‘এপ্রিল ফুল’ শব্দটা ইংরেজী। এর অর্থ ‘এপ্রিলের বোকা’। এপ্রিল ফুল ইতিহাসের এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। অথচ প্রতি বছরের এপ্রিল মাসের পহেলা তারিখে আমাদের মাঝে যেন উৎসবের আমেজ পড়ে যায়। পহেলা এপ্রিল এলেই একে অপরকে বোকা বানানো এবং নিজেকে চালাক প্রতিপন্ন করার জন্য একশ্রেণীর লোকদের বিশেষভাবে তৎপর হয়ে উঠতে দেখা যায়। বলা বাহুল্য যে, তারা অপরকে বোকা বানিয়ে নিজেরা আনন্দ উপভোগ করে থাকে হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠে। ইতিহাসের বিভিন্ন বইয়ে ১লা এপ্রিল বা ‘এপ্রিল ফুল ডে’র ঘটনাসমূহে রস, কৌতুক আর আমোদ-প্রমোদের পাশাপাশি রয়েছে বেদনার এক কালো পাহাড়।

এ দিনের সঙ্গে একই সাথে মুসলিম ও খৃষ্টান সম্প্রদায়ের দু’টি পৃথক মর্মান্তিক ঘটনা মিশে আছে। বিশেষ করে মুসলিমদের সাথে এর সম্পর্ক সবচেয়ে নিবিড়। এর ইতিহাস জানতে হ’লে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৪৯২ সালে।

ইসলামের সোনালী যুগে জাযীরাতুল আরবের সীমানা ছাড়িয়ে ইসলামী রাষ্ট্র বিস্তৃত হয়েছিল পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণের সকল দিগন্তে। আলী (রাঃ)-এর ইন্তেকালের পর উমাইয়া খিলাফত শুরু হয়, তাদের সময় ব্যাপক সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটে। ইসলামের শাশবত সৌন্দর্য ও কল্যাণে আকৃষ্ট হয়ে বিশেবর দেশে দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের যে জোয়ার ওঠে সেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের মাটিতেও। এ সময়ে মুসলিমরা জিব্রাল্টার পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বুকে স্পেন সাম্রাজ্যের প্রতাপশালী ও অত্যাচারী রাজা রডারিককে পরাজিত করেন। সেটি অষ্টম শতকের কথা।

মুসলিমরা স্পেন নিজেদের ইচ্ছায় দখল করেননি। স্পেনের প্রজা উৎপীড়ক রাজা রডারিক ক্ষমতায় এসেছিলেন তার পূর্বসূরী রাজা উইটিজাকে হত্যা করে। এ সময় সিউটা দ্বীপের শাসক ছিলেন কাউন্ট জুলিয়ান। তাই উইটিজার আধিপত্য ও তার পাশাপাশি অমানবিক অত্যাচার শুরু করলে জুলিয়ান তার কন্যা ফ্লোরিডাকে রাজকীয় আদব-কায়দা শেখানোর জন্য রডারিকের কাছে প্রেরণ করেন। কিন্তু রডারিক ফ্লোরিডার সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে।  উইটিজা  ছিলেন জুলিয়ানের শ্বশুর।  শ্বশুর হত্যা ও কন্যার অপমানের প্রতিশোধ নিতে জুলিয়ান তার জনগণের প্রবল ইচ্ছার কারণে মুসলিম বীর মূসার কাছে আবেদন করলেন স্পেন জয় করার জন্য। স্পেনের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা যখন অত্যন্ত শোচনীয় তখন মূসাকে আহবান জানানো হয় তা আক্রমণের জন্য। সে সময় মুসলিম বিশ্বের শাসক ছিলেন ওয়ালীদ। মূসা তাঁর অনুমতি নিয়ে সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদকে পাঠান স্পেন আক্রমণে। পরে মূসা এসে তার সাথে যোগ দেন।

সেনাপতি তারিক ১২ হাযার সৈন্য নিয়ে রডারিকের ১ লক্ষ ২০ হাযার সৈন্যের মোকাবিলায় এগিয়ে আসেন। সৈন্য সংখ্যার ব্যবধান তাকে মোটেও ভাবিয়ে তোলেনি। কারণ তিনি জানতেন তাদের আসল শক্তি লোকবল নয়; বরং ঈমান।

