আল্লাহ বলেন,

مَنْ ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ وَلَهُ أَجْرٌ كَرِيمٌ- (الحديد 11)-

অনুবাদ : ‘কে আছ যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিবে? অতঃপর তিনি তার জন্য তা বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন? আর তার জন্য রয়েছে উত্তম পুরস্কার’ (হাদীদ ৫৭/১১)

কুরতুবী বলেন, القَرْضُ : اسْمٌ لِكُلِّ مَا يُلْتَمَسُ عَلَيْهِ الْجَزَاءُ কর্য অর্থ ঋণ। যার মাধ্যমে প্রতিদান কামনা করা হয়।[1]

قَرَضَ يَقْرِضُ قَرْضًا অর্থ কেটে ফেলা। সেখান থেকে مِقْرَاضٌ অর্থ কাঁচি। কর্য দেওয়া অর্থ নিজের মাল থেকে কিছু অংশ কেটে দেওয়া। কর্য ভাল ও মন্দ দু’অর্থে আসে। নেকীর উদ্দেশ্যে কর্য দিলে সেটা হয় কর্যে হাসানাহ(القرض الحسن)। আর অন্যায় উদ্দেশ্যে দিলে সেটা হয় মন্দ ঋণ (القرض السئ)। যেমন আল্লাহ বলেন,وَلاَ تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنْفِقُونَ- ‘তোমরা খরচ করার সময় মন্দ সংকল্প করো না’ (বাক্বারাহ ২/২৬৭)

যেমন আরবরা বলে থাকে, عِنْدَهُ قَرْضُ صِدْقٍ وَقَرْضُ سُوْءٍ ‘তার কাছে আমার সত্য ঋণ ও মন্দ ঋণ রয়েছে’। তবে যে কেউ কোন সৎকর্ম করলে তারা বলে, قَدْ أَقْرَضَ ‘সে কর্য দিল’।[2] তাদের ভাষাতেই কুরআন নাযিল হয়েছে। সেকারণ এখানে অর্থ হবে ‘উত্তম ঋণ’। কালবী বলেন, قَرْضاً حَسَناً অর্থ : صَدَقَةً مُحْتَسِبًا مِنْ قَلْبِهِ بِلاَ مَنٍّ وَلاَ أَذًى ‘কোনরূপ খোঁটা ও কষ্টদান ছাড়াই কেবল ছওয়াবের আশায় ছাদাক্বা দেওয়া’।

আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত ‘কর্যে হাসানাহ’ অর্থ ওমর (রাঃ) ও অন্য সালাফগণ বলেন, الْإِنْفَاقُ فِي سَبِيلِ اللهِ ‘আল্লাহর পথে ব্যয় করা’।[3] যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَأَنْفِقُوا فِي سَبِيلِ اللهِ وَلاَ تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ- ‘আর তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় কর এবং নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না। তোমরা সৎকর্ম কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন’ (বাক্বারাহ ২/১৯৫)। আল্লাহর জন্য প্রদত্ত যেকোন আর্থিক ঋণ বা অন্যান্য ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ তাকে মহান পুরস্কারে ভূষিত করবেন। এই পুরস্কারের পরিমাণ সাত থেকে সাতশত গুণ বা তারও বেশী হ’তে পারে। যেমন আল্লাহ বলেন,مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِائَةُ حَبَّةٍ وَاللهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ‘যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের ন্যায়। যা থেকে সাতটি শিষ জন্মে। প্রত্যেকটি শিষে একশ’টি দানা থাকে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহুগুণ বর্ধিত করে দেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ প্রশস্ত দাতা ও সর্বজ্ঞ’ (বাক্বারাহ ২/২৬১)। আল্লাহর পথে আর্থিক ব্যয় ছাড়াও সময়, শ্রম ও ইলমের ব্যয় এবং অন্যান্য সকল প্রকার ব্যয়ের পুরস্কার সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,مَنْ ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ أَضْعَافًا كَثِيرَةً وَاللهُ يَقْبِضُ وَيَبْسُطُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ- ‘কোন সে ব্যক্তি যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিবে, অতঃপর তিনি তার বিনিময়ে তাকে বহুগুণ বেশী দান করবেন? বস্ত্ততঃ আল্লাহ্ই রূযী সংকুচিত করেন ও প্রশস্ত করেন। আর তাঁরই দিকে তোমরা ফিরে যাবে’ (বাক্বারাহ ২/২৪৫)। দুনিয়াতে আল্লাহ বান্দার রূযী কমবেশী করেন এবং আখেরাতে তার আমল ও তার খুলূছিয়াতের তারতম্যের ভিত্তিতে পুরস্কারে তারতম্য করেন। কুশায়রী বলেন, কর্যে হাসানাহ হওয়ার জন্য ১০টি শর্ত রয়েছে। যেমন, (১) সৎ উদ্দেশ্য ও খুশী মনে হওয়া (২) স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হওয়া। যেখানে কোনরূপ রিয়া ও শ্রুতি থাকবে না (৩) হালাল মাল হওয়া (৪) নিকৃষ্ট দানের সংকল্প না করা এবং উত্তম দান করা (৫) সুস্থ অবস্থায় দান করা। যখন মালের প্রতি লোভ ও সচ্ছল জীবনের প্রতি আকাংখা থাকে। চরম অসুস্থ ও মৃত্যুকালে নয়।[4] (৬) গোপনে হওয়া (বাক্বারাহ ২/২৭১)। (৭) খোঁটা না দেওয়া (বাক্বারাহ ২/২৬৪)। (৮) অধিক দানকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। কেননা আখেরাতের পুরস্কারের তুলনায় দুনিয়ার পুরাটাই তুচ্ছ। (৯) প্রিয় বস্ত্ত দান করা (আলে ইমরান ৩/৯২)। (১০) দান অধিক ও মূল্যবান হওয়া। রাসূল (ছাঃ) বলেন,الرِّقَابِ أَفْضَلُ قَالَ: أَغْلاَهَا ثَمَنًا، وَأَنْفَسُهَا عِنْدَ أَهْلِهَا ‘শ্রেষ্ঠ দাসমুক্তি হ’ল যা তার মালিকের নিকট অধিক মূল্যবান ও সর্বাধিক সুঠাম’।[5]

