (হা-মীম সাজদা ৪১/৩৩-৩৪)।

উপরোক্ত আয়াতে দাওয়াতের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। এর ফলে পারস্পরিক শত্রুতা দূরীভূত হয় এবং বন্ধুত্ব ফিরে আসে। একে অপরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসা সৃষ্টি হয়। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,ثُمَّ كَانَ مِنَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَتَوَاصَوْا بَالصَّبْرِ وَتَوَاصَوا بِالْمَرْحَمَةِ، أُوْلَئِكَ أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ. ‘অতঃপর (আল্লাহর নৈকট্য তারাও লাভ করতে পারে) যারা ঈমান আনে এবং পরস্পরে ধৈর্যের উপদেশ দেয় এবং পরস্পরে দয়ার উপদেশ দেয়। তারাই হ’ল ডানপন্থী, তারাই সফলকাম’ (বালাদ ৯০/১৭)। অত্র আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মানুষ দাওয়াতের মাধ্যমে ঈমানদার হয়, ধৈর্যশীল হয় এবং পরস্পর দয়া ও করুণা করতে শিখে, যা মানব সমাজে খুবই প্রয়োজন। আল্লাহ আরো বলেন,وَالْعَصْرِ، إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِيْ خُسْرٍ، إِلاَّ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوْا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَصَوْا بِالصَّبْرِ. ‘কালের শপথ! নিশ্চয়ই মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে নিপতিত। তবে তারা ব্যতীত, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, পরস্পরকে হকের উপদেশ দেয় এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দেয়’ (আছর ১০৩/১-৩)। আল্লাহ তা‘আলা এখানে হক-এর দাওয়াত দিতে বলেছেন। আর হক-এর দাওয়াত দিতে গিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হ’লে ধৈর্যধারণ করতে বলেছেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

مَنْ سَنَّ فِي الإِسْلاَمِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهُ أَجْرُهَا وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا مِنْ غَيْرِ أَنْ يُّنْقَصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئٌ وَمَنْ سَنَّ فِيْ الإِسْلاَمِ سُنَّةً سَيِّئَةً كَانَ عَلَيْهِ وِزْرُهَا وَوِزْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا مِنْ بَعْدِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يُّنْقَصَ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَيْئٌ.

‘যে ব্যক্তি (দাওয়াতের মাধ্যমে) ইসলামের একটি উত্তম সুন্নাত চালু করবে সে তার নেকী পাবে এবং ঐ সুন্নাতের প্রতি মানুষ আমল করে যত নেকী পাবে, তাদের সমপরিমাণ নেকী তার আমলনামায় লেখা হবে। তবে তাদের কারো নেকী কম করা হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইসলামে কোন মন্দ আমল চালু করবে, সেজন্য তার পাপ রয়েছে। আর ঐ মন্দ আমল করে যত লোক যে পরিমাণ পাপ অর্জন করবে সবার সমপরিমাণ পাপ তার আমলনামায় লেখা হবে। তবে তাদের কারো পাপ এতটুকুও কম করা হবে না’।[5]

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ أُجُوْرِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا-

‘যে ব্যক্তি হেদায়াতের দিকে আহবান করবে তার জন্য তার অনুসারী ব্যক্তিদের সমপরিমাণ নেকী রয়েছে। কিন্তু তাদের নেকী থেকে বিন্দু পরিমাণও হ্রাস করা হবে না। অপরদিকে যে ব্যক্তি ভ্রষ্টতার দিকে আহবান করবে তার জন্য তার অনুসারী ব্যক্তিদের সমপরিমাণ পাপ রয়েছে। কিন্তু তাদের পাপ থেকে বিন্দু পরিমাণও হ্রাস করা হবে না’।[6] অন্য বর্ণনায় এসেছে,

عَنْ أَبِىْ مَسْعُوْدٍ الأَنْصَارِىِّ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ إِنِّى أُبْدِعَ بِى فَاحْمِلْنِى فَقَالَ مَا عِنْدِى فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللهِ أَنَا أَدُلُّهُ عَلَى مَنْ يَحْمِلُهُ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ.

