কালোজিরার বৈজ্ঞানিক নাম nigella sativa। হাদীছে একে ‘হাববাতুস সাওদা’ বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘কালোজিরা সকল রোগের ঔষধ মৃত্যু ব্যতীত’ (বুখারী হা/৫৬৮৭; মুসলিম হা/২২১৫; মিশকাত হা/৪৫২০)। এই কালো বীজের স্বাস্থ্য উপকারিতা অপরিসীম। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নিধন থেকে শুরু করে শরীরের কোষ ও কলার বৃদ্ধিতে সহায়তা করে কালোজিরা। শুধুমাত্র স্বাস্থ্যের জন্যই নয় কালোজিরা চুল ও ত্বকের জন্যও অনেক উপকারী। কালোজিরার উপকারিতা নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-

১. স্মরণ শক্তি বৃদ্ধি : এক চা-চামচ পুদিনাপাতার রস বা কমলার রস অথবা এক কাপ রং চায়ের সাথে এক চা-চামচ কালোজিরার তেল মিশিয়ে দিনে তিনবার করে নিয়মিত সেবন করলে দুশ্চিন্তা দূর হয়। এছাড়া কালোজিরা মেধা বিকাশের জন্য কাজ করে। এটি মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধির মাধ্যমে স্মরণ শক্তি বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে।

২. মাথা ব্যথা নিরাময়ে : ১/২ চা-চামচ কালোজিরার তেল মাথায় ভালোভাবে লাগাতে হবে এবং এক চা চামচ কালোজিরার তেল সমপরিমাণ মধুসহ দিনে তিনবার করে ২/৩ সপ্তাহ সেবন করলে মাথা ব্যথা দূর হবে।

৩. সর্দি সারাতে : এক চা-চামচ কালোজিরার সঙ্গে তিন চা-চামচ মধু ও দুই চা-চামচ তুলসী পাতার রস মিশিয়ে খেলে জ্বর ও সর্দি-কাশি দূর হয়। সর্দি বসে গেলে কালোজিরা বেটে কপালে প্রলেপ দিলে উপকার হয়। একই সঙ্গে পাতলা পরিষ্কার কাপড়ে কালোজিরা বেঁধে শুকতে থাকলে, শ্লেষ্মা তরল হয়ে ঝরে পড়বে। আরো দ্রুত ফল পেতে বুকে ও পিঠে কালোজিরার তেল মালিশ করতে হবে।

৪. বাতের ব্যথা দূরীকরণে : আক্রান্ত স্থান ধুয়ে পরিষ্কার করে তাতে মালিশ করতে হবে। এক চা-চামচ কাঁচা হলুদের রসের সাথে সমপরিমাণ কালোজিরার তেল ও সমপরিমাণ মধু বা এক কাপ রং চায়ের সাথে দৈনিক ৩বার করে ২/৩ সপ্তাহ সেবন করলে ব্যাথা দূর হবে।

৫. বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগ সারাতে : আক্রান্ত স্থান ধুয়ে পরিষ্কার করে তাতে কালোজিরার তেল মালিশ করতে হবে। সেই সাথে এক চা-চামচ কাঁচা হলুদের রসের সাথে সমপরিমাণ কালোজিরার তেল ও সমপরিমাণ মধু বা এককাপ রং চায়ের সাথে দৈনিক ৩বার করে ২/৩ সপ্তাহ সেবন করতে হবে।

৬. হার্টের বিভিন্ন সমস্যার ক্ষেত্রে : এক চা-চামচ কালোজিরার তেল এক কাপ দুধের সাথে দৈনিক ২বার করে ৪/৫ সপ্তাহ সেবন করতে হবে। সেই সাথে শুধু কালোজিরার তেল বুকে নিয়মিত মালিশ করতে হবে।

৭. ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখতে : প্রতিদিন সকালে রসুনের দু’টি কোষ চিবিয়ে খেয়ে এবং সমস্ত শরীরে কালোজিরার তেল মালিশ করে সূর্যের তাপে কমপক্ষে আধাঘন্টা অবস্থান করতে হবে। সেই সাথে এক চা-চামচ কালোজিরার তেল সমপরিমাণ মধুসহ প্রতি সপ্তাহে ২/৩ দিন সেবন করলে ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে থাকে। এছাড়া কালোজিরা বা কালোজিরার তেল বহুমুত্র রোগীদের রক্তের শর্করার মাত্রা কমিয়ে দেয় এবং নিম্ন রক্তচাপকে বৃদ্ধি করে ও উচ্চ রক্তচাপকে হ্রাস করে।

