ভূমিকা :
তা‘লীমী বৈঠক দ্বীন চর্চার অন্যতম একটি মাধ্যম। এটি হ’তে পারে কোন মাহফিল-জালসা বা দ্বীন শিক্ষার কোন প্রশিক্ষণ সমাবেশ অথবা ঘরোয়া পরিবেশে পারিবারিক বৈঠক কিংবা মহিলা সমাবেশ। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ ও সময়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে হ’লেও সবগুলোই মূলতঃ দ্বীন শিক্ষার আসর। মহিলা তা‘লীমী বৈঠক বর্তমান সমাজে কম প্রচলিত ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে কম গুরুত্বের হ’লেও সমাজ সংস্কারে রয়েছে এর রয়েছে নীরব ভূমিকা।
দায়িত্বশীল আল্লাহভীরু নারীকে পরিবারের ‘হৃদয়’ বলা যেতে পারে। কোন ব্যক্তির ক্বলব বা হৃদয় ঠিক থাকলে যেমন তার যাবতীয় কর্মকান্ড সুসংহত থাকে, তেমনি পরিবারে নারী তাক্বওয়াশীল হ’লে তার তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতির মৃদু সমীরণ পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে শীতলতায় পরিতৃপ্ত করে। পরিবারের পুরুষ যত উচ্চমান আল্লাহভীরু হোক না কেন, সন্তানের ক্ষেত্রে পিতার আল্লাহভীরুতার উত্তাপ তাক্বওয়াহীন মায়ের সামনে শুকনো মড়মড়ে পাতার ন্যায় গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যায়। সন্তানের উপর মায়ের প্রভাব এতটাই বেশী।
মা হ’লেন সন্তান গড়ার কারিগর আর পিতা তার সহায়ক শক্তি। এ বিবেচনায় মহিলা তা‘লীমী বৈঠককে গুরুত্বহীন মনে করা যায় না। বরং পরিবারকে সুশৃংখল রাখতে এবং দ্বীনী ছাঁচে গড়ে তুলতে মহিলা তা‘লীমী বৈঠকের গুরুত্ব অপরিসীম। সেকারণ তা‘লীমী বৈঠকের প্রতি মহিলাদের উৎসাহিত করা, তাদেরকে অংশগ্রহণ করতে সুযোগ করে দেওয়া ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা পুরুষেরও দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে মহিলাদের তা‘লীম :
রাসূল
(ছাঃ)-এর যুগেই সূচনা হয় মহিলা তা‘লীমী বৈঠকের। মসজিদে নববীতে মহিলা
ছাহাবীরা যদি পুরুষদের পাশাপাশি ছালাতে অংশগ্রহণ করতে পারেন, তাহ’লে
নিশ্চয়ই সেখানে তারা দ্বীন শিক্ষাও করতে পারতেন। কিন্তু দ্বীনী জ্ঞানের
পিপাসা নিবারণের লক্ষ্যে তারা নিজেদের জন্য পৃথক একটি দিন রাসূল (ছাঃ)-এর
নিকট দাবী করেন। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, قَالَتِ النِّسَاءُ
لِلنَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم غَلَبَنَا عَلَيْكَ الرِّجَالُ، فَاجْعَلْ
لَنَا يَوْمًا مِنْ نَفْسِكَ فَوَعَدَهُنَّ يَوْمًا لَقِيَهُنَّ فِيهِ،
فَوَعَظَهُنَّ وَأَمَرَهُنَّ، فَكَانَ فِيمَا قَالَ لَهُنَّ مَا مِنْكُنَّ
امْرَأَةٌ تُقَدِّمُ ثَلاَثَةً مِنْ وَلَدِهَا إِلاَّ كَانَ لَهَا حِجَابًا
مِنَ النَّارِ فَقَالَتِ امْرَأَةٌ وَاثْنَيْنِ فَقَالَ وَاثْنَيْنِ
‘নারীরা রাসূল (ছাঃ)-কে বলল, (জ্ঞানের দিক দিয়ে) পুরুষরা আপনার কাছে
অগ্রগামী হয়ে গেল। আপনি আমাদের জন্য একটি দিন নির্ধারণ করে দিন। অতঃপর তিনি
তাদেরকে নির্ধারণ করে দিলেন। তারা সমবেত হ’লে রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে উপদেশ
দিলেন, শিক্ষাদান করলেন। এরপর তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে যার তিনটি সন্তান
হবে তারা তার জন্য জাহান্নামের প্রতিবন্ধক হবে। একজন জিজ্ঞেস করল, দু’টি
হ’লে? রাসূল (ছাঃ) বলেন, দু’টি হ’লেও’।[1]
অত্র হাদীছে কয়েকটি বিষয় ফুটে ওঠেছে। ১. নারীর শিক্ষা গ্রহণের অধিকার শরী‘আত স্বীকৃত ২. নারী তার প্রয়োজন নির্দ্বিধায় পেশ করতে পারে ৩. নারী অধিক সুবিধার প্রয়োজনে তার ক্ষেত্রকে পৃথক করতে পারে। সুতরাং বর্তমান সময়েও নারী সমাজ মহিলা তা‘লীমী বৈঠকের আয়োজন করে এবং তাতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দ্বীন শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
