আল্লাহ বলেন,
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَّمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ، وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ- ‘তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ কাফের ও কেউ মুমিন। আর তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ সবই দেখেন’ (তাগাবুন ৬৪/২)।
অত্র আয়াতে বিশ্বাসগত দিক দিয়ে মানুষকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। হয় সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী হিসাবে ‘মুমিন’ হবে, অথবা অবিশ্বাসী হিসাবে ‘কাফের’ হবে। আল্লাহর উপর বিশ্বাসী হ’লে তার সার্বিক জীবন আল্লাহর বিধান অনুযায়ী গড়ে উঠবে। আর অবিশ্বাসী হ’লে তার সার্বিক জীবন শয়তানী খোশ-খেয়াল অনুযায়ী গড়ে উঠবে। পরিণতির দিক দিয়েও এক দল জান্নাতী হবে, এক দল জাহান্নামী হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, فَرِيقٌ فِي الْجَنَّةِ وَفَرِيقٌ فِي السَّعِيرِ- ‘সেদিন একদল হবে জান্নাতী ও একদল হবে জাহান্নামী’ (শূরা ৪২/৭)।
একটি মৌলিক দর্শন :
فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَّمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ ‘অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ কাফের ও কেউ মুমিন’ বলার মধ্যে একটি মৌলিক দর্শনের সন্ধান রয়েছে যে, আল্লাহ কাফের-মুমিন এবং কুফর ও ঈমান সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু বান্দা তার ইচ্ছামত কুফর বা ঈমানকে বেছে নেয় ও সেমতে সে কাজ করে। যেটি আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ‘আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সবই দেখেন’। আর সে হিসাবে তার পুরস্কার ও শাস্তি হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَّإِمَّا كَفُورًا- ‘আমরা তাকে সুপথ প্রদর্শন করেছি। এক্ষণে সে কৃতজ্ঞ হৌক কিংবা অকৃতজ্ঞ হৌক’ (দাহর ৭৬/৩)।
ক্বাযা ও ক্বদর :
তবে সবকিছুই হয় ক্বাযা ও ক্বদর তথা আল্লাহর পূর্ব নির্ধারণ অনুযায়ী এবং সবই হয় তাঁর অনুমতিক্রমে ও তাঁর জ্ঞাতসারে। তাঁর ইচ্ছা ও তাঁর জানার বাইরে বান্দা কিছুই করতে পারে না। এই সঠিক বিশ্বাস থাকলে অদৃষ্টবাদ ও অদৃষ্টকে অস্বীকারের ভ্রান্তি থেকে মানুষ নিরাপদ থাকবে। এই বিশ্বাস থাকলে বান্দা আনন্দে আত্মহারা হবেনা বা ব্যর্থতায় দিশেহারা হবেনা। যেমন আল্লাহ বলেন,مَآ أَصَابَ مِنْ مُّصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلاَ فِي أَنْفُسِكُمْ اِلاَّ فِي كِتَابٍ مِّنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللهِ يَسِيرٌ- لِكَيْلاَ تَأْسَوْا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلاَ تَفْرَحُوا بِمَآ آتَاكُمْ وَاللهُ لاَ يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ- ‘পৃথিবীতে বা তোমাদের জীবনে এমন কোন বিপদ আসে না, যা তা সৃষ্টির পূর্বে আমরা কিতাবে লিপিবদ্ধ করিনি। নিশ্চয় এটা আল্লাহর জন্য সহজ’। ‘যাতে তোমরা যা হারাও তাতে হতাশ না হও এবং যা তিনি তোমাদের দেন, তাতে উল্লসিত না হও। বস্ত্ততঃ আল্লাহ কোন উদ্ধত ও অহংকারীকে ভালবাসেন না’ (হাদীদ ৫৭/২২-২৩)। তিনি বলেন,قُلْ لَنْ يُّصِيبَنَا اِلاَّ مَا كَتَبَ اللهُ لَنَا هُوَ مَوْلاَنَا وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ- ‘তুমি বল, আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন, তা ব্যতীত কিছুই আমাদের নিকট পৌঁছবে না। তিনিই আমাদের অভিভাবক। অতএব আল্লাহর উপরেই মুমিনদের ভরসা করা উচিত’ (তওবা ৯/৫১)।
ফাসেকদের অবস্থান :