আয়াতটিতে আল্লাহর পথে সকল প্রকার ব্যয় এবং বিশেষ করে জিহাদের জন্য ব্যয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। কেননা জিহাদ হ’ল ইসলামের চূড়া (ذِرْوَةُ سَنَامِهِ الْجِهَادُ)।[6] চূড়াবিহীন গৃহের যে অবস্থা, জিহাদবিহীন দ্বীনের সেই অবস্থা। ইসলামের প্রথম দিকে সূরা মুয্যাম্মিল নাযিল হয়। যেখানে আল্লাহ বলেন,وَأَقِيمُوا الصَّلاَةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَقْرِضُوا اللهَ قَرْضًا حَسَنًا وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنْفُسِكُمْ مِنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِنْدَ اللهِ هُوَ خَيْرًا وَأَعْظَمَ أَجْرًا وَاسْتَغْفِرُوا اللهَ إِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ- ‘ তোমরা ছালাত কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। বস্ত্ততঃ তোমরা তোমাদের জন্য অগ্রিম যা প্রেরণ করবে, তার বিনিময় আল্লাহর নিকট পুরোপুরি পাবে। আর সেটাই শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম পুরস্কার। তোমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (মুয্যাম্মিল ৭৩/২০)

মাদানী জীবনে একই মর্মে সূরা বাক্বারাহ ২৪৫ আয়াত নাযিল হলে কাফের-মুশরিকরা ঠাট্টা করে বলে, আল্লাহ ফকীর। আমরা ধনী। যেমন আল্লাহ বলেন,لَقَدْ سَمِعَ اللهُ قَوْلَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللهَ فَقِيرٌ وَنَحْنُ أَغْنِيَاءُ سَنَكْتُبُ مَا قَالُوا وَقَتْلَهُمُ الْأَنْبِيَاءَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَنَقُولُ ذُوقُوا عَذَابَ الْحَرِيقِ ‘অবশ্যই আল্লাহ তাদের কথা শুনেছেন, যারা বলে আল্লাহ ফকীর ও আমরা ধনী। তারা যা বলে এবং তারা যে অন্যায়ভাবে নবীদের হত্যা করেছিল, সবই আমরা লিখে রাখব এবং তাদেরকে (ক্বিয়ামতের দিন) বলব, দহনজ্বালাকর শাস্তির স্বাদ আস্বাদন কর’(আলে ইমরান ৩/১৮১)

ইবনুল ‘আরাবী বলেন, উক্ত আয়াত শোনার পর মানুষ তিনভাগে ভাগ হয়ে যায়। একভাগের লোকেরা বলে, মুহাম্মাদের রব অভাবগ্রস্ত এবং আমাদের মুখাপেক্ষী। অথচ আমরা ধনী (আলে ইমরান ৩/১৮১)। এটা স্রেফ মূর্খতা। দ্বিতীয় ভাগের লোকেরা উক্ত আয়াতের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে অলসতা করে এবং অধিক কৃপণ হয়ে পড়ে। তৃতীয় ভাগের লোকেরা আল্লাহর ডাকে দ্রুত সাড়া দেয় এবং আল্লাহর পথে ব্যয়ে সাথে সাথে এগিয়ে আসে।[7] যেমন এগিয়ে আসেন আবুবকর, ওমর, ওছমান, আলী ও অন্যান্য শ্রেষ্ঠ ছাহাবীগণ। ৯ম হিজরীতে তাবূকের যুদ্ধে গমনকালে আবুবকর (রাঃ) তাঁর সমস্ত সম্পদ, ওমর (রাঃ) তাঁর অর্ধেক সম্পদ এবং ওছমান (রাঃ) তাঁর সম্পদের বৃহদাংশ দান করেন। বলা চলে যে, ত্রিশ হাযার সেনাবাহিনীর জন্য সর্বাধিক রসদ সম্ভার তিনি একাই দান করেন। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَا ضَرَّ ابْنَ عَفَّانَ مَا عَمِلَ بَعْدَ الْيَوْمِ، يُرَدِّدُهَا مِرَاراً ‘আজকের দিনের পর কোন আমলই ইবনু আফফানের (অর্থাৎ ওছমানের) কোন ক্ষতিসাধন করবে না’। কথাটি তিনি কয়েকবার বলেন’।[8] এই বিপুল দানের জন্য তিনি مُجْهِزُ جَيْشِ الْعُسْرَةِ অর্থাৎ ‘তাবূক যুদ্ধের রসদ যোগানদাতা’ খেতাব প্রাপ্ত হন (ইবনু খালদূন)

ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, যখন এই আয়াত নাযিল হয়, তখন আবুদ্দাহদাহ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ কি আমাদের নিকট ঋণ চাচ্ছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, فَإِنِّي أَقْرَضْتُ رَبِّي حَائِطًا فِيهِ سِتُّمِائَةِ نَخْلَةٍ ‘আমি আল্লাহর জন্য ঋণ দিলাম উত্তম খেজুর বাগানটি, যাতে ছয়শ‘ খেজুর গাছ আছে’। অতঃপর তিনি বাগানে গেলেন। যেখানে তার স্ত্রী ও সন্তানেরা ছিল। সেখানে গিয়ে তিনি স্ত্রীকে ডেকে বললেন,اخْرُجِي،  فَإِنِّي قَدْ أَقْرَضْتُ رَبِّي حَائِطًا فِيهِ سِتُّمِائَةِ نَخْلَةٍ ‘বেরিয়ে এস। কেননা আমি ছয়শ‘ খেজুর গাছের এই বাগিচাটি আমার প্রতিপালককে ঋণ দিয়েছি’।[9]

তাফসীরে আব্দুর রাযযাকে উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে, আবুদ্দাহদাহ বলেন, আমার দু’টি বাগিচা রয়েছে। একটি উচ্চ ভূমিতে অন্যটি নিম্ন ভূমিতে। আমি এদু’টির উত্তমটি আল্লাহকে ঋণ দিতে চাই। তখন রাসূল (ছাঃ) বলেন, এর বিনিময়ে আবুদ্দাহদাহকে আল্লাহ জান্নাতে কত বেশী খেজুরের কাঁদি দান করবেন! (তাফসীর আব্দুর রাযযাক হা/৩০৭)। হাদীছটির সনদ ‘মুরসাল’। তবে এর বিশুদ্ধ ভিত্তি রয়েছে ছহীহ মুসলিমে। যেখানে জাবের বিন সামুরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (ছাঃ) আবুদ্দাহদাহ-এর জানাযা করে ফিরে আসার সময় বলেন,كَمْ مِنْ عِذْقٍ مُعَلَّقٍ فِى الْجَنَّةِ لأَبِى الدَّحْدَاحِ ‘আবুদ্দাহদাহ্র জন্য জান্নাতে কতই না অধিক  খেজুরের ঝুলন্ত কাঁদি রয়েছে! (মুসলিম হা/৯৬৫)

আনাস বিন মালেক (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, ‘জনৈক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! অমুক ব্যক্তির খেজুর গাছ রয়েছে। তাকে বলুন, যেন সে ওটা আমার নিকটে বিক্রি করে দেয়। যাতে আমি সেখানে একটি বাগিচা বানাতে পারি। রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, তুমি জান্নাতে একটি খেজুর গাছের বিনিময়ে ওটা বিক্রি করে দাও। তখন সে অস্বীকার করল। এমন সময় আবুদ্দাহদাহ এসে তাকে বলল, তুমি আমার বাগিচার বিনিময়ে তোমার খেজুর গাছটি বিক্রি করে দাও। তখন সে রাযী হ’ল। অতঃপর আবুদ্দাহদাহ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার বাগিচার বিনিময়ে খেজুর গাছটি খরীদ করেছি এবং বাগিচাটি আমি তাকে দিয়ে দিয়েছি। তখন রাসূল (ছাঃ) কয়েকবার বললেন, كَمْ مِنْ عِذْقٍ رَدَاحٍ لِأَبِي الدَّحْدَاحِ فِي الْجَنَّةِ ‘আবুদ্দাহদাহ্র জন্য জান্নাতে কতই না বড় বড়  খেজুরের ঝুলন্ত কাঁদি রয়েছে! অতঃপর আবুদ্দাহদাহ তার স্ত্রীর নিকটে এসে বলল, اخْرُجِي مِنَ الْحَائِطِ، فَإِنِّي بِعْتُهُ بِنَخْلَةٍ فِي الْجَنَّةِ ‘বাগান থেকে বেরিয়ে এস। কেননা এটাকে আমি জান্নাতে একটি খেজুর গাছের বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছি’। জবাবে স্ত্রী বলল, قَدْ رَبِحْتَ الْبَيْعَ ‘আপনি ব্যবসায়ে লাভবান হয়েছেন’ (হাকেম হা/২১৯৪)