নারী সমাজে দাওয়াতের হালচাল :
দাওয়াতের
ময়দানে বাতিলপন্থীদের থাবা সুবিস্তৃত। উপযুক্ত দাঈ ছাড়া দ্বীনের স্বচ্ছ
অনুসারী বানানো অসম্ভব। অথচ সমাজে এক শ্রেণীর দাঈ গোচরীভূত হয়, যারা ইলমের
জগতে একেবারেই আনাড়ি। তারা ইসলামের মূল বিষয়াদির তেমন কিছুই সঠিকভাবে জানে
না। তাওহীদ-শিরক, সুন্নাত-বিদ‘আতের স্বচ্ছ জ্ঞান তাদের নেই। নেই জাল ও যঈফ
হাদীছ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। তাদের অজ্ঞতা রয়েছে হিজাব সম্পর্কে, নারীর ঘর
থেকে বের হওয়ার নিয়ম-কানুনে। অথচ তারা দ্বীনের দাঈ! আমরা এসব অজানাকে
সমালোচনা করি না। সমালোচনা করে কারো জ্ঞানের দরজায় করাঘাত করা গেলেও এটি
শোভনীয় নয়। সমালোচনা করতে হয় তখন যখন এসব অজানা মানুষগুলো মানুষের দুয়ারে
গিয়ে নিজেকে দ্বীনের মস্তবড় দাঈ হিসাবে দাবী করেন এবং ভুল দ্বীন শিক্ষা
দিয়ে অবলা-সরলা মা-বোনদের বিভ্রান্ত করেন। এপ্রসঙ্গে রাসূল (ছাঃ) যথার্থই
বলেছেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا، يَنْتَزِعُهُ
مِنَ الْعِبَادِ، وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ،
حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا، اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالاً
فَسُئِلُوا، فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ، فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا- ‘আল্লাহ
বান্দার অন্তর থেকে ইলম টেনে বের করে ইলম উঠিয়ে নিবেন না। বরং আলেমগণকে
উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ইলম উঠিয়ে নিবেন। অবশেষে যখন কোন আলেমই বাকী থাকবেন
না তখন লোকেরা অজ্ঞ লোকেদেরকে তাদের নেতা বানিয়ে নিবে। তারা ইলম (জানা)
ছাড়াই (মনগড়া) ফৎওয়া দিবে। ফলে নিজেরা গোমরাহ হবে এবং অপরকেও গোমরাহ করবে’।[2]
এসব দা‘ঈদের সংখ্যাধিক্যের কারণে ইসলামের খাঁটি রূপে দেখা দিয়েছে নানান বিকৃতি। গ্রাম-গঞ্জে দেখা যায়, মহিলা বক্তা আসার ঘোষণা দিয়ে পাথেয় দেয়ার জন্য চাঁদা তোলা হয়। দা‘ঈ নারীরা এসে গ্রামের সহজ-সরল মা-বোনদেরকে ইসলামের নামে যে উদ্ভট শিক্ষা দিয়ে যান, ছহীহ হাদীছের কষ্টি পাথরে হাযারো ঘর্ষণের পরও সে ভুল শিক্ষা মুছে যেতে চায় না।
অনেক মহিলা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কুরআন শিক্ষা দেওয়ার কাজ করে থাকেন। তাদের কেউ বিশুদ্ধ কুরআন পাঠ করতে পারেন, আবার কেউ পারেন না। তারা সাধারণ মহিলাদের বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হন। অনেক ক্ষেত্রে তারা সঠিক সমাধান না জেনেও সমাধান দিয়ে ফেলেন। আর এভাবে দ্বীন বিকৃত হয়। একথা স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, কুরআন শিক্ষা দেওয়া ও মাসআলার জবাব দেওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টি বিষয়। মাসআলায় পারদর্শী হ’লে তবে তার নিকট থেকে জবাব নেওয়া যাবে, অন্যথায় নয়।
অনেকে আবার সাজগোজ করেন, মোহনীয় ভঙ্গি অবলম্বন ও সুন্দর উচ্চারণভঙ্গি ব্যবহার করে থাকেন দ্বীনের পথে ডাকার মাধ্যম হিসাবে। তাদের যুক্তি, তাদের স্মার্টনেস, অবস্থান ও ফ্যাশনেবল উপস্থিতির কারণে সমাজের ধনিক শ্রেণী ও আধুনিকমনা মানুষ দ্বীনকে সহজেই গ্রহণ করবে।