৭১১ খৃষ্টাব্দে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে স্পেনের মাটিতে পা রেখেই সৈন্যদের নামিয়ে আনলেন তারিক। জ্বালিয়ে দিলেন তাদেরকে বয়ে আনা জাহাজগুলো। তারপর সৈন্যদের লক্ষ্য করে বীর সেনানী তারিক ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ‘প্রিয় বন্ধুগণ! এখন তোমাদের সামনে স্পেন, রডারিকের সেনাবাহিনী আর পিছনে ভূমধ্য সাগরের উত্তাল জলরাশি। তোমাদের সামনে দু’টো পথ। হয় লড়তে লড়তে জয়ী হয়ে ইসলামের বিজয় নিশান স্পেনের বুকে উড়ানো বা শাহাদাতের মর্যাদাসিক্ত হওয়া কিংবা সাগরের উত্তাল তরঙ্গের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাপুরুষোচিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। অত্যাচারী স্পেনীয় শাসক রডারিকের বিরুদ্ধে জিহাদ করে বিজয় ছিনিয়ে আনার বাসনা যদি থাকে তবে সামনে অগ্রসর হও।’ এই বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিমগণ মহান প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলার নামে রডারিকের রণসম্ভারে সুসজ্জিত বিশাল বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং কেড়ে নিয়েছিল স্পেন। রডারিক ওয়াডালেট নদীতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে। এ যুদ্ধ জয় ইসলামের আরেকটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।

আসলেই তখন ছিল ইউরোপীয় মানুষদের মধ্যযুগ। পুরো ইউরোপ জুড়ে তখন খৃষ্টীয় শাসন চলছিল। গীর্জা ও রাষ্ট্রের যৌথ শাসন জনগণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছিল। বিজ্ঞানীদের ধর্ম-বিদ্বেষী চিহ্নিত করে তাদের প্রতি নির্যাতন চলছিল। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল সর্বত্র। ধর্মীয় বিধানসমূহ গীর্জা ও পুরোহিত শাসকদের ইচ্ছানুযায়ী পরিবর্তিত হচ্ছিল বারবার।

এমনি সময়ে স্পেনের বুকে ইসলামের বিজয় ছিল স্পেনীয় সাধারণ মানুষের একটি বড় পাওনা। তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান, আদল-ইনছাফ, সাম্য-সৌভ্রাতৃত্ব, সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক নতুন সড়কে পা রাখল মুসলিম শাসন ব্যবস্থার অধীনে। মুসলিম শাসনের সময় স্পেনের রাজধানী ছিল গ্রানাডা এবং তার অপর প্রধান শহর ছিল কর্ডোভা। গ্রানাডায় গড়ে ওঠে মুসলিম সভ্যতার একটি অন্যতম বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সেখানকার আল-হামরা প্রাসাদ, গ্রান্ড মসজিদ আজো মানুষের কাছে বিস্ময়কর স্থাপত্য। কর্ডোভায় গড়ে ওঠে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রসমূহ। বিশ্বের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে গড়ে ওঠে কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়। সারা ইউরোপ থেকে দলে দলে শিক্ষার্থীরা এসে এখানে জড়ো হয় মুসলিম জগতের সহায়তায় গড়ে ওঠা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য। আজ যেমন লোকেরা হার্ভার্ড বা অক্সফোর্ডে যায়, তখন তারা যেত কর্ডোভায়। এ বাতিঘর থেকে আলোকিত হয়েই আধুনিক ইউরোপের উদ্দীপক ঘটনা শিল্প-বিপ্ল­বের নায়কেরা নিজ নিজ দেশে শিল্প গবেষণা ও উন্নয়নের রেনেসাঁর সূচনা করেন।

এভাবে মুসলিমদের সুশাসনে স্পেন হয়ে উঠে ইউরোপসহ সারা বিশেবর সকল মানুষের জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। মুসলিম শাসনামলে স্পেনের ঘরে ঘরে ইসলামের বিস্তার ঘটে। দুই সভ্যতার মিলনকেন্দ্র স্পেনে দীর্ঘ মুসলিম শাসনামল ছিল শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতার চরম উৎকর্ষের কাল, ধর্মীয় সহনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধের লালন ও বিকাশের সময়। মূলতঃ মুসলিমদের নিরলস প্রচেষ্টায় স্পেন জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সভ্যতার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি লাভ করে। দীর্ঘ ৮০০ বছর একটানা অব্যাহত থাকে এ উন্নতির ধারা। স্পেনে মুসলিমদের ৮০০ বছরের গৌরবময় শাসনের ফলে দেশটিতে তখন অর্থ-সম্পদ, বিত্ত-বৈভবের অঢেল জোয়ার। এ সময় ইউরোপের এ ভূখন্ডে গড়ে উঠেছিল এক অনন্য মুসলিম সভ্যতা। ফলে স্পেনীয় মুসলিমগণ সমগ্র ইউরোপের সামনে সভ্যতা ও সংস্কৃতির মডেল হিসাবে চিহ্নিত হয়। এটিকে ইউরোপ স্বীকৃতি দিয়েছে ‘মরুসভ্যতা’ হিসাবে।

