কুরআন অনুধাবনের শর্তাবলী :

(১) আরবী ভাষা জ্ঞানে পরিপক্কতা অর্জন করা।

ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, যতক্ষণ না কারু মধ্যে কোন আরবী বাক্যকে আরবী ভাষারই দৃষ্টিভঙ্গিতে অনুধাবনের যোগ্যতা সৃষ্টি হয়, ততক্ষণ সে কুরআনের উচ্চাঙ্গের বর্ণনা ভঙ্গি ও তার বিশেষ ব্যাখ্যা পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হ’তে পারবে না। আর যদি তা না হয় তবে কুরআনের ভাব ও অর্থের এমন অনেক দিক দেখা দিবে, যা তার জ্ঞান ও অনুভূতিতে ধরা পড়বে না’। অর্থাৎ কুরআন অনুধাবনের জন্য কেবল আরবী ভাষা জ্ঞান যথেষ্ট নয়, বরং আরবী ভাষার যথার্থ অনুভূতি আবশ্যক। এর জন্য দীর্ঘ সাধনার প্রয়োজন হয়। এজন্য তাকে আরবীর সকল পরিভাষা ও ব্যবহার ক্ষেত্র সমূহ সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত হ’তে হবে। যাতে একই বিষয় বিভিন্ন বর্ণনা ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা যায়। আর এইসব বর্ণনা ভঙ্গির সূক্ষ্ম পার্থক্য সমূহ সে পুরা মাত্রায় অনুধাবন করবে।

উদাহরণ : কোন রোগীকে কুশল জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘ভাল আছি’। কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তি বুঝতে পারেন যে, এই বাক্যের দু’টি পরস্পর বিরোধী অর্থ হ’তে পারে। যেখানে পার্থক্য থাকে কেবল বর্ণনা ভঙ্গির। যদি রোগী নৈরাশ্যের অনুশোচনায় ‘ভাল আছি’ বলে থাকেন, তবে বুঝতে হবে তিনি ‘ভাল নেই’। আর যদি প্রশান্ত মনে বলে থাকেন, তবে বুঝতে হবে যে, প্রকৃত অর্থেই তিনি সুস্থ। এ কারণেই অলংকার শাস্ত্রবিদগণের মতে শব্দসমূহের কোন প্রতিশব্দই নেই এবং একটির অর্থ কেবল একটিই হ’তে পারে’। কেবল ভাষাবিদ নয় এমন ব্যক্তিই নানারূপ অর্থ ও তথ্যের বর্ণনা দিয়ে থাকেন। কিন্তু ভাষাবিদ শ্রোতা বাক্য শ্রবণ মাত্রই তার একটি অর্থই নির্দিষ্ট করে ফেলেন। তিনি নানা প্রকার ব্যাখ্যার বিভ্রান্তিতে জড়িয়ে পড়েন না। তিনি বুঝতে পারেন, এখানে বর্ণনাকারীর মূল উদ্দেশ্য কি?

অলংকার শাস্ত্রের বিভিন্ন শ্রেণী ও স্তর :

কোন বাক্য সম্পর্কে এ দাবী করা যায় না যে, এর উপরেই বালাগাতের সমাপ্তি ঘটেছে। কেননা অলংকার শাস্ত্র হচ্ছে, পরিস্থিতি অনুযায়ী বাক্যালাপ করণ। যাতে সামান্য পার্থক্যের কারণে অবস্থার চাহিদানুযায়ী নানারূপ অর্থ হ’তে পারে। একটি বাক্য যতই অলংকারপূর্ণ হৌক না কেন, তা অন্য বাক্যের তুলনায় নিম্নমানের হ’তে পারে। আর কুরআন হ’ল অলংকার শাস্ত্রের সেই চূড়ান্ত রূপ, যার কোন তুলনা নেই।

অতএব কুরআন অনুধাবনের অর্থ হ’ল, এমন এক পরিপক্ক অনুভূতির সৃষ্টি হওয়া যা আরবী ভাষার অর্থ ও উদ্দেশ্য পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম হয়। তার ইশারা ও ইঙ্গিত সম্পর্কে অবহিত হ’তে পারে ও শব্দ সমূহের সঠিক অর্থ নিরুপন করতে পারে। আর যেহেতু কুরআন মজীদ বালাগাতের শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত, তাই ঐ সকল মনীষীবৃন্দ ব্যতিরেকে যাদেরকে স্বয়ং নবী করীম (ছাঃ) নবুঅতের আলোকে আলোকিত করেছেন, অন্য কোন ব্যক্তি দাবি সহকারে বলতে পারেন না যে, অত্র আয়াতের সঠিক অর্থ তাই-ই, যা তিনি বুঝেছেন। কুরআন নিঃসন্দেহে সহজ ও সরল। কিন্তু কোন জিনিসের সহজ-সরল হওয়ার অর্থ এটা নয় যে, তা অনুধাবনের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় মৌলিক বিষয়াবলীর জ্ঞান অর্জন করতে হবে না। বর্তমানে যারা কুরআনের সঠিক অনুধাবনের দাবীদার, তাদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে, তারা কতদূর এই দাবীর যোগ্য।

উদাহরণ স্বরূপ : সূরা বাক্বারাহ ১৯ আয়াতে أَوْ كَصَيِّبٍ مِنَ   السَّمَاءِ  অর্থ করা হয়ে থাকে ‘আকাশ হ’তে পানি বর্ষণের ন্যায়’ (ড. মুজীবুর রহমান)। ‘দুর্যোগ পূর্ণ ঝড়ো রাতে’ (মুহিউদ্দীন খান)। ‘আকাশের বর্ষণ মুখর ’ (ইফাবা)। অথচ সঠিক অনুবাদ হওয়া উচিত, ‘আকাশ জুড়ে মুষল ধারে বৃষ্টির ন্যায়’। কেননা صَيِّبٌ এখানে مبالغة বা আধিক্য অর্থে এবং السَّمَاءُ-এর আলিফ লাম إستغراق বা ব্যাপকতা বুঝানোর জন্য এসেছে। যার বাস্তবতা বুঝানো হয়েছে পরের শব্দগুলিতে فِيهِ ظُلُمَاتٌ وَرَعْدٌ وَبَرْقٌ ‘যাতে রয়েছে ঘনান্ধকার, বজ্র ও বিদ্যুতের চমক’।