মূলতঃ এগুলো দাওয়াতের সঠিক পদ্ধতি নয়। মহিলারা নিজ এলাকা ছেড়ে পুরুষদের ন্যায় দেশ-বিদেশে ঘুরে দাওয়াত দিবে এটিও ইসলামের দাবী নয়। বরং তারা নিজ নিজ পাড়া-মহল্লার মধ্যেই দাওয়াতের ক্ষেত্র তৈরী করবেন। তবে মনে রাখতে হবে যিনি মানুষকে আললাহর পথে ডাকবেন তার মধ্যে দাঈর গুণাবলীর ঘাটতি থাকলে তার দাওয়াতের ফল সুদূর প্রসারী হবে না। একজন দাঈর আবশ্যিক প্রথমগুণ হ’ল- তাক্বওয়া বা আল্লাহর ভয়। দ্বিতীয় গুণ হ’ল যোগ্যতা। এই দ্বিবিধ গুণের সমন্বয় ঘটলে তার দাওয়াতের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের আশা করা যায়। শুধুমাত্র তাক্বওয়া দিয়ে আল্লাহর প্রিয়ভাজন হ’তে পারলেও যেমন দাঈ হওয়া যায় না, তেমনি শুধু যোগ্যতা দিয়ে জ্ঞানী হওয়া গেলেও সফল দাঈ হওয়া যায় না।
বাহ্যিক সৌন্দর্য প্রদর্শন কিংবা অতি সাদামাটা ভাব প্রকাশ কোনটিই দ্বীনের পথে আহবানের মাধ্যম নয়। সুন্দর পোষাক ব্যবহারে অনুমতির যেমন স্পষ্ট হাদীছ রয়েছে, তেমন বিলাসিতা পরিহারের স্পষ্ট দলীল রয়েছে। ব্যক্তি তার স্বভাব, রুচিবোধ, সামর্থ্য ও তাক্বওয়ার ভিত্তিতে পোষাক পরবে। বাহ্যিক প্রদর্শনী দাওয়াতী কাজের মাধ্যমে নয়। দাওয়াতে একনিষ্ঠতা, আল্লাহভীতি, যোগ্যতা, পরিস্থিতি অনুযায়ী কথা বলার ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তার সাথে মাসআলা-মাসায়েলের ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক সমাধান, ব্যক্তিগত গাম্ভীর্য প্রভৃতির মাধ্যমে একজন সফল দাঈ হওয়া যায়। অতএব বাতিলপন্থী দাঈদের বিপরীতে ছহীহ আক্বীদা ও আমল ভিত্তিক হকপন্থী মা-বোনদের কালবিলম্ব না করে স্ব স্ব পরিবারে, সমাজে নিয়মিত বৈঠক চালু করা সময়ের অনিবার্য দাবী।
তা‘লীমী বৈঠক পরিচালনার পদ্ধতি :
নিয়মিত বৈঠককে প্রাণবন্ত রাখার জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ যরূরী। বৈঠকে উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে বৈঠক পরিচালিত হবে। উপস্থিত সদস্যের বয়স, মেধা ও আগ্রহের উপর ভিত্তি করে উপযুক্ত পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। নিম্নোক্তভাবে বৈঠক পরিচালনা করা যেতে পারে।-
কুরআন শিক্ষার জন্য একটি বোর্ড থাকবে। যাতে মাদ্দ-মাখরাজের চর্চা সহজে করা যায়। বোর্ডে প্রয়োজনীয় অংশ লিখে বুঝিয়ে দিবেন। মাখরাজের ভিন্নতায় কিভাবে অর্থের বিকৃতি ঘটে উদাহরণের মাধ্যমে (যেমন- قُلْ ‘তুমি বল’, كُلْ ‘তুমি খাও’ عَلِيْمٌ ‘মহাজ্ঞানী’, أِليْمٌٌ ‘যন্ত্রণাদায়ক’) ফুটিয়ে তুলবেন।
তাজবীদ কঠিন নিয়মে মুখস্থ না করিয়ে উদাহরণের মাধ্যমে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে অতঃপর নিয়ম মুখস্থ করাবেন। কুরআন শিক্ষার সাথে সাথে নিয়মিত দো‘আ শিখাবেন। তাদের মধ্যকার আচরণ-আদবের প্রতি লক্ষ্য রেখে তাদের সুন্নাত শিক্ষা দিবেন। যেমন- কেউ হাই তুলল কিন্তু মুখে হাত দিল না, তখন নিয়মিত পাঠ শেষে সুন্দর করে হাই তোলার সুন্নাতী তরীকা বুঝিয়ে দিবেন। তাছাড়া বিশুদ্ধ ছালাত শিক্ষার বাস্তব প্রশিক্ষণ, তাফসীরুল কুরআন, ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), নবীদের কাহিনী ও অন্যান্য ছহীহ বইয়ের উপর ধারাবাহিক আলোচনা এবং বিভিন্ন উপলক্ষে বিষয় ভিত্তিক বক্তব্য থাকবে। বৈঠক সোনামণি বৈঠক হ’লে তাদের উৎসাহ প্রদানের জন্য মাঝে-মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং হালকা পুরস্কারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
বৈঠকের সমাপ্তিকালে সুন্নাতী তরীকায় বৈঠক শেষের দো‘আ পড়ে বৈঠক শেষ হবে। মোটকথা উপস্থিত শিক্ষার্থীদের পরিবেশ বুঝে বৈঠকটি সজীব রাখার স্বার্থে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। বৈঠকের দায়িত্বশীলকে লক্ষ্য রাখতে হবে, কোনক্রমে যেন এটা শিক্ষার্থীর কাছে একঘেঁয়ে না হয়ে যায়। নিজের সুযোগ, তাদের আগ্রহ মেধা ও মনোযোগ পর্যবেক্ষণ করে নতুন নতুন মাত্রা যোগ করলে তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে।