আল্লাহ এখানে কেবল কাফের ও মুমিন বলেছেন, কিন্তু ফাসেক বলেননি। কারণ ফাসেকদের বিষয়টি উক্ত বক্তব্যের মধ্যেই বুঝা যায়। আল্লাহ মুমিন ও কাফের বলে ঈমান ও কুফরের দুই প্রান্তসীমাকে বুঝিয়েছেন। মধ্যবর্তী ফাসেকী অবস্থাকে উহ্য রেখেছেন (কুরতুবী)। ফাসেকরা ছগীরা অথবা কবীরা গোনাহগার হবে। মুমিনরাও তেমনি নিম্নস্তরের ও উঁচু স্তরের হবে।
ত্রুটিপূর্ণ
মুমিনগণ ‘ফাসেক’। কিন্তু ‘কাফের’ বা ইসলাম থেকে খারিজ ও ‘মুরতাদ’ নয়। যেমন
বনু মুছত্বালিক্বদের নিকট থেকে ‘যাকাত’ সংগ্রহের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
অলীদ বিন ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বকে প্রেরণ করেন। কিন্তু মাঝপথ থেকে ফিরে
এসে বলেন যে, তারা ‘মুরতাদ’ হয়ে গিয়েছে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি
নিচ্ছে। তখন রাসূল (ছাঃ) খালেদ বিন অলীদকে পাঠিয়ে জানতে পারেন যে, তারা আদৌ
মুরতাদ হয়নি। বরং মুমিন ও পূর্ণ আনুগত্যশীল রয়েছে। ফলে রাসূল (ছাঃ) তাদের
দমনে সৈন্য পাঠানো থেকে বিরত হন। উক্ত ঘটনা উপলক্ষ্যে নাযিল হয়,يَآأَيُّهَا
الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَآءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ
تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ
نَادِمِينَ- ‘হে মুমিনগণ! যদি কোন ফাসেক ব্যক্তি তোমাদের নিকট কোন সংবাদ
নিয়ে আসে, তাহ’লে তোমরা সেটা যাচাই কর, যাতে অজ্ঞতাবশে তোমরা কোন
সম্প্রদায়ের ক্ষতি সাধন না করে বস। অতঃপর নিজেদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত
হও’ (হুজুরাত ৪৯/৬)। ভুল তথ্য প্রদানের জন্য ঐ ব্যক্তিকে কুরআনে
‘ফাসেক’ বলা হয়েছে। কিন্তু তাকে কাফের বা ‘মুরতাদ’ বলা হয়নি। রাসূল (ছাঃ)
তাকে হত্যাও করেননি। একইভাবে মক্কা বিজয়ের অভিযানের খবর ফাঁস করে কুরায়েশ
নেতাদের নিকট গোপনে পত্র প্রেরণকারী ছাহাবী হাতেব বিন আবু বালতা‘আহকে রাসূল
(ছাঃ) ‘কাফের’ বলেননি বা তাকে হত্যা করেননি। বরং কৈফিয়ত নিয়ে তাকে ক্ষমা
করে দেন।[1]
পাপ ও পুণ্যের স্তর বিন্যাস :
বস্ত্ততঃ ঈমান ও কুফরের স্তর বিন্যাস পাপ ও পুণ্যের কম-বেশীর কারণে হয়ে থাকে। এর আলোকেই ছগীরা ও কবীরা গুনাহ সাব্যস্ত হয়। যা তওবার মাধ্যমে মাফ হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,اَلَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَآئِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ إِلاَّ اللَّمَمَ؛ إِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِ، ‘যারা বড় বড় পাপ ও অশ্লীল কর্ম সমূহ হ’তে বেঁচে থাকে ছোট-খাট পাপ ব্যতীত; (সে সকল তওবাকারীর জন্য) তোমার প্রতিপালক প্রশস্ত ক্ষমার অধিকারী’ (নাজম ৫৩/৩২)। তিনি সবাইকে তওবার আহবান জানিয়ে বলেন,وَتُوبُوا إِلَى اللهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ- ‘আর হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে যাও! যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (নূর ২৪/৩১)।
মুমিন
ও কাফেরের স্তরভেদের কারণে জান্নাতে ও জাহান্নামেও স্তরভেদ রয়েছে এবং
রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে সর্বোচ্চ জান্নাতুল ফেরদাঊস প্রার্থনা করতে বলেছেন।[2]
শাফ‘আতকে অস্বীকার :
আহলে
সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা হ’ল, কবীরা গোনাহগার মুমিনগণ রাসূল
(ছাঃ)-এর শাফা‘আতের ফলে ক্রমে ক্রমে জাহান্নাম থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর
রহমতে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। উক্ত বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