প্রকৃতপক্ষে ইউরোপের বাতিঘর গ্রানাডা ছিল সকল মানুষের জন্য এক আকর্ষণীয় কেন্দ্রবিন্দু। কালক্রমে এ সভ্যতায় ভাটা পড়ে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে মুসলিমদের শাসন ক্ষমতায় অবক্ষয় দেখা দেয়। একে একে মুসলিমগণ সময়ের সাথে সাথে বদলে যেতে থাকেন। নবম থেকে পঞ্চদশ শতক খৃষ্টানদের মধ্যযুগের শেষ পর্যায়। স্পেনের গ্রানাডার মুসলিম রাষ্ট্র তীব্র গতিতে ছুটছিল ধ্বংসের দিকে। কালের আবর্তে মুসলিম শাসক ও জনগণ হারিয়ে ফেলল তাঁদের মূল শক্তি ঈমান। মুসলিমদের মধ্যে শুরু হ’ল ক্ষমতার টানাটানি। মুসলিমরা ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে ভুলে যায় কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা। নৈতিক অবক্ষয় ও অনৈক্য ধীরে ধীরে গ্রাস করে তাদের। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সন্ধানে কঠিন সাধনার পথ ছেড়ে তারা ধীরে ধীর ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশে মত্ত হয়ে পড়ে। ঐক্য-সংহতি, শৌর্যের স্থলে তারা বিভক্তি, হানাহানি, ভীরুতা ও অদূরদর্শিতার পথে পা বাড়ায়। তাদের মাঝে শুরু হয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, গড়ে উঠে রং-মহল, তাদের হেরেমের নেতৃত্ব চলে যায় ইউরোপীয় রাজন্যবর্গের সুন্দরী আত্মীয়দের হাতে।

মুসলিম শাসকরা যখন কুরআন ও সুন্নাহর কথা একেবারে ভুলে গিয়ে জনসাধারণের সুখ-শান্তির মূলে পদাঘাত করে ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে পড়ে তখন তারা হারিয়ে ফেলে ইসলামী চেতনা। কিন্তু পাশর্ববর্তী রাজ্যগুলোর খৃষ্টান রাজারা মুসলিমদের এ দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে। খৃষ্টান নৃপতিরা চারিদিকে মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত হ’তে থাকে। তারা মেতে উঠে কুটিল ষড়যন্ত্রে। তারা ঘোষণা করে যে, পিরিনিজ পর্বতমালা অতিক্রমকারী দুর্ধর্ষ মুসলিম বাহিনীকে যদি হটানো না যায়, তাহ’লে আগামী দিনগুলোতে ইউরোপের সকল গীর্জা থেকে মুসলিমদের আযান ধ্বনি শোনা যাবে। ফলে তারা সিদ্ধান্ত নেয় স্পেনের মাটি থেকে মুসলিমদের উচ্ছেদ করার। এতদুদ্দেশ্যে পর্তুগীজ রাণী ইসাবেলা পাশর্ববর্তী রাজা ফার্ডিন্যান্দের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয় এবং উভয়ে খৃষ্টান বাহিনীর নেতৃত্ব দেয়। মুসলমানদের শক্তি অপ্রতিরোধ্য ছিল। স্পেন থেকে মুসলমানদের উৎখাত করার জন্য খৃষ্টানরা অনেকবারই চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু সফল হ’তে পারেনি। তাই তারা মুসলমানদের এ শক্তির রহস্য জানতে গিয়ে অবগত হ’ল যে, মুসলমানদের আত্মিক শক্তির মূল রহস্য হচ্ছে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি। তারা একমাত্র আল্ল­াহইে ভয় করে, অন্য কাউকে নয়। তারা মূলে আঘাত হেনে মুসলমানদের ঈমানী শক্তি দুর্বল করার জন্য মদ এবং নেশাজাতীয় সামগ্রী স্পেনে রফতানী আরম্ভ করল। তাদের এ কৌশলে ধীরে ধীরে মুসলমানদের ঈমান দুর্বল হ’তে লাগল। এক সময় পাশ্চাত্যের ক্যাথলিক খৃষ্টানরা স্পেনের সকল যুবকদের কাবু করে ফেলল।

