ব্রিটিশ আমলে উপমহাদেশের মুসলমানদের আক্বীদা-আমল, আচার-আচরণে আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। বিজাতীয় সংস্কৃতির অনেক কিছুই মুসলমানদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছিল। ফলে তারা নিজেদের ধর্মীয় কর্মকান্ড থেকেও অনেক ক্ষেত্রে দূরে সরে গিয়েছিল। এহেন প্রেক্ষাপটে হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০) বাংলার মুসলমানদের মাঝে তাদের বিস্মৃত ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত করার মাধ্যমে তাদেরকে ইসলামের ফরয বিধান পালনের দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য ১৮১৮ সালে আন্দোলন শুরু করেন। এ আন্দোলনই ইতিহাসে ‘ফরায়েযী আন্দোলন’ নামে পরিচিত। নিম্নে এ আন্দোলন সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা পেশ করা হ’ল।-
আন্দোলনের ফরায়েযী পেক্ষাপট :
ভারতীয় উপমহাদেশে শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (১৭০৩-৭৯ খৃ.) ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। পরবর্তী সময়ে তাঁর ধর্মীয় শিক্ষা বাংলায় বিস্তার লাভ করলেও এ অঞ্চলে ফরায়েযী আন্দোলনের সূচনাকারী হাজী শরীয়তুল্লাহ আরবে সূচিত মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন থেকে সরাসরি অনুপ্রেরণা পান। তাঁর সূচিত ফরায়েযী আন্দোলন বাংলার মুসলমানদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। নদী বিধেŠত বাংলা অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীই ছিল মুসলমান। ফরায়েযী আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল এ অঞ্চলকে ইসলামী পুনরুজ্জীবনবাদে উদ্বুদ্ধ করা। এ সংস্কার আন্দোলনের দু’টি বৈশিষ্ট্য ছিল। ১. মুসলিম কৃষক শ্রেণীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনৈসলামিক বিশ্বাস ও আচারকে সংশোধন করা। ২. তাদের সংস্কার করা ধর্মমতকে কায়েমী স্বার্থান্বেষী জমিদার ও নীল করদের থেকে রক্ষা করা। এ আন্দোলন মুসলিম কৃষক শ্রেণীর মধ্যেই বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।[1]
হাজী শরীয়তুল্লাহ ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে ধর্মীয় সামাজিক আন্দোলন হিসাবে ফরায়েযী আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনটি পূর্ব বাংলা ও আসামে বিশেষ করে পূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। ফরায়েযী শব্দটি আরবী ফারাইয শব্দ থেকে গৃহীত। ফারায়েয হ’ল ফারীযাতুন-এর বহুবচন। তবে ফার্সী ভাষার অনুসরণে বাংলায় এর উচ্চারণ হয় ফরায়েয এবং তা থেকে ‘ফরায়েযী’। ধর্মে অবশ্যপালনীয় কতিপয় কর্ম রয়েছে। এসব অবশ্যপালনীয় কর্তব্য সম্পর্কে যারা আন্দোলন করেছে তাদেরকে ‘ফরায়েযী’ বলা হয়। তবে ফরায়েযীরা ফারাইয শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছে। এরা মহান আল্লাহ ও তাঁর নবীর নির্দেশিত সকল ধর্মীয় কর্তব্যকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছে। যদিও তারা ইসলামের পাঁচটি মৌলিক বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছে বেশী। ইসলামের পাঁচটি মৌলিক বিষয় হ’ল (ক) কালেমা (খ) ছালাত (গ) ছিয়াম (ঘ) যাকাত (ঙ) হজ্জ।