شَفَاعَتِي لِأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّتِي- ‘আমার শাফা‘আত হবে আমার
উম্মতের কবীরা গুনাহগারদের জন্য’।[3] আল্লাহ বলেন,يَوْمَئِذٍ لاَّ تَنْفَعُ
الشَّفَاعَةُ إِلاَّ مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلاً-
‘সেদিন দয়াময় (আল্লাহ) যাকে অনুমতি দিবেন এবং যার কথায় তিনি সন্তুষ্ট
হবেন, সে ব্যতীত কারু সুফারিশ কোন কাজে আসবে না’ (ত্বোয়াহা ২০/১০৯; সাবা ৩৪/২৩; নাজম ৫৩/২৬)।
খারেজী ও মু‘তাযেলীগণ কবীরা গুনাহগার মুমিনদের জন্য শাফা‘আতকে অস্বীকার
করেন। কেননা তাদের মতে কবীরা গুনাহগার মুমিন চিরস্থায়ী জাহান্নামী’।[4]
চরমপন্থী ও শৈথিল্যবাদী আক্বীদা :
খারেজী-মু‘তাযেলী ও তাদের অনুসারীগণ মানুষকে কেবল মুমিন ও কাফের দুই ভাগে ভাগ করেন। মধ্যবর্তী ত্রুটিপূর্ণ ঈমানদার তথা ফাসেক মুমিনদেরকে তারা কাফের বলেন। উক্ত চরমপন্থী আক্বীদার লোকদের মাধ্যমেই ইসলামের নামে যুগে যুগে জঙ্গীবাদের উদ্ভব ঘটেছে।
অন্যদিকে ‘মুরজিয়া’দের মতে আমল ঈমানের অংশ নয়। সেহেতু কবীরা গোনাহ তাদের ঈমানের কোন ক্ষতি করবেনা। এই আক্বীদায় বিশ্বাসীরা দ্বিধাহীন ভাবে কবীরা গোনাহ করে যায়। এরা হালাল-হারামের কোন তোয়াক্কা করেনা। এদের কারণেই সমাজ পাপে ডুবে যাচ্ছে। মানবতা বিধবস্ত হচ্ছে। এদেরকে ‘শৈথিল্যবাদী’ বলা হয়। মুসলিম উম্মাহ উপরোক্ত দুই ভ্রান্ত মতবাদের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে।
সঠিক আক্বীদা :
উপরোক্ত দুই চরমপন্থী মতবাদের মধ্যবর্তী সঠিক আক্বীদা এই যে, কবীরা গোনাহগার মুমিন ঈমান হ’তে খারিজ নয়। সে তওবা না করে মারা গেলেও স্থায়ীভাবে জাহান্নামী নয়। কেননা আল্লাহ পাক চাইলে শিরক ব্যতীত বান্দার যেকোন গুনাহ মাফ করতে পারেন (নিসা ৪/৪৮)।
আয়াতটির তাফসীর :
দরসে বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় মু‘তাযেলী মুফাসসির আল্লামা যামাখশারী (৪৬৭-৫৩৮ হি.) বলেন, فَمِنْكُمْ آتٍ بِالْكُفْرِ وَفَاعِلٌ لَهُ وَمِنْكُمْ آتٍ بِالْإِيمَانِ وَفَاعِلٌ لَهُ ‘অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ কুফরী নিয়ে আগমন করে ও তার জন্য সে কাজ করে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ ঈমান নিয়ে আগমন করে ও তার জন্য সে কাজ করে’। তিনি বলেন,فَمَا أَجْهَلَ مَنْ يَّمْزُجُ الْكُفْرَ بِالْخَلْقِ وَيَجْعَلُهُ مِنْ جُمْلَتِهِ، وَالْخَلْقُ أَعْظَمُ نِعْمَةٍ مِّنَ اللهِ تَعَالَى عَلَى عِبَادِهِ، وَالْكُفْرُ أَعْظَمُ كُفْرَانٍ مِّنَ الْعِبَادِ لِرَبِّهِمْ سُبْحَانَهُ- ‘তার চেয়ে বড় মূর্খ আর কে আছে, যে কুফরকে সৃষ্টির সঙ্গে মিশ্রিত করে এবং একে তার মধ্যে শামিল করে? অথচ ‘সৃষ্টি’ হ’ল বান্দার উপর আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ এবং ‘কুফর’ হ’ল বান্দার পক্ষ হ’তে আল্লাহর প্রতি সবচেয়ে বড় অকৃতজ্ঞতা’ (কাশশাফ)।
উক্ত ব্যাখ্যার মাধ্যমে তিনি আহলে সুন্নাতের আক্বীদাকে তীব্রভাবে কটাক্ষ করেছেন। কেননা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত আহলেহাদীছের বিশুদ্ধ আক্বীদা হ’ল, কুফরী সহ বান্দার স্বেচ্ছাকৃত ভাল-মন্দ সকল কর্মের মূল স্রষ্টা হ’লেন আল্লাহ। আর বান্দা হ’ল আল্লাহ প্রদত্ত কর্মশক্তির ভাল-মন্দ প্রয়োগের ফলাফল অর্জনকারী (মুহাক্কিক কাশশাফ)। যেমন আল্লাহ বলেন, وَاللهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ- ‘আল্লাহ তোমাদের ও তোমাদের কর্মসমূহ সৃষ্টি করেছেন’ (ছাফফাত ৩৭/৯৬)। চাই সে কর্ম ভাল হৌক বা মন্দ হৌক। ভাল করলে ভাল ফল পাবে এবং মন্দ করলে মন্দ ফল পাবে। যেমন আল্লাহ বলেন,مَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفْسِهِ وَمَنْ أَسَآءَ فَعَلَيْهَا وَمَا رَبُّكَ بِظَلاَّمٍ لِّلْعَبِيدِ- ‘যে ব্যক্তি সৎকর্ম করে, সে তার নিজের জন্যই সেটা করে। আর যে অসৎ কর্ম করে তার প্রতিফল তার উপরেই বর্তাবে। বস্ত্ততঃ তোমার প্রতিপালক তার বান্দাদের প্রতি যুলুমকারী নন’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৪৬)। এটা না থাকলে আল্লাহ কেবল ভাল-র স্রষ্টা হবেন। মন্দের স্রষ্টা আরেকজনকে মানতে হবে। যা স্পষ্ট শিরক।