মহিলা তা‘লীমী বৈঠকের ভূমিকা :
সমাজ সংস্কারে মহিলা তা‘লীমী বৈঠকের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। কোন পরিবারে মায়ের মধ্যে দ্বীনের ব্যাপারে সচেতন অনুভূতি থাকার অর্থ হ’ল সে ঘরটি দ্বীনের একটি অনুশীলন ঘর। আর এ অর্জনটি হওয়া সম্ভব মহিলা তা‘লীমী বৈঠকে নিয়মিত যোগদানের মাধ্যমে। কোন মা-বোন যদি তা‘লীমী বৈঠকের সংস্পর্শে এসে দ্বীন মেনে নেন এবং পরিবর্তনের পথে এগিয়ে আসেন, তবে পরিবার ও সমাজ নিম্নোক্ত উপকার তার নিকট থেকে পেতে পারে।
১. দাম্পত্য জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য :
স্ত্রী ভীতি বিবাহিত পুরুষদের একটি কমন ফোবিয়া বা আতঙ্কের নাম। কার নেই
স্ত্রীভীতি? কি বারাক ওবামা, কি বিল ক্লিন্টন আর কি সাকিব আল-হাসান- মগজের
ভীতি অংশের হিটলিষ্টে রয়েছে নিজ নিজ স্ত্রীদের নাম। পোশাকের মান-মূল্য,
বাজার-ঘাট, সম্পদ অর্জন, ব্যয়-বণ্টন এমনকি স্বামী বেচারার হাঁটাচলাও রয়েছে
স্ত্রীর আধিপত্য। একান্তই স্ত্রীর মনোবৃত্তির অনুগত হয়ে তাকে মেনে নিতে হয়
সব। অথচ রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ يَنْظُرُ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى إِلَى
امْرَأَةٍ لَا تَشْكَرُ لِزَوْجِهَا وَهِيَ لَا تَسْتَغْنِي عَنْهُ ‘আল্লাহ
ঐ নারীর দিকে করুণার দৃষ্টি দেন না যে স্বামীর শুকরিয়া আদায় করে না এবং
নিজের জন্য স্বামীকে পরিপূর্ণ মনে করে না’।[3] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,
لاَ يَحِلُّ لِلْمَرْأَةِ أَنْ تَصُومَ وَزَوْجُهَا شَاهِدٌ إِلاَّ
بِإِذْنِهِ، وَلاَ تَأْذَنَ فِى بَيْتِهِ إِلاَّ بِإِذْنِهِ ‘কোন স্ত্রীর
জন্য স্বামীর অনুমতি ব্যতীত নফল ছিয়াম পালন করা বৈধ নয় এবং স্বামীর অনুমতি
ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে প্রবেশ করতে অনুমতি দেয়া জায়েয নয়’।[4]
এছাড়াও আরো অনেক হাদীছ রয়েছে যেগুলোতে পুরুষ জাতির মর্যাদা ও সম্মানকে স্পষ্ট করা হয়েছে। অনুরূপভাবে নারীর মর্যাদা সম্পর্কেও বহু হাদীছ এসেছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا وَخِيَارُكُمْ خِيَارُكُمْ لِنِسَائِهِمْ خُلُقًا ‘তোমাদের মধ্যে পূর্ণতর মুমিন সে, যে আচরণে ভাল। আর তোমাদের মধ্যে উত্তম সে, যে তার স্ত্রীর নিকটে উত্তম’।[5] অর্থাৎ স্ব স্ব স্থানে সবারই একটা মর্যাদা রয়েছে। রয়েছে নিজস্ব একটা ক্ষমতা। যাতে কোন মানুষই নিজেকে তুচ্ছ-হীন মনে না করে। এভাবে যখন স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক মর্যাদা ও অধিকারের কথা জানতে পারবে, তা অবশ্যই তাদের দাম্পত্য জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনয়ন করবে।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হ’ল শ্রদ্ধামিশ্রিত, ভালবাসাপূর্ণ। তারা একে অপরের অকৃত্রিম বন্ধু। জীবনে চলার পথে বন্ধুত্বের গতি কখনোবা মন্থর হ’তেও পারে। তাই বলে দাম্পত্য কলহ স্থায়ী হ’তে পারে না। স্ত্রীর মেজায যখন খড়খড়ে হয়ে যায়, তখন স্বামী কি একটু চুপ থাকতে পারেন না? স্ত্রী যদি আপনার সাথে অভিমান না করে, তবে তার অভিমান দেখানোর জায়গা কোথায়? এজন্য তাকেও দু’চার কথা বলার সুযোগ দিন। আর স্ত্রীকেও মনে রাখতে হবে, স্বামীর মর্যাদা তার চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে। সঙ্গত কারণে তার দায়িত্বপূর্ণ ও যৌক্তিক কথা মেনে নিতে হবে। নতুবা পরিবারে শৃংখলার ব্যত্যয় ঘটবে। হালে নারীরা স্বামীদেরকে তাদের ‘অধীনস্ত’ কিছু একটা মনে করতে শুরু