আবু মাসঊদ আল-আনছারী (রাঃ) বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বলল, আমার সওয়ারী ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাকে একটি সওয়ারী দান করুন। তিনি বললেন, সওয়ারী আমার কাছে নেই। এক ব্যক্তি বলল, হে আললাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি তাকে এমন লোকের কথা বলে দিতে পারি, যে তাকে সওয়ারীর পশু দিতে পারবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘যে ব্যক্তি কল্যাণের দিকে পথ দেখায় তার জন্য কল্যাণকর কাজ সম্পাদনকারীর সমপরিমাণ পুরস্কার রয়েছে’।[7]

দাওয়াত দানের পদ্ধতি :

দাওয়াত দানের পদ্ধতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ- ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক কর সুন্দর পন্থায়’ (নাহল ১৬/১২৫)

এ আয়াতে দাওয়াতের তিনটি পদ্ধতি উল্লিখিত হয়েছে। যথা-

(১) হিকমত তথা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক দাওয়াত দেওয়া। (২) উত্তম উপদেশ দেওয়া। (৩) উত্তম পন্থায় বিতর্ক করা।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, দ্বীনের দাওয়াত দিতে হবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে। প্রথমে তাওহীদের প্রতি মানুষকে আহবান করতে হবে। কেননা ইসলামের মূল ভিত্তি হচ্ছে তাওহীদ। পরে ইসলামের যাবতীয় বিধান সম্পর্কে ছহীহ সুন্নাহর আলোকে মানুষকে দাওয়াত দিতে হবে। হাদীছে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رضى الله عنهما أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم بَعَثَ مُعَاذًا رضى الله عنه إِلَى الْيَمَنِ فَقَالَ ادْعُهُمْ إِلَى شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَأَنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ، فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوْا لِذَلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللهَ قَدِ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِيْ كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ، فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوْا لِذَلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً فِيْ أَمْوَالِهِمْ، تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ وَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ-

ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) মু‘আয (রাঃ)-কে ইয়ামান দেশে (শাসক হিসাবে) প্রেরণ করেন। এ সময় তাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘সেখানকার অধিবাসীদেরকে এ সাক্ষ্য দানের প্রতি আহবান জানাবে যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল। যদি তারা তা মেনে নেয় তবে তাদেরকে অবগত করাবে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর দিনে ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেছেন। যদি সেটাও তারা মেনে নেয় তবে তাদেরকে অবগত করাবে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পদে ছাদাক্বা (যাকাত) ফরয করেছেন। যা তাদের ধনীদের নিকট থেকে গ্রহণ করা হবে আর দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করা হবে’।[8]

উম্মাতে মুহাম্মাদীর শ্রেষ্ঠত্বের কারণ :

মহান আল্লাহ বলেন,كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللهِ- ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য। তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে ও অন্যায় কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনবে’ (আলে ইমরান ৩/১১০)। আলোচ্য আয়াতে শ্রেষ্ঠ জাতির শ্রেষ্ঠ গুণ হিসাবে ‘আমর বিল মারূফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ তথা সৎ কর্মের আদেশ ও অন্যায় ও নিষিদ্ধ কর্মের নিষেধাজ্ঞা উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং উম্মাতে মুহাম্মাদীর শ্রেষ্ঠত্বের মূল কারণই হচ্ছে দাওয়াত।

আল্লাহর পথে দাওয়াত দানকারীর যেসব গুণাবলী থাকা আবশ্যক :

