আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللهِ وَرَسُولِهِ وَإِذَا كَانُوا مَعَهُ عَلَى أَمْرٍ جَامِعٍ لَمْ يَذْهَبُوا حَتَّى يَسْتَأْذِنُوهُ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَأْذِنُونَكَ أُولَئِكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَرَسُولِهِ فَإِذَا اسْتَأْذَنُوكَ لِبَعْضِ شَأْنِهِمْ فَأْذَنْ لِمَنْ شِئْتَ مِنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمُ اللهَ إِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ- ‘মুমিন তো কেবল তারাই, যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং যখন তারা তার সঙ্গে কোন সমষ্টিগত গুরুত্বপূর্ণ কাজে সাথী হয়, তখন তারা চলে যায় না যতক্ষণ না তার কাছ থেকে অনুমতি নেয়। নিশ্চয়ই যারা তোমার নিকট অনুমতি প্রার্থনা করে, তারাই আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি বিশ্বাসী। অতএব তারা তাদের কোন কাজে তোমার নিকট অনুমতি চাইলে তুমি তাদেরকে অনুমতি দাও যাকে চাও। আর তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (নূর ২৪/৬২)।
অত্র আয়াতে আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ-নিষেধ বিনা দ্বিধায় মান্য করার প্রতি তাকীদ করা হয়েছে। যা ব্যতীত ঈমান পূর্ণতা লাভ করবে না (কুরতুবী)। أَمْرٍ جامِعٍ বা ‘সমষ্টিগত গুরুত্বপূর্ণ কাজ’ বলতে আমীর যেটাকে দ্বীনের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ মনে করবেন, সেটাকে বুঝানো হয়েছে (কুরতুবী)। এর মধ্যে সাংগঠনিক শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। উম্মতের সমষ্টিগত কল্যাণের স্বার্থে যখন কোন সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন আমীরের অনুমতি ব্যতীত কেউ সেখান থেকে চলে যেতে পারে না, কপট বিশ্বাসী ও স্বার্থপর সাথীরা ব্যতীত। তারা ঈমানের দাবীদার হ’লেও কখনো পূর্ণ মুমিন নয়। যে ব্যক্তি এটা মেনে চলবে, সেই-ই কেবল পূর্ণ মুমিন হবে (ইবনু কাছীর)।
মাদানী জীবনে ইহূদীদের শঠতা ও মুনাফিকদের কপটতাই ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবনে সবচেয়ে বড় বেদনার বিষয়। একই সাথে এটা ছিল ইসলামের প্রচার ও প্রসারে সবচেয়ে বড় বাধা। ঝুঁকির সময়ে মুনাফিকরা নানা অজুহাতে সরে পড়ত। কিন্তু গণীমত লাভের সহজ সুযোগ পেলে আগে যেয়ে গণীমত দাবী করত। এদের এই সুবিধাবাদী চরিত্র খুবই স্পষ্ট ছিল। যা অত্র সূরায় ইঙ্গিতে বলা হয়েছে। এছাড়াও সূরা মুনাফিকূন নাযিল হয় এদেরই কারণে। এর মধ্যে মুসলিম উম্মাহর নেতৃবৃন্দের জন্য সতর্কবাণী রয়েছে।
অত্র আয়াতটি إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ দিয়ে শুরু হয়েছে। যার অর্থ ‘তারা ব্যতীত মুমিন নয়’ এর প্রায়োগিক অর্থ তারা ব্যতীত পূর্ণ মুমিন নয়’ (কুরতুবী)। এখানে মুমিনের তিনটি গুণ বলা হয়েছে। আল্লাহর উপরে বিশ্বাস, তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস এবং নেতার আনুগত্য। প্রথম দু’টি না থাকলে ঈমানই থাকবে না এবং শেষেরটি না থাকলে ঈমান পূর্ণ হবে না। কারণ নেতার মাধ্যমে সমাজ পরিচালিত হয়। ফলে তার প্রতি আনুগত্য না থাকলে সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। এমনকি সমাজ বিপর্যস্ত হয়। আর নেতাদের জন্যও রয়েছে নির্দিষ্ট গুণাবলী। তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় গুণ হ’ল তাকে আল্লাহর বিধান কায়েমের ব্যাপারে আপোষহীন ও দৃঢ়চিত্ত থাকতে হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ تَنْزِيلًا- فَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ وَلاَ تُطِعْ مِنْهُمْ آثِمًا أَوْ كَفُورًا- وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ بُكْرَةً وَّأَصِيلاً- ‘নিশ্চয়ই আমরা তোমার উপর কুরআন নাযিল করেছি পর্যায়ক্রমে’। ‘অতএব তুমি তোমার পালনকর্তার আদেশের অপেক্ষায় ধৈর্য ধারণ কর। আর তুমি ওদের মধ্যকার কোন পাপাচারী কিংবা অবিশ্বাসীর আনুগত্য করবে না’। ‘তুমি সকালে ও সন্ধ্যায় তোমার পালনকর্তার নাম স্মরণ কর’ (দাহর ৭৬/২৩-২৫)। এতে বলে দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহর বিধান কায়েমে গোপনে বা প্রকাশ্যে বাধা দানকারীদের কথা মেনে নেওয়া যাবে না। আর দৃঢ় থাকার জন্য সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে ও তাঁর সাহায্য কামনা করতে হবে। কারণ প্রকাশ্য বিরোধীদের সহজে চেনা যায়। কিন্তু গোপন বিরোধীদের সহজে চেনা যায় না।
অনেক সময় শত্রুদের প্রতারণায় নিজের লোকেরাও নেতাকে মিসগাইড করে। এটা তারা সরল মনে অথবা কোন স্বার্থের চাপে দুর্বল হয়ে করে। সকল অবস্থাতেই নেতাকে আল্লাহর উপর ভরসা করে শক্ত থাকতে হয় এবং আপোষহীন ভাবে আল্লাহর বিধান কায়েমে দৃঢ় থাকতে হয়। তাতে আল্লাহর অদৃশ্য মদদ নেমে আসে। যেমনটি দেখা গেছে হোনায়েন যুদ্ধে শত্রুর বেষ্টনীর মধ্যে পড়ে রাসূল (ছাঃ)-এর মধ্যে। যেমনটি দেখা গেছে ছাহাবীগণের জীবনে বহু স্থানে। দেখা গেছে মুতার যুদ্ধে সম্মিলিত খৃষ্টান বাহিনীর বিরুদ্ধে অমিততেজা তরুণ সেনাপতি আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহার মধ্যে। মুমিন সর্বদা সঠিক পথে পরিচালিত হয় তার দৃঢ় ঈমানের জোরে। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ يَهْدِيهِمْ رَبُّهُمْ بِإِيمَانِهِمْ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهِمُ الْأَنْهَارُ فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ- ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সুপথ প্রদর্শন করেন তাদের ঈমানের মাধ্যমে নে‘মতপূর্ণ জান্নাত সমূহের দিকে। যেসবের তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়’ (ইউনুস ১০/৯)।
সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সর্বদা ঈমানী পরীক্ষার মধ্য দিয়ে চলতে হয়। এমতাবস্থায় তাদের সাথে যতবেশী দৃঢ়চেতা ঈমানদার সাথী থাকে, ততবেশী তারা নিরাপদ থাকেন। যদি সাথীরা দুর্বলচেতা হয় বা অতি সরল হয়, তাহ’লে তারা বিরোধীদের সহজ শিকারে পরিণত হয়। ফলে নেতার হাযারো সদিচ্ছা তখন কার্যকর হয় না। এমনই অবস্থা হয়েছে যুগে যুগে অদ্যাবধি।
আজকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ঘুষ-দুর্নীতি ও অবাধ লুটপাট চলছে, তার মূল কারণ হ’ল ঈমানী সংকট। সর্বোচ্চ নেতা হন মূলতঃ একজন দলনেতা। তদুপরি যদি তিনি ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্ত্তবাদী হন, তাহ’লে আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার ভয় তার মধ্যে থাকেনা। অন্যদিকে দেশে তাকে জবাবদিহি করার মত কেউ থাকেনা। ফলে মযলূমের কান্না তিনি শুনতে পাননা। বরং তিনি সর্বত্র কেবল উন্নয়নের জোয়ার