৮. অর্শ রোগ নিরাময়ে : এক চা-চামচ মাখন ও সমপরিমাণ তেল চুরন/তিলের তেল, এক চা-চামচ কালোজিরার তেল সহ প্রতিদিন খালি পেটে ৩/৪ সপ্তাহ সেবন করলে অর্শ দূর হবে।

৯. শ্বাস কষ্ট বা হাঁপানী রোগ সারাতে : হাঁপানী বা শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য কালোজিরা অনেক বেশী উপকারী। প্রতিদিন কালোজিরার ভর্তা খেলে হাঁপানি বা শ্বাস কষ্টজনিত সমস্যা উপশম হবে। এছাড়া এক চা-চামচ কালোজিরার তেল, এক কাপ দুধ বা রং চায়ের সাথে দৈনিক ৩বার করে নিয়মিত সেবন করলে উপকার হবে।

১০. ডায়বেটিক নিয়ন্ত্রণে : ডায়াবেটিক রোগ উপশমে বেশ কাজে লাগে কালোজিরা। এক চিমটি পরিমাণ কালোজিরা এক গ্লাস পানির সঙ্গে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এছাড়া এক চা-চামচ কালোজিরার তেল, এক কাপ রং চা বা গরম ভাতের সাথে মিশিয়ে দৈনিক ২বার করে নিয়মিত সেবন করলে ডায়বেটিক নিয়ন্ত্রণে শতভাগ ফলপ্রসু হবে।

১১. জৈব শক্তি বৃদ্ধির জন্য : কালোজিরা নারী-পুরুষ উভয়ের স্নায়ুবিক ক্ষমতা বাড়ায়। প্রতিদিন কালোজিরা খাবারের সাথে খেলে পুরুষের স্পার্ম সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং পুরুষত্বহীনতা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়। এক চা-চামচ মাখন, এক চা-চামচ জাইতুন তেল সমপরিমাণ কালোজিরার তেল ও মধুসহ দৈনিক ৩ বার ৪/৫ সপ্তাহ সেবন করলে উপকার হবে।

১২. অনিয়মিত মাসিক স্রাব বা মেহ/প্রমেহ রোগের ক্ষেত্রে : এক কাপ কাঁচা হলুদের রস বা সমপরিমাণ আতপ চাল ধোয়া পানির সাথে এক চা-চামচ কালোজিরার তেল মিশিয়ে দৈনিক ৩বার করে নিয়মিত সেবন করলে শত ভাগ উপকার হবে।

১৩. দুগ্ধ দানকারিনী মায়েদের দুধ বৃদ্ধির জন্য : যেসব মায়েদের বুকে পর্যাপ্ত দুধ নেই, তাদের জন্য কালোজিরা মহৌষধ। মায়েরা প্রতি রাতে শোয়ার আগে ৫-১০ গ্রাম কালোজিরা মিহি করে দুধের সঙ্গে খেলে। মাত্র ১০-১৫ দিনে দুধের প্রবাহ বেড়ে যাবে। এছাড়া এ সমস্যা সমাধানে কালোজিরা ভর্তা করে ভাতের সঙ্গে খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া এক চা-চামচ কালোজিরার তেল সমপরিমাণ মধুসহ দৈনিক ৩ বার করে নিয়মিত সেবন করলে শতভাগ ফল পাওয়া যাবে।

১৪. ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে : ত্বকের প্রভা ও উজ্জ্বলতা বৃদ্ধির জন্য কালোজিরা ফলপ্রদ। এতে লিনোলেইক ও লিনোলেনিক নামের এসেনশিয়াল ফ্যাটি এসিড থাকে, যা পরিবেশের প্রখরতা, স্ট্রেস ইত্যাদি থেকে ত্বককে রক্ষা করে এবং ত্বককে সুন্দর করে ও ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখে।

