يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ- قُمْ فَأَنْذِرْ- وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ- وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ- وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ- وَلاَ تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ- وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ-
‘হে চাদরাবৃত!’ (১) ‘ওঠ! সতর্ক কর’ (২) ‘আর তোমার পালনকর্তার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর’ (৩) ‘তোমার পোশাক পবিত্র কর’ (৪) ‘নাপাকী বর্জন কর’ (৫)। ‘অধিক পাওয়ার আশায় কাউকে দান করো না’ (৬)। ‘আর তোমার প্রতিপালকের সন্তুষ্টির জন্য ছবর কর’ (মুদ্দাছছির ৭৪/১-৭)।
শাব্দিক ব্যাখ্যা : (১) يَا أَيُّهَا ‘হে’ مُدَّثِّرُ ‘চাদরাবৃত’ (২) قُمْ ‘দাঁড়াও’ فَأَنْذِرْ ‘সতর্ক কর’ (৩) وَرَبَّكَ ‘আর তোমার পালনকর্তার’ فَكَبِّرْ ‘শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর’ (৪) وَثِيَابَكَ ‘তোমার পোশাক’ فَطَهِّرْ ‘পবিত্র কর’ (৫) وَالرُّجْزَ ‘নাপাকী’ فَاهْجُرْ ‘বর্জন কর’ (৬) وَلاَ تَمْنُنْ ‘কাউকে দান করো না’ تَسْتَكْثِرُ ‘অধিক পাওয়ার আশায়’ (৭) وَلِرَبِّكَ ‘আর তোমার প্রতিপালকের সন্তুষ্টির জন্য’ فَاصْبِرْ ‘ছবর কর’।
শানে নুযূল :
রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) বলেন, একদা কুরায়েশনেতা ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ সকল নেতৃবৃন্দকে নিজ বাড়ীতে দাওয়াত করে খাওয়ান। খানাপিনা শেষে নেতারা সবাই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে আলোচনা করতে লাগল। কেউ বলল, উনি জাদুকর, কেউ বলল, ভবিষ্যদ্বক্তা, কেউ বলল, কবি। কেউ বলল, উনি জাদুকর নন; তবে তার মধ্যে জাদু আছে, যা অন্যের উপরে আছর করে থাকে। অবশেষে সকলে শেষোক্ত কথাটির উপরেই একমত হ’ল। এই মন্তব্যগুলি নবীর কানে পৌঁছে গেলে তিনি খুবই দুঃখিত হন ও মাথা নীচু করে চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে থাকেন। তখন পরপর উপরোক্ত সাতটি আয়াত নাযিল হয় (ত্বাবারাণী, ইবনু কাছীর)।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, একদিন তিনি রাস্তায় চলা অবস্থায় হঠাৎ গায়েবী আওয়ায শুনে আসমানে জিব্রীল ফেরেশতাকে দেখেই চিনতে পারেন ও ভয়ে মাটিতে বসে পড়েন। অতঃপর বাড়ীতে এসে দ্রুত চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় উক্ত আয়াতগুলি নাযিল হয়।[1]
নাযিলের সময়কাল :
সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআনের সূরা আলাক্ব-এর প্রথম পাঁচটি আয়াত নাযিল হয়। তারপর দীর্ঘ আড়াই অথবা তিন বছর যাবৎ কোন আয়াত নাযিল হয়নি (আর-রাহীক্ব ৬৯ পৃ.)। অতঃপর প্রথম এই সূরা নাযিল হয়। এরপর থেকে অহি নাযিলের ধারা অব্যাহত থাকে। এভাবে সূরা আলাক্ব-এর মাধ্যমে নবুঅতের সূচনা হয় এবং দীর্ঘ বিরতির পর সূরা মুদ্দাছছির-এর মাধ্যমে রিসালাতের অবতরণ ধারা শুরু হয়।
সংক্ষিপ্ত তাফসীর :