সত্যবাদী হওয়া : আল্লাহর পথের দাঈকে অবশ্যই সত্যবাদী হ’তে হবে। দাঈর মধ্যে যদি মিথ্যার লেশমাত্র পাওয়া যায় তাহ’লে তার দাওয়াত ফলপ্রসু হবে না। কুরআন ও হাদীছে সত্যবাদিতার বহু ফযীলত বর্ণিত হয়েছে এবং মুমিনদেরকে সত্যবাদীদের সাথী হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اتَّقُوا اللهَ وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (তওবা ৯/১১৯)

ধৈর্যশীল হওয়া : ধৈর্য মহৎ গুণ। আল্লাহর পথের দাঈদের এই মহৎ গুণে গুণান্বিত হ’তে হবে। নচেৎ দাওয়াত দানে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে না। কেননা আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াত দিতে গেলে অনেক বিপদ আসতে পারে, সেক্ষেত্রে ধৈর্যের সাথে তা মোকাবিলা করতে হবে। আল্লাহ বলেন,وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ، الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُوْنَ- ‘সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের। যাদের উপরে কোন বিপদ আসলে তারা বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর দিকেই আমরা ফিরে যাব’ (বাক্বারাহ ২/১৫৫-১৫৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُوْنَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ ‘নিশ্চয়ই যারা ধৈর্যশীল, তারা তাদের পুরস্কার পায় অগণিত’ (যুমার ৩৯/১০)

কোমল স্বভাবের অধিকারী হওয়া : নম্রতা-ভদ্রতা ও কোমলতা আদর্শ মানুষের গুণ। দ্বীনের দাঈর মধ্যে অবশ্যই এ গুণ থাকা বাঞ্ছনীয়। এ গুণের অধিকারী দাঈগণ দাওয়াতী কাজে সহজে মানুষের মাঝে প্রভাব ফেলতে পারে। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে কোমলতা অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফেরাঊনের সাথে কোমল আচরণের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা মূসা ও হারূণ (আঃ)-এর উদ্দেশ্যে বলেন, اذْهَبَا إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى، فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى- ‘তোমরা উভয়ে ফেরাউনের নিকটে যাও, নিশ্চয়ই সে সীমালংঘণ করেছে। অতঃপর তার সাথে নম্র ভাষায় কথা বল। সম্ভবতঃ সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীতি অবলম্বন করবে’ (ত্ব-হা ৩৯/৪৩-৪৪)। রাসূল (ছাঃ)-কে আল্লাহ বলেন,

فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِيْنَ-

‘আর আল্লাহর রহমতে তুমি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমল হৃদয় হয়েছ। যদি তুমি কর্কশভাষী ও কঠোর হৃদয়ের অধিকারী হ’তে তাহ’লে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত। কাজেই তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর যখন তুমি সংকল্পবদ্ধ হবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার উপর ভরসাকারীদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)

দ্বীনী কাজে একনিষ্ঠ হওয়া : দ্বীনি কাজে একনিষ্ঠতা ব্যতীত কখনও দাওয়াতী কাজে সফলতা আসবে না। আর ইখলাছ বা একনিষ্ঠতা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করা। মহান আল্লাহ বলেন,قُلْ إِنِّي أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ- ‘বল, আমি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদত করতে আদিষ্ট হয়েছি’ (যুমার ৩৯/১১)

কথায় ও কাজে মিল থাকা : আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لِمَ تَقُولُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُوْنَ، كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُوْنَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল যা নিজেরা কর না? তোমরা যা কর না তা বলা আল্লাহর দৃষ্টিতে অতিশয় অসন্তোষজনক’ (ছফ ৬১/২-৩)। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

رَأَيْتُ لَيْلَةَ أُسرِيَ بِيْ رِجَالاً تُقرَضُ شَفَاهُهُمْ بِمَقَارِيْضَ مِنَ النَّارِ فَقُلتُ مَنْ هَؤُلاَءِ يَا جِبْرِيْلُ قَالَ الْخُطَبَاءُ مِنْ أُمَّتِكَ الَّذِيْنَ يَأْمُرُوْنَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَيَنسَوْنَ أَنْفُسَهُمْ وَهُمْ يَتْلُوْنَ الْكِتَابَ أَفَلاَ يَعْقِلُوْنَ.