যামাখশারীর উক্ত আক্বীদা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর তাফসীর গ্রন্থের অধিকাংশ স্থানে। যেমন নিম্নোক্ত আয়াতের তাফসীরে।-
يَآ أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلاَ تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য তার রাসূলের। আর তোমরা তোমাদের আমলগুলিকে বিনষ্ট করো না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৩)। এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ ও রাসূলের অবাধ্যতামূলক কোন কাজই আল্লাহর নিকট কবুল হবে না। সর্বোপরি কুফরী সকল সৎকর্ম বিনষ্ট করে দেয়। যেমন অন্যত্র এসেছে,قُلْ أَطِيعُوا اللهَ وَالرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْكَافِرِينَ- ‘তুমি বল, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। যদি তারা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহ’লে (তারা জেনে রাখুক যে) আল্লাহ কাফিরদের ভালবাসেন না’ (আলে ইমরান ৩/৩২)। অর্থাৎ আল্লাহ ও রাসূল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটা কাফেরদের স্বভাব। যাদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন না।
উপরোক্ত আয়াতে ঈমানদারগণকে ‘কাফির’ বলা ও তাদের ‘সমস্ত আমল বিনষ্ট হওয়া’ কথাগুলি অবাধ্য মুসলিমদের প্রতি কঠোর ধমকি হিসাবে এসেছে এবং অবাধ্যতা যে সবচেয়ে বড় কবীরা গোনাহ সেটা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর দ্বারা তাদেরকে ইসলাম থেকে খারিজ ‘প্রকৃত কাফির ও মুরতাদ’ বুঝানো হয়নি। কেননা আল্লাহ তাদেরকে ‘মুমিন’ বলে সম্বোধন করেছেন। আর তিনি মুমিনের কোন নেক আমল বিনষ্ট করেন না (আলে ইমরান ৩/১৯৫)। তবে যদি সে ঈমান আনার পরেও ‘মুরতাদ’ হয়ে যায়, তাহ’লে তার বিগত সকল নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে। যেমনটি অত্র আয়াতের শেষে এবং পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে (ইবনু কাছীর)।
মুহাম্মাদ ৩৩ আয়াতের শেষে বর্ণিত وَلاَ تُبْطِلُوآ أَعْمالَكُمْ ‘আর তোমরা তোমাদের আমলগুলিকে বিনষ্ট করো না’-এর ব্যাখ্যায় যামাখশারী বলেন,لاَ تُحْبِطُوا الطَّاعَاتِ بِالْكَبَائِرِ كقوله تعالي يَآأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُواْ لاَ تَرْفَعُواْ أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبـِىِّ ...أَن تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنتُمْ لاَ تَشْعُرُونَ- ‘তোমরা কবীরা গোনাহসমূহের মাধ্যমে তোমাদের সৎকর্মসমূহকে বিনষ্ট করো না। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের উপরে তোমাদের কণ্ঠস্বর উঁচু করো না ...যাতে তোমাদের কর্মফল সমূহ বিনষ্ট হয়ে যাবে। অথচ তোমরা বুঝতে পারবে না’ (হুজুরাত ৪৯/২)।
এটি তাঁর মু‘তাযেলী আক্বীদা অনুযায়ী ব্যাখ্যা। যাদের মতে কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি কাফের। সে একটি কবীরা গুনাহ করলেও তার যাবতীয় সৎকর্ম বিনষ্ট হবে। তারা ফাসেকদের চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়ার আক্বীদা পোষণ করেন। সেকারণ ফাসেকের ঈমান বা সৎকর্ম তাদের মতে কোন কাজে আসবে না (মুহাক্কিক কাশশাফ)। অথচ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত আহলেহাদীছের আক্বীদা হ’ল, কবীরা গোনাহগার মুমিন কাফের নয়। বরং ফাসেক। সে তওবা না করে মারা গেলেও চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়। কারণ আল্লাহ শিরক ব্যতীত বান্দার যেকোন গোনাহ মাফ করতে পারেন’ (নিসা ৪/৪৮)।