আল্লাহ বলেন,لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللهَ بِهِ عَلِيمٌ- ‘তোমরা কখনোই কল্যাণ লাভ করবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্ত্ত থেকে দান করবে। আর তোমরা যা কিছু ব্যয় কর, আল্লাহ তা সবই জানেন’ (আলে ইমরান ৩/৯২)

ইবনু কাছীর বলেন, অত্র আয়াতে বির্র (الْبِرَّ) অর্থ ‘জান্নাত’ (الجنة)। অত্র আয়াত নাযিলের পর সবচেয়ে ধনাঢ্য আনছার ছাহাবী আবু ত্বালহা (রাঃ) তার সবচেয়ে প্রিয় এবং মূল্যবান সম্পদ ‘হা’ কূয়াটি (بئرحاء), যা মসজিদে নববীর সম্মুখে ছিল (বর্তমানে উত্তর দিকের শেষ প্রান্তে কাতারের কার্পেটের নীচে স্থানটি চিহ্নিত করা আছে) এবং যেখান থেকে রাসূল (ছাঃ) পানি পান করতেন, সেটা দান করে দিলেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, রাখ, রাখ, এটা খুবই মূল্যবান সম্পদ। আমি মনে করি এটা তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বণ্টন করে দাও। তিনি  বললেন, সম্পদ আপনাকে দিয়েছি হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এটা যেভাবে খুশী ব্যয় করুন। আমি তো কেবল আল্লাহর নিকটে এর প্রতিদান চাই। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) উক্ত সম্পদ আবু ত্বালহার নিকটাত্মীয় ও চাচাতো ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন’।[10] অনুরূপভাবে হযরত ওমর (রাঃ) এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ হ’ল খায়বর যুদ্ধে প্রাপ্ত গণীমতের অংশ। আপনি এ ব্যাপারে আমাকে কি নির্দেশ দিচ্ছেন? রাসূল (ছাঃ) বললেন, বাগিচাটি রেখে দাও ও ফল দান করে দাও।[11] এমনিভাবে যায়েদ বিন হারেছাহ (রাঃ) তাঁর প্রিয় ঘোড়াটি দান করে দেন। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রা) তাঁর প্রিয় গোলাম নাফে‘-কে মুক্ত করে দেন।[12]

দরসে বর্ণিত আয়াতে মুমিনকে তার জান-মাল আল্লাহর পথে ব্যয়ের মাধ্যমে তাঁকে উত্তম ঋণ দানের আহবান জানানো হয়েছে। যার বিনিময়ে আল্লাহ তাকে মহা পুরস্কারে ভূষিত করবেন। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন,يَا ابْنَ آدَمَ مَرِضْتُ فَلَمْ تَعُدْنِى. قَالَ يَا رَبِّ كَيْفَ أَعُودُكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ. قَالَ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ عَبْدِى فُلاَنًا مَرِضَ فَلَمْ تَعُدْهُ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ عُدْتَهُ لَوَجَدْتَنِى عِنْدَهُ يَا ابْنَ آدَمَ اسْتَطْعَمْتُكَ فَلَمْ تُطْعِمْنِى... يَا ابْنَ آدَمَ اسْتَسْقَيْتُكَ فَلَمْ تَسْقِنِى... قَالَ اسْتَسْقَاكَ عَبْدِى فُلاَنٌ فَلَمْ تَسْقِهِ أَمَا إِنَّكَ لَوْ سَقَيْتَهُ وَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِى ‘হে আদম সন্তান! আমি পীড়িত ছিলাম, কিন্তু তুমি আমার সেবা করোনি। বান্দা বলবে, হে  আল্লাহ! কিভাবে আমি আপনাকে সেবা করব? অথচ আপনি জগতসমূহের প্রতিপালক! আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা পীড়িত ছিল? অথচ তুমি তার সেবা করোনি। তুমি কি জানো না যদি তুমি তাকে সেবা করতে, তাহ’লে তুমি আমাকে সেখানে পেতে? হে আদম সন্তান! আমি খাদ্য চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খাদ্য দাওনি।... হে আদম সন্তান! আমি পানি চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পানি দাওনি।... তুমি কি জানো না যদি তুমি তাকে পানি পান করাতে, তাহ’লে তুমি আমাকে সেখানে পেতে? (মুসলিম হা/২৫৬৯)

জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন রোগীর সেবায় রওয়ানা হ’ল, সে আল্লাহর রহমতের দরিয়ায় সাঁতার কাটতে থাকল। যতক্ষণ না সে সেখানে গিয়ে বসে। অতঃপর যখন বসল, সে আল্লাহর রহমতের দরিয়ায় ডুব দিল’।[13] ছাওবান (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا عَادَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ لَمْ يَزَلْ فِى خُرْفَةِ الْجَنَّةِ حَتَّى يَرْجِعَ ‘মুসলমান যখন তার কোন মুসলিম ভাইয়ের সেবা করে, তখন সে জান্নাতের বাগিচায় অবস্থান করে, যতক্ষণ না সে ফিরে আসে’।[14] হযরত আলী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘যখন কোন মুসলমান সকালে কোন মুসলমানকে দেখতে যায়, তখন তার জন্য সত্তুর হাযার ফেরেশতা সন্ধ্যা পর্যন্ত দো‘আ করে। আর যদি সন্ধ্যাবেলা দেখতে যায়, তাহ’লে সকাল পর্যন্ত সত্তুর হাযার ফেরেশতা সন্ধ্যা পর্যন্ত দো‘আ করে। আর তার জন্য জান্নাতে একটি বাগিচা তৈরী করা হয়’।[15]

উপরোক্ত হাদীছগুলিতে রোগীর সেবা, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান ও তৃষ্ণার্তকে পানি প্রদান দ্বারা দৈহিক, আর্থিক ও মানবিক সকল প্রকার ত্যাগ ও সহানুভূতিকে আল্লাহর জন্য উত্তম ঋণ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। যদি সেটা আল্লাহর জন্য হয়। ইসলাম আগমনের শুরু থেকেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় সাথীদের মধ্যে এই ত্যাগের জাযবা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ছাহাবীগণ নিজেদের জান-মাল আল্লাহর পথে উৎসর্গ করেছেন স্রেফ আখেরাতে তার প্রতিদান পাওয়ার জন্য। দুনিয়া অর্জনের জন্য নয়। যেমন ৬ষ্ঠ বা ৭ম মুসলিম হযরত খাববাব ইবনুল আরাত (রাঃ) আল্লাহর পথে প্রচন্ড কষ্ট ভোগ করেছিলেন। তাঁকে গনগনে লোহার আগুনের উপর চিৎ করে শুইয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। ফলে পিঠের চামড়া, গোশত ও রক্তে ভিজে লোহার আগুন নিভে গিয়েছিল। পরবর্তীতে ইসলামের বিজয় লাভের যুগে ওমর ও ওছমান ও আলী (রাঃ)-এর খেলাফতকালে যখন তিনি ঘরে ৪০ হাযার দীনার রেখে ৬৩ বছর বয়সে সচ্ছল অবস্থায় কূফায় মৃত্যুবরণ করেন, তখন তাকে পরিচর্যাকারী জনৈক সাথী বললেন, أَبْشِرْ يَا أَبَا عَبْدِ اللهِ، فَإِنَّكَ مُلاَقٍ إِخْوَانَكَ غَدًا ‘হে আবু আব্দুল্লাহ! সুসংবাদ গ্রহণ করুন। কেননা কালই আপনি আপনার সাথীদের সঙ্গে মিলিত হবেন’। জবাবে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ذَكَّرتموني أقواماً، وإخواناً مَضَوْا بِأُجُورهم كُلِّهَا لَمْ يَنالُوا مِنَ الدُّنيا شَيْئًا ‘তোমরা আমাকে এমন ভাইদের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে, যারা তাদের সম্পূর্ণ নেকী নিয়ে বিদায় হয়ে গেছেন। দুনিয়ার কিছুই তারা পাননি’। আর আমরা তাঁদের পরে বেঁচে আছি। অবশেষে দুনিয়ার অনেক কিছু পেয়েছি। অথচ তাঁদের জন্য আমরা মাটি ব্যতীত কিছুই পাইনি। এসময় তিনি তার বাড়ি এবং বাড়ির সম্পদ রাখার কক্ষের দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, মদীনায় প্রথম দাঈ ও ওহোদ যুদ্ধের পতাকাবাহী মুছ‘আব বিন উমায়ের শহীদ হওয়ার পর কিছুই ছেড়ে যায়নি একটি চাদর ব্যতীত। অতঃপর তিনি তার কাফনের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা হামযার জন্য এতটুকু কাফনও জুটেনি। মাথা ঢাকলে পা ঢাকেনি। পা ঢাকলে মাথা ঢাকেনি। অতঃপর সেখানে ইযখির ঘাস দিয়ে ঢাকা হয়েছিল’ (সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ১৪৭-৪৮ পৃঃ)