‘যখন আমাকে মে‘রাজের রাতে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমি কিছু লোককে দেখলাম, যাদের ঠোঁট আগুনের কাঁচি দ্বারা কেটে দেওয়া হচ্ছে। আমি বললাম, হে জিব্রীল! এরা কারা? তিনি বললেন, তারা আপনার উম্মতের বক্তাগণ, যারা মানুষকে ভাল কাজের জন্য আদেশ করত এবং নিজেদেরকে ভুলে যেত, অথচ তারা কুরআন তেলাওয়াত করত। কিন্তু তারা চর্চা করত না’।[9]

অন্যত্র তিনি বলেন,يُجَاءُ بِالرَّجُلِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيُلْقَى فِي النَّارِ فَتَنْدَلِقُ أَقْتَابُهُ فِي النَّارِ فَيُطْحَنُ فِيْهَا كَطَحْنِ الْحِمَارِ بِرَحَاهُ فَيَجْتَمِعُ أَهْلُ النَّارِ عَلَيْهِ فَيَقُوْلُوْنَ أَيْ فُلاَنُ مَا شَأْنُكَ أَلَيْسَ كُنْتَ تَأْمُرُنَا بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَانَا عَنْ الْمُنْكَرِ قَالَ كُنْتُ آمُرُكُمْ بِالْمَعْرُوْفِ وَلاَ آتِيْهِ وَأَنْهَاكُمْ عَنْ الْمُنْكَرِ وَآتِيْهِ. ‘ক্বিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এতে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে

যাবে। আর সে তা নিয়ে ঘুরতে থাকবে যেমনভাবে গাধা আটা পিষা জাঁতার সাথে ঘুরতে থাকে। জাহান্নামীরা তার নিকট একত্রিত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করবে, আপনি কি আমাদেরকে ভাল কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ করতেন না? সে বলবে, হ্যাঁ। আমি তোমাদেরকে ভাল কাজের আদেশ করতাম, কিন্তু নিজে তা করতাম না। আর খারাপ কাজ হ’তে তোমাদেরকে নিষেধ করতাম, কিন্তু আমি নিজেই তা করতাম’।[10]

দাওয়াত না দেওয়ার পরিণতি :

আল্লাহর পথে দাওয়াত দানে অলসতাকারীর জন্য পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে। নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

مَثَلُ الْمُدْهِنِ فِيْ حُدُوْدِ اللهِ وَالْوَاقِعُ فِيْهَا مَثَلُ قَوْمٍ اِسْتَهَمُوْا سَفِيْنَةً فَصَارَ بَعْضُهُمْ فِيْ اَسْفَلِهَا وَصَارَ بَعْضُهُمْ فِيْ أَعْلاَهَا فَكَانَ الَّذِيْ فِيْ أَسْفَلِهَا يَمُرُّ بِالْمَاءِ عَلَى الَّذِيْنَ فِيْ أَعْلَهَا فَتَأَذَّوْا بِهِ فَأَخَذَ فَأْسًا فَجَعَلَ يَنْقُرُ أَسْفَلَ السَّفِيْنَةِ فَأَتَوْهُ فَقَالُوْا مَا لَكَ قاَلَ تَأَذَّيْتُمْ بِيْ وَلاَ بُدَّلِيْ مِنَ الْمَاءِ فَاِنْ أَخَذُوْا عَلَى يَدَيْهِ أَنْجُوْهُ وَنَجُّوْا أَنْفُسَهُمْ وَإِنْ تَرَكُوْهُ أَهْلَكُوْهُ وَأَهْلَكُوْا أَنْفُسَهُمْ.