কাফেরদের সঙ্গে জিহাদের মানদন্ড :
আল্লাহ বলেন,قَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُوا إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ- ‘তোমরা যুদ্ধ কর আল্লাহর রাস্তায় তাদের বিরুদ্ধে, যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তবে বাড়াবাড়ি করো না। কেননা আল্লাহ সীমালংঘন কারীদের ভালবাসেন না’ (বাক্বারাহ ২/১৯০)।
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) যখন কোন সেনাদল প্রেরণ করতেন, তখন বলতেন,اغْزُوا بِاسْمِ اللهِ فِى
سَبِيلِ اللهِ قَاتِلُوا مَنْ كَفَرَ بِاللهِ اغْزُوا وَلاَ تَغُلُّوا
وَلاَ تَغْدِرُوا وَلاَ تُمَثِّلُوا وَلاَ تَقْتُلُوا الْوِلْدَانَ وَلاَ
أَصْحَابَ الصَّوَامِعِ- ‘তোমরা আল্লাহর নামে তাঁর রাস্তায় যুদ্ধ কর তাদের
বিরুদ্ধে যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করে। যুদ্ধ কর, কিন্তু গণীমতের মালে
খেয়ানত করো না। চুক্তি ভঙ্গ করো না। শত্রুর অঙ্গহানি করো না। শিশুদের ও
উপাসনাকারীদের হত্যা করো না’।[5] ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, এক যুদ্ধে এক
মহিলাকে নিহত দেখতে পেয়ে রাসূল (ছাঃ) দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হন এবং নারী ও
শিশুদের থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দেন।[6]
রাসূল (ছাঃ)-এর মাক্কী ও মাদানী জীবন পর্যালোচনা করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বাতিলের বিরুদ্ধে জিহাদ সর্বাবস্থায় ফরয। তবে সেটি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কখনো নিরস্ত্র হবে, কখনো সশস্ত্র হবে। নিরস্ত্র জিহাদ মূলতঃ প্রজ্ঞাপূর্ণ দাওয়াত ও হক-এর উপরে দৃঢ় থাকার মাধ্যমে হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে সশস্ত্র জিহাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ, পর্যাপ্ত সামর্থ্য, বৈধ কর্তৃপক্ষ এবং স্রেফ আল্লাহর ওয়াস্তে নির্দেশ দানকারী আমীরের প্রয়োজন হবে। নইলে ছবর করতে হবে এবং আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকারের মৌলিক দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ، وَيُقِيمُوا الصَّلاَةَ، وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ، فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ عَصَمُوا مِنِّى دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلاَّ بِحَقِّ الإِسْلاَمِ، وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللهِ- ‘আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি, যে পর্যন্ত না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। আর তারা ছালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে। যখন তারা এগুলি করবে, তখন আমার পক্ষ হ’তে তাদের জান ও মাল নিরাপদ থাকবে ইসলামের হক ব্যতীত এবং তাদের (অন্তর সম্পর্কে) বিচারের ভার আল্লাহর উপর রইল’।[7] যেমন মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইকে সকল নষ্টের মূল জেনেও রাসূল (ছাঃ) তাকে হত্যা করেননি তার বাহ্যিক ইসলামের কারণে।