উল্লেখ্য যে, আল্লাহ ঐসব ব্যক্তির ঋণ কবুল করেন না, যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে। যারা আল্লাহকে শক্তিহীন ও স্রেফ একটি অন্ধ বিশ্বাস বলে ধারণা করে। যারা স্রষ্টা ও সৃষ্টিতে কোন পার্থক্য করে না। যারা আল্লাহর নিজস্ব কোন আকার নেই বলে ধারণা করে; বরং প্রত্যেক সৃষ্টিকেই যারা আল্লাহর অংশ বলেন, এরূপ অদ্বৈতবাদী ও সর্বেশ্বরবাদী আক্বীদার লোকদের কোন ঋণ কবুল হবে না। কারণ ঐ ব্যক্তি তো নিজেকেই আল্লাহ ভাবে। এইসব লোকেরা বাহ্যতঃ কোন সৎকর্ম করলে তা আদৌ কোন সৎকর্ম হিসাবে কবুল হবে না। কারণ মানবিক তাকীদ ব্যতীত তার মধ্যে আর কোন তাকীদ নেই। ফলে আল্লাহ তাকে কেন প্রতিদান দিবেন? তাছাড়া এই তাকীদ হ’ল ঠুনকো। যা স্বার্থের সংঘাতে যেকোন সময় উবে যাবে। পক্ষান্তরে আল্লাহকে ঋণ দেওয়া হয় পরকালীন তাকীদে। যা কোন অবিশ্বাসী, কপট বিশ্বাসী, শিথিল বিশ্বাসী এবং অদ্বৈতবাদী ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যাবে না। অতএব আল্লাহকে ঋণ দেবার আগে নিজের বিশ্বাসকে স্বচ্ছ করে নিতে হবে এবং স্রেফ আল্লাহর কাছেই এর প্রতিদান কামনা করতে হবে।

একইভাবে যদি কেউ মনে করে যে, সৎকর্মের বদলা দিতে আল্লাহ বাধ্য অথবা মনে করে যে, ‘আমার ইচ্ছা বলে কিচ্ছু নেই, কিছু হইতে কিছু হয় না, যাহা কিছু হয় আল্লাহ হইতে হয়। আমি একটা পুতুল মাত্র। যেমনে নাচায় তেমনি নাচি, ঐ ব্যক্তি তার সৎকর্মের পুরস্কার পাবেনা। কেননা আল্লাহ কাউকে পুরস্কার দিতে যেমন বাধ্য নন, তেমনি তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত কারু কিছু করারও ক্ষমতা নেই এবং কেউ কিছু পাবেও না।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَنْ يُنَجِّىَ أَحَدًا مِنْكُمْ عَمَلُهُ قَالُوا وَلاَ أَنْتَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ وَلاَ أَنَا، إِلاَّ أَنْ يَتَغَمَّدَنِى اللهُ بِرَحْمَةٍ، سَدِّدُوا وَقَارِبُوا، وَاغْدُوا وَرُوحُوا ، وَشَىْءٌ مِنَ الدُّلْجَةِ ‘তোমাদের কাউকে তার আমল জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিতে পারবে না। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকেও না? তিনি বললেন, আমাকেও না। তবে যদি আল্লাহ নিজ রহমত দ্বারা আমাকে ঢেকে নেন। অতএব তোমরা সঠিকভাবে কাজ কর ও মধ্যপন্থা অবলম্বন কর। সকালে, সন্ধ্যায় ও রাত্রিতে কিছু কাজ কর। সাবধান! তোমরা মধ্যপন্থা অবলম্বন করবে, মধ্যপন্থা অবলম্বন করবে। তাতে তোমরা গন্তব্য স্থলে পৌঁছতে পারবে।[16]

অতএব সৎকর্ম করার জন্য নিজের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তি ব্যয় করতে হবে, সর্বদা মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে এবং আল্লাহর অনুগ্রহের আকাংখী থাকতে হবে।

উত্তম ঋণ দানকারীদের জন্য পুরস্কার :

দরসে বর্ণিত আয়াতের পরেই আল্লাহ বলেন,يَوْمَ تَرَى الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ يَسْعَى نُورُهُمْ بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ بُشْرَاكُمُ الْيَوْمَ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ‘যেদিন তুমি দেখবে ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীদেরকে, তাদের সম্মুখ ভাগে ও দক্ষিণ পার্শ্বে তাদের জ্যোতি ছুটোছুটি করবে। তখন তাদের বলা হবে, আজ তোমাদের জন্য সুসংবাদ হ’ল জান্নাতের, যার তলদেশে নদী সমূহ প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর এটাই হ’ল মহা সফলতা’ (হাদীদ ৫৭/১২)

ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, মুমিনগণ স্ব স্ব নূর সহ পুলছিরাত পার হবে। সে সময় তাদের কারো নূর পাহাড়ের মত হবে। কারো খেজুর গাছের মত হবে। কারো একজন দাঁড়ানো ব্যক্তির ন্যায় হবে। সবচেয়ে কম হবে ঐ ব্যক্তির যার বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে কখনো নূর চমকাবে, কখনো নিভে যাবে’ (ইবনু কাছীর)

সেদিন মুনাফিকদের অবস্থা কেমন হবে, সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন,