[2] এ পাঁচটি প্রধান বিষয় পালনের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করাই ছিল ফরায়েযীদের মৌলিক লক্ষ্য। বাংলার সাধারণ মুসলিম সমাজ ইসলামের মূল বিষয়গুলো সম্পর্কে উদাসীন থেকে নানা ধরনের শিরক, বিদ‘আত এবং উৎসব ও স্থানীয় আচার পালনে অভ্যস্ত হওয়ার কারণেই ফরায়েযী আন্দোলন সূচিত হয়। মোদ্দাকথা ফরায়েযী আন্দোলন বাংলার মুসলিম সমাজকে সংশোধন করার লক্ষ্যেই শুরু হয়েছিল। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল একদিকে প্রকৃত ইসলামে ফিরে যাওয়া এবং অন্যদিকে মুসলিম সমাজকে পরিশুদ্ধ করা।[3]
ফরায়েযী আন্দোলনের কর্মসূচী বা সংস্কার সমূহ :
হাজী শরীয়তুল্লাহ সংস্কার আন্দোলন পরিচালনার মাধ্যমে ইসলামের আদি শিক্ষা সমাজে প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন এবং বাংলার মুসলমানদেরকে যাবতীয় কুসংস্কার ও ধর্ম বিরোধী ক্রিয়াকলাপ থেকে মুক্ত করে বিশুদ্ধ সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন।
সংস্কার আন্দোলন পরিচালনায় হাজী শরীয়তুল্লাহর প্রথম পদক্ষেপ ছিল মুসলমানদেরকে তওবা করার জন্য আহবান জানানো। এর মাধ্যমে পূর্বের পাপ মোচন করে আত্মাকে বিশুদ্ধ করার পথ প্রদর্শন করা। আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার পর তিনি মুসলিম সমাজকে আল্লাহ এবং রাসূল (ছাঃ) নির্দেশিত অবশ্য পালনীয় কর্তব্য সমূহ পালনের উদাত্ত আহবান জানান। আর তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলা হয় যে, এই আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এমন সবকিছুই পরিত্যাগ করতে হবে। কুরআন ও হাদীছে নেই এমন সব ধরনের প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসবাদি ফরায়েযীগণ পরিত্যাগ করার আহবান জানান।[4]
এ আন্দোলনের ৫টি নীতি হ’ল-
(ক) তওবা ও বায়‘আত : হাজী শরীয়তুল্লাহর মতে ‘তওবা’ হ’ল বিগত জীবনের পাপ সমূহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং ভবিষ্যতে পাপ না করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা। তওবা করার পদ্ধতি হ’ল, উস্তাদ শাগরেদকে বা শিষ্যকে মুখোমুখি বসিয়ে এ মর্মে শপথ করাবেন যে, ‘আমি ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যে সমস্ত শিরক, বিদ‘আত, নাফরমানী, অন্যায়-অত্যাচার করেছি, সমস্ত হ’তে তওবা করলাম। আর ওয়াদা করছি যে, আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করি এবং তাঁর যাবতীয় আদেশ ও নির্দেশ যথাসাধ্য পালন করব এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত ও তরীকা মোতাবেক চলব’।
