عَنِ ابْنِ عُمَرَ رضى الله عنهما قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بُنِىَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالْحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ-
১. অনুবাদ : হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন যে, ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপরে দন্ডায়মান (১) সাক্ষ্য দান করা এই মর্মে যে, ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল’ (২) ছালাত কায়েম করা (৩) যাকাত আদায় করা (৪) হজ্জ সম্পাদন করা ও (৫) রামাযানের ছিয়াম পালন করা।[1]
২. রাবীর পরিচয় : রাবী আব্দুল্লাহ দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র-যিনি ইসলাম জগতে ‘ইবনু ওমর’ নামে সমধিক পরিচিত। হযরত ওমরের আরও পুত্র সন্তান থাকলেও ‘ইবনে ওমর’ বলতে কেবল ‘আব্দুল্লাহ বিন ওমর’-কেই বুঝানো হয়। তিনি প্রসিদ্ধ চারজন আব্দুল্লাহ-র অন্যতম। চারজন আব্দুল্লাহ হ’লেন হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর, আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ, আব্দুল্লাহ বিন আববাস ও আব্দুল্লাহ বিন যোবায়ের প্রমুখ খ্যাতিমান ছাহাবী। ইবনু ওমর কিশোর বয়সে মক্কা শরীফে পিতা ওমরের সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন ও পিতার সাথেই মদীনায় হিজরত করেন। বয়স ও মাপে ছোট হওয়ায় ওহোদ যুদ্ধে সুযোগ পাননি। কিন্তু ১৫ বছর বয়সে সর্বপ্রথম খন্দকের যুদ্ধে এবং এর পরের সকল যুদ্ধে ও ‘বায়‘আতুর রিযওয়ানে’ অংশগ্রহণ করেন। তিনি অত্যন্ত পরহেযগার ও সুন্নাতের পাবন্দ ছাহাবী ছিলেন। মায়মূন বিন মিহরান বলেন, আমি ইবনু ওমরের চাইতে পরহেযগার ও ইবনে আববাসের চাইতে বিদ্বান কাউকে দেখিনি’। তিনি এক হাযারেরও বেশী গোলাম আযাদ করেন। নবী করীম (ছাঃ) তাঁকে رَجُلٌ صَالِحٌ বা ‘নেককার ব্যক্তি’ বলে প্রশংসা করেছেন।[2] তিনি ২৬৩০টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তার মধ্যে বুখারী ও মুসলিম উভয়ে সংকলন করেছেন ১৭০টি। বুখারী এককভাবে করেছেন ৮১টি ও মুসলিম ৩১টি। এক্ষেত্রে সর্বাধিক হাদীছ বর্ণনাকারী ছাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর পরেই ছিল তাঁর স্থান এবং তিনি ছিলেন সেরা হাদীছ বর্ণনাকারী ছয়জন ছাহাবীর অন্যতম। তাঁর থেকে বহু তাবেঈ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। রাসূল (ছাঃ)-এর নবুঅত লাভের অল্পদিন পরেই তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন ও ৭৪ হিজরীতে হজ্জের পরে হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (১-৭৩ হি.)