‘আল্লাহর বিধান পালনে অলসতাকারী ও অমান্যকারীর দৃষ্টান্ত ঐ লোকদের ন্যায় যারা লটারীর মাধ্যমে কেউ জাহাজের উপরে, কেউ জাহাজের নীচে স্থান পেল। তাদের মধ্যে যারা নীচে রয়েছে, তারা পানি আনার জন্য উপরে গেলে উপরের লোকদের কষ্ট হ’ত। কাজেই নীচের এক ব্যক্তি (পানি সংগ্রহের জন্য) একটি কুঠার নিয়ে নৌকার তলা ছিদ্র করতে আরম্ভ করল। তখন উপরের লোকজন এসে বলল, তোমার কি হয়েছে? (তুমি নৌকা ছিদ্র করছ কেন?) সে বলল, উপরে পানি আনতে গেলে তোমাদের কষ্ট হয়, আর পানি আমার একান্ত প্রয়োজন। এক্ষণে যদি তারা ঐ ব্যক্তিকে নৌকা ছিদ্র করতে বাধা দেয় তবে তারা তাকে এবং নিজেদেরকে রক্ষা করল। আর যদি তাকে নৌকা ছিদ্র করার কাজে ছেড়ে দেয় তবে তারা তাকে এবং নিজেদেরকে ধ্বংস করল’।[11]

আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,

يَقُوْلُ إِنَّ النَّاسَ إِذَا رَأَوْا مِنْكُمْ فَلَمْ يُغَيِّرُوهُ يُوْشكُ أَنْ يَّعُمَّهُمُ اللهُ بِعِقَابَهِ وَفِيْ رِوَايَةٍ أَبِيْ دَاوُدَ مَا مِنْ قَوْمٍ يَعْمَلُ فِيْهِمْ بِالْمَعَاصِيْ ثُمَّ يَقْدِرُوْنَ عَلَى أَنْ يُّغَيِّرُوْا ثُمَّ لاَ يُغَيِّرُوْنَ إِلاَّ أَنْ يَّعُمَّهُمْ اللهُ بِعِقَابٍ.

‘নিশ্চয়ই মানুষ যখন কোন গর্হিত কর্ম দেখে তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা না করে, অচিরেই আল্লাহ তাদের সকলকে শাস্তি দিবেন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, যখন কোন সম্প্রদায়ের মাঝে পাপ হ’তে থাকে এবং প্রতিরোধ করতে সক্ষম ব্যক্তিরা প্রতিরোধ না করে, তখন আল্লাহ সকলকেই শাস্তি দেন’।[12] হুযাইফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ أَوْ لَيُوْشِكَنَّ اللهُ أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عَذَابًا مِنْ عِنْدِهِ ثُمَّ لَتَدْعُنَّهُ وَلَا يُسْتَجَابُ لَكُمْ.

‘সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! তোমরা অবশ্যই ভাল কাজের আদেশ দিবে এবং খারাপ কাজ হ’তে নিষেধ করবে। নতুবা অচিরে আল্লাহ তা‘আলা নিজের পক্ষ হ’তে তোমাদের উপর আযাব প্রেরণ করবেন। অতঃপর তোমরা (আযাব মুক্তির জন্য) তাঁর নিকটে দো‘আ করবে, কিন্তু তোমাদের দো‘আ কবুল হবে না’।[13]

জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, مَا مِنْ رَجُلٍ يَكُوْنُ فِيْ قَوْمٍ يَعْمَلُ فِيْهِمْ بِالْمَعَاصِي يَقْدِرُوْنَ عَلَى أَنْ يُغَيِّرُوْا عَلَيْهِ وَلَا يُغَيِّرُوْنَ إِلَّا أَصَابَهُمُ اللهُ مِنْهُ بِعِقَابٍ قَبْلَ أَنْ يَمُوْتُوْا. ‘যে সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন এক ব্যক্তি পাপে লিপ্ত হয়, আর সে সম্প্রদায়ের লোকেরা ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাকে পরিবর্তন না করে, তখন তাদের মৃত্যুর পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলার আযাব তাদের উপর পতিত হবে’।[14]