একইভাবে সূরা তওবা ৭২ আয়াতে وَرِضْوَانٌ مِنَ اللهِ أَكْبَرُ অর্থ করা হয়ে থাকে ‘আর আল্লাহর সন্তুষ্টি হচ্ছে সবচেয়ে বড় (নিয়ামত)’ - ড. মুজীবুর রহমান। ‘বস্ত্ততঃ এ সমুদয়ের মাঝে সবচেয়ে বড় হ’ল আল্লাহর সন্তুষ্টি’ (মুহিউদ্দীন খান)। ‘আল্লাহর সন্তুষ্টিই সর্বশ্রেষ্ঠ’ (ইফাবা)। অথচ এখানে সঠিক অনুবাদ হওয়া উচিৎ ‘আল্লাহর পক্ষ হ’তে সামান্য সন্তুষ্টিই সবচেয়ে বড়’। কেননা رِضْوَانٌ শব্দটিতে تنوين (তানভীন) এসেছে تقليل বা স্বল্পতা বুঝানোর জন্য।

তাফসীরের সংজ্ঞা :

আবু হাইয়ান আন্দালুসী বলেন, 

هُوَ عِلْمٌ يُبْحَثُ فِيهِ عَنْ كَيْفِيَّةِ النُّطْقِ بِأَلْفَاظِ الْقُرْآنِ، وَمَدْلُولاَتِهَا، وَأَحْكَامِهَا الْإِفْرَادِيَّةِ وَالتَّرْكِيبِيَّةِ، وَمَعَانِيهَا الَّتِي تُحْمَلُ عَلَيْهَا حَالَةُ التَّرْكِيبِ، وَتَتِمَّاتٍ لِذَلِكَ-

‘এটি এমন এক ইলম, যাতে কুরআনের শব্দমালার বাচনভঙ্গী, অর্থ ও উদ্দেশ্য, তার ব্যষ্টি ও সমষ্টিগত আহকাম এবং বাক্যের সংযোজন হেতু গৃহীত অর্থাবলী ছাড়াও এর পরিশিষ্ট সম্পর্কে আলোচনা করা হয়’। এর মাধ্যমে তিনি ইলমে ছরফ, নাহু, বালাগাত, হাকীকাত-মাজায ছাড়াও تتمات ‘পরিশিষ্ট’ অর্থাৎ নাসখ ও শানে নুযূল-এর জ্ঞান বুঝিয়েছেন, যাতে তিনি অস্পষ্ট বিষয় সমূহ উদ্ধার করতে সক্ষম হন’। উল্লেখ্য যে, যতদিন ইসলাম আরব ভূখন্ডে সীমাবদ্ধ ছিল, ততদিন আরবী ভাষা ও সাহিত্যে কোন ব্যাকরণ রচিত হয়নি এবং প্রয়োজনও ছিল না। ব্যাকরণ ভাষা হ’তে সৃষ্টি হয়, ভাষার উৎপত্তি ব্যাকরণ হ’তে নয়। এ কারণেই ছাহাবায়ে কেরামের যুগে কুরআন মাজীদের তাফসীর সংক্রান্ত মতানৈক্য কদাচিৎ দেখা যায়। কিন্তু যখন অনারব দেশ সমূহে কুরআনের বিস্তৃতি ঘটে, তখন ব্যাকরণ রচিত হয়।

অতএব যতক্ষণ না কোন ব্যক্তি আরবী ভাষা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ের জ্ঞান, যার সংখ্যা আলেমগণ ১৪টি বর্ণনা করেছেন, পূর্ণভাবে আয়ত্ত করবে, ততক্ষণ কোন আয়াত সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত মত পোষণ করার অধিকার নেই।

তাফসীর ও তাবীল :

তাফসীরের জন্য কুরআন বর্ণিত একক শব্দমালার রহস্য সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান থাকা আবশ্যক। উদাহরণ স্বরূপ তাবীল (تاويل) শব্দটি কুরআন নাযিলের যুগে ‘পরিণাম’ অর্থে ব্যবহৃত হ’ত। যেমন আল্লাহ বলেন,هَلْ يَنْظُرُونَ إِلاَّ تَأْوِيلَهُ يَوْمَ يَأْتِي تَأْوِيلُهُ يَقُولُ الَّذِينَ نَسُوهُ مِنْ قَبْلُ قَدْ جَاءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِالْحَقِّ ‘তারা কি তবে তার পরিণতির (ক্বিয়ামতের) অপেক্ষা করছে? যেদিন সেই পরিণতি এসে যাবে, সেদিন যারা এই পরিণতির কথা ইতিপূর্বে ভুলে গিয়েছিল (অর্থাৎ অবিশ্বাসীরা) বলবে, বাস্তবিকই আমাদের প্রতিপালকের রাসূলগণ সত্যসহ আগমন করেছিলেন’ (আ‘রাফ ৭/৫৩)। অতঃপর দীর্ঘদিন পরে তাবীল শব্দটি ‘তাফসীর’ অর্থে ব্যবহৃত হ’তে থাকে। যদিও দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এরূপ অনেক শব্দ আছে যার অর্থ কুরআন নাযিলের যুগে একরূপ ছিল এবং দু’এক শতাব্দী পরে তা অন্য অর্থে ব্যবহৃত হ’তে থাকে। অতএব কুরআন অনুধাবনকারীকে সেই অর্থই গ্রহণ করতে হবে, যা কুরআন নাযিলের যুগে গ্রহণ করা হ’ত।

আরবদের উচ্চারণ পদ্ধতির জ্ঞান :