-এর শাহাদত লাভের তিন বা ছয় মাস পরে ৮৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মক্কার নিকটবর্তী ‘মুহাছছাব’ অথবা ‘যূ-তুওয়া’ (ذُو طُوَى) নামক স্থানে মুহাজেরীন কবরস্থানে তিনি সমাহিত হন। ‘হারাম শরীফ’-এর অনতিদূরে ‘হ’ল’ (حل) নামক স্থানে সমাহিত করার জন্য তিনি অছিয়ত করে গিয়েছিলেন। কিন্তু অত্যাচারী গবর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ-এর কারণে তা সম্ভব হয়নি। কথিত আছে যে, হজ্জের সময় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যেসব স্থানে দাঁড়িয়েছিলেন, ইবনু ওমর (রাঃ) সেসব স্থানে আগে আগে গিয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন। হাজ্জাজ এটাকে তার অসম্মান হিসাবে গণ্য করে। এরপর হাজ্জাজ লম্বা খুৎবা দেওয়ার ফলে ওয়াক্ত ক্বাযা হয়ে যাচ্ছিল দেখে ইবনু ওমর (রাঃ) তাকে লক্ষ্য করে বলেন, إِنَّ الشَّمْسَ لاَ تَنْتَظِرُكَ ‘সূর্য তোমার জন্য অপেক্ষা করবে না’। এতে হাজ্জাজ ক্ষুব্ধ হয়। অন্য বর্ণনায় আছে যে, খলীফা আব্দুল মালেক বিন মারওয়ান গবর্ণর হাজ্জাজকে নির্দেশ পাঠান, যেন কোন বিষয়ে ইবনু ওমর (রাঃ)-এর বিরোধিতা না করা হয়’। এতে সে আরও জ্বলে ওঠে এবং ইবনু ওমরকে তার নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে থাকে। সে একজন আততায়ী নিয়োগ করে, যে হজ্জের ভিড়ের মধ্যে বিষমাখানো তীরের তীক্ষ্ণ ধার ইবনু ওমরের পায়ের উপর পিঠে ঠেকিয়ে দেয়। এতে বিষক্রিয়ার ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন ও কিছুদিন পরে মৃত্যুবরণ করেন (মিরক্বাত হা/৪-এর আলোচনা, ১/৬৭)।
৩. হাদীছের ব্যাখ্যা :
অত্র হাদীছে ইসলামকে একটি তাঁবুর সাথে তুলনা করা হয়েছে, যা কালেমায়ে শাহাদাতের মূল খুঁটির চারপাশে চারটি খুঁটি দ্বারা যুক্ত হয়ে দন্ডায়মান রয়েছে। যদি পাশের খুঁটিগুলি ভেঙ্গে যায়, তবুও মধ্যম খুঁটি তাঁবুর অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু মধ্যম মূল খুঁটি ভেঙ্গে পড়লে আর তাঁবুর অস্তিত্ব থাকে না। ঈমান মূলতঃ বিশ্বাস ও স্বীকৃতির নাম এবং ইসলাম হ’ল বাহ্যিক আমলের নাম। অত্র হাদীছটিকে ঈমান-এর অধ্যায়ের প্রথমদিকে নিয়ে ........ ঈমান ও ইসলাম বাস্তব ও প্রয়োগিকভাবে একই অর্থ বহন করে। যেমন আত্মা ও দেহ মূলতঃ পৃথক হ’লেও বাস্তবে একটিকে ছেড়ে অপরটি নয়। প্রাণহীন দেহ যেমন লাশ বৈ কিছুই নয়, ঈমানহীন আমল বা আমলহীন ঈমান তেমনি মূল্যহীন। উক্ত পাঁচটি স্তম্ভের কোন একটিকে যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে অস্বীকার করে তাহ’লে সে কাফের হয়ে যাবে (মির‘আত)।
(ক) কালেমায়ে শাহাদাতকে প্রথমে আনার উদ্দেশ্য হ’ল যে, এটাই ইসলামের প্রথম ও মূল বিষয়। এটাতে মানুষ রাযী হ’লেই তবে বাকী হুকুমগুলি তার উপরে প্রযোজ্য হয়। এখানে خَمْسٍ থেকে ‘বদল’ হওয়ার কারণে দুই যের সহ شَهَادَةٍ পড়া হয়েছে। ব্যাকরণের অন্য নিয়মানুযায়ী رفع ونصب বা পেশ ও যবর পড়া যেতে পারে।