মুখের ব্রণ দূর করতে সাইডার ভিনেগারের সাথে কালোজিরা মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে আক্রান্ত স্থানে লাগিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিতে হবে। এভাবে নিয়মিত লাগালে ব্রণ দূর হবে। শুষ্ক ত্বকের জন্য কালোজিরার গুঁড়া ও কালোজিরার তেলের সাথে তিলের তেল মিশিয়ে ত্বকে লাগালে এক সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণীয় পরিবর্তন আসবে।

১৫. গ্যাষ্ট্রিক ও আমাশয় নিরাময়ে : এক চা-চামচ তেল সমপরিমাণ মধু সহ দিনে ৩বার করে ২/৩ সপ্তাহ সেবন করলে উপকার হবে।

১৬. জন্ডিস বা লিভারের বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণে : এক গ্লাস ত্রিফলার শরবতের সাথে এক চা-চামচ কালোজিরার তেল দিনে ৩বার করে ৪/৫ সপ্তাহ সেবন করলে ফল পাওয়া যাবে।

১৭. রিউমেটিক ও পিঠে ব্যথা দূর করার জন্য : কালোজিরার তেল আমাদের দেহে বাসা বাঁধা দীর্ঘ মেয়াদী রিউমেটিক এবং পিঠে ব্যথা কমাতে বেশ সাহায্য করে।

১৮. শিশুর  দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি করতে কালোজিরা : দুই বছরের অধিক বয়সী শিশুদের কালোজিরা খাওয়ানোর অভ্যাস করলে দ্রুত শিশুর দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি ঘটে। শিশুর মস্তিষ্কের সুস্থতা এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতেও অনেক কাজ করে কালোজিরা।

১৯. মাথা ব্যথা দূর করতে : মাথা ব্যথায় কপালের উভয় চিবুকে ও কানের পার্শ্ববর্তী স্থানে দৈনিক ৩/৪ বার কালোজিরা তেল মালিশ করলে উপকার পাওয়া যায়।

২০. স্বাস্থ্য ভাল রাখতে : মধুসহ প্রতিদিন সকালে কালোজিরা সেবনে স্বাস্থ্য ভালো থাকে ও সকল মহামারী রোগ হ’তে রক্ষা পাওয়া যায়।

২১. হজমের সমস্যা দূরীকরণে : হজমের সমস্যায় এক-দুই চা-চামচ কালোজিরা বেটে পানির সঙ্গে খেতে থাকুন। এভাবে প্রতিদিন দু’তিনবার খেলে এক মাসের মধ্যে হজমশক্তি বেড়ে যাবে। পাশাপাশি পেট ফাঁপাভাবও দূর হবে।

২২. লিভারের সুরক্ষায় : লিভারের সুরক্ষায় ভেষজটি অনন্য। লিভার ক্যান্সারের জন্য দায়ী আফলাটক্সিন নামক বিষ ধ্বংস করে কালোজিরা।

২৩. চুল পড়া বন্ধ করতে : কালোজিরা খেলে চুল পর্যাপ্ত পুষ্টি পাবে। ফলে চুল পড়া বন্ধ হবে। আরো ফল পেতে চুলের গোড়ায় এর তেল মালিশ করা যেতে পারে।

২৪. দেহের সাধারণ উন্নতি : নিয়মিত কালোজিরা সেবনে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সতেজ করে ও সার্বিকভাবে স্বস্থ্যের উন্নতি সাধন করে। এটি মূত্র বর্ধক ও উচ্চরক্তচাপ হ্রাসকারক, গ্যসট্রিক আলসার প্রতিরোধক, ভাইরাস প্রতিরোধক, টিউমার ও ক্যান্সার প্রতিরোধক, ব্যাকটেরিয়া এবং কৃমিনাষক, রক্তের স্বাভাবিকতা রক্ষাকারক, যকৃতের বিষক্রিয়ানাসক, এলার্জি প্রতিরোধক। অরুচি, উদরাময় নিরাময়ে কালোজিরা সহায়তা করে। মাথা ঝিমঝিম করা, মুখশ্রী ও সৌন্দর্য রক্ষা, অবসন্নতা-দুর্বলতা, নিষ্ক্রিয়তা ও অলসতা, আহারে অরুচি দূর করতে কালোজিরা উপযোগী। দেহের কাটা-ছেঁড়া শুকানোর জন্য কাজ করে। এছাড়া কালোজিরা নিয়মিত খেলে শরীরে সহজে ঘা, ফোড়া, সংক্রামক রোগ হয় না। তিলের তেলের সঙ্গে কালোজিরা বাঁটা বা কালোজিরার তেল মিশিয়ে ফোড়াতে লাগালে ফোড়া উপশম হয়।