অত্র হাদীছে বুঝানো হয়েছে যে, কাফির-মুশরিকরা যুদ্ধ করতে এলে তোমরাও যুদ্ধ করবে। কিংবা তাদের মধ্যকার যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে। কিন্তু নিরস্ত্র, নিরপরাধ বা দুর্বলদের বিরুদ্ধে নয়। কাফির পেলেই তাকে হত্যা করবে সেটাও নয়। এই যুদ্ধ কোন মুসলমানের বিরুদ্ধে হবে না। কেননা উক্ত হাদীছটি অন্য বর্ণনায় এসেছে,أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ الْمُشْرِكِينَ... ‘আমি আদিষ্ট হয়েছি মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে’।[8] অথচ চরমপন্থীরা মুসলমানদেরকেই হত্যা করে এবং তারা সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ صَلَّى صَلاَتَنَا، وَاسْتَقْبَلَ قِبْلَتَنَا، وَأَكَلَ ذَبِيحَتَنَا، فَذَلِكَ الْمُسْلِمُ الَّذِى لَهُ ذِمَّةُ اللهِ وَذِمَّةُ رَسُولِهِ، فَلاَ تُخْفِرُوا اللهَ فِى ذِمَّتِهِ- ‘যে ব্যক্তি আমাদের তরীকায় ছালাত আদায় করে, আমাদের কেবলাকে কেবলা বলে গ্রহণ করে এবং আমাদের যবেহ করা পশুর গোশত খায়, সে ব্যক্তি ‘মুসলিম’। তার (জান-মাল ও ইযযত রক্ষার জন্য) আল্লাহ ও তার রাসূলের দায়িত্ব রয়েছে। অতএব তোমরা আল্লাহর দায়িত্বে হস্তক্ষেপ করোনা’।[9] এতে বুঝা যায় যে, প্রকাশ্য ইসলামী আমলের মাধ্যমেই ব্যক্তি ‘মুসলিম’ সাব্যস্ত হবে।
অত্র হাদীছে শৈথিল্যবাদী মুরজিয়াদের প্রতিবাদ রয়েছে। যারা বলেন, ঈমানের জন্য কেবল স্বীকৃতিই যথেষ্ট। আমলের প্রয়োজন নেই। এর মধ্যে বিদ‘আতীদের কাফের না বলারও দলীল রয়েছে (মিরক্বাত, মির‘আত)।
মুসলিম উম্মাহর মধ্যে পরস্পরে কাফের গণ্য করার ধারাবাহিক ইতিহাস :
উম্মতের মধ্যে প্রথম বিদ‘আতের সূচনা হয় পরস্পরকে ‘কাফির’ বলার মাধ্যমে। খারেজীরা হ’ল উম্মতের প্রথম ভ্রান্ত ফের্কা, যারা কবীরা গোনাহগার মুসলিমকে ‘কাফের’ বলে এবং তাকে হত্যা করা সিদ্ধ বলে। এদের সাথে সাথেই সৃষ্টি হয় আরেকটি চরমপন্থী ভ্রান্ত ফের্কা শী‘আ দল। যারা বলে, রাসূল (ছাঃ)-এর পরে মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ, আবু যর গেফারী ও সালমান ফারেসী (রাঃ) ব্যতীত সকল ছাহাবী ‘মুরতাদ’ বা ধর্মত্যাগী।
প্রথম যুগের চরমপন্থী খারেজী ও শী‘আদের অনুকরণে আধুনিক যুগে কয়েকজন চিন্তাবিদের আবির্ভাব ঘটে। যাদের যুক্তিবাদী লেখনীতে প্রলুব্ধ হয়ে বিভিন্ন দেশে ইসলামের নামে চরমপন্থী দলসমূহের উদ্ভব ঘটে। বিংশ শতাব্দীতে এসব দলের যে আক্বীদা প্রচারিত হয়, তা হ’ল ‘দ্বীন আসলে হুকূমতের নাম। শরী‘আত ঐ হুকূমতের কানূন। আর ইবাদত হ’ল ঐ কানূন ও বিধানের আনুগত্য করার নাম’। তাদের মতে ‘ছালাত-ছিয়াম, হজ্জ-যাকাত, যিকর ও তাসবীহ সবকিছু উক্ত বড় ইবাদতের জন্য প্রস্ত্ততকারী অনুশীলনী বা ট্রেনিং কোর্স মাত্র’। তারা বলেন, ইসলাম কোন বণিকের দোকান নয় যে, ইচ্ছামত কিছু মাল কিনবে ও কিছু ছাড়বে। বরং ইসলামের হয় সবটুকু মানতে হবে, নয় সবটুকু ছাড়তে হবে’। তাদের ধারণায় ‘আল্লাহর ইবাদত ও সরকারের আনুগত্য দু’টিই সমান। যদি ছালাত-ছিয়াম ইত্যাদি ইবাদত হুকূমত কায়েমের লক্ষ্য হতে বিচ্যুত হয়, তাহ’লে আল্লাহর নিকট এ সবের কোন ছওয়াব মিলবে না’। তারা বলেন, এই দাওয়াত যারা কবুল করবে না, তাদের অবস্থা হবে নবীযুগে ইসলামী দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারী ইহূদীদের মত’।
তাদের উক্ত আক্বীদা বিগত যুগের চরমপন্থী খারেজী, শী‘আ, মু‘তাযিলা প্রভৃতি ভ্রান্ত দলসমূহের অনুরূপ। সে যুগে তারা ছাহাবীদের ‘কাফের’ বলেছিল ও তাদের রক্ত হালাল করেছিল। এ যুগে এরা অন্য মুসলমানদের ‘ইহূদী’ অর্থাৎ কাফের ভাবছে ও তাদের রক্ত হালাল গণ্য করছে। সে যুগে যেমন যেকোন মূল্যে ক্ষমতা দখলই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল, এ যুগেও তেমনি ব্যালট বা বুলেট যেভাবেই হৌক ক্ষমতা দখলই তাদের মূল লক্ষ্য এবং এটাই হ’ল তাদের দৃষ্টিতে বড় ইবাদত।