(খ) إِقَامِ الصَّلاَةِ বা ছালাত কায়েম করার অর্থ নিয়মিতভাবে ছালাত আদায় করা এবং ছালাতে ক্বিয়াম-কুঊদ, রুকু-সুজূদ, দো‘আ-দরূদ সবকিছু ছহীহ হাদীছ মোতাবেক আদায় করা। খুশু-খুযু ও তা‘দীলে আরকান সহকারে ছালাত আদায় করা। বহু মুছল্লী আছেন, যারা দো‘আ-দরূদ জানেন না। কেউ জানলেও তার সঠিক উচ্চারণ জানেন না। কেউ যঈফ হাদীছ অথবা হাদীছে কোন ভিত্তি নেই এমন কিছু বিষয় সুন্নাত মনে করে ছওয়াবের আশায় আমল করে যাচ্ছেন। অথচ রাসূল (ছাঃ)-এর ছহীহ তরীকা অনুযায়ী না হওয়ার কারণে তা কবুল হবে না। যদিও তাঁরা ভাবেন যে, আমরা নেকীর কাজ করছি (কাহফ ১৮/১০৩-৪)।
অতএব প্রত্যেক মুছল্লীর উচিত হবে মৃত্যুর আগেই নিজের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল ‘ছালাত’-কে ছহীহ হাদীছ-এর মানদন্ডে যাচাই করে সংশোধন করে নেওয়া। কোন মাযহাব, তরীকা, ব্যক্তি বা রেওয়াজের দোহাই দিয়ে পরকালে কোন লাভ হবে না। এখানে ‘ছালাত’-কে সেরা ইবাদত হিসাবে প্রথমে আনা হয়েছে। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَوَّلُ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الصَّلَاةُ، فَإِنْ صَلَحَتْ صَلَحَ لَهُ سَائِرُ عَمَلِهِ، وَإِنْ فَسَدَتْ فَسَدَ سَائِرُ عَمَلِهِ- ‘ক্বিয়ামতের দিন বান্দার প্রথমে হিসাব দিতে হবে তার ছালাতের। ছালাতের হিসাব সুষ্ঠু হ’লে বাকী আমলের হিসাব সুষ্ঠু হবে। নইলে সব বেকার হবে’।[3] এজন্য ছালাতকে ‘উম্মুল ইবাদাত’ (أُمُّ الْعِبَادَاتِ) বা ‘ইবাদত সমূহের মূল’ বলা হয়ে থাকে (মিরক্বাত)।
এখানে একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, ছালাতের বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা ছহীহ হাদীছ মোতাবেক হওয়ার সাথে সাথে ..... হাদীছটির প্রতি সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে যে, لا صلاة الا بحضور القلب ‘ছালাত কবুল হয় না হৃদয় তন্ময় না হওয়া ব্যতীত’ (...)। যে ছালাত মুছল্লীর হৃদয়ে দাগ কাটে না ঐ ছালাতের মাধ্যমে ছালাতের মূল উদ্দেশ্য হাছিল হ’তে পারে না। আল্লাহ বলেন, إِنَّ الصَّلاَةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ ‘নিশ্চয়ই ছালাত যাবতীয় অশ্লীলতা ও গর্হিত কর্ম থেকে বিরত রাখে’ (আনকাবূত ২৯/৪৫)। এক্ষেত্রে যদি কোন মুছল্লী নিয়মিত ছালাত আদায় করা সত্ত্বেও ঐসব কাজ থেকে বিরত না হয়, তাহ’লে বুঝতে হবে তার ছালাত তার হৃদয়ে দাগ কাটেনি। এটা হ’ল ছালাতের আভ্যন্তরীণ দিক। যেটা হাছিল করাই হ’ল ছালাতের মূল উদ্দেশ্য।