সমাজের মানুষ সাধারণতঃ পরিবেশের অনুসারী হয়ে থাকে। ফলে একটি নোংরা সমাজে জন্মগ্রহণকারী নিষ্পাপ শিশুটিও পরে সামাজিক পরিবেশের শিকার হয়ে মানুষ নামের অযোগ্য হয়ে পড়ে। অধঃপতনের অতল তলে তলায়মান ঐ সমাজটিকে ফিরিয়ে আনার জন্য অথবা অন্ততঃ থমকিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন এমন কিছু মানুষের যাঁরা গতানুগতিকতাকে ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াবেন ও পুরো সমাজকে তার আহবানের দিকে ফিরিয়ে আনবেন। রেওয়াজপন্থী অলস নেতারা চিরকাল এগুলির বিরোধিতা করে থাকেন। ফলে জিহাদ অপরিহার্য হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে নিঃস্বার্থ সংস্কারবাদীরা অবশেষে জয়ী হয়। পুরানো সমাজ ভেঙ্গে নতুন সমাজ গড়ে ওঠে।
আরব উপদ্বীপ ও তৎকালীন বিশ্বে যে অমানবিকতা ও চরম জাহেলিয়াত বিরাজ করছিল, তা সকলেরই জানা আছে। সেই প্রচলিত জাহেলিয়াতকেই সে যুগের লোকেরা তাদের কপালের লিখন বলে ধরে নিয়েছিল। কোনরূপ পরিবর্তনের আওয়াযকে তারা ভয় পেত। মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ সেই সমাজেরই নেতৃস্থানীয় কুরায়েশ বংশের সর্দারের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু কি করবেন সে পথও জানতেন না। সমাজের দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থার পরিবর্তন চিন্তায় ব্যাকুল মুহাম্মাদ হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় একদিন হঠাৎ জিবরীল ফেরেশতা মারফত ‘অহি’ পেলেন ‘ইক্বরা’- ‘তুমি পড় তোমার প্রভুর নামে’। পাঁচটি আয়াত শুনিয়ে ফেরেশতা চলে গেলেন। ভীত-বিহবল ও ব্যাকুল মুহাম্মাদ (ছাঃ) চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে দীর্ঘ আড়াই-তিনটি বছর অতিবাহিত করলেন। জাদুকর, কবি, পাগল, ভূতেধরা ইত্যাদি হরেক রকমের টিটকারি হযম করে সমাজের এক কোণে জড়সড় হয়ে কোন মতে বেঁচে রইলেন। হঠাৎ তিনি একদিন রাস্তায় চলা অবস্থায় গায়েবী আওয়ায শুনে চমকে উঠলেন। কিন্তু কই! কিছুই তো দেখিনা। ডাইনে-বামে সামনে-পিছনে, না কোথাও কেউ নেই। আবার সেই আওয়ায। আবার, চারপাশে দেখলেন। না কিছুই নেই। আবার সেই আওয়ায...। এবার তিনি উপরের দিকে তাকালেন। দেখলেন তিন বছর পূর্বের সেই ফেরেশতা আসমানে স্বীয় আসনে সমাসীন অবস্থায় আছেন। প্রচন্ডভাবে ভীত মুহাম্মাদ দ্রুত বাড়ী এসে খাদীজাকে বললেন, আমাকে চাদর মুড়ি দাও, চাদর মুড়ি দাও। আমার মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালো’। এরপরেই নাযিল হ’ল ‘ইয়া আইয়ুহাল মুদ্দাছ্ছির... হে চাদরাবৃত! ওঠ! সতর্ক কর...।[2]
কুসংস্কারের গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজকে মানবতার আলোকোজ্জ্বল রাজপথে জমায়েত করার জন্য চিন্তামগ্ন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ উঠে দাঁড়ালেন। নতুন পথের দিশা পেয়ে আশায় বুক বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সমাজ সংস্কারের দুরূহ পথে। কিন্তু একজন সমাজ সংস্কারকের জন্য এবং একজন বিশ্ব সংস্কারকের জন্য কি কি গুণাবলী প্রয়োজন?