১৫শ’ শতাব্দীর শেষে স্পেনের মুসলিম শাসক বাদশাহ হাসানকে পরাস্ত করার লক্ষ্যে তারই ছেলে আব্দুল­াহকে দিয়ে হাসানের বিরুদ্ধে খৃষ্টানরা বিদ্রোহ করাল। খৃষ্টানরা তাকে বুঝাল যে, বাবাকে গদিচ্যুত করতে পারলে তোমাকে ক্ষমতায় বসানো হবে। পিতার বিরুদ্ধে আবু আব্দুল্ল­াহ বিদ্রোহ করলে, তিনি ক্ষমতা ছেড়ে পলায়ন করেন। আবু আব্দুল্ল­াহ ক্ষমতা গ্রহণ করার পর পরই শুরু হয় স্পেনের মুসলিমদের পতন। কিন্তু বেশী দিন স্থায়ী হয়নি তার এ মসনদ। আবু আব্দুল্ল­াহর দুর্বল নেতৃত্ব, নৈতিক অবস্থান চিন্তা করে রাজা ফার্ডিন্যান্দ ও রাণী ইসাবেলার যৌথ বাহিনী স্পেন আক্রমণ করে বসে। আক্রমণ নিয়ে আবু আব্দুল্ল­াহ আলোচনার জন্য দরবারে বিশেষ সভার আয়োজন করেন। ফার্ডিন্যান্দ আবু আব্দুল্ল­াহকে আশ্বাস দেয় যে, তারা যদি বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাহ’লে তাদের জীবন রক্ষা করা হবে। দুর্বল রাজা ও তার সভাসদবর্গ অবশেষে নিজেদের জীবন বাঁচাতে অতীতের চুক্তিভঙ্গের রেকর্ড ভুলে গিয়ে ফার্ডিন্যান্দের সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আবু আব্দুল্ল­াহর সভাসদের অন্যান্য সকলেই খৃষ্টানদের সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করতে রাজি হ’লেও, কিন্তু সেনাপতি মূসা এ সন্ধি মানতে রাজি হ’লেন না। কারণ খৃষ্টানদের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে তিনি ভালভাবে অবহিত ছিলেন।

রাজা পঞ্চম ফার্ডিন্যান্দের সাথে পর্তুগিজ রাণী ইসাবেলার বিয়ের মাধ্যমে গড়ে ওঠা খৃষ্টান শক্তির ঐক্য স্পেনে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা মুসলিমদের প্রদীপে বাতাসের প্রবল ঝাপটা দিল। ফার্ডিনান্দের শক্তির সামনে ছোট ছোট মুসলিম শাসকরা ছিল দুর্বল, বলা যেতে পারে প্রায় শক্তিহীন। মুসলিমদের ধর্মচ্যুত করার পায়তারা চলে ফার্ডিন্যান্দের আমলে। মুসলিমদের আরবী পড়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আরবীয় পোশাক পরা ছিল আইন পরিপন্থী। বাধ্য করা হয় মুসলিমদের খৃষ্টান স্কুলে ভর্তি হ’তে। এতে যারা খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করত, তাদের জন্য ছিল বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা। মুসলিমদের জন্য বিশেষ পোশাক ছিল, যা দেখে যত্রতত্র তাদের অপদস্থ করা হ’ত।

বিয়ের পর দু’জনে সম্মিলিতভাবে মুসলিম নিধনে নেতৃত্ব দেয়। সম্মিলিত খৃষ্টান বাহিনী হাযার হাযার মুসলিম নারী-পুরুষকে হত্যা করে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে উল্লাস করতে করতে ছুটে আসে রাজধানী গ্রানাডায়। সম্মুখ যুদ্ধে মুসলিমদের কখনও পরাজিত করতে পারেনি বলে চতুর ফার্ডিন্যান্দ পা বাড়ায় ভিন্ন পথে। তার নির্দেশে আশপাশের সব শস্যখামার জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আগুন জ্বালিয়ে পুড়ে দেয়া হয় শহরের খাদ্য সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র ভেগা উপত্যকা। অচিরেই দুর্ভিক্ষ নেমে আসে শহরে।

এভাবে একের পর এক স্পেনের অধিকাংশ এলাকা খৃস্টানদের দখলে চলে যায়। অনেক আগেই তারা মুসলিমদের হাত থেকে কর্ডোভাসহ অনেক অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। বাকি ছিল গ্রানাডা। মুসলিম সেনাপতি মূসা আত্মসমর্পণের চেয়ে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জন দেয়াকেই অধিক সম্মানজনক মনে করেছিলেন। আবু আব্দুল্লাহ খৃষ্টানদের কাছে আত্মসমর্পণ করে প্রাণে রক্ষা পাবেন বলে যে ধারণা করেছিলেন, শিগগিরই তা মিথ্যায় পর্যবসিত হয়। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ফার্ডিন্যান্দ বাহিনী শহর অবরোধ করে রাখে। বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যান কিছু মুসলিম।