২৫. দাঁত ব্যথা দূরীকরণে : দাঁতে ব্যথা হ’লে কুসুম গরম পানিতে কালোজিরা গুড়া বা তেল দিয়ে কুলি করলে ব্যথা কমে যাবে এবং জিহবা, তালু, দাঁতের মাড়ির জীবাণু মরে যায়।

২৬. শান্তিপূর্ণ ঘুমের প্রয়োজনে : কালোজিরার তেল ব্যবহারে রাতভর শান্তিপূর্ণ নিদ্রা হয়।

২৭. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে : কালোজিরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। নিয়মিত কালোজিরা খেলে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সতেজ থাকে। এতে করে যে কোন জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেহকে প্রস্তুত করে তোলে এবং সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি করে। ১ চামচ কালোজিরা অথবা কয়েক ফোটা কালোজিরার তেল ১ চামচ মধুসহ প্রতিদিন সেবন করলে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে।

২৮. পারকিনসন্স রোগের প্রতিকারে : কালোজিরায় থাইমোকুইনিন থাকে যা পারকিনসন্স ও ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তদের দেহে উৎপন্ন টক্সিনের প্রভাব থেকে নিউরনের সুরক্ষায় কাজ করে।

২৯. চুলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে : কালোজিরার তেল চুলের কোষ ও ফলিকলকে চাঙ্গা করে ও শক্তিশালী করে, যার ফলে নতুন চুল সৃষ্টি হয়। এছাড়াও কালোজিরার তেল চুলের গোড়া শক্ত করে ও চুল পড়া কমায়।

৩০. কিডনির পাথর ও ব্লাডার : কালোজিরা উত্তমরূপে গুঁড়ো করে মধুর সাথে মিশ্রিত করে দুই চামচ মিশ্রণ আধাকাপ গরম পানিতে মিশিয়ে প্রতিদিন আধাকাপ তেল সহ পান করতে হবে। কালোজিরার টীংচার মধুসহ দিনে ৩/৪ বার ১৫ ফোঁটা সেবন করা যেতে পারে।

৩১. চোখের ব্যথা দূর করতে : রাতে ঘুমাবার আগে চোখের উভয়পাশে ও ভ্রূতে কালোজিরার তেল মালিশ করতে হবে। এককাপ গাজরের রসের সাথে একমাস কালোজিরা তেল সেবন করলে ব্যথা দূর হবে। নিয়মিত গাজর খেলে এবং কালোজিরা টীংচার সেবন ও তেল মালিশে উপকার হবে।

৩২. ডায়রিয়া : মুখে খাবার স্যালাইন ও হোমিও ওষুধের পাশাপাশি ১ কাপ দই ও বড় একচামচ কালোজিরা তেল দিনে ২ বার সেবন করলে ডায়রিয়া কমে যাবে।

৩৩. জ্বর : সকাল-সন্ধ্যায় লেবুর রসের সাথে ১ চামচ কালোজিরা তেল পান করলে জ্বর কমবে। কালোজিরা ও লেবুর টীংচার (অ্যাসেটিক অ্যাসিড) মিশ্রণ করে সেবন করা যেতে পারে।

৩৪. আঁচিল : হেলেঞ্চা দিয়ে ঘষে কালোজিরার তেল লাগানো যায়। হেলেঞ্চা মূল আরক মিশিয়ে নিলেও হবে।

সতর্কতা : গর্ভাবস্থায় ও দুই বছরের কম বয়সের বাচ্চাদের কালোজিরার তেল সেবন করা উচিত নয়। তবে বাহ্যিকভাবে ব্যবহার করা যাবে। পুরাতন কালোজিরার তেল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

\ সংকলিত \






আরও
আরও
.