তওবা করার পদ্ধতিকে ফরায়েযীগণ ‘ইস্তিগফার’ বা ক্ষমা প্রার্থনা বলে। এটাকে ‘ইকরারী বায়‘আত’ও বলা হয়। যার অর্থ উস্তাদ এবং শাগরেদ পরস্পরকে স্পর্শ না করে শপথ নেওয়া। পীরদের শপথ ও ফরায়েযীদের শপথের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পীরগণ সাধারণত মুরীদদের হাতে নিজের হাত রেখে বায়‘আত পরিচালনা করে থাকেন। এই ধরনের শারীরিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকভাবে পীরের আশীর্বাদ মুরীদের কাছে পৌঁছানো হয় বলে তারা বিশ্বাস করে। ফরায়েযীগণ এই ধরনের প্রচলিত বায়‘আতকে বিদ‘আত বলে পরিত্যাগ করেন।[5]
(খ) ফারায়েয : ইসলামের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য সমূহকে পালন করা ফরায়েযী সংস্কার সমূহের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য, যা এই আন্দোলনের নাম থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। ফরায়েযী শব্দটি দিয়ে হাজী শরীয়তুল্লাহ আল্লাহ এবং নবী করীম (ছাঃ)-এর নির্দেশিত কর্তব্য সমূহকে বুঝাতে চেয়েছেন। আর তিনি ইসলামের পাঁচটি মৌলিক বিষয় পালনের প্রতি বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ হ’ল (১) কালেমা (২) ছালাত (৩) ছিয়াম (৪) যাকাত ও (৫) হজ্জ। ইসলামের অনুশাসন অনুযায়ী প্রথম তিনটি বিষয় ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকলের জন্য পালনীয় এবং শেষোক্ত দু’টি বিষয় শুধু বিত্তশালীদের জন্য পালনীয়।
হাজী শরীয়তুল্লাহ যখন মক্কা থেকে ফিরে আসেন তখন তিনি বাংলায় ‘ঈমানের পানি’র অভাবে মৃত প্রায় ইসলামকে দেখেন। এই বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে W.W. Hunter বলেন, ‘একশত বছর পূর্বে বাংলায় মোহাম্মাদী ধর্ম মতৃপ্রায় ছিল’।[6] ধর্মীয় কর্তব্য পালনে ফরায়েযীগণ কড়াকড়ি মনোভাব পোষণ করত। এ বিষয়ে জেমস টেইলর বলেন, ‘ফরায়েযীগণ অন্যান্য মুসলমানদের চেয়ে অধিক কড়াকড়ি প্রকৃতির নৈতিকতার অধিকারী ছিলেন’। ইসলামের পাঁচটি মূলনীতি পালনে উস্তাদ এবং খলীফাগণ অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। যে সকল অঞ্চলে ফরায়েযীগণ বসবাস করতেন সেসব স্থানে উস্তাদ এবং খলীফাগণ যে কোন ধরনের গাফলতির জন্য তাদের অনুসারীদের সতর্ক করে দিতেন।[7]
(গ) তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ব : ইসলামী পুনরুজ্জীবনের প্রবক্তা হিসাবে হাজী শরীয়তুল্লাহ কুরআন ভিত্তিক তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বের ধারণাকে গুরুত্ব সহকারে দেখেছেন। একত্ববাদ বিষয়টি ফরায়েযী সমাজে কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করা হয় এবং তাওহীদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন সব বিষয়কে বিলোপ করা হয়।