করেছে। যা সম্পূর্ণ অন্যায় ও অযৌক্তিক। যে স্ত্রীর মধ্যে দ্বীনের সামান্যতম জ্ঞান থাকে তার দ্বারা এই অন্যায় ধারণা আদৌ সম্ভব নয়। অতএব স্বামী-স্ত্রীর স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন যাপনে তা‘লীমী বৈঠক যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। নিয়মিত বৈঠকে যোগদান এবং কুরআন-হাদীছের আলোচনা শ্রবণে স্ত্রীর মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। দু’দিন আগের স্বামী বিদ্বেষী স্ত্রী পরিণত হ’তে পারে চরম স্বামীভক্ত স্ত্রীতে। হাছিল করতে পারেন অনন্ত সুখের চিরন্তন স্থান জান্নাত।
২. সন্তান প্রতিপালন : সন্তানের জন্য মায়ের উষ্ণ কোলের যেরূপ তুলনা নেই, তেমন মাতৃশিক্ষার সমতুল্য আর কিছু নেই। ‘গোবরে পদ্মফুল’ ফুটে গেলেও পদ্মের গায়ে গোবরের নির্যাস লেগে থাকে। এজন্য আমরা দেখে থাকি, ছোট ঘর থেকে ওঠে আসা বড় মানুষগুলোর মধ্যে ‘পারিবারিক লোগো’ টাইপের কিছু বৈশিষ্ট্য থেকেই যায়। যে বাচ্চা মায়ের কাছে ইলম-আদবের ছবক পায়, সে বড়ই ভাগ্যবান। কারণ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সাথে সাথে সে শৈশবের সেই আদবের অনুশীলন তীব্রভাবে অনুভব করে নিজের মধ্যে। ছোটবেলায় যারা মা শিক্ষকের শিক্ষা লাভ করতে পারেননি, তারা নিজের প্রতি লক্ষ্য করুন! আত্মিক পশুত্বকে দূর করতে নিজের সাথে কতটা কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছে! সুতরাং ইসলামী মূল্যবোধের পরিবার গড়তে সৎকর্ম পরায়ণ মায়ের বড়ই প্রয়োজন রয়েছে। আর সৎকর্মপরায়ণ মা গঠনে নিয়মিত তা‘লীমী বৈঠকে অংশগ্রহণ আবশ্যক।
৩. প্রতিবেশীর অধিকার : প্রতিবেশীর
ফিৎনা প্রতিটি সমাজেই রয়েছে। প্রতিবেশীর যন্ত্রণা যে কত দুঃসহ তা শুধু
ভুক্তভোগীই বুঝে। কারো জন্য পরিস্থিতি কখনো কখনো এতটাই জটিল হয়ে যায় যে,
ভিটা-মাটি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যায়। অথচ ইসলাম প্রতিবেশীকে দিয়েছে
প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহারের এক গুরু দায়িত্ব। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)
হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন,خَيْرُ الأَصْحَابِ عِنْدَ اللهِ خَيْرُهُمْ
لِصَاحِبِهِ وَخَيْرُ الْجِيرَانِ عِنْدَ اللهِ خَيْرُهُمْ لِجَارِهِ
‘আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম সাথী সে, যে তার সাথীর নিকটে উত্তম। আল্লাহর নিকট
সর্বোত্তম সে, যে তার প্রতিবেশীর নিকটে উত্তম’।[6]
আবু
হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ يَمْنَعُ جَارٌ جَارَهُ أَنْ
يَغْرِزَ خَشَبَهُ فِى جِدَارِهِ ‘কোন প্রতিবেশী যেন তার প্রতিবেশীর দেয়ালে
খুঁটি গাড়তে নিষেধ না করে’। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,مَا لِى أَرَاكُمْ
عَنْهَا مُعْرِضِينَ وَاللهِ لأَرْمِيَنَّ بِهَا بَيْنَ أَكْتَافِكُمْ
‘তোমাদের কি হ’ল? আমি তোমাদেরকে এই বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখছি।
আল্লাহর কসম! আমি এই বিধান তোমাদের ঘাড়ের উপর ফেলব (অর্থাৎ তোমাদেরকে এ
বিধান পালনে বাধ্য করব)’।[7]
আবু হুরায়রা
(রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, يَا أَبَا ذَرٍّ إِذَا طَبَخْتَ مَرَقَةً
فَأَكْثِرْ مَاءَهَا وَتَعَاهَدْ جِيرَانَكَ ‘হে আবূ যার! তুমি যখন ঝোল
রাঁধ, তাতে পানি বাড়িয়ে দাও এবং তোমার প্রতিবেশীর প্রতি লক্ষ্য রাখ’।[8]
রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَا زَالَ جِبْرِيلُ يُوصِينِى بِالْجَارِ حَتَّى
ظَنَنْتُ أَنَّهُ سَيُوَرِّثُهُ ‘জিবরীল (আঃ) আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে
এমনভাবে উপদেশ করতে থাকেন যে, অবশেষে আমার মনে হ’ল, তিনি প্রতিবেশীকে আমার
ওয়ারিছ (সম্পদের ভাগীদার) বানিয়ে দিবেন’।[9]
উল্লিখিত হাদীছগুলোতে প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্কের একটা পরিধি ফুটে ওঠেছে। এক সমাজে চলতে গেলে কখনো কখনো মনোমালিন্য হয়ে গেলেও, এটাকে গেঁথে না রেখে পূর্ব সম্পর্কে ফিরে আসার দ্রুত চেষ্টা করতে হবে। তার অন্যায় প্রতিরোধ করতে তাকে বাড়িতে ডেকে এনে গল্পচ্ছলে সদুপদেশ দিতে হবে। সে উপদেশ গ্রহণ না করলেও তার মন্দ আচরণ ও যুলূম প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আর এ মহতী কাজে নারীর ভূমিকা অনেকাংশেই বেশী।
মহিলা তা‘লীমী বৈঠক একজন নারীকে তার প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণের বাস্তব ভিত্তিক শিক্ষা দিতে পারে। যে শিক্ষা লাভ করে সে এমনই সদাচারী ও সহমর্মী হবে যে, তার দ্বারা প্রতিবেশীর সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সুন্দরতম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে।
৪. ফকীর-মিসকীনের সাথে আচরণ : সমাজে
সবচেয়ে অবহেলা ও অবজ্ঞার পাত্র ফকীর-মিসকীন। সর্বনিম্ন শ্রেণীর এই
মানুষগুলোর তাচ্ছিল্যের কারণ অবশ্য ব্যবসায়ী, মিথ্যুক ও শঠ ভিক্ষুকেরা।
তারা প্রকৃত ফকীরদের কষ্টে ফেলেছে। এজন্য ব্যবসায়ী ফকীরদের থেকে কৌশলে
সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। আপনি তাকে ঠুনকো কাজে দিন নির্ধারণ করে
জোরালোভাবে চুক্তিবদ্ধ করুন, দেখবেন সে পরের দিন আপনার পাশের দরজায় কড়া
নাড়লেও আর আপনার দরজায় আসবে না। তাদেরকে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে
হবে। তবে কোনভাবেই আচরণ মন্দ করা যাবে না। অথচ প্রকৃত ভিক্ষুকের কথা সমাজের
কেউ ভাবে না। কত যন্ত্রণাময় ও বেদনাকাতর তাদের জীবনকাহিনী তা জানার
প্রয়োজনটুকুও আমরা মনে করি না। এমন হতভাগ্য জীবন তাদের, মানব সমাজে তারা
কাজের লোকের সাথেও দাঁড়াতে পারে না। অথচ রাসূল (ছাঃ) বলেন, السَّاعِى عَلَى
الأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِينِ كَالْمُجَاهِدِ فِى سَبِيلِ اللهِ
وَأَحْسِبُهُ قَالَ، يَشُكُّ الْقَعْنَبِىُّ كَالْقَائِمِ لاَ يَفْتُرُ،
وَكَالصَّائِمِ لاَ يُفْطِرُ ‘বিধবা ও মিসকীনদের অভাব দূর করার চেষ্টায় রত
ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর সমতুল্য। বর্ণনাকারী বলেন, আমার ধারণা
তিনি একথাও বলেন, সে ঐ নফল ছালাত আদায়কারীর ন্যায়, যে ক্লান্ত হয় না এবং ঐ
ছিয়ামপালনকারীর ন্যায় যে ছিয়াম ছাড়ে না’।[10] অন্যত্র তিনি বলেন,شَرُّ
الطَّعَامِ طَعَامُ الْوَلِيمَةِ يُمْنَعُهَا مَنْ يَأْتِيهَا وَيُدْعَى
إِلَيْهَا مَنْ يَأْبَاهَا وَمَنْ لَمْ يُجِبِ الدَّعْوَةَ فَقَدْ عَصَى
اللهَ وَرَسُولَهُ ‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট খাবার ঐ ওয়ালীমার খাবার, সেখানে যে আসে
(অর্থাৎ গরীব) তাকে বাধা দেয়া হয় এবং যাকে দাওয়াত দেয়া হয় (অর্থাৎ ধনী),
সে আসতে অস্বীকার করে। আর যে দাওয়াত কবুল করে না সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল
(ছাঃ)-এর বিরোধিতা করল’।[11]