মুসলিম বাহিনীর শেষ আশ্রয়স্থল ছিল রাজধানী গ্রানাডা। ফার্ডিন্যান্দ বাহিনীও গ্রানাডার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছে যায়। ১৪৯১ সালের ২৪ নভেম্বর সহজেই ফার্ডিন্যান্দ গ্রানাডার রাজপথসহ সমগ্র শহর দখল করে নেয়। শুরু করে নৃশংস ও বর্বর হত্যাযজ্ঞ, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ। অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে অনেক মুসলিম স্থানে স্থানে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহী এসব লোকজনকে হত্যা করা হয়। এক পর্যায়ে রাজা ফার্ডিন্যান্দ ও ইসাবেলার বাহিনীর পক্ষ থেকে একটি ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয় যে, ‘মুসলিমগণ যদি শহরের প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত করে দিয়ে এবং নিরস্ত্র হয়ে গ্রানাডার মসজিদগুলোতে আশ্রয় নেয়, তবে তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হবে। আর যারা খৃষ্টান জাহাজগুলোতে আশ্রয় নেবে, তাদের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়া হবে। অন্যথা আমাদের হাতে তোমাদের প্রাণ হারাতে হবে।’

অসহায় মুসলিমগণ আল্লাহর উপর ভরসা করার কথা ভুলে গিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যুদ্ধ বন্ধ করে দেয়। সেদিন ছিল ১৪৯২ খৃষ্টাব্দের ১লা এপ্রিল মোতাবেক ৮৯৭ হিজরীর ১২ রবীউল আউয়াল। দুর্ভাগ্যতাড়িত গ্রানাডাবাসী অসহায় নারী ও মা‘ছূম বাচ্চাদের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে খৃষ্টানদের আশবাসে বিশবাস করে খুলে দেয় শহরের প্রধান ফটক। সরল বিশবাসে, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সেদিন হাযার হাযার মুসলিম নর-নারী, বৃদ্ধ-শিশু সবাইকে নিয়ে আশ্রয় নেয় আল্লাহর ঘর পবিত্র মসজিদে। অনেকে আরোহণ করে জাহাজে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস মিথ্যাবাদী প্রতারক কুখ্যাত ফার্দিন্যান্দ ইসাবেলার খৃষ্টান বাহিনী শহরে প্রবেশ করে মুসলিমদেরকে মসজিদের ভেতর আটকে রেখে প্রতিটি মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয়। তারা তখনও জানত না যে, তারা মুসলিম ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর ইতিহাসে পরিণত হ’তে যাচ্ছে। এরপর রাতের আঁধারে একযোগে শহরের সমস্ত মসজিদের চারিপাশের্ব আগুন লাগিয়ে মসজিদে আশ্রয় গ্রহণকারী নিরস্ত্র হাযার হাযার নিরপরাধ মুসলিম শিশু-বৃদ্ধ নর-নারীকে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে বর্বর উল্লাসে মেতে ওঠে। লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু অসহায় আর্তনাদ করতে করতে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারায় মসজিদের ভেতর। প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখায় দগ্ধ অসহায় মুসলিমদের আর্তচিতকার যখন গ্রানাডার আকাশ-বাতাস ভারী ও শোকাতুর করে তুলল, তখন ফার্দিন্যান্দ ও রাণী ইসাবেলা আনন্দে আত্মহারা হয়ে হেসে বলতে লাগল, ‘হায় মুসলিম! হায় (April’s Fool) এপ্রিলের বোকা। শত্রুর আশ্বাসে কেউ বিশ্বাস করে’? দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুন, নারী-পুরুষের আর্ত চিৎকার আর ফার্ডিন্যান্দ-ইসাবেলার ক্রুর হাসি একাকার হয়ে যায়। ওদিকে জাহাজে আরোহণকারী মুসলিমদের জাহাজ ডুবিয়ে হত্যার মাধ্যমেও খৃষ্টানরা বিশবাসঘাতকতার পরিচয় দেয়। জীবিতদেরকে জোরপূর্বক খৃষ্টান বানায়। ৭১২ সালে এক মুসলিম সেনাপতি মূসা যে রাজ্যের পত্তন করেন। ৭৮০ বছর পরে ১৪৯২ সালে ঐ নামের আরেক সেনাপতির হাতে একই রাজ্যের পতন ঘটে। এ হৃদয়বিদারক ও করুণ ঘটনার মাধ্যমেই নিভে গেল মিটমিট করে জ্বলতে থাকা মুসলিম রাষ্ট্রশক্তির প্রদীপের শেষ আলো। মুসলিমদের বোকা বানিয়ে মুসলিম ইতিহাসের এক রক্তাক্ত জঘন্য উৎসবে মেতেছিল খৃষ্টানরা, আর এখনও সে ধারাবাহিকতা চলছে সারা বিশেব। একদিন যে কর্ডোভা ও গ্রানাডার মসজিদগুলো থেকে পাঁচ ওয়াক্ত আযান ধ্বনিত হ’ত, আন্দোলিত হ’ত স্পেনের মুসলিদের হৃদয়, আজ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সব গীর্জার স্তম্ভ। যেকোন মুসলিম স্পেনের বিমানবন্দরে ছালাত আদায়ের জন্য দাঁড়ালে অন্যরা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে, কী করছে এই লোক? আহ্ কী অসহ্য দৃশ্য!