দেখেন। মুসলমান হ’লে তার হৃদয়ে আল্লাহভীতির তাকীদ অনুভব করলেও সাংবিধানিক ও আইনী কোন বাধ্যবাধকতা না থাকায় তা কোন গুরুত্ব বহন করে না। তাদের ঈমান কেবল ছালাত-ছিয়ামের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। প্রশাসনিক ও বিচারিক জীবনে তার কোন প্রতিফলন থাকেনা। আর তাই সর্বোচ্চ নেতার সকল হম্বিতম্বি দলীয় লোকদের নিকট কেবল চিৎকার সর্বস্ব হয়ে পড়ে। যার তিক্ত ফল ভোগ করে তৃণমূল জনসাধারণ। দেখা দেয় সর্বত্র অশান্তি ও বিশৃংখলা। এক সময় লাগামছাড়া হয়ে পড়ে প্রশাসন। ফলে নেমে আসে আল্লাহর গযব। যা থেকে বাঁচার কোন উপায় থাকেনা।
বর্তমানে করোনা ভাইরাসের মহামারীর মধ্যে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতির যেসব নমুনা বেরিয়ে আসছে, তা তুলনাহীন। কেউ কি ধারণা করতে পারে যে সঞ্চয়ী ব্যাংকের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারী প্রতিষ্ঠানে বিগত ৩১ বৎসর যাবৎ কোন অডিট হয়নি। জনগণের সঞ্চিত কত সহস্র কোটি টাকা যে লুটপাট হয়েছে, তার কোন হিসাব নেই (দৈনিক ইনকিলাব ১৪.৯.২০২০)। তিতাস গ্যাসের দায়িত্বহীনতার কারণে নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লা বায়তুছ ছালাত জামে মসজিদে গ্যাস পাইপের লিকেজ থেকে গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর এশার সময় গ্যাস বিস্ফোরণে নিহত হ’ল ৩১ জন মুছল্লী এবং বাকীদের অবস্থা সংকটাপন্ন। কিন্তু কোম্পানীর কোন জবাবদিহিতা নেই। নেই ক্ষতিপূরণ দানের কোন ব্যবস্থা।
দেশে গ্যাসের রিজার্ভ কমে যওয়ায় সরকার ২০০৯ সাল থেকে বাসা বাড়িতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করেছে। সরকারী তিতাস কোম্পানী এই সুযোগটি কাজে লাগায় এবং তখন থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা ও আশপাশে ২৪৫ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইনের গ্রাহক প্রায় ১০ লাখ। বিল তোলা হয়, কিন্তু সরকার পায় না। প্রতিটি সংযোগ নিতে তাদের দিতে হয় ২০ হাযার থেকে ১ লাখ টাকা ঘুষ (প্রথম আলো ১০.৯.২০২০)। আলোচ্য মসজিদ কমিটি ৫০ হাযার টাকা ঘুষ দেয়নি বলে তারা লিকেজ মেরামত হয়নি (প্রথম আলো ৮.৯.২০২০)।
ঘুষের কোন প্রমাণ থাকে না। অতএব তদন্তে কোম্পানী নির্দোষ প্রমাণিত হবে। কিন্তু ভুক্তভোগীরাই আসল সাক্ষী। ঘুষখোররা সরকারী দলের নেতা-কর্মী। ফলে তাদের কিছুই হবে না। এরূপ একটা বিশ্বাস সকল পর্যায়ে দানা বেঁধেছে বলেই দেশে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। যা দ্রুত চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এভাবে পূর্বেকার ও বর্তমানের অসংখ্য দৃষ্টান্ত একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, গণতন্ত্রের নামে দলীয় সরকার ও তার সহযোগীরা থাকে সকল জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। যদিও মুখে সর্বদা জনগণের নিকট জবাবদিহিতার কথা তারা বলেন। অথচ ইচ্ছা থাকলেও সরকার প্রধান সেটা পারেন না, দলীয় স্বার্থের কারণে। একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে যে, সব স্থানেই রয়েছে কেবল ঈমানী সংকট। যদি প্রত্যেক দায়িত্বশীল স্ব স্ব সমষ্টিগত দায়িত্বের বোঝা বহনের হিসাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে বলে বিশ্বাস করতেন, তার সকল কাজ আল্লাহ দেখছেন ও শুনছেন বলে ভয় পেতেন, তাহ’লে তাদের দ্বারা কোনরূপ দায়িত্বহীনতা ও অসৎকর্ম সম্পাদিত হ’ত না।
বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ। এখানকার সব স্তরের দায়িত্বশীল প্রায় সবাই মুসলিম। তারা ছালাত-ছিয়ামে অভ্যস্ত। অথচ যত অপকর্ম তাদের মাধ্যমেই হচ্ছে। কেন হচ্ছে? কারণ তারা লৌকিক ইসলামে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পারলৌকিক চেতনা অবলুপ্ত হয়ে গেছে। অথচ ঈমানের বিষয়টি হ’ল সেখানের। যা বাহির থেকে দেখা যায় না। একই পাকা কলা মানুষে খায় ও ছাগলে খায়। কিন্তু মুমিন হালাল-হারাম বেছে খায়। ছাগল তা বাছেনা। কারণ তাকে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হয় না। পক্ষান্তরে মুমিন যখন একইরূপ বিশ্বাসী হয়, তখন ছাগলের সাথে তার আর কোন পার্থক্য থাকে না। এটাকেই আল্লাহ বলেছেন,وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ لَهُمْ قُلُوبٌ لاَ يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لاَ يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لاَ يَسْمَعُونَ بِهَا أُولَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ- ‘আর আমরা বহু জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য। যাদের হৃদয় আছে কিন্তু বুঝে না। চোখ আছে কিন্তু দেখে না। কান আছে কিন্তু শোনে না। ওরা হ’ল চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়, বরং তার চাইতেও পথভ্রষ্ট। ওরা হ’ল উদাসীন’ (আ‘রাফ ৭/১৭৯)।
নবী-রাসূলগণ যুগে যুগে মানুষকে ঈমানী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। যার বাস্তব নমুনা ছিলেন ছাহাবায়ে কেরাম। যারা জাহেলী যুগের অবস্থা থেকে ইসলামী যুগে এসে সম্পূর্ণ নতুন মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। তাদের হাতে কেবল মানুষ কেন একটা নগণ্য প্রাণীও নিরাপদ ছিল। অথচ আজকের পৃথিবীর শাসকদের অত্যাচারে মানুষ নিজ বাড়ীতেও নিরাপদ নয়। এমনকি মিথ্যা মামলা, ভুয়া দলীল, অফিসের ঘুষ-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজদের অত্যাচারে ভিটে-মাটি ছাড়া হয়ে মানুষ বনে-জঙ্গলে ও সাগরে-নদীতে ভেসে বেড়াচ্ছে সর্বত্র।
আমরা সেই মুসলমান, যাদের পূর্বসূরী একজন মুসলমান নৌকাডুবি থেকে সাঁতরে তীরে জঙ্গলে উঠে বাঘের মুখে পড়েন। সাক্ষাৎ বিপদে তিনি বাঘকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-এর গোলাম সাফীনাহ। আমি বিপদগ্রস্থ। তাতেই বাঘ থেমে যায় ও তার নিকটে এসে মাথা নীচু করে সম্মান প্রদর্শন করে। সে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় ও জঙ্গল পার করে পথে উঠিয়ে দেয়। অতঃপর তার নিকটে হামহুম করে সহানুভূতি প্রকাশ করে বিদায় নেয়’।[1]
উপরোক্ত ঘটনা প্রমাণ করে যে, সত্যসেবী মুমিনকে আল্লাহ এমনকি হিংস্র ব্যাঘ্রকে দিয়েও সাহায্য করে থাকেন।
আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার শর্তাবলী :