যেমন সূরা নমলে হযরত সুলায়মান (আঃ) হুদহুদ পাখি সম্পর্কে বলছেন,لَأُعَذِّبَنَّهُ عَذَابًا شَدِيدًا أَوْ لَأَاذْبَحَنَّهُ أَوْ لَيَأْتِيَنِّي بِسُلْطَانٍ مُبِينٍ- ‘আমি তাকে অবশ্যই কঠিন শাস্তি দেব অথবা যবহ করব। অথবা সে উপযুক্ত কারণসহ আমার কাছে হাযির হবে’ (নমল ২৭/২১)। এখানে ذ-এর পূর্বে একটি ا রয়েছে, যা অপ্রয়োজনীয়। অথচ এটাই রীতি হয়ে আছে। এক্ষণে যে ব্যক্তি আরবের ক্বিরাআত সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, তিনি ভুল অর্থ বুঝবেন এবং লিখবেন, ‘আমি তাকে যবহ করব না’- যা হবে একেবারেই উল্টা অর্থ।

অনুরূপভাবে একদা রাসূল (ছাঃ) يَايَحْيَى দীর্ঘ করে পড়েন। তখন ছাফওয়ান বিন আসসাল বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটি তো কুরায়শী পদ্ধতি নয়’। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, এটি তাদের মাতৃকুল বনু সা‘দ-এর পদ্ধতি’।

(২) কুরআন অনুধাবনের দ্বিতীয় শর্ত হ’ল কুরআনের সঠিক অনুভূতি। যেমন কোন ব্যক্তি কাব্য ও সাহিত্যের স্বভাবজাত প্রেরণা ও অনুভূতি ব্যতিরেকে কবি ও সাহিত্যিক হ’তে পারে না। ঠিক তেমনি কারু পক্ষে কুরআন অনুধাবনের স্বাভাবিক প্রেরণা ছাড়া কুরআনের মর্ম উদ্ধার করা সম্ভব নয়। সৈয়দ রশীদ রেযা বলেন, এটি দু’পদ্ধতিতে হ’তে পারে- كَسْبِي ও وهبى কসবী জ্ঞান সমূহ দ্বারা হাদীছ শাস্ত্রের জ্ঞান, ছাহাবা ও তাবেঈদের বর্ণনা সমূহ ও কার্যাবলী, প্রথম যুগের প্রসিদ্ধ বিদ্বানগণের বর্ণনা সমূহ প্রভূতি। এতদ্ব্যতীত প্রাকৃতিক জ্ঞান, বিশ্ব ইতিহাস ও আত্মিক জ্ঞান ইত্যাদি, যা কুরআন অনুধাবনে সাহায্য করে। এগুলি হ’ল অর্জিত জ্ঞান, যা চেষ্টা ও সাধনার মাধ্যমে লাভ করা যায়। দ্বিতীয় প্রকার হ’ল- অহবী বা আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ জ্ঞান। হযরত আলী (রাঃ) বলেন, কুরআন অনুধাবনের জ্ঞান আল্লাহর এক বিশেষ নে‘মত যা আল্লাহ তাঁর বিশেষ বান্দাদের প্রদান করেন’। তবে কসবী বা অর্জিত জ্ঞানই হ’ল প্রকৃত জ্ঞান যার ফলশ্রুতিতে অহবী জ্ঞানের সৃষ্টি হয়। আর অহবী জ্ঞানের কারণেই কসবী জ্ঞানে পারদর্শী আলেমগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের কমবেশী হয়।

(৩) কুরআন অনুধাবনের তৃতীয় শর্ত- আল্লাহভীতি :

কুরআন পথ প্রদর্শক হ’ল মুত্তাক্বীদের, ফাসেকদের নয় (هُدًى لِلْمُتَّقِينَ) আল্লাহভীতির অর্থ হ’ল : আল্লাহর কালাম শ্রবণ করে আত্মিকভাবে তার প্রভাব গ্রহণে সক্ষম হওয়া’। পাকস্থলী অকেজো হ’লে খাদ্য বা ঔষধ যেমন কোন কাজ করে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে কুফলের আশংকা থাকে, কুরআন অনুধাবনের বিষয়টিও অনুরূপ।

আবু আলী ইবনে সীনা তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘ইশারাত’-এর শেষভাগে স্বীয় শিষ্যকে বলেন, আমার এই গ্রস্থ যেন সবাইকে পড়তে না দেওয়া হয়। বরং কেবল ঐ লোকদের মধ্যেই এটা সীমাবদ্ধ থাকবে যারা কলহপ্রিয় বা পথভ্রষ্ট নয়। যদি এর ব্যতিক্রম করা হয়, তাহ’লে আমি আল্লাহর নিকট তোমার বিরুদ্ধে নালিশ করব’।

কেননা ইল্ম হ’ল এক বিশেষ জ্যোতি, যা আল্লাহ তার মুত্তাকী বান্দার মধ্যে সৃষ্টি করেন এবং যা জ্ঞানের অনুভূতির উৎস রূপ হয়। এক্ষেত্রে ইমাম শাফেঈ-র দু’টি পংক্তি প্রণিধানযোগ্য।-

شَكَوْتُ إلَى وَكِيعٍ سُوءَ حِفْظِي + فَأَوْصَانِى إلَى تَرْكِ الْمَعَاصي

فَإنَّ العِلْمَ نُورٌ مِنْ إِلَهِ + وَنُوْرُ اللهُ  لاَ يُعْطَى لِعَاصِي

ইবনে সীনা নফসকে আয়নার সঙ্গে তুলনা করে বলেন, আয়না যেভাবে নিজ সম্মুখস্থ বস্ত্তর আকৃতি ধারণ করে থাকে। তেমনিভাবে নফস যতবেশী পার্থিব জগতের সাথে নিবিড় হবে, ততবেশী সে আল্লাহর জ্ঞান ভান্ডার থেকে দূরে সরে যাবে এবং অদৃশ্য জগতের রহস্য অনুধাবনে অক্ষম হয়ে পড়বে। পক্ষান্তরে নফস যে পরিমাণ পার্থিব জগত হ’তে দূরে এবং আধ্যাত্মিক জগতের নিকটবর্তী হবে, ঠিক তত পরিমাণ তাতে মহাজ্ঞানী আল্লাহর জ্ঞান ভান্ডারের সান্নিধ্য লাভের দরুন অদৃশ্য জগতের রহস্যাবলী অনুধাবনের যোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। যার মস্তিষ্কে ও অন্তরে তার কুকর্ম সমূহের আবরণ পড়ে, তার থেকে কুরআন অনুধাবনের আশা করা দুরাশা মাত্র। আল্লাহ বলেন, لَهُمْ قُلُوبٌ لاَ يَفْقَهُونَ بِهَا ‘যাদের হৃদয় আছে কিন্তু বুঝে না’ (আ‘রাফ ৭/১৭৯)