উপসংহার :

তমসাচ্ছন্ন এই সমাজ অজ্ঞতা, হীনতা, হিংসা-বিদ্বেষ, খুন-খারাবী, নগ্নতা ও বেহায়াপনার মত জঘন্য পাপাচারে নিমজ্জিত। সমাজের এহেন পরিস্থিতি মোকাবিলায় আল্লাহর পথে দাওয়াত দানের কোন বিকল্প নেই। দাওয়াতের মাধ্যমেই একটি সুষ্ঠু-সুন্দর ও আদর্শ সমাজ গঠন করা সম্ভব। এ কাজে সবাইকে এগিয়ে আসা এখন সময়ের অনিবার্য দাবী। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে সাধ্যমত দ্বীনের দাওয়াতে সময় ও শ্রম কুরবানী করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!



[1]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৫/১৫৭

[2]. আদ-দাওয়াত ইলাল ইছলাহ, পৃঃ ১৭

[3]. বুখারী হা/৩৪৬১; মিশকাত হা/১৯৮

[4]. মুসলিম হা/৪৯ ‘ঈমান’ অধ্যায়

[5]. মুসলিম, মিশকাত হা/২১০ ‘ইলম’ অধ্যায়।

[6]. মুসলিম হা/৬৯৮০; মিশকাত হা/১৫৮

[7]. মুসলিম হা/৫০০৭; মিশকাত হা/২০৯

[8]. বুখারী হা/১৩৯৫, ‘যাকাত’ অধ্যায়, ‘যাকাত ওয়াজিব হওয়া’ অনুচ্ছেদ, বঙ্গানুবাদ বুখারী ২/৭৫ পৃঃ; মুসলিম হা/১৯।

[9]. আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২৩২৭; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৯১

[10]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৩৯, বাংলা মিশকাত, ৯ম খন্ড হা/৪৯১২ ‘আদব’ অধ্যায়, ‘সৎ কাজের নির্দেশ’ অনুচ্ছেদ।

[11]. বুখারী, মিশকাত হা/৫১৩৮; বাংলা মিশকাত, ৯ম খন্ড, হা/৪৯১১।

[12]. তিরমিযী, আবুদাউদ, মিশকাত হা/৫১৪২।

[13]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৫১৪০; তারগীব হা/৩৩০৭

[14]. আবুদাঊদ,  ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৫১৪৩





বিশ্ব ভালবাসা দিবস
শিশু প্রতিপালন : কতিপয় পরামর্শ
মিডিয়া আগ্রাসনের কবলে ইসলাম ও মুসলিম (পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আরাফাহ দিবস : গুরুত্ব ও ফযীলত - আত-তাহরীক ডেস্ক
সমাজে প্রচলিত কিছু শিরক - নূরজাহান বিনতে আব্দুল মজীদ
যিকর : মৃত আত্মায় জীবনের সঞ্চার - শরীফা বিনতে আব্দুল মতীন
এপ্রিল ফুল বা এপ্রিলের বোকা! - নূরজাহান বিনতে আব্দুল মজীদ
সূরা ফাতিহার ফযীলত ও বৈশিষ্ট্য - শিউলী ইয়াসমীন
পর্দা : বন্দীত্ব নয় স্বাধীনতা - নিশাত তাসনীম
নফল ছিয়াম : পরকালীন মুক্তির পাথেয় - শরীফা বিনতে আব্দুল মতীন
দাওয়াতের গুরুত্ব ও দাঈর গুণাবলী - আফরোযা খাতুন, কোরপাই, বুড়িচং, কুমিল্লা
ছয়টি বাক্যের অনন্য সান্ত্বনা ও আমাদের শিক্ষা - শরীফা বিনতে আব্দুল মতীন
আরও
আরও
.