নবী করীম (ছাঃ)-এর মদীনায় হিজরতের পূর্বে ইয়াছরিবের কতিপয় লোক হজ্জের মৌসুমে মক্কায় এসে আক্বাবা নামক স্থানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাতে আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করেন। যার মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-এর মদীনায় হিজরতের সূচনা হয়। সে সম্পর্কিত দু’টি হাদীছ-

ইমাম আহমাদ কর্তৃক জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে হাসান সনদে বর্ণিত হয়েছে, জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা কোন কথার উপরে আপনার নিকটে বায়‘আত করব? তিনি বললেন, (১) সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় আমার কথা শুনবে ও মেনে চলবে (২) অভাবে ও সচ্ছলতায় সর্বাবস্থায় (আল্লাহর রাস্তায়) খরচ করবে (৩) সর্বদা ন্যায়ের আদেশ দিবে ও অন্যায় থেকে নিষেধ করবে (৪) আল্লাহর জন্য কথা বলবে এভাবে যে, আল্লাহর পথে কোন নিন্দুকের নিন্দাবাদকে পরোয়া করবে না (৫) যখন আমি তোমাদের কাছে হিজরত করে যাব, তখন তোমরা আমাকে সাহায্য করবে এবং যেভাবে তোমরা নিজেদের ও নিজেদের স্ত্রী ও সন্তানদের হেফাযত করে থাক, সেভাবে আমাকে হেফাযত করবে। বিনিময়ে তোমরা ‘জান্নাত’ লাভ করবে’ (৬) ওবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) বর্ণিত অপর রেওয়ায়াতে এসেছে যে, ‘আর তোমরা নেতৃত্বের জন্য ঝগড়া করবে না’।[1]

বস্ত্ততঃ প্রায় দেড় হাযার বছর পূর্বে নেওয়া বায়‘আতের শর্তগুলির প্রতিটির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এ যুগেও পুরোপুরিভাবে বিদ্যমান। সেদিনও যেমন জান্নাতের বিনিময়ে নেওয়া বায়‘আত সর্বাত্মক সমাজবিপ্লবের কারণ ঘটিয়েছিল, আজও তেমনি তা একই পন্থায় সম্ভব, যদি আমরা আন্তরিক হই।

জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কায় দশ বছর অবস্থান করেছিলেন। [মক্কায় দশ বছর তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করেন। প্রথম অহী লাভের পর তিন বছর গোপনে ইসলাম প্রচার করেন। সম্ভবত এই তিন বছর হিসাবে ধরা হয়নি] তিনি উকায, মাজান্না ও হজ্জ মৌসুমে মিনায় জনসমাগম স্থলে লোকদের অনুসরণ করতেন। তিনি তাদের বলতেন, এমন কে আছে যে আমাকে আশ্রয় দিবে এবং আমাকে সাহায্য করবে, যাতে আমি আমার প্রভুর বার্তা (মানুষের নিকট) পৌঁছে দিতে পারি আর বিনিময়ে সে জান্নাত লাভ করবে? এমনি করে হয়তো একজন লোক ইয়ামন প্রদেশ কিংবা মুযার গোত্র থেকে আসে আর তিনি তাকে এভাবে বলেন, অতঃপর সে তার গোত্রে ফিরে যায় তখন গোত্রের লোকেরা বলে, কুরাইশদের ঐ নওজওয়ানকে তুমি এড়িয়ে চলবে, সে যেন তোমাকে ফিতনায় না ফেলে। তিনি তাদের সওয়ারি/কাফেলাগুলোর মাঝে হেঁটে চলেন; তারা তখন তাকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে। এমনি করে আল্লাহ তা‘আলা ইয়াছরিব থেকে আমাদেরকে তাঁর নিকট পাঠালেন। আমরা তাঁকে আশ্রয় দিলাম এবং তাঁকে সত্য বলে মানলাম। আমাদের কোন লোক তাঁর নিকট গেলে সে তাঁর উপর ঈমান আনত, তিনি তাকে কুরআন শিখাতেন। তারপর সে তার পরিবারে ফিরে এলে তার ইসলাম গ্রহণের কারণে তারাও ইসলাম গ্রহণ করত। এমনিভাবে আনছারদের এমন কোন বাড়ি বাকী ছিল না, যেখানে একদল মুসলিম ছিল না। তারা তাদের ইসলাম (গ্রহণের বিষয়) প্রকাশ করত। তারপর তারা সবাই মিলে পরামর্শ করল। আমরা বললাম, কতকাল আর আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ছেড়ে থাকব আর তিনিই বা কতকাল মক্কার পাহাড়গুলোতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ঠেলা খেয়ে ফিরবেন। তখন আমাদের মধ্য হ’তে সত্তর জন লোক তাঁর নিকট যাত্রা করলাম। হজ্জ মৌসুমে আমরা তাঁর সঙ্গে মিলিত হ’লাম। আমরা তাঁর সঙ্গে মিলিত হ’তে আক্বাবার গিরিপথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হ’লাম। আমরা একজন দু’জন করে সবাই তাঁর সঙ্গে মিলিত হ’লাম। আমরা তাঁকে বললাম, আমরা আপনার হাতে কিসের উপরে বায়‘আত গ্রহণ করব। তিনি বললেন, তোমরা আমার নিকট এই শর্তে বায়‘আত গ্রহণ কর যে, তোমরা আমীরের কথা শুনবে ও মানবে কর্মমুখর সময়ে ও অলস মুহূর্তে, অর্থ ব্যয় করবে সচ্ছলতায় ও অসচ্ছলতায়, আদেশ করবে সৎ কাজের এবং নিষেধ করবে অসৎ কাজের। তোমরা আল্লাহর পক্ষে কথা বলবে। আল্লাহর পক্ষে কথা বলতে কোন নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবে না। আর আমি যখন তোমাদের ওখানে যাব তখন তোমরা আমাকে সাহায্য করবে এবং যা কিছু থেকে তোমরা নিজেদের জীবন, স্ত্রী ও সন্তানদের রক্ষা কর, তৎসমুদয় থেকে আমাকে রক্ষা করবে। (এ সবের বিনিময়ে) তোমাদের জন্য জান্নাত রয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর আমরা তাঁর নিকট উঠে গেলাম এবং বায়‘আত গ্রহণ করলাম। আস‘আদ ইবনু যারারাহ তাঁর হাত ধরল। সে ছিল দলের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে ছোট। সে বলল, হে ইয়াছরিববাসী একটু থাম। তিনি যে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সে কথা জেনেই আমরা উট হাঁকিয়ে এখানে এসেছি। আজ তাঁকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার অর্থ সারা আরবের বিরোধিতা কাঁধে তুলে নেওয়া, তোমাদের শ্রেষ্ঠজনদের নিহত হওয়া এবং তোমাদের তলোয়ারের পাকড়াওয়ের মুখোমুখি হওয়া। এখন ভেবে চিন্তে বল, তোমরা কি এসব বিষয়ে ধৈর্য ধরে থাকবে এবং আল্লাহর নিকট থেকে পুরস্কার লাভ করবে, নাকি কাপুরুষতা বশত নিজেদের জীবন বাঁচানোর ভয় করবে? এটা আল্লাহর নিকট তোমাদের ওযর হ’তে পারে। তারা বলল, হে আস‘আদ, আমাদের থেকে দূর হও। আল্লাহর কসম! আমরা এই বায়‘আত কখনই ত্যাগ করব না এবং কখনই তা ছিন্ন করব না। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর আমরা তাঁর নিকট উঠে গেলাম এবং বায়‘আত করলাম। তিনি আমাদের থেকে শর্তমূলে বায়‘আত গ্রহণ করলেন এবং বিনিময়ে তিনি আমাদের জান্নাত দিলেন। অর্থাৎ জান্নাত লাভের প্রতিশ্রুতি দিলেন’।[2]

[1]. আহমাদ হা/১৪৪৯৬; সিলসিলা ছাহীহাহ হা/৬৩; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৬৬।

[2]. আহমাদ হা/১৪৪৯৬; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬২৭৪; বায়হাকী, সুনানুল কুবরা হা/১৬৫৫৬।






হাদীছের গল্প - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
মুসলিম ও মুশরিকদের একত্রিত মজলিসে সালাম দেয়ার পদ্ধতি - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
মহামারী আক্রান্ত এলাকায় না যাওয়া - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
যু-ক্বারাদ ও খায়বার যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-এর মু‘জেযা এবং ছাহাবীগণের অতুলনীয় বীরত্ব - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
ছালাত-ছিয়াম ও দান-ছাদাক্বার উপমা - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
কাউকে জান্নাতী বা জাহান্নামী বলা যাবে না - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
রাসূল (ছাঃ) ও মুজাহিদদের সম্পদে বরকত - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
আল্লাহর উপর ভরসার প্রতিদান - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
জাবের ইবনু আব্দিল্লাহ (রাঃ)-এর উটের ঘটনা - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
মুমিনদের শাফা‘আত - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
জান্নাত-জাহান্নামের সৃষ্টি ও জাহান্নামের কতিপয় শাস্তি - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
ওযূবিহীন ছালাত আদায়ের শাস্তি - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আরও
আরও
.