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, شَرُّ الطَّعَامِ طَعَامُ الْوَلِيمَةِ يُدْعَى لَهَا الأَغْنِيَاءُ ، وَيُتْرَكُ الْفُقَرَاءُ ‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট ওয়ালীমার খাবার হ’ল যাতে ধনীদেরকে দাওয়াত করা হয় এবং গরীবদেরকে বর্জন করা হয়’।[12] দুর্ভাগ্য আমাদের স্বভাব হচ্ছে, বাসায় সাধারণ কেউ আসলে খালি মুখে বিদায় দেই। আর মান সম্পন্ন কেউ আসলে যারপর নাই ব্যস্ত হয়ে পড়ি। একেই বলে ‘তেলা মাথায় তেল দেয়া’। আমাদের মনোভাবের পরিবর্তন হওয়া উচিত। মানীর মান তো রাখতেই হয়। সেই সাথে দরিদ্র মেহমানদের জন্যও আমাদের হৃদয় কোণে মেহমানদারীর এক চিলতে দায়িত্ব থাকা সুন্নাতের দাবী। নিয়মিত তা‘লীমী বৈঠকে যোগদান ও দ্বীনী পরিবেশে থাকার মাধ্যমে এই মন্দ স্বভাবের পরিবর্তন হওয়া সম্ভব।
৫. সদাচরণ : সদাচরণ
মানব চরিত্রের এক অমূল্য অর্জন। সদাচরণ এমন একটি গুণ যাতে লুকিয়ে আছে
ধৈর্য, বিনয়-নম্রতা, আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখা, প্রতিবেশীর অধিকার
রক্ষা, পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও সমাজ চালানোর যোগ্যতা, সর্বোপরি আত্মিক
মযবুতির বড় উপকরণ। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ رَفِيقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ
وَيُعْطِى عَلَى الرِّفْقِ مَا لاَ يُعْطِى عَلَى الْعُنْفِ وَمَا لاَ
يُعْطِى عَلَى مَا سِوَاهُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোমল। তিনি কোমলতাকে ভালবাসেন।
কোমলতার উপর তিনি যা দেন, কঠোরতা ও অন্য জিনিসের উপর তা দেন না’।[13]
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, এক বেদুঈন মসজিদের ভিতর প্রস্রাব করে দিলে লোকেরা তাকে ধমকানোর জন্য উঠে দাঁড়াল। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তাকে ছেড়ে দাও। প্রস্রাবের উপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। কারণ তোমাদেরকে সহজ নীতি অবলম্বনের জন্য পাঠানো হয়েছে। কঠোর নীতি অবলম্বনের জন্য নয়’।[14] লোকটি এখানে কয়েকটি অন্যায় করেছে- ১. নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়েছে, ২. মসজিদ অপবিত্র করেছে, ৩. রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে চরম বেয়াদবী করেছে, ৪. সমাজ বহির্ভূত কাজ করেছে ইত্যাদি। এক কথায়, সে তার উক্ত কাজে সকলকে হতভম্ব করে দিয়েছে। অথচ এরপরেও সৃষ্টির সর্বসেরা মানুষ (রাসূল (ছাঃ), তাতে সহজ নীতি অবলম্বন করার পরামর্শ দিলেন। কত সুমহান সদাচরণ! কত উন্নত শিক্ষা! হাদীছের শিক্ষা কত অসীম, ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।
আমরা যারা ঠুনকো ব্যাপার নিয়ে নিজেদেরকে সামলে রাখতে পারি না, তাদের কাছে এই হাদীছ কি কোন আবেদন তৈরী করতে পারছে না? বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে বড় একটি ব্যাপারকে হজম করে ফেলার ও সেটি এড়িয়ে যাওয়ার শিক্ষা পাওয়া যায় অত্র হাদীছে। নিজের দিকে ভাবলে একটু কেমন লাগে? যদি আমাদের সামনে অনুরূপ ঘটনা ঘটে যেত, তবে শত ভদ্রতার মাঝেও হয়ত মুখ দিয়ে বের হয়েই যেত, ছি! কত বেশরম! আফসোস! এই শিক্ষা যে মহান শিক্ষক দিলেন, তাঁকে আজ জাতির একশ্রেণীর শিক্ষিত মূর্খ ‘যুদ্ধবাজ’ বলছে। তাঁকে ব্যঙ্গ করছে, ঠাট্টা-বিদ্রূপ করছে, উপহাস করছে। ধিক, শত ধিক! তাদের উপর আল্লাহর লা‘নত।
ইসলাম মানুষের বিবেককে ভালোর মাধ্যমে জাগিয়ে তোলার শিক্ষা দেয়। যেহেতু নারীর হাতে পরিবারের পরিচালনার ভার রয়েছে, সেহেতু নারী নিজে উত্তম আচরণের শিক্ষা রপ্ত করে পরিবারের সদস্যদের সেই আবেশে গড়ে তুলবেন। এজন্যই মহিলাদের দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করা অতীব যরূরী। আর এক্ষেত্রে যথার্থ ভূমিকা পালন করতে পারে ‘তা‘লীমী বৈঠক’।
তা‘লীমী বৈঠক বাস্তবায়নে আহলেহাদীছ আন্দোলনের ভূমিকা :