(৪) কুরআন অনুধাবনের ৪র্থ শর্ত :

একটি আয়াতে একটি শব্দ দেখা মাত্র তার তাফসীর ও তাবীলের সাহস না করা। বরং গোটা কুরআন মাজীদ গভীরভাবে অনুধাবন করার পর তার ভাষা, বাচনভঙ্গী এবং বর্ণনা পদ্ধতির সাথে এমন সম্পর্ক স্থাপন করা প্রয়োজন, যেন সঠিক অর্থ নির্ধারণে কোনরূপ জটিলতা দেখা না দেয়। উপরন্তু এক স্থানে যে শব্দের কোন অর্থ গ্রহণ করা হয়, তা যেন অন্য স্থানে ব্যবহৃত অর্থের পরিপন্থী না হয়। কেননা প্রত্যেক বর্ণনাকারীর একটি বিশেষ বর্ণনা পদ্ধতি রয়েছে। কোন ব্যক্তি যে পর্যন্ত বর্ণনাকারীর উক্ত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত না হবে, সে পর্যন্ত তার বর্ণনার মর্ম সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারবে না। উদাহরণ স্বরূপ-

(ক) কুরআনে পবিত্রতা সম্পর্কে বলা হয়েছে,وَإِنْ كُنْتُمْ مَرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ ‘আর যদি তোমরা পীড়িত হও অথবা সফরে থাক, অথবা পায়খানা থেকে আস অথবা স্ত্রীগমন করে থাক, আর যদি পানি না পাও, তাহ’লে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর। এমতাবস্থায় মুখমন্ডল ও হাত মাটিতে মাসাহ করে নাও’ (নিসা ৪/৪৩)

এখানে لمس-এর অর্থ নিয়ে মুফাসসিরগণ মতভেদ করেছেন। কেউ বলেছেন, স্রেফ স্পর্শ করা, কেউ বলেছেন, স্ত্রী মিলন করা। অথচ এর সমাধান কুরআনের অন্য আয়াতেই পাওয়া যায়। যেমন তালাকের ক্ষেত্রে আল্লাহ বলেছেন,لاَ جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِنْ طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ مَا لَمْ تَمَسُّوهُنَّ ‘যদি তোমরা স্ত্রীদের স্পর্শ করার আগেই অথবা তাদের জন্য মোহর নির্ধারণ না করেই তালাক প্রদান কর, তবে তাতে তোমাদের কোন দোষ নেই’ (বাক্বারাহ ২/২৩৬)। এখানে لمس-এর অর্থ স্ত্রী মিলন (বাক্বারাহ ২/২৩৭)। ইদ্দত-এর বর্ণনায় বলা হয়েছে,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نَكَحْتُمُ الْمُؤْمِنَاتِ ثُمَّ طَلَّقْتُمُوهُنَّ مِنْ قَبْلِ أَنْ تَمَسُّوهُنَّ... ‘হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা মুমিন নারীদের বিবাহ করবে; অতঃপর তাকে স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিবে...’ (আহযাব ৩৩/৪৯)। مس অর্থ স্পর্শ করা এবং لمس অর্থ অনুসন্ধানের দৃষ্টিতে স্পর্শ করা। অর্থাৎ مس-এর তুলনায় لمس-এর অর্থে মিলন ও সান্নিধ্যের আধিক্য পাওয়া যায়। অতএব مس দ্বারা যখন স্ত্রীমিলন বুঝায়, তখন لمس দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে স্ত্রীমিলনই বুঝাবে।

এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, নারী জাতি সম্পর্কে বর্ণনার সময় কুরআনের এক বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। তা হ’ল প্রকাশ্যে বর্ণনার পরিবর্তে ইঙ্গিতে বর্ণনা করা। যেমন ঋতুকালীন সময়ে স্ত্রীমিলন নিষেধ করে বলা হয়েছে,فَاعْتَزِلُوا النِّسَاءَ فِي الْمَحِيضِ ‘অতএব ঋতুকালে স্ত্রীসঙ্গ হ’তে বিরত থাক’ (বাক্বারাহ ২/২২২)। অন্যস্থানে স্ত্রীমিলন বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে এভাবে, وَقَدْ أَفْضَى بَعْضُكُمْ إِلَى بَعْضٍ ‘অথচ তোমরা একে অপরের প্রতি উপগত হয়েছ’ (নিসা ৪/২১)

অতএব কুরআনের কোন শব্দের অর্থ নির্দিষ্ট করণের জন্য যদি স্বয়ং কুরআন থেকে সাহায্য নেয়া হয়, তবে সম্ভবতঃ কোন মতবিরোধ ও মতপার্থক্য দেখা দিবে না, যা সাধারণতঃ তাফসীর সমূহে পরিদৃষ্ট হয়ে থাকে। সম্ভবতঃ এরই ভিত্তিতে বলা হয়েছে, الْقُرْآنُ يُفَسِّرُ بَعْضُهَا بَعْضًا ‘কুরআনের একাংশ অন্য অংশের ব্যাখ্যা করে’।