হাজী শরীয়তুল্লাহ তাঁর নিজ ধর্মের লোকদের মধ্যে তাওহীদের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করানোর জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তাওহীদ সম্পর্কে প্রচলিত ব্যাখ্যায় তিনি সন্তুষ্ট হ’তে পারেননি। কারণ এই ব্যাখ্যায় শুধু আল্লাহর একত্ব সম্পর্কে ধারণা ছিল। তিনি ঈমান বা ধর্ম বিশ্বাসকে দু’টি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করেন। যথা- (১) আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করা এবং তাঁর উপরে দৃঢ়ভাবে আমল করা (২) আল্লাহর সঙ্গে অন্য কিছুর অংশীদারিত্ব স্থাপন তথা শিরক থেকে বিরত থাকা। সুতরাং তাঁর মতে তাওহীদ শুধু একটি মতবাদ নয় বরং তাঁর উপর বাস্তবে আমল করতে হবে। যেকোন বিশ্বাস এবং কাজের সঙ্গে যদি নাস্তিকতা, শিরক অথবা বিদ‘আতের সামান্যতম সংশ্রব থাকে তাহ’লে তা হবে তাওহীদ পরিপন্থী। এছাড়া হিন্দুদের আচার-উৎসবে চাঁদা দেওয়া, পীরদের প্রতি অস্বাভাবিক ভক্তি, মৃত ব্যক্তির জন্য ফাতিহা অনুষ্ঠান এবং এমন ধরনের অন্যান্য কর্মকান্ডকেও তিনি তাওহীদ বিরোধী মনে করেন।
তাওহীদ সম্পর্কে ফরায়েযী মতবাদ মুসলিম সমাজের অনৈসলামিক কার্যকলাপ শুদ্ধিকরণের বিষয়ে কাজ করেছে। জেমস টেইলর বলেন, ‘ফরায়েযীগণ কুরআনের কড়াকড়ি নিষেধ অনুযায়ী সকল উৎসবাদি যা কুরআন কর্তৃক অনুমোদিত নয় তা বাতিল বলে ঘোষণা করেছে’।[8] W. W. Hunter লিখেছেন, ‘হাজী শরীয়তুল্লাহ ঈমান অনুযায়ী ‘কুফর’-এর বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছেন অথবা সকল অনুষ্ঠানাদি ও আচার যা বিদ‘আত এবং আল্লাহর সঙ্গে অংশীদারিত্বের বা শিরকের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দিয়েছিলেন’।[9] এইচ বেভারিজ বলেন, ‘ফরায়েযী আন্দোলন প্রিমিটিভ চার্চ আন্দোলনের মত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মৌলিক মতবাদে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে শুরু হয়েছিল এবং কুসংস্কারপূর্ণ আচার যেগুলো কালের বিবর্তনে হিন্দু বা অন্যান্য বিধর্মীদের কাছ থেকে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছিল তা পরিত্যাগের আহবান জানিয়েছিল।[10]
(ঘ) জুম‘আ এবং ঈদের ছালাত : বাংলায় অন্যান্য মুসলমানদের সঙ্গে ফরায়েযীদের পার্থক্য ঈদ এবং জুম‘আর ছালাতের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ফরায়েযীগণ এই দুই ধরনের ছালাত বৃটিশ আমলে স্থগিত ঘোষণা করেন। এই ছালাতগুলো ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের শহরগুলোতে পুনরায় শুরু করা হয়। ফরায়েযীগণ হানাফী ফিক্বহ অনুসারে দাবী করেন যে, মিসর আল-জামি‘তেই (অর্থাৎ যেখানে প্রশাসক এবং কাযী উপস্থিত আছে এবং যারা মুসলিম সুলতান দ্বারা নিয়োগ প্রাপ্ত) শুধু এই ছালাত সমূহ অনুষ্ঠিত হওয়া বৈধ। সুতরাং ‘মিসর আল-জামি’ একটি নির্দিষ্ট শহর, যা আইন দ্বারা ব্যাখ্যাত হয়েছে। তাই ফরায়েযীগণ মনে করেন যে, বৃটিশ শাসনামলে বাংলায় এই ধরনের কোন শহর নেই।
(ঙ) প্রচলিত উৎসব এবং আচার-অনুষ্ঠান বর্জন :