আজ হ’তে প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ বছর আগে সেই যে স্পেনের রাজধানীতে এক ট্রাজেডির মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় মুসলিমদের পতন হয়, তা কেবল একটি ঘটনামাত্র নয়, বরং হাযার ঘটনার জন্মদাতা। এরই পথ ধরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে থাকে বিদ্বেষী খৃষ্টান-ইহুদীগণ। পরপর তিনটি ক্রুসেডের পর মুসলিম দুনিয়া মূলতঃ অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিতে পরিণত হয়। ফলে পরাজিত মুসলিমগণ বিজয়ীদের সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক গোলামে পরিণত হয়।

মূলতঃ ফার্ডিন্যান্দের হাতে স্পেনের পতন, চেঙ্গিসের হাতে বোখারার পতন, হালাকু খাঁর হাতে বাগদাদের পতন, লর্ড ক্লাইভের হাতে সিরাজের পতন আর বেলফোর ঘোষণার মধ্যে দিয়ে ইসরাঈল নামক মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়ার জন্ম; এ সবই যেন একই সুতোয় গাঁথা। আর বর্তমান সময়ে ইরাক ও আফগানিস্তানে যা হচ্ছে, গোটা মধ্যপ্রাচ্যে যা কিছু ঘটছে এগুলোও বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। সময়ের পার্থক্য ছাড়া এ সব ঘটনার প্রকৃতি, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, পরিণতি প্রায় এক ও অভিন্ন। আমরা হয়ত একটি ঘটনা বিশ্লে­ষণ করি, কষ্ট পাই, আহত হই, আবার সাহসও খুঁজে পাই কিন্তু এড়িয়ে যাই অপর ঘটনা। অথচ এ সবের মাঝে থোড়াই পার্থক্য।  আমাদের এই যে চেইন অভ ট্রাজেডি, তার কী কোন শেষ নেই? যে দিকে তাকাই দেখতে পাই একই দৃশ্যপট, একই দৃশ্যকাব্য, আমরা আমাদের অনৈক্য, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত, অবিমৃষ্যকারিতার মাশুলও দিয়ে চলেছি।

‘এপ্রিল ফুল ডে’ উদযাপনে একে অন্যকে বোকা বানায়। এপ্রিল ফুল বাংলাদেশের বা প্রাচ্যের কোন উৎসব বা আনন্দের দিন নয়। বাংলাদেশসহ এ উপমহাদেশে দিনটির প্রচলন হয় ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পরিণামে। ব্রিটিশরা আমাদের প্রায় ২০০ বছর শাসন করেছিল। অন্য অনেক কিছুর মতো ইংরেজরা এ দেশে তাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির নানা বিষয় চালু করে। এর একটি দৃষ্টান্ত, এপ্রিলের ১ তারিখে ‘এপ্রিল ফুল ডে’ চালু করা।

ইংল্যান্ডে আঠারো শতক থেকে দিনটি ব্যাপকভাবে উদযাপিত হ’তে থাকে। ইংরেজ ও ফরাসিরা তাদের উপনিবেশগুলোতে এ প্রথার প্রচলন করে। স্কটল্যান্ডে ৪৮ ঘণ্টাব্যাপী এপ্রিল ফুল ডে উদযাপিত হয়। মেক্সিকোতে এ দিবসটি অন্য প্রেক্ষাপটে উদযাপিত হয়ে থাকে। ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ খৃষ্টানরা এরাডসের হাতে নিষ্পাপ শিশুদের নির্মম হত্যাকান্ডের স্মরণে দিনটি উদযাপন করে।

এপ্রিল ফুলের এ ব্যাখ্যাটি দিয়েছেন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রফেসর জোসেফ বসকিন। তিনি বলেন, এ প্রথাটির শুরু হয় রোমান সম্রাট কনস্ট্যান্টাইনের (২৮৮-৩৩৭ খৃঃ) শাসনামলে। হাসি-ঠাট্টা নিয়ে মেতে থাকে এমন একদল বোকা গোপাল ভাঁড় সম্রাটকে কৌতুক করে বলে, তারা রাজার চেয়ে ভালভাবে দেশ চালাতে পারবে। রাজা মহোদয় বেশ পুলকিত হ’লেন। রাজা গোপাল ভাঁড়দের সর্দার কুগেলকে একদিনের জন্য বাদশাহ বানিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন। আর কুগেল সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যময় আইন জারি করে দিল যে, প্রতি বছরের এ দিনে সবাই মিলে তামাশা করবে। প্রফেসর বসকিন আরো বলেন, প্রাচীন ঐ সময়ের মারাত্মক দিনগুলোতে রাজাদের দরবারে কিন্তু বোকারূপীরাই ছিল প্রকৃত জ্ঞানী। তারা মজা বা হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে অনেক কাজ কৌশলে হাছিল করে নিত বা জ্ঞানের কথা রসালোভাবে চারদিকে ছড়িয়ে দিত। ১৯৮৩ সালে বার্তা সংস্থা এপি পরিবেশিত বসকিনের এ ব্যাখ্যাটি অনেক কাগজে নিবন্ধাকারে প্রকাশিত হয়। বসকিন মূলতঃ আগের সব ব্যাখ্যাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। আর্টিকেলটি ছাপানোর আগে এপি দুই সপ্তাহ ধরে ভেবেছে তারাই এপ্রিল ফুল বোকামির শিকার হচ্ছে না তো!