বস্ত্ততঃ উপরোক্ত চিন্তাধারায় সবচেয়ে বড় ভুল হ’ল তিনটি : (১) সর্বাত্মক দ্বীন-এর ধারণা। ফলে তাদের মতে দ্বীনের কোন একটি অংশ ছাড়লেই সব দ্বীন চলে যাবে। (২) দ্বীন ও দুনিয়ার পার্থক্য পরিষ্কার না হওয়া এবং (৩) আল্লাহর ইবাদত ও সরকারের আনুগত্যকে এক করে দেখা’। এই দর্শনের ফলে ইসলামী সরকারের বিরোধিতা করা এবং অনৈসলামী বা অমুসলিম সরকারের আনুগত্য করা দু’টিই শিরকে পরিণত হয়। যাতে সরকার ও মুমিন জনগণের মধ্যে গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হবে। যেমনটি বর্তমানে অনেক স্থানে হচ্ছে।
একই ধারণা প্রচারিত হয় মিসরে। যারা খারেজীদের ন্যায় মুসলিম উম্মাহকে কাফের ও মুমিন দু’ভাগে ভাগ করে বলেন, ‘লোকেরা আসলে মুসলমান নয় যেমন তারা দাবী করে থাকে। তারা জাহেলিয়াতের জীবন যাপন করছে। ... তারা ধারণা করে যে, ইসলাম এই জাহেলিয়াতকে নিয়েই চলতে পারে। কিন্তু তাদের এই ধোঁকা খাওয়া ও অন্যকে ধোঁকা দেওয়ায় প্রকৃত অবস্থার কোনই পরিবর্তন হবে না। না এটি ইসলাম এবং না তারা মুসলমান’। তারা বলেন, ‘কালচক্রে দ্বীন এখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহতে এসে দাঁড়িয়ে গেছে। ... মানুষ প্রাচ্যে-প্রতীচ্যে সর্বত্র মসজিদের মিনার সমূহে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর ধ্বনি বারবার উচ্চারণ করে কোনরূপ বুঝ ও বাস্তবতা ছাড়াই। এরাই হ’ল সবচেয়ে বড় পাপী ও ক্বিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তির(أثقلُ إثماً وأشدُّ عذاباً يومَ القيامة) অধিকারী। কেননা তাদের কাছে হেদায়াত স্পষ্ট হওয়ার পরেও এবং তারা আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে থাকার পরেও তারা মানুষপূজার দিকে ফিরে গেছে’। তারা বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বে কোন মুসলিম রাষ্ট্র নেই বা কোন মুসলিম সমাজ নেই’। তারা মুসলমানদের সমাজকে জাহেলী সমাজ এবং তাদের মসজিদগুলিকে ‘জাহেলিয়াতের ইবাদতখানা’ (مُعَابِدُ الْجَاهِلِيَّةِ) বলে আখ্যায়িত করেন’। তারা আল্লাহর ইবাদত ও সরকারের আনুগত্যকে সমান মনে করেন এবং অনৈসলামী সরকারের আনুগত্য করাকে ‘ঈমানহীনতা’ গণ্য করেন’। ‘একটি বিষয়েও অন্যের অনুসরণ করলে সে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে’ বলে তারা ধারণা করেন। তারা বলেন, ইসলামে জিহাদের উদ্দেশ্য হ’ল, ইসলাম বিরোধী শাসনের বুনিয়াদ সমূলে ধ্বংস করা এবং সে স্থলে ইসলামের ভিত্তিতে রাষ্ট্র কায়েম করা’।
বলা বাহুল্য, এইসব খারেজী ও শী‘আপন্থী তাফসীরের কারণে মুসলিম উম্মাহর প্রায় সর্বত্র চরমপন্থী মতবাদ ছরিয়ে পড়েছে। যা বহু তরুণের পথভ্রষ্টতার কারণ হয়েছে। তারা অবলীলাক্রমে মুসলিম সরকার ও সমাজকে কাফের ভাবছে ও তাদেরকে বোমা মেরে ধ্বংস করে দেওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। অথচ অন্তর থেকে কালেমা শাহাদাত পাঠকারী কোন মুমিন কবীরা গোনাহের কারণে কাফের হয় না। এটাই হ’ল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত আহলেহাদীছের সর্বসম্মত আক্বীদা। আর আক্বীদা পরিচ্ছন্ন না হ’লে কখনো আমল পরিচ্ছন্ন হয় না। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন সঠিক আক্বীদার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মুসলমানদের আমল শুদ্ধ করা।
ত্বাগূতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ :
‘ত্বাগূত’ (الطاغوت) অর্থ শয়তান, মূর্তি, প্রতিমা ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে, ‘কুরআন ও সুন্নাহ বাদ দিয়ে অন্য কোন বাতিলের কাছে ফায়ছালা তলব করা’। মূলতঃ এটি হ’ল মুনাফিকদের স্বভাব (নিসা ৪/৬০-৬১)।