হাজী শরীয়তুল্লাহ বহুসংখ্যক কুসংস্কার, সামাজিক আচার অনুষ্ঠানাদি বিলুপ্ত করেন। কোন কুফর, শিরকই তাঁর সংস্কার থেকে বাদ পড়েনি। জেমস টেইলর লিখেছেন যে, ফরায়েযীগণ পট্টি, চাট্টি এবং চিল্লা ত্যাগ করেন, যা একটি শিশুর জন্মদিন এবং চল্লিশ দিনের সময় উদযাপিত হ’ত। ফরায়েযীগণ শুধু আক্বীক্বা অনুষ্ঠান করত, যা ইসলামী বিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ তথ্য সুন্নাত ছিল। পুরুষ সন্তানের জন্য দু’টি ছাগল এবং মেয়ে সন্তানের একটি ছাগল জবাই করে অনুষ্ঠান করা হ’ত। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মীয় এবং বন্ধুদের আপ্যায়ন করা হ’ত এবং শিশুর নাম রাখা হ’ত।[11]
হিন্দু জমিদারেরা হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সবার কাছে কালীপূজা, দূর্গাপূজা, রথযাত্রা, দাড়ি রাখার জন্য কর আদায় করত। হাজী শরীয়তুল্লাহ তাঁর অনুসারীদেরকে এসব কর দিতে নিষেধ করেন। হিন্দু জমিদারের এলাকায় কুরবানী বন্ধ করা, আযান নিষিদ্ধ করা, গরু যবেহ এবং গরুর গোশত খাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করার বিরুদ্ধে তিনি জনগণকে সোচ্চার করেন। তিনি মুহাররমের তা‘যিয়া মিছিল ও অনুষ্ঠান নাজায়েয ঘোষণা করেন।[12]
খোয়াজের ভেলা পানিতে ভাসানো, গাযী ও কালুর দূর্গা তৈরী করা, বার মাসে বার পূজা, দশ হরা রথ যাত্রা, চড়ক পূজা, পীরের নামে জনে জনে পূজা দেওয়া, মুহাররমের জারী গাওয়া, পাঁচ পীরের নামে মোকাম উঠানো, বাড়ীর চারিদিকে কলা গাছ গাড়া- এসব কুসংস্কার হাজী শরীয়তুল্লাহ নিষিদ্ধ করেন।
(চ) পীরবাদ : হাজী শরীয়তুল্লাহ তাওহীদের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আচার সমূহের সঙ্গে পীরতন্ত্রকে তাঁর সংস্কারের আওতায় আনেন। সে সময় আল্লাহ ও মানুষের মধ্যবর্তী তথা অসীলা হিসাবে পীরদের বিবেচনা করা হ’ত। হাজী শরীয়তুল্লাহ অভিযোগ করেন যে, পীর শব্দটি অপঅর্থে ব্যবহৃত হয়ে একটি দেবতায় পরিণত হয়েছে। তাই পীর শব্দটি তিনি বাদ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।[13] পীরদের মৃত্যুবার্ষিকীতে ওরস অনুষ্ঠানের তিনি কড়া বিরোধিতা করেন। কারণ এটি বিদ‘আত।
(ছ) বর্ণপ্রথা : ফরিদপুর যেলার মুসলিম সমাজে বর্ণ প্রথার প্রচলন ছিল। সৈয়দ, শেখ, পাঠান এবং মোল্লা পদবিধারী ব্যক্তিরা সেখানকার মুসলিম সমাজে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিল। যা হিন্দু সমাজের বর্ণপ্রথার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বলা যায়। এছাড়া সৈয়দ, খন্দকার, চৌধুরী, কাযী পরিবার তাদের বংশীয় ঐতিহ্যের জন্য সুপরিচিত ছিল। অন্যদিকে জোলা (তাঁতী), বেলদার (খনক), নিকারী (মাছ সংগ্রাহক), কুলু (তেলী), কাহার বা চাকর (পাল্কী বাহক এবং পাখা চালক), দাই মুসলিম সমাজে নির্দিষ্ট বর্ণে চিহ্নিত হ’ত। যাদের সঙ্গে অন্যান্য মুসলমানেরা বৈষম্যমূলক আচরণ করত। জেমস ওয়াইজ বলেন, বাংলার মুসলিম সমাজ হিন্দুদের বর্ণ প্রথার অনেকাংশই অনুসরণ করত। সংস্কারক হাজী শরীয়তুল্লাহ মুসলমান সমাজের বৈষম্য সমূহ গভীরভাবে লক্ষ্য করেন এবং পরবর্তীতে তিনি ফরায়েযীদের কোন পদবী ব্যবহার না করার জন্য উৎসাহিত করেন।[14]