 يَوْمَ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ لِلَّذِينَ آمَنُوا انْظُرُونَا نَقْتَبِسْ مِنْ نُورِكُمْ قِيلَ ارْجِعُوا وَرَاءَكُمْ فَالْتَمِسُوا نُورًا فَضُرِبَ بَيْنَهُمْ بِسُورٍ لَهُ بَابٌ بَاطِنُهُ فِيهِ الرَّحْمَةُ وَظَاهِرُهُ مِنْ قِبَلِهِ الْعَذَابُ- يُنَادُونَهُمْ أَلَمْ نَكُنْ مَعَكُمْ قَالُوا بَلَى وَلَكِنَّكُمْ فَتَنْتُمْ أَنْفُسَكُمْ وَتَرَبَّصْتُمْ وَارْتَبْتُمْ وَغَرَّتْكُمُ الْأَمَانِيُّ حَتَّى جَاءَ أَمْرُ اللهِ وَغَرَّكُمْ بِاللهِ الْغَرُورُ- فَالْيَوْمَ لاَ يُؤْخَذُ مِنْكُمْ فِدْيَةٌ وَلاَ مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مَأْوَاكُمُ النَّارُ هِيَ مَوْلاَكُمْ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ-

‘যেদিন কপট বিশ্বাসী পুরুষ ও কপট বিশ্বাসী নারীরা মুমিনদের বলবে, তোমরা আমাদের জন্যে অপেক্ষা কর, আমরাও কিছু আলো নিব তোমাদের জ্যোতি থেকে। বলা হবে, তোমরা পিছনে ফিরে যাও ও আলোর খোঁজ কর। অতঃপর উভয় দলের মাঝখানে খাড়া করা হবে একটি প্রাচীর, যার একটি দরজা হবে। তার অভ্যন্তরভাগে থাকবে রহমত এবং বহির্ভাগে থাকবে আযাব’। ‘তারা মুমিনদের ডেকে বলবে, আমরা কি (দুনিয়ায়) তোমাদের সাথে ছিলাম না? তারা বলবে, হ্যাঁ। কিন্তু তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে বিপদগ্রস্ত করেছ। প্রতীক্ষা করেছ, সন্দেহ পোষণ করেছ এবং অলীক আশার পিছনে বিভ্রান্ত হয়েছ। অবশেষে আল্লাহর আদেশ (মৃত্যু) এসে গেছে। এ সবই তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে প্রতারিত করেছে’। ‘অতএব আজ তোমাদের কাছ থেকে কোন মুক্তিপণ নেওয়া হবে না এবং কাফেরদের কাছ থেকেও নয়। তোমাদের সবার আবাসস্থল জাহান্নাম। সেটাই তোমাদের সঙ্গী। আর কতই না নিকৃষ্ট এই প্রত্যাবর্তন স্থল’ (হাদীদ ৫৭/১২-১৫)

মুনাফিকরা দুনিয়াতে মুমিনদের সাথেই বসবাস করে। তাদের সাথেই জুম‘আ, জামা‘আত, ঈদ, হজ্জ, ওমরাহ এমনকি জিহাদেও অংশগ্রহণ করে। কিন্তু স্রেফ দুনিয়াবী স্বার্থ ও কপটতার কারণে তারা ক্বিয়ামতের দিন নূর থেকে বঞ্চিত হবে। তারা সেদিন অন্ধকারে আলো হাতড়াবে। কিন্তু কিছুই পাবে না। অবশেষে পুলছিরাত থেকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। অন্যদিকে মুমিনরা তাদের জ্যোতির আলোকে চোখের পলকে পুলছিরাত পার হয়ে জান্নাতে চলে যাবে।

অতঃপর ১৮ আয়াতে আল্লাহ বলেন,إِنَّ الْمُصَّدِّقِينَ وَالْمُصَّدِّقَاتِ وَأَقْرَضُوا اللهَ قَرْضًا حَسَنًا يُضَاعَفُ لَهُمْ وَلَهُمْ أَجْرٌ كَرِيمٌ ‘নিশ্চয়ই দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, যারা আল্লাহ্কে উত্তম ঋণ দেয়, তাদেরকে দেওয়া হবে বহুগুণ এবং তাদের জন্যে রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার’ (হাদীদ ৫৭/১৮)

মৃত্যুর পরেও উত্তম ঋণ জারী থাকে :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ اِنْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ، رواه مسلم-

‘মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার সমস্ত আমল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, কেবল তিনটি আমল ব্যতীত : (ক) ছাদাক্বায়ে জারিয়া (খ) এমন ইল্ম যা থেকে কল্যাণ লাভ হয় এবং (গ) নেককার সন্তান, যে তার জন্য দো‘আ করে’।[17]