পাশ্চাত্যের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে কাউকে বিভিন্নভাবে বোকা বানানোর প্রথা চালু আছে। রোমানদের হিলারিয়া উৎসবও এর অন্যতম। তারা মার্চের ২৫ তারিখে আট্রিসের পুনরুত্থান নিয়ে এ দিনে হালকামি করত, ইহুদীরা করত পুরিম উপলক্ষে। হিন্দুরাও হোলি উৎসব এ দিনের আশেপাশে করে থাকে।

অন্যান্য দিবসের মতো এপ্রিল ফুল দিবসটির উৎপত্তি পাশ্চাত্যে হ’লেও এর বিস্তৃতি এখন দেশে দেশে। পশ্চিমা সমাজে এ সংস্কৃতির চর্চা ব্যাপক। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, নির্মম কৌতুকও করা হয়। যেমন, কারো পিতামাতা বা স্ত্রীর ও বন্ধুর মৃত্যুর সংবাদ পরিবেশন করে কৌতুক করা হয়। সাদা কাগজ খামে ভর্তি করে বা স্বাক্ষর ছাড়া শূন্য চেক বন্ধুর কাছে পাঠিয়েও কৌতুক করা হয়। এপ্রিল ফুল উৎসব আজ মুসলিমদের জীবনেও প্রবেশ করেছে। অথচ এর উৎসব মূলতঃ মুসলিমদের বিরুদ্ধে স্পেনের মাটিতে খৃষ্টানদের প্রতারণাপূর্ণ বিজয়ের ইতিহাস। কেননা পয়লা এপ্রিলের অন্য সব ইতিহাস ১৪৯২ সালের পরে। আর ঈসা (আঃ) সম্পর্কিত ঘটনার ভিত্তি খুবই দুর্বল। প্রকৃতপক্ষে, ইতিহাসের অলীক মারপ্যাঁচে এ পৃথিবীর মুসলিমদেরকে এপ্রিল ফুলের মাধ্যমে বোকা বানানোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে গিয়ে মূলতঃ তারাই বোকা বনে গেছে।

মুসলিমদের বোকা বানানোর এ দিনটিকে স্মরণীয় করতে আসল ঘটনা বেমালুম চাপা দিয়ে ১৫০০ সালের ১লা এপ্রিল থেকে সমগ্র খৃষ্টান জগতে এ দিনটিকে হাসি, ঠাট্টা এবং মিথ্যা প্রেম দেয়া-নেয়ার দিন হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করে আসছে। আজ অবধি ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ সমগ্র বিশেব বোকা বানানোর এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। এ দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন রকমের ‘এপ্রিল ফুলস্ ডে’ সম্বন্ধীয় বিশেষ কার্ড ও নিমন্ত্রণপত্র বের হয় পশ্চিমা দেশগুলোতে। খরচ করা হয় হাযার হাযার ডলার। পশ্চিমা দেশের মতো আমাদের দেশেও এপ্রিল ফুলের প্রচলন আছে। শহর কিংবা গ্রামে সব জায়গাতেই এ দিনে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে অনেক ঠাট্টা-মসকরা এবং হৃদয়গ্রাহী রসিকতা চলে।