কিছু ঈমানদার (?) আছেন, যারা ছালাতের আনুষ্ঠানিকতাকে গুরুত্ব দেন না। বরং ‘ক্বলব ছাফ’ করার কসরতে বিভিন্ন লতীফার যিকর করে গলদঘর্ম হন। তারা ‘দিল কা‘বায়’ সিজদা করেন ও দাবী করেন যে, আমাদের দিল ছাফ আছে। অতএব ছালাত আদায়ের প্রয়োজন নেই। বরং অনেক মুছল্লীর চাইতে আমরা সৎ আছি। এর একটাই জওয়াব এই যে, যদি তারা নিজেদেরকে ‘মুসলিম’ হিসাবে দাবী করেন, তবে তাদেরকে অবশ্যই কুরআন ও হাদীছের বিধানের নিকটে আত্মসমর্পণ করতে হবে। ইসলাম অহি-ভিত্তিক ধর্ম। এখানে কারু যুক্তি ও বিদ্যাবুদ্ধির মূল্য নেই। যিনি এটাকে সর্বান্তঃকরণে মেনে নিতে পারেন না, তিনি ইসলাম পরিত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু মুখে ইসলামের দাবী করবেন, আর ইসলামী ইবাদতের বিরুদ্ধে কল্পিত যুক্তি প্রদর্শন করে নিজেদের আবিষ্কৃত নতুন নতুন তরীকা চালু করবেন কিংবা সম্পূর্ণ দায়িত্বমুক্ত হয়ে মুক্ত বিহঙ্গের মত কল্পনার পাখা মেলে উড়ে বেড়াবেন, এটা চলবে না। এইসব যুক্তিবাদীগণ নিজেদের দুনিয়াবী নেতা-নেত্রীর হুকুম পালনে জান-মাল উৎসর্গ করতে প্রস্ত্তত কিংবা পীর-আউলিয়ার আবিষ্কৃত তরীকা পালন করতে গিয়ে রাত্রি জেগে জান শেষ করে আধমরা হ’তে রাযী আছেন। কিন্তু ধীরস্থিরভাবে তা‘দীলে আরকান সহকারে মসজিদে দু’রাক‘আত ফরয ছালাত আদায়ের গড়িমসি করেন। ছালাত আদায় করেও যারা সৎ হ’তে পারছেন না, তাদেরকে আরও ভালভাবে ছালাত আদায়ের মাধ্যমে সৎ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ছালাত পরিত্যাগ করলে সে সুযোগটুকু থেকেও সে মাহরূম হবে। যেমন একজন ছাত্র পরীক্ষায় ভাল না করলে পুনরায় পরীক্ষা দেয় কিন্তু লেখাপড়া পরিত্যাগ করে না। যদি একবার লেখাপড়া ত্যাগ করে, তবে সে আর ঐ সুযোগ পায় না। সারাজীবন সে মূর্খ হয়েই থাকে। অতএব আল্লাহভীরু মুসলমানদের ঐসব যুক্তিবাদীদের থেকে দূরে থাকা উচিত।
বাক্যে إِقَامِ الصَّلاَةِ মূলতঃ إِقَامَةُ الصَّلوة ছিল। দুই শব্দকে মিলানোর সুবিধার জন্য ة ফেলে দেওয়া হয়েছে। কেউ বলেছেন যে, দু’টিই ‘মাছদার’ বা ক্রিয়ামূল।
(গ) إِيتَاءِ الزَّكَاةِ যাকাত আদায় করা অর্থ যথার্থ হকদারের নিকটে যাকাত পৌঁছে দেওয়া। পবিত্র কুরআনে অধিকাংশ স্থানে ছালাত-এর সাথে সাথে যাকাত আদায়ের হুকুম এসেছে। হাদীছেও একইভাবে এসেছে। এর দ্বারা ইসলামের নৈতিক বা আধ্যাত্মিক ইবাদতের সাথে সাথে অর্থনৈতিক বা বৈষয়িক ইবাদতের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যাকাত দেন ঐ ব্যক্তি যিনি অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল এবং হালাল মালে যাকাতের নির্দিষ্ট নেছাবের মালিক। যাকাত দেওয়ার যোগ্যতা হাছিলের জন্য এবং হালালভাবে অর্থনৈতিক জীবন পরিচালনার মাধ্যমে ইহকাল ও পরকালে শান্তিময় জীবন লাভের প্রতি অত্র হাদীছে ইংগিত রয়েছে।