(খ) উদাহরণ : যিকর-এর অর্থ আল্লাহ বলেন,وَاذْكُرُوا اللهَ فِي أَيَّامٍ مَعْدُودَاتٍ فَمَنْ تَعَجَّلَ فِي يَوْمَيْنِ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ وَمَنْ تَأَخَّرَ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ ‘আর তোমরা (মিনায়) গণিত দিনগুলিতে আল্লাহকে স্মরণ কর। অতঃপর যে ব্যক্তি ব্যস্ততা বশে দু’দিনেই (মক্কায়) ফিরে আসে, তার জন্য কোন গোনাহ নেই। আর যে ব্যক্তি দেরী করে, তারও কোন গোনাহ নেই...’ (বাক্বারাহ ২/২০৩)। অত্র আয়াতে ‘যিকর’ শব্দটির অর্থ ‘মিনায় কংকর নিক্ষেপ করা’ এবং নির্দিষ্ট দিনগুলি’ অর্থ আইয়ামে তাশরীকের ১১, ১২ ও ১৩ই যিলহাজ্জ তিনদিন। এক্ষণে যদি কোন ভ্রান্ত বিতর্ককারী বলতে চায় যে, ‘যিকর’ অর্থ ‘স্মরণ করা’ এবং أَيَّامٍ مَعْدُودَاتٍ অর্থ جمع قلت অনুযায়ী ৩ থেকে ৯ দিন বুঝতে হবে। কেননা أَيَّامٍ ও مَعْدُودَاتٍ দু’টি শব্দই نكرة বা অনির্দিষ্ট বাচক; অতএব যদি কেউ বছরের অনির্দিষ্ট কয়েকদিনে কোন উপায়ে আল্লাহকে স্মরণ করে, তাহ’লে সে ব্যক্তি উক্ত আয়াতের হুকুম যথার্থভাবে পালন করল।

এর জবাব এই যে, প্রকৃত অর্থে ‘আল্লাহর স্মরণ’ হ’ল তাই, যা তিনি স্বীয় নবীর মাধ্যমে বান্দাকে জানিয়ে দিয়েছেন। আর সেটাই হ’ল আইয়ামে তাশরীকের তিনদিন কংকর নিক্ষেপ করা। দ্বিতীয় জবাব এই যে, কুরআন মাজীদের বিশেষ বর্ণনাভঙ্গি এই যে, কুরআন ইবাদত সমূহের নাম উল্লেখ করে না। বরং তার মূল উদ্দেশ্য বর্ণনা করে। এখানে কংকর মারার কথা উল্লেখ না করে তার মূল উদ্দেশ্য আল্লাহকে স্মরণ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন আরাফাত থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মুযদালিফাতে অবস্থান করার কথা স্পষ্ট ভাষায় না বলে তার উদ্দেশ্যটুকু বর্ণনা করে বলা হয়েছে, فَإِذَا أَفَضْتُمْ مِنْ عَرَفَاتٍ فَاذْكُرُوا اللهَ عِنْدَ الْمَشْعَرِ الْحَرَامِ وَاذْكُرُوهُ كَمَا هَدَاكُمْ... ‘আর যখন তোমরা আরাফাত থেকে (মিনায়) ফিরবে, তখন (মুযদালিফায়) মাশ‘আরুল হারামে পৌঁছে আল্লাহকে স্মরণ কর। আর তোমরা তাঁকে স্মরণ কর যেভাবে তিনি তোমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন...’ (বাক্বারাহ ২/১৯৮)। সেই পথপ্রদর্শন এসেছে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের মাধ্যমে। ফলে এখানে নিজ ইচ্ছামত ব্যাখ্যা করার কোন সুযাগ নেই।

অতএব কুরআন মজীদে যেখানে ‘যিকর’ শব্দটি কোন বিশেষ কাল বা স্থানের বন্ধনসহ উল্লেখ হয়েছে, সেখানে তা দ্বারা বিশেষ ইবাদত পদ্ধতি বুঝানো হয়েছে। সাধারণভাবে ‘স্মরণ করা’ নয়। অতএব হাদীছকে অগ্রাহ্য করে কুরআন অনুধাবনের দাবী হাস্যকর মাত্র।

(৫) পঞ্চম শর্ত :

কুরআনের আহকাম নির্দিষ্ট করণে দূরদৃষ্টতা। কুরআন মাজীদের প্রত্যেক শব্দের অর্থ নির্দিষ্ট করণে যেমনিভাবে উক্ত শব্দাবলী কুরআনের যে সকল স্থানে এসেছে, সে সকল স্থানের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা অপরিহার্য। তেমনিভাবে কোন আয়াত থেকে কোন হুকুম বের করার ক্ষেত্রে কুরআনের যে সকল স্থানে সেটি বর্ণিত হয়েছে, সে সকল স্থানের প্রতিও দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন এবং প্রত্যেক স্থানের পূর্বাপর প্রয়োগ পদ্ধতির উপর দূরদৃষ্টতা সহকারে উক্ত হুকুমের মূল লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করা আবশ্যক। যেমন  আল্লাহ বলেন,  فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ‘অতএব তোমার পালনকর্তার শপথ! তারা কখনো (পূর্ণ) মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়ে তোমাকে ফায়ছালা দানকারী হিসাবে মেনে নিবে’ (নিসা ৪/৬৫)

খারেজী আক্বীদার মুফাসসিরগণ অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন ‘তাগূতের অনুসারী ঐসব লোকেরা ‘ঈমানের গন্ডী থেকে বেরিয়ে যাবে। মুখে তারা যত দাবীই করুক না কেন’।[1] অথচ এখানে لاَ يُؤْمِنُونَ ‘তারা মুমিন হ’তে পারবে না’-এর প্রকৃত অর্থ হ’ল, لاَ يَسْتَكْمِلُوْنَ الْإِيْمَانَ ‘তারা পূর্ণ মুমিন হ’তে পারবে না’ (ফাৎহুল বারী হা/২৩৫৯-এর ব্যাখ্যা)। কারণ উক্ত আয়াত নাযিল হয়েছিল দু’জন ছাহাবীর পরস্পরের জমিতে পানি সেচ নিয়ে ঝগড়া মিটানোর উদ্দেশ্যে।[2] দু’জনেই ছিলেন বদরী ছাহাবী এবং দু’জনেই ছিলেন স্ব স্ব জীবদ্দশায় ক্ষমাপ্রাপ্ত ও জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত। অতএব তাদের কাউকে মুনাফিক বা কাফির বলার উপায় নেই। কিন্তু খারেজী ও শী‘আপন্থী মুফাসসিরগণ তাদের ‘কাফের’ বলায় প্রশান্তি বোধ করে থাকেন। তারা এরদ্বারা সকল কবীরা গোনাহগার মুসলমানকে ‘কাফের’ সাব্যস্ত করেছেন। ফলে তাদের ধারণায় কোন মুসলিম সরকার ‘মুরতাদ’ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার রাষ্ট্রে কিছু কুফরী কাজের প্রকাশ ঘটালো’।