নির্ভেজাল তাওহীদের ঝান্ডাবাহী এ দেশের অনন্য দ্বীনী সংগঠন ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ চারটি স্তরে সমাজে দাওয়াতী কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে ‘সোনামণি’ সংগঠন, ছাত্র ও যুবকদের মধ্যে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’, বয়ষ্কদের মধ্যে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ এবং মা-বোনদের জন্য ‘আহলেহাদীছ মহিলা সংস্থা’। সমাজ সংস্কারে আহলেহাদীছ আন্দোলনের দাওয়াতী পদ্ধতির অন্যতম হচ্ছে ‘সাপ্তাহিক তা‘লীমী বৈঠক’। এটি অত্র সংগঠনের অধীনস্ত সকল শাখা-এলাকার প্রতি সাংগঠনিক নির্দেশ। সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে মহল্লার মসজিদে বা বিশেষ কোন স্থানে নির্ধারিত সময়ের জন্য এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত মুছল্লীগণ এর মাধ্যমে দ্বীনের প্রয়োজনীয় বিষয় এবং বিশুদ্ধ ইবাদত, দো‘আ-কালাম ইত্যাদি শিক্ষা লাভ করেন। অনরূপভাবে ‘আহলেহাদীছ মহিলা সংস্থা’র উদ্যোগেও ‘মহিলা তা‘লীমী বৈঠক’ হয়ে থাকে। মহল্লার অবলা-সরলা শিক্ষিত-অশিক্ষিত মহিলারা উক্ত বৈঠকে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দ্বীন শিক্ষা লাভ করে নিজ পরিবারে এর বাস্তব অনুশীলন করেন। কাজেই যোগ্য নারীদের উচিত মা-বোনদের মধ্যে সঠিক দ্বীন প্রচারের স্বার্থে নিজ নিজ পাড়া-মহল্লায় নিরাপদ পরিবেশে মহিলা তা‘লীমী বৈঠকের আয়োজন করা। আহলেহাদীছ আন্দোলনের এই একটি নির্দেশ যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি তাহ’লে সেদিন বেশী দূরে নয় যেদিন অশান্ত সমাজে শান্তি ফিরে আসবে, পারিবারিক কলহ, কুসংস্কার চিরতরে বিদূরিত হয়ে এক একটি পরিবার জান্নাতী পরিবারে পরিণত হবে।
সমাপনী :
পরিবারের
সদস্যরা সেভাইে গড়ে ওঠে মা যেভাবে গড়ে তুলেন। এ নীতিতে বিশ্বাস করলে
নারীকে দ্বীন শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা করা
সুবিবেকের কাজ। সমাজের স্থিতিশীলতার স্বার্থে নারীকে দ্বীন শিক্ষা দেয়া
প্রয়োজন। তাকে দ্বীনের বড়-ছোট নানাবিধ মাসআলা, বিধি-বিধান জানতে হবে।
দুর্ভাগ্য আজ অবস্থা এমন হয়েছে যে, কোন কাজ ইসলামী পদ্ধতিতে করার অর্থই হ’ল
সেকেলে। নারীরা নিজেকে সস্তা বানাতে বানাতে এমন পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে যে,
তারা যেন ঝুড়ির তলায় থাকা উচ্ছিষ্ট পণ্য। সমঅধিকারের জন্য চিৎকার করতে করতে
আজ যেন তারা নিঃস্ব। আমরা কি এমন স্বপ্ন দেখতে পারি না যে, প্রতিটি পাড়ায়
একটি মহিলা তালীমী বৈঠক হবে? সেই বৈঠকের নরম-কোমল আলোয় ঝলমলে হবে পাড়া থেকে
পাড়ান্তর। বদলে যেতে থাকবে মানুষের জীবনচিত্র। পরিবর্তন আসবে পোশাকে,
আমল-আক্বীদায়। পাল্টে যেতে থাকবে জীবন পদ্ধতি। দূরীভূত হবে আঁধার। মহান
আল্লাহ আমাদের কবুল করুন-আমীন!
শরীফা বিনতে আব্দুল মতীন
সহকারী শিক্ষিকা, মহিলা সালাফিইয়াহ মাদরাসা, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
[1]. বুখারী হা/১০১; আহমাদ হা/১১৩১৪; ‘ইলম’ অধ্যায়, ‘নারীদের জন্য কি একটি দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল’? অনুচ্ছেদ।
[2]. বুখারী হা/১০০; মুসলিম হা/২৬৭৩; মিশকাত হা/২০৬।
[3]. হাকেম হা/২৭৭১, ছহীহ।
[4]. মুসলিম হা/১০২৬; মিশকাত হা/২০৩১।
[5]. তিরমিযী হা/১১৬২; মিশকাত হা/৩২৬৪।
[6]. তিরমিযী হা/১৯৪৪, সনদ হাসান।
[7]. বুখারী হা/২৪৬৩; মুসলিম হা/১৬০৯; মিশকাত হা/২৯৬৪।
[8]. মুসলিম হা/২৬২৫।
[9]. বুখারী হা/৬০১৫; মুস©র্লম হা/২৬২৪; মিশকাত হা/৪৯৬৪।
[10]. বুখারী হা/৬০০৭; মুসলিম হা/২৯৮২; মিশকাত হা/৪৯৫১।
[11]. বুখারী হা/৫১৭৭; মুসলিম হা/১৪৩২; মিশকাত হা/৩২১৮।
[12]. বুখারী হা/৫১৭৭।
[13]. মুসলিম হা/২৫৯৩।
[14]. বুখারী হা/২২০।