অত্যাচারী রাজা রডারিকের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ জনগণকে মুক্তি দেয়ার জন্য বীর মুজাহিদ তারিক বিন যিয়াদ স্পেনে যে ইসলামী শাসনের সূত্রপাত করেছিলেন তার সুফল ভোগ করেছিল স্পেনবাসী দীর্ঘ ৮০০ বছর। স্পেনের ইতিহাসে এ স্বর্ণালী সময়ের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে গ্রানাডা, আল-হামরা, কর্ডোভা, সেভিজা, টলেডো। কিন্তু আফসোস! বিলাসবসনে মত্ত হয়ে মুসলিমরা ইসলাম থেকে সরে দাঁড়ানোর ফলে তাদের জীবনে সীমাহীন দুঃখই কেবল নেমে আসেনি, তাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিলীন হয়ে গেছে স্পেনের মাটি থেকে। ১৯৯৩ সালের ১ এপ্রিল গ্রানাডা ট্র্যাজেডির (পশ্চিমা বিশেব স্পেন থেকে মুসলিম উৎখাতের) ৫০০ বছর পূর্তি (১৪৯২-১৯৯২) উপলক্ষে স্পেনে আড়ম্বরপূর্ণ এক সভায় মিলিত হয়েছিল বিশব খৃষ্ট সম্প্রদায়। সেখানে তারা নতুন করে শপথ গ্রহণ করে একচ্ছত্র খৃষ্টীয় বিশব প্রতিষ্ঠার। বিশবব্যাপী মুসলিম জাগরণ প্রতিহত করার জন্য গড়ে তোলে ‘হলি মেরি ফান্ড’। আর এরই ধারাবাহিকতায় গোটা খৃষ্টান বিশব নানা অজুহাতে একের পর এক মুসলিম দেশগুলোতে আগ্রাসন চালাচ্ছে। অতএব সামনে ভয়াবহ দুর্দিন। এই দুর্দিনে এসব নব্য ইসাবেলাদের বিরুদ্ধে শান্তিকামী মুসলিম শক্তির চাই সুদৃঢ় ঐক্য। আর যদি তা করতে আমরা ব্যর্থ হই তবে অচিরেই গ্রানাডার মতো বধ্যভূমিতে পরিণত হবে গোটা মুসলিম বিশব।

ইতিহাসের হৃদয়বিদারক ঘটনা ভুলে না গেলে এপ্রিল ফুল কোনো মুসলিমকে আনন্দ দান করতে পারে না। এখন আমরা কি পয়লা এপ্রিল হাসি-আনন্দের সাথে ‘এপ্রিল ফুল ডে’ উদযাপন করব, নাকি ইউরোপের বুকে অসহায় মুসলিম নারী-পুরুষ, শিশুদের নৃশংস হত্যাকান্ডের স্মরণে দুঃখ অনুভব করব, মুসলিম ভাই-বোনেরা ভেবে দেখবেন কি?

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, ইসলামী দৃষ্টিকোণে সবচেয়ে ঘৃণিত হচ্ছে হাসি-মসকরাচ্ছলে মিথ্যা বলা। অনেকে ধারণা করে যে হাসি-রসিকতায় মিথ্যা বলা বৈধ। আর এ থেকেই বিশ্ব ধোঁকা দিবস বা এপ্রিল ফুলের জন্ম। এটা ভুল ধারণা, এর কোন ভিত্তি নেই ইসলাম ধর্মে। রসিকতা কিংবা স্বাভাবিক অবস্থায় মিথ্যা সর্বাবস্থায় হারাম। ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আমি রসিকতা করি ঠিক, তবে সত্য ব্যতীত কখনো মিথ্যা বলি না’। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, ছাহাবায়ে কেরাম একদা বলল, হে আল্ল­াহর রাসূল, আপনি তো আমাদের সঙ্গে রসিকতা করেন। তিনি বললেন, ‘আমি সত্য ভিন্ন কিছু বলি না’।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ‘এপ্রিল ফুল ডে’ উদযাপন তথা একে অন্যকে বোকা বানিয়ে, মিথ্যা বলে আনন্দ লাভ করার প্রচেষ্টা ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের পরিপন্থী। সুতরাং এ থেকে আমাদের বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!

নূরজাহান বিনতে আব্দুল মজীদ

গোবিন্দা, পাবনা।

১. তাবরানী ১২/৩৯১; ছহীহুল জামে হা/২৪৯৪।

২. তিরমিযী, হা/১৯৯০।






সূরা ফাতিহার ফযীলত ও বৈশিষ্ট্য - শিউলী ইয়াসমীন
পর্দা : বন্দীত্ব নয় স্বাধীনতা - নিশাত তাসনীম
বিশ্ব ভালবাসা দিবস
মিডিয়া আগ্রাসনের কবলে ইসলাম ও মুসলিম (পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এপ্রিল ফুল বা এপ্রিলের বোকা! - নূরজাহান বিনতে আব্দুল মজীদ
শিশু প্রতিপালন : কতিপয় পরামর্শ
সমাজে প্রচলিত কিছু শিরক - নূরজাহান বিনতে আব্দুল মজীদ
ছয়টি বাক্যের অনন্য সান্ত্বনা ও আমাদের শিক্ষা - শরীফা বিনতে আব্দুল মতীন
নিজে বাঁচুন এবং আহাল-পরিবারকে বাঁচান!
মহিলা তা‘লীম বৈঠক : সমাজ সংস্কারে ভূমিকা - শরীফা বিনতে আব্দুল মতীন
মিডিয়া আগ্রাসনের কবলে ইসলাম ও মুসলিম - নূরজাহান বিনতে আব্দুল মজীদ
আরাফাহ দিবস : গুরুত্ব ও ফযীলত - আত-তাহরীক ডেস্ক
আরও
আরও
.