অথচ তারা আরবীয় বাকরীতি এবং হাদীছের প্রতি লক্ষ্য করেননি। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ، وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ، وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ. قِيلَ وَمَنْ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ : الَّذِى لاَ يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَايِقَهُ- ‘আল্লাহর কসম! ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় (৩ বার), যার প্রতিবেশী তার অনিষ্টকারিতা হ’তে নিরাপদ নয়’।[3] এখানে ‘মুমিন নয়’ অর্থ পূর্ণ মুমিন নয়। অন্য হাদীছে এসেছে, سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ، وَقِتَالُهُ كُفْرٌ ‘মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসেকী এবং পরস্পরে যুদ্ধ করা কুফরী’।[4] এর অর্থ সে প্রকৃত কাফের নয়, বরং মহাপাপী। যদি এর অর্থ প্রকৃত কাফের বলতে হয়, তাহ’লে উটের যুদ্ধে ও ছিফফীন যুদ্ধে উভয় পক্ষের সকল ছাহাবীকে কাফের বলতে হবে। কোন বিদ্বান যা বলেননি।

(৬) ৬ষ্ঠ শর্ত : নাসেখ-মানসূখের জ্ঞান অর্জন :

আহকামের বাহ্যিক দ্বন্দ্বের ফলে অনেক তাফসীরবিদ কুরআনের আয়াত সমূহে নাসেখ-মানসূখের মত পোষণ করে থাকেন এবং একে এতই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে, এ বিষয়ে অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে। আমাদের মতে এর দ্বারা নাস্খ-এর পরিভাষাগত অর্থ (রহিত করা) নয়, বরং আহকামের প্রয়োগ বিধি বুঝানো হয়েছে। কেননা প্রকৃত প্রস্তাবে কোন আয়াত মানসূখ (রহিত) নয়। বরং এক হুকুমকে অন্য হুকুমের তুলনায় সাময়িকভাবে মানসূখ বলা যেতে পারে।

উদাহরণ স্বরূপ : (১) কুরআনের এক স্থানে কাফিরদের উৎপীড়নে ধৈর্যধারণের কথা বলা হয়েছে (মুযযাম্মিল ৭৩/১০; মুদ্দাছছির ৭৪/৭; আহক্বাফ ৪৬/৩৫)। কিন্তু অন্যত্র জোরালো ভাষায় জিহাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, يَاأَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِينَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ- ‘হে নবী! কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর ও তাদের প্রতি কঠোর হও। তাদের ঠিকানা হল জাহান্নাম। আর ওটা হল নিকৃষ্ট ঠিকানা’ (তওবাহ ৯/৭৩)। এখানে একটি অপরটির নাসিখ নয়। বরং ধৈর্য ধারণের নির্দেশ সেই যুগে ছিল, যখন মুসলমানগণ দুর্বল ছিল। আর জিহাদের নির্দেশ সেই সময়ের জন্য যখন মুসলমানেরা শক্তিশালী হয়েছিল। এই নিয়ম সকল যুগেই প্রযোজ্য।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ হবে অস্ত্রের দ্বারা এবং মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ হবে যবান দ্বারা এবং অন্যান্য পন্থায় কঠোরতা অবলম্বনের দ্বারা’। মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে সকল নষ্টের মূল জেনেও রাসূল (ছাঃ) তাকে হত্যার নির্দেশ দেননি তার বাহ্যিক ইসলামের কারণে। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর হাত দ্বারা, না পারলে যবান দ্বারা, না পারলে ওদেরকে এড়িয়ে চল’। ইবনুল ‘আরাবী বলেন, যবান দ্বারা দলীল কায়েম করার বিষয়টি হ’ল স্থায়ী জিহাদ’।[5]

এমনিভাবে যে সকল আয়াত সম্পর্কে নাস্খ-এর দাবী করা হয়েছে, সেগুলি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, কুরআনের কোন আয়াতই অন্য কোন আয়াত দ্বারা মানসূখ নয়।

উদাহরণ (২) : সূরা নিসাতে বলা হয়েছে,فَمَا اسْتَمْتَعْتُمْ بِهِ مِنْهُنَّ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً ‘অতঃপর তাদের মধ্যে যাকে তোমরা ভোগ করবে, তাকে তার ফরয মোহরানা প্রদান কর’ (নিসা ৪/২৪)। অত্র আয়াতে اسْتَمْتَعْتُمْ শব্দ দ্বারা অনেকে মুৎ‘আ বিবাহ অর্থ নিয়েছেন। যার হুকুম রহিত হয়েছে। অতএব তারা অত্র আয়াতকে হুকুমের দিক থেকে মানসূখ বলেছেন। অথচ মুৎ‘আর সাথে এ আয়াতের কোন সম্পর্কই নেই। 