হালাল উপার্জনের মাধ্যমে একজন মুসলিমের পুঁজিবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। কেননা একদিকে তার জন্য অর্থোপার্জনের হারাম পথ সমূহ বন্ধ থাকে। অন্যদিকে উপার্জিত সম্পদের (১/৪০) অংশ বা শতকরা আড়াই টাকা হারে গরীব মুসলিম ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে সে বাধ্য থাকে। এর ফলে সে একাই স্বচ্ছল থাকে না বরং সমাজের অন্য ভাইয়েরাও অভাবমুক্ত হয়। তার দেওয়া ফরয যাকাত ও অন্যান্য নফল ছাদকার মাধ্যমে গরীবদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং তারা সম্পদশালীদের শিল্পকারখানায় উৎপাদিত দ্রব্যাদি খরিদ করে। ফলে ধনীর ব্যবসাও চালু থাকে, গরীবেরাও অভাবমুক্ত জীবন যাপন করে। এজন্যই কুরআনে বলা হয়েছে, ‘সূদ ধন কমায় ও ছাদকা সম্পদ বাড়ায়’ (বাক্বারাহ ২/২৭৬)। এভাবে ইসলামী সমাজে ধনী-গরীবের ব্যবধান কমে আসে। ধনী চূড়ান্ত ধনী হ’তে পারে না, গরীব নিঃস্ব হয় না। ইসলামী যাকাত, ওশর, ফিৎরা ইত্যাদি ফরয ছাদকাগুলি সঠিকভাবে আদায় ও বণ্টন হ’লে মুসলিম সমাজে আর্থিক অনটন থাকার কথা নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে এখনো চেতনা ফিরে আসেনি। যদি আধ্যাত্মিক ইবাদতের সাথে সাথে আর্থিক ইবাদত আমরা সঠিকভাবে আদায় করতে পারি, তবে ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশের নাগরিকগণ সর্বাধিক সুখী সমাজের অধিকারী হবেন। এর জন্য মুসলিম রাজনীতিক ও সমাজনেতাদের কর্তব্য হ’ল, সর্বাগ্রে সমাজের নৈতিক মূল্যবোধ উন্নত করা ও এজন্য প্রথমে নিজেদেরকে উন্নত নৈতিকতা সম্পন্ন তথা ঈমানদার হিসাবে গড়ে তোলা ও দেশের প্রচার মাধ্যমগুলিকে নীতি সম্পন্ন করা এবং সাথে সাথে হারাম উপার্জনের ছিদ্র পথগুলি বন্ধ করে হালালের পথ সমূহ খুলে দেওয়া। এজন্য পুরা রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সমাজকে সুশীল সমাজে পরিণত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা অবশ্য কর্তব্য। তাকদীরে বিশ্বাস ও অল্পে তুষ্ট থাকার নীতি মুসলিম জীবনকে অতি লোভী ও অর্থগৃধু হ’তে বাধা দেয়। সে অর্থের গোলাম হয় না। আল্লাহ বলেন, وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ ‘তাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে’ (যারিয়াত ৫১/১৯)। তাই যাকাত দেওয়া ধনীর করুণা নয়। বরং এটা ধনীর সম্পদে গরীবের ‘হক’ বা অধিকার। ধনী যদি গরীবের অধিকার তাকে বুঝে না দেয়, তবে তার প্রতিফল সে ইহকালেও ভোগ করবে; পরকালেও ভোগ করবে। ইসলাম এজন্যই ছালাত ও যাকাতকে সর্বদা পর পর বর্ণনা করেছে দু’টির সমগুরুত্ব বুঝানোর জন্য। জাতি এদিকে যতই গুরুত্ব দিবে, ততই মঙ্গল হবে। নেতারা কেবল অর্থনৈতিক উন্নতি নিয়েই ব্যস্ত। অথচ তা নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। সামাজিক ন্যায়বিচার ও নৈতিক উন্নতি একটি জাতিকে সার্বিক উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেয়। জাতির নেতারা সেদিকে দৃষ্টি দিবেন কি?