উক্ত হাদীছে বর্ণিত তিনটি ছাদাক্বায়ে জারিয়ার মধ্যে ইল্ম সর্বাধিক দীর্ঘস্থায়ী। শত শত বছর ধরে মানুষ ইল্ম থেকে কল্যাণ লাভ করে। সেকারণ নবী-রাসূলগণ কোন কিছুই ছেড়ে যান না, ইল্ম ব্যতীত। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ إِنَّ الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا وَلاَ دِرْهَمًا إِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَ بِهِ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ ‘নিশ্চয়ই আলেমগণ নবীদের ওয়ারিছ। আর নবীগণ দীনার ও দিরহাম ছেড়ে যান না। বরং তাঁরা কেবল ইল্ম ছেড়ে যান। যে ব্যক্তি তা থেকে গ্রহণ করে, সে ব্যক্তি পূর্ণমাত্রায় তা গ্রহণ করে’।[18]

এখানে ইল্ম বলতে ঐ ইল্মকে বুঝানো হয়েছে, যা মানুষকে নির্ভেজাল তাওহীদ ও ছহীহ সুন্নাহ্র পথ দেখায় এবং যাবতীয় শিরক ও বিদ‘আত হ’তে বিরত রাখে। উক্ত উদ্দেশ্যে উচ্চতর ইসলামী গবেষণা খাতে সহযোগিতা প্রদান, প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও পরিচালনা। বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমল সম্পন্ন বই ছাপানো ও বিতরণ করা এবং এজন্য অন্যান্য স্থায়ী প্রচার মাধ্যম স্থাপন ও পরিচালনা করা ইত্যাদি।

বস্ত্ততঃ আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদানের জন্য কুরআনে ছয় জায়গায় বর্ণিত হয়েছে। বাক্বারাহ ২/২৪৫, মায়েদাহ ৫/১২, হাদীদ ৫৭/১১, ১৮, তাগাবুন ৬৪/১৭ ও মুযযাম্মিল ৭৩/২০। মাক্কী ও মাদানী সূরায় সকল স্থানে বান্দাকে উক্ত বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। অতএব মুমিনের কর্তব্য হবে, সাধ্যমত আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেওয়া এবং কোনরূপ রিয়া ও শ্রুতি ছাড়াই আল্লাহর নিকটে উত্তম বিনিময় পাওয়ার আশায় হাদিয়া দেওয়া ও ছাদাক্বা করা। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন- আমীন!


[1]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ২৪৫ আয়াত।

[2]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা হাদীদ ১১ আয়াত।

[3]ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ২৪৫ আয়াত

[4]. বুখারী হা/১৪১৯; মুসলিম হা/১০৩২; মিশকাত হা/১৮৬৭।

[5]. বুখারী হা/২৫১৮; কুরতুবী, তাফসীর সূরা হাদীদ ১১ আয়াত।

[6]. ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭৩; তিরমিযী হা/২৬১৬; আহমাদ হা/২২০৬৯; মিশকাত হা/২৯।

[7]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ২৪৫ আয়াত।

[8]. আহমাদ হা/২০৬৪৯; তিরমিযী হা/৩৭০১; মিশকাত হা/৬০৬৪।

[9]. মুসনাদে বায্যার হা/২০৩৩, অন্য মুদ্রণে হা/২১৯৫; রাবীগণ বিশ্বস্ত, হায়ছামী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১০৮৭০।

[10]. বুখারী হা/১৪৬১; মুসলিম হা/৯৯৮; মিশকাত হা/১৯৪৫।

[11]. নাসাঈ হা/৩৬০৫; ইবনু মাজাহ হা/২৩৯৭; বুখারী হা/২৭৭২; মুসলিম হা/১৬৩২; প্রভৃতি; ইবনু কাছীর।

[12]. কুরতুবী হা/১৭২৬; সনদ মুরসাল জাইয়িদ।

[13]আহমাদ হা/১৪২৯৯; মিশকাত হা/১৫৮১

[14]. মুসলিম হা/২৫৬৮; মিশকাত হা/১৫২৭।

[15]ইবনু মাজাহ হা/১৪৪২; ছহীহাহ হা/১৩৬৭; মিশকাত হা/১৫৫০

[16]. বুখারী হা/৬৪৬৩; মুসলিম হা/২৮১৬; মিশকাত হা/২৩৭১।

[17]. মুসলিম হা/১৬৩১; মিশকাত হা/২০৩ ‘ইল্ম’ অধ্যায়।

[18]. তিরমিযী হা/২৬৮২; আবুদাঊদ হা/৩৬৪১; মিশকাত হা/২১২।





আলোর পথ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মাপে ও ওযনে ফাঁকি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
যাকাত ও ছাদাক্বার কল্যাণকারিতা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল্লাহ সর্বশক্তিমান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নবচন্দ্র সমূহ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
উঠে দাঁড়াও - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সমাজ পরিবর্তনের স্থায়ী কর্মসূচী - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
চারটি বিদায়ী উপদেশ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইবাদতের স্বাদ বৃদ্ধির উপায় সমূহ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল্লাহকে উত্তম ঋণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
এলাহী গযব নাযিলের বিধি, কারণ ও করণীয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ঈমানী সংকট - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.