(জ) ‘দাই’-এর প্রচলন : ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের আদম শুমারীতে ফরিদপুরের ‘দাই’দেরকে মুসলিম সমাজের নির্দিষ্ট বর্ণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। জীবিকা হিসাবে ‘দাই’রকে নিম্ন মানের বিবেচনা করা হ’ত। জেমস ওয়াইজ বলেন, ‘দাই’দেরকে সাধারণভাবে ‘নাড় কাটা’ বলা হ’ত। কোন হিন্দু বা মুসলিম অভিজাত নাড়ী কর্তন করত না। ফলে ‘দাই’ মহিলাদের স্বল্পতার কারণে বিশেষত ফরিদপুর যেলায় প্রায়ই নাড়ি কর্তনের জন্য একজন মাকে হয়ত সারাদিন বা তারো বেশী সময় অপেক্ষা করতে হ’ত। এজন্য হাজী শরীয়তুল্লাহ নাড়ী কর্তনের জন্য এককভাবে ‘দাই’কে ব্যবহার করার প্রচলিত আচারের বিরোধিতা করেন। তিনি নাড়ী কর্তনের জন্য পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা বা গ্রামের একজন বলিষ্ঠ মহিলা অথবা প্রয়োজনে সন্তানের পিতা নাড়ী কর্তন করতে পারবেন বলে মত প্রকাশ করেন। এই মতের বিরুদ্ধে রক্ষণশীল সমাজ প্রতিবাদও করে।[15]
ফরায়েযীদের পোষাক-পরিচ্ছদ : হাজী শরীয়তুল্লাহ তাঁর অনুসারীদের ধুতির বদলে লুঙ্গী বা পাজামা পরিধান করতে বলেন। ধুতি ছিল হিন্দুদের জাতীয় পোষাক, যা সে সময়ের বাংলার মুসলমানরা পরিধান করত। তিনি উল্লেখ করেন যে, পাজামা বা লুঙ্গী ছালাত আদায়ের জন্য সুবিধাজনক। যদি কেউ প্রয়োজনে ধুতি পরিধান করে তাহ’লে তা দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে না টেনে সাধারণভাবে পরতে হবে। এভাবে পরিধান করলে ছালাত আদায়ে সুবিধা হবে বলে তিনি মনে করেন। এভাবে ধুতি পরিধান করার কারণে ফরায়েযীদেরকে ‘কাছা খোলা’ বলা হ’ত। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী নৈতিকতা অনুযায়ী অনুসারীদের উরু যাতে আবৃত থাকে, সেজন্য হাজী শরীয়তুল্লাহ সেটা করতে চেয়েছিলেন।[16]
পরিশেষে বলা যায়, ফরায়েযী আন্দোলন তৎকালীন বাংলার মুসলমানদের আক্বীদা-আমল পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। সে সময় মুসলমানদের মাঝে জেঁকে বসা নানা কুসংস্কার এ ‘আন্দোলন’-এর মাধ্যমে দূর করার প্রয়াস চালানো হয়। যার মাধ্যমে অনেকের মাঝে ইসলাম সম্পর্কে সচেতনতা ফিরে আসে।
এ্যাডভোকেট জারজিস আহমাদ
উপদেষ্টা, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ, রাজশাহী-সদর যেলা।
[1]. ড. মুঈন উদ্দীন আহমদ খান, বাংলায় ফরায়েযী আন্দোলনের ইতিহাস, অনুবাদ : ড. গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১ম প্রকাশ, জুন’০৭), পূর্ব কথা দ্র.।
[2]. বুখারী হা/৪; মুসলিম হা/১৬।
[3]. ঐ, পৃঃ ১১-১২।
[4]. ঐ, পৃঃ ১১২।
[5]. ঐ, পৃঃ ১১৩।
[6]. Englands work in India, p.47।
[7]. বাংলায় ফরায়েযী আন্দোলনের ইতিহাস, পৃঃ ১১৩-১১৫।
[8]. James Taylor, Topography, p. 249.
[9]. W.W Hunter (ed), Imperial Gezetteer of India, ৬/৩৯৯ পৃঃ।
[10]. বাংলায় ফরায়েযী আন্দোলনের ইতিহাস, পৃঃ ১১৫-১১৬।
[11]. ঐ, পৃঃ ১২৪।
[12]. আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিস্তৃত ইতিহাস, পৃঃ ৯৬
[13]. বাংলায় ফরায়েযী আন্দোলনের ইতিহাস পৃঃ ১২৫।
[14]. ঐ, পৃঃ ১২৬।
[15]. ঐ, পৃঃ ১২৮।
[16]. ঐ, পৃঃ ১২৮-১২৯।