উদাহরণ (৩) : এমন হয় যে, কোন আয়াতে একটি হুকুম সাধারণভাবে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু অন্য আয়াতে হুকুমটি বিশেষ প্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। অনেকে এই নির্দিষ্ট করণকেই নাস্খ ধরে নিয়েছেন। যেমন ইদ্দত সম্পর্কিত আয়াতে বলা হয়েছে, وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنْكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا وَصِيَّةً لِأَزْوَاجِهِمْ مَتَاعًا إِلَى الْحَوْلِ غَيْرَ إِخْرَاجٍ ‘আর তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করে ও স্ত্রীদের ছেড়ে যায়, তারা যেন স্বীয় স্ত্রীগণকে বের করে না দিয়ে এক বছরের জন্য ভরণ-পোষণের অছিয়ত করে যায়’ (বাক্বারাহ ২/২৪০)। অত্র আয়াত দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, মৃত্যুর ইদ্দত এক বছর। কিন্তু অন্য আয়াত বর্ণিত হয়েছে,وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنْكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا فَإِذَا بَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا فَعَلْنَ فِي أَنْفُسِهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ ‘আর তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে ও বিধবা স্ত্রীদের ছেড়ে যাবে, ঐ স্ত্রীগণ চার মাস দশদিন অপেক্ষা করবে (অর্থাৎ ইদ্দত পালন করবে)। অতঃপর যখন তারা মেয়াদ পূর্ণ করবে, তখন তারা নিজেদের বিষয়ে ন্যায়ানুগভাবে যা করবে, তাতে তোমাদের উপর কোন দোষ নেই’ (বাক্বারাহ ২/২৩৪)। অত্র আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ওফাতের ইদ্দত এক বছর নয় বরং চার মাস দশ দিন।

আয়াত দু’টির মধ্যে বাহ্যতঃ বিরোধ দৃষ্ট হওয়ায় তাফসীরবিদগণ নাস্খ-এর মত পোষণ করে থাকেন। অথচ গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, এখানে নাস্খ নেই। শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী বলেন, উক্ত আয়াত দ্বয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের পথ এই যে, মৃত ব্যক্তির স্ত্রীর জন্য এক বছরের থাকা-খাওয়ার অছিয়ত করা মুস্তাহাব। তবে স্ত্রীর ইদ্দতকাল হ’ল চার মাস দশ দিন (যদি সে গর্ভবতী না হয়)। এরপর সে ইচ্ছা করলে অন্যত্র বিবাহ করতে পারে। অবশ্য স্ত্রীর জন্য উক্ত অছিয়ত মোতাবেক এক বছর অবস্থান করা ওয়াজিব নয়।

ইবনুল ক্বাইয়িম, ইবনু হযম, আবুবকর আল-জাছছাছ প্রমুখের বক্তব্য দ্বারা একথা স্পষ্ট হয় যে, কুরআন মজীদের কোন আয়াতের উপরে যখন নাস্খ আরোপ করা হয়, তখন তা দ্বারা রহিত করণ বুঝায় না। বরং একথাই একমাত্র উদ্দেশ্য হয় যে, দু’টি আয়াতের হুকুমের প্রেক্ষিত ও অবস্থা ছিল ভিন্ন। এভাবে আয়াতের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দ্বীনের পূর্ণতারই দলীল।

এ কারণেই যে সকল বিদ্বান নাস্খ স্বীকার করেন, তারা মানসূখ আয়াতের সংখ্যা নির্ধারণে সীমাহীন মত পার্থক্যে পড়ে গেছেন। ফলে মানসূখ আয়াতের সংখ্যা তাদের নিকট ৫০০, ৩০০, ২৫, ২০ ও শেষমেশ ৫টিতে দাঁড়িয়েছে।

উদাহরণ (৪) : ইবনুল ‘আরাবী মানসূখ আয়াতের সংখ্যা ২০টি বলেন। তার মধ্যে একটি হ’ল وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ ‘আর যাদের জন্য এটি খুব কষ্টকর হবে, তারা যেন এর পরিবর্তে একজন করে অভাবীকে খাদ্য দান করে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৪) আয়াতটি পরবর্তী আয়াতفَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ‘অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসের ছিয়াম রাখে’ (বাক্বারাহ ২/১৫৮) দ্বারা মানসূখ হয়েছে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এ আয়াত মানসূখ হয়নি। বরং এটি অতিবৃদ্ধ ও বৃদ্ধা, যারা ছিয়ামে অধিক কষ্টবোধ করেন, তাদের জন্য। তিনি গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিণী মায়েদের জন্যও এটি প্রযোজ্য বলেন। আনাস (রাঃ) নিজের চরম বার্ধক্যে এক বছর বা দু’বছর এরূপ করেছিলেন এবং একদিনে ত্রিশজন মিসকীনকে গোশত ও রুটিসহ উত্তম খাদ্য খাইয়ে পরিতৃপ্ত করেন (কুরতবী; ইবনু কাছীর)। শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর মতে মানসূখ আয়াতের সংখ্যা ৫টি। তবে মুফতী মুহাম্মাদ আব্দুহু-র মতে কুরআনে একটিও মানসূখ আয়াত নেই।

আমাদের মতে নাস্খ দু’প্রকারের। নাস্খে আয়াত ও নাস্খে আহকাম। আমরা নাস্খে আহকামে বিশ্বাস করি, নাস্খে আয়াতে নয়। অর্থাৎ দু’টি ভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে দু’টি ভিন্ন হুকুম নাযিল হয় এবং উভয় হুকুম স্ব স্ব স্থানে সঠিক ও যথাযথ বলে গণ্য হয়। যেমন মুসলমানগণ যখন দুর্বল ছিল, তখন তাদের ধৈর্য ধারণ করতে বলা হয়। পরে যখন শক্তিশালী হয়, তখন জিহাদের হুকুম নাযিল হয়। এই হুকুম দু’টি অতীতে যে প্রেক্ষাপটে যেভাবে আমলযোগ্য ছিল বর্তমানেও তেমন আছে। কিন্তু কাফেররা এই পরিবর্তনের রহস্য বুঝতে না পেরে রাসূলকে ‘মিথ্যা উদ্ভাবনকারীقَالُوا إِنَّمَا أَنْتَ مُفْتَرٍ ‘তারা বলে, তুমি তো মনগড়া কথা বল’ -(নাহল ১৬/১০১) বলে গালি দিয়েছিল।

অতএব যে ব্যক্তি কুরআন অনুধাবনের সৌভাগ্য লাভ করতে চান, তার জন্য যেমন কুরআনের শব্দসমূহের অর্থ নির্দিষ্টকরণে স্বয়ং কুরআনের দিকে প্রত্যাবর্তন করা প্রয়োজন, তেমনি হুকুম সমূহ বের করার ক্ষেত্রে তার জন্য যরূরী হ’ল কোন্ হুকুম কোন্ যুগের জন্য ছিল তার ক্ষেত্র ও স্থান নির্ণয় করা এবং প্রত্যেকটির উদ্দেশ্য উদঘাটনে গবেষণা করা। এটা না করে নাসিখ-মানসূখ বলে চালিয়ে দিলে তা কুরআনের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী হবে।