(১) সমষ্টিগত কাজটি হ’তে হবে আল্লাহর জন্য ও আল্লাহর বিধান মতে। (২) কোনরূপ রিয়া ও শ্রুতি তাকে স্পর্শ করবে না এবং আল্লাহ বিরোধী পন্থায় কাজ করবে না। যারা উক্ত শর্ত দু’টি যত সুন্দরভাবে মেনে চলবেন, তিনি তত বেশী আল্লাহর সাহায্য পাবেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল কখন ক্বিয়ামত হবে? তিনি বলেন, ‘যখন আমানতের খেয়ানত হবে। জিজ্ঞেস করা হ’ল সেটা কিভাবে হবে? তিনি বললেন, যখন অযোগ্য ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হবে। তখন তুমি ক্বিয়ামতের অপেক্ষা কর’।[2] তিনি বলেন, ‘অতদিন ক্বিয়ামত হবেনা যতদিন না মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি পায় ও প্রবহমান হয়। এমন অবস্থা হবে যে, যাকাত নেওয়ার কোন হকদার খুঁজে পাওয়া যাবেনা’।[3] সবদেশের সরকারের একটাই শ্লোগান ‘দারিদ্র্য বিমোচন’। অথচ দারিদ্র্য মানুষের জন্য রহমত স্বরূপ। দরিদ্র মানুষ আছে বলেই ধনী মানুষ বহাল আছে। দরিদ্রদের মাধ্যমেই দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা শ্রমেই দেশ এগিয়ে চলেছে। আললাহ ধনী ও দরিদ্রের এ পার্থক্য সৃষ্টি করেছেন একে অপর থেকে কাজ নেওয়ার জন্য’ (যুখরুফ ৩২)।
ধনীদের কর্তব্য দরিদ্রদের যথাযথ প্রাপ্য প্রদান করা। দরিদ্রদের কর্তব্য মনিবের আমানত যথাযথভাবে রক্ষা করা ও তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা। এতে ধনী যেমন দিয়ে তৃপ্তি পাবে, গরীব তেমনি তার দায়িত্ব পালন করতে পেরে তৃপ্তি পাবে। উভয়ে পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে যাবে এবং পরকালে আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম পুরস্কার লাভে ধন্য হবে। বস্ত্ততঃ আল্লাহকে সন্তুষ্ট করাই হ’ল ইসলামী সমাজ জীবনের রূহ। এই রূহ হারিয়ে গেলে কেবল বাহ্যিক সমৃদ্ধির খোলসটুকু পড়ে থাকবে, যা কোন কল্যাণ বয়ে আনে না। সুতরাং ‘দারিদ্র্য বিমোচন’ কথাটি অবাস্তব। এটি স্রেফ রাজনৈতিক প্রতারণা মাত্র। বরং হওয়া উচিত ধনী-গরীবের বৈষম্য হ্রাস ও তাদের মধ্যে ন্যায়ানুগ সম্পর্ক স্থাপন করা। লক্ষ্য হওয়া উচিত সমাজের সর্বত্র অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
সম্প্রতি মৃত্যুবরণকারী দেশের কয়েকজন শিল্পপতির জীবনী পড়ে দেখা গেছে, তারা হতদরিদ্র অবস্থা থেকে এতদূর পর্যন্ত উঠে এসেছেন মূলতঃ কর্মচারীদের সাথে গভীর সৌহার্দ্য ও ন্যায়ানুগ সম্পর্ক থাকার কারণে। এদিকে ইঙ্গিত করেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা আমাকে দুর্বল শ্রেণীর মধ্যে তালাশ কর। কেননা তোমরা রূযী প্রাপ্ত হয়ে থাক ও সাহায্য প্রাপ্ত হয়ে থাক তোমাদের দুর্বল শ্রেণীর মাধ্যমে’।[4] তিনি বলেন, ধনীদের পাঁচশত বছর পূর্বে গরীবরা জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[5] আর সেটা হবে তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন ও দৃঢ় ঈমানের কারণে। অন্যায় স্বার্থ হাছিলের জন্য যে ঘুষ দেয় ও যে ঘুষ খায় উভয়কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) লা‘নত করেছেন।[6] আর এটাই স্বতঃসিদ্ধ যে, রাসূল (ছাঃ)-এর লা‘নতপ্রাপ্ত ব্যক্তি কখনো জান্নাতে যাবেনা।
অতএব যারা আল্লাহকে সর্বক্ষণ ভয় করে, তিনি সবকিছু দেখছেন ও শুনছেন বলে বিশ্বাস করে এবং পরকালে জান্নাত লাভের দৃঢ় আকাংখা পোষণ করে, তারা কখনো আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়া খরীদ করতে পারেনা, দুর্নীতি করে জান্নাত হারাতে পারেনা। নিশ্চয়ই তাদের সৎকর্মশীল স্ত্রী-সন্তানেরাও এটা চাইবে না। এমন একটা সময় আসবে, যখন সন্তানরা বড় হয়ে পিতার সম্পদের উত্তরাধিকার নিতে অস্বীকার করবে। অথচ সন্তানের জন্যই পিতা-মাতা সবকিছু করেন। অতএব ঘুষ ও দুর্নীতিতে অভ্যস্ত পিতা-মাতারা সাবধান হও। দুনিয়াতে তোমরা হবে ঘৃণিত এবং আখেরাতে হবে জাহান্নামের ইন্ধন। সেদিন জাহান্নামীরা বলবে, ‘হায়! যদি আমরা আল্লাহকে মানতাম ও রাসূলকে মানতাম!’ (৬৬) ‘তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতাদের ও বড়দের আনুগত্য করতাম। অতঃপর তারাই আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল’ (৬৭)। ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তাদেরকে তুমি দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং তাদেরকে মহা অভিশাপ দাও’ (আহযাব ৬৬-৬৮)।
সেদিন হারামখোর ধনীদের সকল সৎকর্ম বৃথা যাবে। আল্লাহ বলেন, ‘আর আমরা সেদিন তাদের কৃতকর্মসমূহের দিকে মনোনিবেশ করব। অতঃপর সেগুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব’ (ফুরকবান ২৩)। অন্যদিকে ফেরেশতারা তাদের বলবে, ‘সেদিন পাপীদের জন্য কোন সুসংবাদ থাকবে না এবং তারা বলবে, বাঁচাও বাঁচাও’ (ফুরকবান ২২)। সবদিকে নিরাশ হয়ে সীমালংঘনকারীরা সেদিন কেবল হা-হুতাশ করবে। আল্লাহ বলেন, ‘যালেম সেদিন নিজের দু’হাত কামড়ে বলবে, হায়! যদি (দুনিয়াতে) রাসূলের পথ অবলম্বন করতাম’ (২৭)। ‘হায় দুর্ভোগ আমার! যদি আমি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম’ (২৮)। ‘আমার কাছে উপদেশ (কুরআন) আসার পর সে আমাকে পথভ্রষ্ট করেছিল। বস্ত্ততঃ শয়তান মানুষের জন্য পথভ্রষ্টকারী’ (ফুরক্বান ২৭-২৯)। উম্মতের এই দুর্দশা দেখে আমাদের প্রাণপ্রিয় রাসূল আল্লাহর নিকট তখন কৈফিয়ত স্বরূপ বলবেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! নিশ্চয়ই আমার উম্মত এই কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছিল’ (ফুরক্বান ৩০)।
পবিত্র কুরআনের উক্ত বাণীগুলি কারু কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে কি? কারু হৃদয়ে করাঘাত করবে কি? মনে রেখ কুরআন সরাসরি আল্লাহর কালাম। উম্মতে মুহাম্মাদীর সৌভাগ্য যে, আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আগেই আমরা দুনিয়াতে বসে আমাদের সৃষ্টিকর্তার কালাম শুনছি, পড়ছি ও অনুধাবন করছি। যেন কোন মুমিন দুনিয়াতে অসুখী না হয় এবং আখেরাতে জাহান্নামের আগুনে দগ্ধীভূত না হয়। আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে আগেভাগেই আমাদের সাবধান করে শেষ নবীর মাধ্যমে তার কালাম পাঠিয়েছেন। যাতে কোন ত্রুটি নেই, সন্দেহ নেই, মিথ্যা নেই। এই মহাসত্য যাদের ঘরে, তারাই কি সবচেয়ে সৌভাগ্যবান নয়? এমনকি ইমাম তিরমিযী বলেন, যাদের ঘরে হাদীছের কিতাব আছে, স্বয়ং আল্লাহর নবী যেন তার গৃহে কথা বলেন’। পৃথিবীতে বসবাসকারী কোন মানুষের এই সৌভাগ্য নেই কেবল মুসলমানের ব্যতীত। অতএব আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা।
হে ঈমানী সংকটের আবর্তে পথহারা মানুষ! ফিরে এসো আল্লাহর পথে, বেরিয়ে এস শয়তানী প্রতারণা থেকে। দুনিয়াবী মোহের চাকচিক্য ভুলে যাও। তোমার কবরটিকে ঈমানের আলোকে আলোকিত করার জন্য পাথেয় সঞ্চয় কর। বাড়ী-গাড়ী সবই পড়ে থাকবে দুনিয়ায়। যা তোমার জন্য কেবল অস্থায়ী ঠিকানা। তাই চিরস্থায়ী ঠিকানার জন্য দু’হাতে সঞ্চয় কর। যে কোন সময় মৃত্যু এসে গেলে যেন হাসিমুখে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হ’তে পার। শুধুমাত্র শাস্তি দিয়ে যে দুর্নীতি দূর করা সম্ভব নয়, যার নগদ প্রমাণ হ’ল কক্সবাজারে অতিসম্প্রতি