(ঘ) ‘হজ্জ’ হ’ল এমন গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা বিশ্বমুসলিমের ঐক্যশক্তির উত্থান ঘোষণা করে। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য ‘হজ্জ’ হ’ল বার্ষিক বিশ্ব সম্মেলন। আল্লাহ তাঁর নেকবান্দাদের ঐক্য ও শক্তি কামনা করেন। এই ইবাদতের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে তার আদর্শিক স্বার্থে সর্বদা ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
(ঙ) صَوْمُ رَمَضَانَ ‘রামাযানের ছিয়াম পালন করা’। বছরে একটি মাস বিশেষ নৈতিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে সমাজকে নীতিবান ও সুন্দর সমাজে পরিণত করার জন্য ছিয়ামের ইবাদত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য ধর্মের উপবাসের সাথে ইসলামের ছিয়াম পালনের পার্থক্য এই যে, এখানে কেবল খানাপিনা থেকে বিরত থাকা হয় না বরং ছিয়াম পালনকারীকে যাবতীয় অন্যায় অপকর্ম হ’তেও বিরত থাকতে হয়। নইলে তার ছিয়াম ত্রুটিপূর্ণ থেকে যায়। একমাস ছিয়াম পালন শেষে তাকে আবশ্যিকভাবে ফিৎরা দিতে হয় যা ব্যক্তির নৈতিক উন্নতির সাথে সাথে সমাজে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখে।
প্রকাশ থাকে যে, ছালাত ফরয হয়েছে দশম নববী সনের রামাযানের পর হ’তে হিজরতের পূর্ববর্তী সময়ে মি‘রাজের রাত্রিতে। ছিয়াম ফরয হয়েছে ২য় হিজরীতে। এরপরে একই বছরে ‘যাকাত’ ফরয হয়েছে। অতঃপর ৬ষ্ঠ কিংবা ৯ম হিজরীতে ‘হজ্জ’ ফরয করা হয়েছে। ফরয হওয়ার এই পরম্পরাগত বিষয়টি আমাদেরকে এই ইংগিত দেয় যে, আগে নৈতিকভাবে কাউকে গড়ে তুলতে না পারলে সে অর্থনৈতিক বা অন্য কোন দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয় না। সেজন্য ব্যক্তি ও সমাজের নৈতিক মূল্যবোধ উন্নত রাখা ব্যতীত সামাজিক বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। ব্যক্তি জীবনে যে চোর রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক জীবনে সে কখনো সাধু হ’তে পারে না। তাই ছালাতকে প্রথমে ফরয করে ইসলাম তার অনুসারীকে প্রথমে উন্নত নৈতিকতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে চেয়েছে। অতঃপর ‘ছিয়াম’ ফরয করে মুমিনকে ‘দুনিয়াত্যাগে’ উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। অতঃপর ‘যাকাত’ ফরয করে তাকে ‘সম্পদের প্রতি লোভহীনতা’ শিখানো হয়েছে। সবচেয়ে ‘হজ্জ’ ফরয করে বিশ্বমুসলিমকে একটি ‘ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী মহাজাতিতে’ পরিণত হওয়ার প্রতি জোরালো ইঙ্গিত করা হয়েছে।
মুসলিম শরীফের বর্ণনায় ‘ছিয়ামের’ কথা আগে এসেছে ও ‘হজ্জ’-এর কথা শেষে এসেছে সম্ভবতঃ হজ্জ শেষে ফরয হওয়ার কারণে। এখানে ‘শাহাদাতায়েন’ হ’ল ইসলামের মূল। সেজন্য তাকে আগে আনা হয়েছে, যা ‘ইবাদতে ক্বওলী’ বা মৌখিক ইবাদত। অতঃপর ইবাদতে ফে‘লীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইবাদত হিসাবে ‘ছালাত’-কে প্রথমে আনা হয়েছে যা ‘ইবাদতে বদনী’ বা দৈহিক ইবাদত। অতঃপর ‘যাকাত’ যা ‘ইবাদতে মালী’ বা আর্থিক ইবাদত। অতঃপর ‘হজ্জ’ যা ইবাদতে মালী ও বদনী অর্থাৎ আর্থিক ও দৈহিক উভয় ইবাদতের সমন্বয়। সবশেষে ‘ছিয়াম’ যা ‘ইবাদতে তারকী’ (عبادة تركى) বা খানাপিনা ইত্যাদি পরিত্যাগ করার ইবাদত। ছিয়ামের মাধ্যমে দুনিয়া ভোগের বদলে দুনিয়া ত্যাগের প্রশিক্ষণ নেওয়া হয় যা একজন উন্নত মানুষ গড়ার প্রকৃষ্ট হাতিয়ার।
ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের উক্ত গুরুত্বপূর্ণ হাদীছটি বুখারী (হা/৮) ‘ঈমান ও তাফসীর’ অধ্যায়ে, মুসলিম (হা/১৬), আহমাদ (হা/৬০১৫), নাসাঈ (৫০০১) ও তিরমিযী (হা/২৬০৯) স্ব স্ব গ্রন্থের ‘ঈমান’ অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন (মির‘আত)।
[1]. বুখারী হা/৮; মুসলিম হা/১৬; মিশকাত হা/৪।
[2]. বুখারী হা/৭০১৬; মিশকাত হা/৬১৮৭।
[3]. ত্বাবারানী আওসাত্ব হা/১৮৫৯; ছহীহাহ হা/১৩৫৮।