তাফসীর ও তাবীল-এর পার্থক্য :

তাফসীরের অর্থ হ’ল শব্দের ব্যাখ্যা করা এবং তাবীলের অর্থ হ’ল মূল উদ্দেশ্য ব্যক্ত করা। যেমন (১) إِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ ‘নিশ্চয় তোমার পালনকর্তা ঘাঁটিতে সদা সতর্ক থাকেন’ (ফজর ৮৯/১৪)। এর তাফসীর হ’ল ‘তোমার প্রভু তোমার কার্যাবলী পর্যবেক্ষণ করছেন’ এবং তার তাবীল হ’ল, আমাদেরকে অন্যায় কাজ সমূহ হ’তে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু এই তাবীলের ক্ষেত্রে মনগড়া ব্যাখ্যা করা যাবে না। বরং ছহীহ হাদীছের আশ্রয় নিতে হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, (২) الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানের সাথে শিরককে মিশ্রিত করেনি, তাদের জন্যই রয়েছে (জাহান্নাম থেকে) নিরাপত্তা এবং তারাই হেদায়াত প্রাপ্ত’ (আন‘আম ৬/৮২)। ‘ঐসকল ব্যক্তি যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে কোনরূপ অন্যায়-অত্যাচারের সাথে সংমিশ্রণ ঘটায়নি, তাদের জন্য রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই সুপথপ্রাপ্ত’। এখানে ظُلْم-এর আভিধানিক অর্থ নিলে ছাগীরা ও কাবীরা সকল গোনাহ বুঝায়। এজন্য ছাহাবায়ে কেরামের একটি দল রাসূল (ছাঃ)-কে বললেন, আমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে স্বীয় নাফ্সের উপরে কখনো যুলুম করেনি? তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, এখানে ظُلْم দ্বারা ‘শিরক’ বুঝানো হয়েছে। এজন্য ইমাম বাগাবী বলেন, তাবীলের অর্থ হ’ল, আয়াত দ্বারা এমন অর্থ গ্রহণ করা যা উক্ত আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্কিত হবে এবং কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী হবে না’।

হাদীছ ব্যতিরেকে সঠিকভাবে কুরআন অনুধাবন করা কি সম্ভব? সম্প্রতি এমন সব পন্ডিতের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যারা কুরআনের সঠিক মর্ম উদ্ধারে হাদীছের জ্ঞানকে শর্ত মনে করেন না। তাদের মতে হাদীছ অনির্ভরশীল ও অগ্রহণযোগ্য। এমনকি একজন হাদীছ অস্বীকারকারী ব্যক্তি হাদীছ গ্রন্থসমূহকে ‘মিথ্যার উত্তাল তরঙ্গ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এতদসত্ত্বেও মানুষ তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। তার প্রবন্ধসমূহ সাময়িকীতে স্থান দেয় এবং তাকে محيى شريعت مجدد ملت (শরী‘আত জীবিতকারী, উম্মতের সংস্কারক) ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করে।

জানা আবশ্যক যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কেবল একজন বার্তাবহক ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন কুরআনের অর্থ ও উদ্দেশ্য বর্ণনাকারী এবং তার ব্যাখ্যা প্রদানকারী। যেমন ইরশাদ হয়েছে,وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ إِلاَّ لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي اخْتَلَفُوا فِيهِ ‘আমরা তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করেছি কেবল এজন্য যে, তুমি তাদেরকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে দিবে যেসব বিষয়ে তারা মতভেদ করে’ (নাহল ১৬/৬৪)। এখানে فِيهِ সর্বনাম দ্বারা ‘কিতাব’ বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ কুরআনের কোন শব্দের অর্থ বা হুকুম সম্পর্কে মতভেদ দেখা দিলে রাসূল (ছাঃ) যখন তার ব্যাখ্যা দিবেন, তখন তাঁর ব্যাখ্যাই হবে চূড়ান্ত। যেমন বলা হয়েছে,وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلاَ مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা দিলে কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর সে বিষয়ে নিজস্ব কোন ফায়ছালা দেওয়ার এখতিয়ার নেই’ (আহযাব ৩৩/৩৬)। এখানে কেবল আল্লাহর নির্দেশ নয় বরং রাসূলের নির্দেশ অমান্য করারও কোন এখতিয়ার মুমিনকে দেওয়া হয়নি এবং তার অবাধ্যতাকে প্রকাশ্য গোমরাহী বলা হয়েছে।

(চলবে)


[1]. সাইয়িদ কুতুব, তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন ২/৮৯৫; জিহাদ ও ক্বিতাল ৬৭ পৃ.।

[2]. বুখারী হা/২৩৫৯; মুসলিম হা/২৩৫৭; মিশকাত হা/২৯৯৩।

[3]. বুখারী হা/৬০১৬; মিশকাত হা/৪৯৬২।

[4]. বুখারী হা/৪৮; মুসলিম হা/৬৪; মিশকাত হা/৪৮১৪।

[5]. কুরতুবী, সূরা তওবা ৭৩ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য; ৮/১৮৭ পৃ.; তাফসীর ইবনু কাছীর ৪/১৯২।





আল্লাহকে উত্তম ঋণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল্লাহ সর্বশক্তিমান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মানব সৃষ্টির ইতিহাস - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল্লাহকে উত্তম ঋণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল্লাহকে দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
অধিক পাওয়ার আকাংখা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
অহংকার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আত্মাকে কলুষমুক্ত করার উপায় সমূহ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সমাজ পরিবর্তনের স্থায়ী কর্মসূচী - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
যাকাত ও ছাদাক্বার কল্যাণকারিতা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মুত্তাক্বীদের পরিচয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মুমিনের গুণাবলী - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.