ক্রসফায়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া। যেখানে প্রতিমাসে ক্রসফায়ার ঘটছিল। হাযার হাযার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার হচ্ছিল। সেখানে গত ৩১শে জুলাই পুলিশ কর্তৃক মেজর (অবঃ) সিনহা হত্যাকান্ডের পর থেকে গত দেড় মাসাধিক কাল ব্যাপী ক্রসফায়র নেই। ইয়াবা চোরাচালানী নেই। এতে প্রমাণিত হয় যে, এ যাবৎ কেবলি চলছিল পুলিশী তান্ডব। যারা রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় ছিল। স্বয়ং পুলিশ প্রধান ও সেনাপ্রধান ঘটনাস্থলে হাযির হয়ে কঠোর বার্তা দিলে সব ঠান্ডা হয়ে গেছে। অতএব সর্বত্র চাই কড়া নৈতিক অনুশাসন ও দ্রুত ন্যায়বিচার।
সরকার তার কর্মচারীদের কাছ থেকে আনুগত্য ও শৃংখলার শপথ নিয়ে থাকেন। সরকারের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলরাও এ শপথ নিয়ে থাকেন। কিন্তু সে শপথ আল্লাহর নামে নেওয়া হয়না। অথচ আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে শপথ করা শিরক বা কুফরী’।[7] ফলে ঐসব শপথকারীগণ স্রেফ বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। যা লংঘন করলে কারু কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই। এর বিপরীতে ইসলামে রয়েছে বায়‘আতের ব্যবস্থা। যেখানে আল্লাহর নামে আমীরের নিকট বায়‘আত নিতে হয়। যার তীব্র দায়িত্বানুভূতি বান্দার মধ্যে সর্বদা জাগরুক থাকে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা তোমার নিকটে আনুগত্যের বায়‘আত করে, তারা আল্লাহর নিকটেই বায়‘আত করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর থাকে। অতঃপর যে ব্যক্তি বায়‘আত ভঙ্গ করে, সে তার নিজের ক্ষতির জন্যই সেটা করে। কিন্তু যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে। সত্বর আল্লাহ তাকে মহা পুরস্কারে ভূষিত করবেন’ (ফাৎহ ১০)। পাশ্চাত্য রীতির চাপে ইসলামী সংগঠনগুলির অধিকাংশ এই পবিত্র রীতি পরিত্যাগ করেছে। এখানেও অলসতা, কপটতা, দলত্যাগ সবই থাকবে। যেমনটি রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনে ঘটেছে। কিন্তু ঐ ব্যক্তিরা আল্লাহর নিকট কৈফিয়ত দানে বাধ্য থাকবে। আল্লাহর নামে কৃত অঙ্গীকারের অনুভূতি তাকে তার জীবদ্দশায় সর্বদা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের দিকে পথ প্রদর্শন করবে। ঔদ্ধত্য ও অবাধ্যতা থেকে ফিরিয়ে রাখবে। সমাজে অশান্তি কম হবে। অতএব সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীলগণের প্রতি আমাদের আহবান থাকবে, ফিরে আসুন আল্লাহর পথে। আনুগত্য ও দায়িত্ব পালন সবই করুন স্রেফ আল্লাহর জন্য। আল্লাহকে লুকিয়ে কোন কিছুই করা সম্ভব নয়। আল্লাহর দন্ডবিধি সমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করুন। সমাজে শান্তি নেমে আসবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, আল্লাহর একটি দন্ডবিধি বাস্তবায়ন করা জনপদে চল্লিশ দিন বৃষ্টিপাতের চাইতে উত্তম’।[8] আসুন আমরা ঈমানী সংকট কাটিয়ে উঠি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!
[1]. হাকেম ২/৬৭৫ পৃ., হা/৪২৩৫।
[2]. বুখারী হা/৫৯; মিশকাত হা/৫৪৩৯।
[3]. মুসলিম হা/১৫৭; মিশকাত হা/৫৪৪০।
[4]. আবুদাঊদ হা/২৫৯৪; মিশকাত হা/৫২৪৬।
[5]. তিরমিযী হা/২৩৫৪; মিশকাত হা/৫২৪৩।
[6]. মুসলিম হা/১৫৯৮; মিশকাত হা/২৮০৭।
[7]. তিরমিযী হা/১৫৩৫।
[8]. ইবনু মাজাহ হা/২৫৩৭।