এক্ষণে কোন মুসলিম সরকার যদি কুরআন ও সুন্নাহর বিধান বাদ দিয়ে নিজেদের মনগড়া আইন অনুযায়ী দেশ শাসন করে, তবে সে সরকার মুনাফিক ও কবীরা গোনাহগার হবে। কিন্তু যদি সেটাকে আল্লাহর বিধানের চাইতে উত্তম বা সমান বা দু’টিই সিদ্ধ মনে করে ও জেনেবুঝে তাতে খুশী থাকে, তাহ’লে উক্ত সরকার প্রকৃত ‘কাফের’ হিসাবে গণ্য হবে। ব্যক্তির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তবে কোন মুসলিম ব্যক্তি বা সরকার কাফের সাব্যস্ত হলেই তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা ফরয নয়।
ত্বাগূতের বিরুদ্ধে কর্তব্য :
উপরোক্ত অবস্থায় মুমিনের কর্তব্য হবে, (১) বৈধভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানো। (২) দেশে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী পন্থায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। (৩) বিভিন্ন উপায়ে সরকারকে নছীহত করা। (৪) সরকারের হেদায়াতের জন্য দো‘আ করা। (৫) সরকারের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকটে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করা। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবেনা। তাতে সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়বে।
উল্লেখ্য যে, মুনাফিকরা বড় কাফের হ’লেও তারা ‘মুরতাদ’ হবে না এবং তাদের উপর দন্ডবিধি জারি হবে না। কেননা তারা বাহ্যিকভাবে ইসলামকে স্বীকার করে। তবে আখেরাতে তারা কাফেরদের সাথেই একত্রে জাহান্নামে থাকবে (নিসা ৪/১৪০)। বরং তারা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে (নিসা ৪/১৪৫)।
পর্যালোচনা :
আধুনিক যুগে ভারতবর্ষ ও মিসরে প্রচারিত উপরোক্ত চরমপন্থী আক্বীদার অনুসারী দল সমূহ কবীরা গোনাহগার মুসলমানদেরকে মুসলমান হিসাবে মেনে নিতে চাননি। বরং তাদেরকে মুসলিম উম্মাহ থেকে খারিজ বলে ধারণা করেছেন। এর ফলে তাঁরা ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। সাথে সাথে পথচ্যুত করেছেন তাদের অনুসারী অসংখ্য মুসলিম নর-নারীকে। অথচ এর কোন বাস্তবতা এমনকি রাসূল (ছাঃ)-এর যুগেও ছিল না। তখনও মুসলমানদের মধ্যে ভাল-মন্দ, ফাসিক-মুনাফিক সবই ছিল। কিন্তু কাউকে তাঁরা কাফির এবং মুসলিম উম্মাহ থেকে খারিজ বলতেন না। সেকারণ আধুনিক বিদ্বানগণ এসব দল ও এদের অনুসারী দলসমূহকে এক কথায় ‘জামা‘আতুত তাকফীর’ (جَمَاعَةُ التَّكْفِيْرِ) অর্থাৎ ‘অন্যকে কাফের ধারণাকারী দল’ বলে অভিহিত করে থাকেন। অথচ এইসব চরমপন্থী আক্বীদার ফলে যিনি মারছেন ও যিনি মরছেন, উভয়ে মুসলমান। আর এটাই তো শয়তানের পাতানো ফাঁদ, যেখানে তারা পা দিয়েছেন।
অতএব মুমিনের কর্তব্য হবে চরমপন্থী তাফসীর সমূহ থেকে বিরত হওয়া ও তাদের সংগঠন থেকে দূরে থাকা। সর্বাবস্থায় আমর বিন মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকারের মৌলিক দায়িত্ব পালন করা এবং মুসলিম-অমুসলিম সকলের নিকট ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরা।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইসলামের মধ্যপন্থী আক্বীদায় বিশ্বাসী হওয়ার ও সে মতে জামা‘আতবদ্ধ হওয়ার তাওফীক দান করুন- আমীন!
[ইসলামের সঠিক আক্বীদা বিষয়ে জানার জন্য পাঠ করুন মাননীয় লেখকের (১) ‘আক্বীদা ইসলামিয়াহ’ (২) ‘ইক্বামতে দ্বীন : পথ ও পদ্ধতি’ (৩) ‘জিহাদ ও ক্বিতাল’ (৪) ‘চরমপন্থীদের বিশ্বাসগত বিভ্রান্তির জবাব’ বই সমূহ। -সম্পাদক]
[1]. বুখারী হা/৪২৭৪।
[2]. তিরমিযী হা/২৫৩১।
[3]. আবুদাঊদ হা/৪৭৩৯।
[4]. আক্বীদাহ ওয়াসিত্বিইয়াহ-শরহ ১৫০ পৃ.।
[5]. মুসলিম হা/১৭৩১; আহমাদ হা/২৭২৮।
[6]. বুখারী হা/৩০১৫।
[7]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১২।
[8]. নাসাঈ হা/৩৯৬৬।
[9]. বুখারী হা/৩৯১।