উপরোক্ত আয়াতগুলিতে সেকথাই ব্যক্ত করা হয়েছে। এই অনন্য গুণগুলি আগে থেকেই মুহাম্মাদী সত্তার মধ্যে আল্লাহ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। অহি-র মাধ্যমে সেগুলিকে একত্রিত করে নির্দেশ দেওয়া হ’ল মাত্র। অতঃপর সমন্বিত গুণাবলীকে তিনি বাস্তবে প্রয়োগ শুরু করলেন। কিন্তু বড় কঠিন সে পথ...।
আয়াতগুলির প্রথমটিতে নবীকে উঠে দাঁড়াতে বলা হয়েছে অর্থাৎ সংস্কারকের জন্য অলসতার সুযোগ নেই। তার দেহ-মনকে সর্বদা সতর্ক ও সচল রাখতে হবে। দেহ কোন সময় অলস হয়ে পড়লেও চিন্তা ধারাকে সর্বদা সতর্ক প্রহরীর মত চাঙ্গা রাখতে হবে। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে তাঁকে এগোতে হবে। রাস্তায় চলতে গিয়ে হ্যোঁচট খেয়ে পড়লেও কিংবা বসে বিশ্রাম নিলেও তাঁকে লক্ষ্য ঠিক রাখতে হবে এবং ধীরে হৌক বা দ্রুত হউক, সেই লক্ষ্য পথেই তাঁকে এগোতে হবে। সমাজকেও সে পথে আহবান করতে হবে।
এক্ষণে তাঁর আহবান কোন দিকে হবে ও তাঁর পদ্ধতি কি হবে? জওয়াব হ’ল এই যে, তাঁর আহবান হবে আল্লাহর দিকে (ক্বাছাছ ২৮/৮৭) এবং পদ্ধতি হবে জান্নাতের সুসংবাদ শুনানো ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন করা (আন‘আম ৬/৪৮)। বর্তমান আয়াতে শুধুমাত্র ভয় প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে। কেননা একজন বিপথগামী মানুষকে প্রথমেই তার ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিতে হবে। তারপরে সঠিক পথে চলার পুরস্কার সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। অন্যান্য আয়াতে জান্নাতের সুসংবাদকে আগে আনা হয়েছে। কেননা তখন ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে গেছে। তাই জনগণকে ভীত-সন্ত্রস্ত করার আগে সুসংবাদের মাধ্যমে আশ্বস্ত ও আকৃষ্ট করার পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। অত্র আয়াত যেহেতু জগদ্বাসীর জন্য অবতীর্ণ প্রথম আয়াত সমূহের অন্তর্ভুক্ত, সেকারণ এখানে বিপথগামী লোকগুলিকে প্রথমেই জাহান্নাম থেকে হুঁশিয়ার করে থমকে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন সাক্ষাত বিপদ হ’তে কাউকে বাঁচানোর জন্য প্রথমেই তাকে বিপদ থেকে হুঁশিয়ার করতে হয়।
জনগণকে সঠিক পথে আহবানের আরেকটি সুন্দর পদ্ধতি এখানে অনুসৃত হয়েছে। রাসূল (ছাঃ)-কে সরাসরি নাম ধরে সম্বোধন না করে ‘চাদরাবৃত’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। যেমনمُلاَطَفَةٌ فِي الْخِطَابِ مِنَ الْكَرِيمِ إِلَى الْحَبِيبِ- ‘কোন বন্ধু তার বন্ধুকে মহববতের সাথে ডেকে থাকে’ (কুরতুবী)। এখানে রাসূল (ছাঃ)-কে চাদরাবৃত বলে সম্বোধন করার মধ্যে একটি স্নেহরস ও মমত্ববোধ প্রকাশ করে সংস্কারকদের বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, তোমরা বিপথগামী জনগণকে ঘৃণা না করে মহববতের সুরে আহবান করবে। তোমার দরদমাখা আহবান যেন তার হৃদয় স্পর্শ করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যিন্দেগীতে আমরা এর অনেকগুলি দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। যেমন একবার হযরত আলী (রাঃ) স্ত্রী ফাতেমা (রাঃ)-এর সাথে রাগ করে মসজিদে এসে ঘুমিয়ে পড়েন। ধুলায় লুটানো ঘুমন্ত জামাতা আলীকে স্নেহাপ্লুত কণ্ঠে সম্বোধন করে রাসূল (ছাঃ) বলেন, قُمْ أَبَا التُّرَابِ- ‘ওঠো হে মাটির বাপ’! (মুসলিম হা/২৪০৯)। খন্দক যুদ্ধের বিভীষিকাময় রজনীতে কষ্টক্লান্ত ছাহাবী হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) এক সময় কাতর হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। সেনাপতি নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাকে আদর করে ডাকেন, قُمْ يَا نَوْمَانُ ‘ওঠো হে ঘুমের রাজা’! (মুসলিম হা/১৭৮৮; কুরতুবী)। এইভাবে অত্র সূরার ১ম ও ২য় আয়াতে স্নেহমাখা আহবান, অলসতার চাদর ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ানোর নির্দেশ এবং জাহান্নামের দিকে ধাবমান মানবতাকে ভয় প্রদর্শনের দায়িত্ব প্রদান মোট তিনটি বিষয়কে একত্রিত করে পেশ করা হয়েছে।
وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ- ‘আর তোমার পালনকর্তার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর’। পূর্ববর্তী আয়াতের উপরে عَطْفُ হয়েছে। অর্থাৎ قُمْ فَأَنْذِرْ وَقُمْ فَكَبِّرْ رَبَّكَ অর্থাৎ ‘দাঁড়াও ভয় দেখাও এবং দাঁড়াও তোমার প্রভুর মাহাত্ম্য ঘোষণা কর’। এখানে فَاءٌ ‘অতিরিক্ত’ অথবা جواب جزاء হিসাবে এসেছে (কুরতুবী)।
‘তাকবীর’ বলতে সাধারণভাবে ছালাতের তাকবীরসহ সকল প্রকারের মাহাত্ম্য ও বড়ত্ব ঘোষণা বুঝানো হ’লেও মূলতঃ এখানে সকল প্রকারের ইলাহ হ’তে মুখ ফিরিয়ে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য স্বীয় হৃদয়কে খালেছ ও নিরংকুশ করা ও তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করার আহবান জানানো হয়েছে। এর দ্বারা সকল সমাজ সংস্কারক মুমিনকে বলে দেওয়া হচ্ছে যে, অন্য কারো প্রদত্ত নীতি-আদর্শ নয় বরং আল্লাহ প্রদত্ত অহি-র বিধান ও রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত নীতি-আদর্শকেই চূড়ান্ত হিসাবে মনে প্রাণে গ্রহণ করতে হবে এবং তাকেই চূড়ান্ত সত্যের মানদন্ড হিসাবে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করতে হবে। মুমিনের বক্তব্য, তার লেখনী, তার জান-মাল, তার চিন্তা-চেতনা ও চেষ্টা-সাধনা সবকিছুকে আল্লাহর বড়ত্ব ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যই ব্যয় করতে হবে। মুখে ‘নারায়ে তাকবীর’ ও বাস্তবে অন্যের আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম প্রকাশ্য মুনাফেকীর নামান্তর।
وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ- ‘তোমার পোশাক পবিত্র কর’। এখানে পোষাক অর্থ আমল, আচরণ, অন্তঃকরন ইত্যাদি। অর্থাৎ عَمَلَكَ فَأَصْلِحْ ‘তোমার আমল-আচরণ সংশোধন করে নাও’। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ)-কে এক ব্যক্তি এই আয়াতের অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, গোনাহ ও বিশ্বাসঘাতকতার দ্বারা নিজেকে কালিমা লিপ্ত করো না। অর্থাৎ নিজেকে পাপমুক্ত রাখো। খ্যাতনামা তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (৩৩-১১০ হি.) বলেন, এর অর্থ হ’ল কাপড় পরিষ্কার করা। কেননা মুশরিকরা কাপড় পরিষ্কার করত না। সেকারণ আল্লাহ তাদেরকে সর্বদা পরিচ্ছন্ন পোষাক পড়তে নির্দেশ দেন। ইমাম ইবনু জারীর ত্বাবারী (২২৪-৩১০ হি.) এ ব্যাখ্যাটি পসন্দ করেছেন। মূলতঃ অত্র আয়াতটিতে রাসূল (ছাঃ)-কে ভিতর-বাহির প্রকাশ্য-গোপন সকল দিকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হওয়ার বিশেষ নির্দেশ দান করা হয়েছে।
وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ- ‘নাপাকী বর্জন কর’। وَالرُّجْزَ ‘রা’ পেশ দিয়ে পড়লে অর্থ হবে প্রতিমা, যের দিয়ে পড়লে গোনাহ ও অপবিত্রতা এবং যবর দিয়ে পড়লে অর্থ হবে ধমকি বা দুঃসংবাদ (কুরতুবী)। এখানে প্রথম দু’টি অর্থই প্রযোজ্য। পূর্বের আয়াতে পবিত্র হওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পরপরই অত্র আয়াতে শিরক ও অন্যান্য যাবতীয় অপবিত্রতা হ’তে বিরত থাকার নির্দেশ দান করা হয়েছে।
وَلاَ تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ- ‘অধিক পাওয়ার আশায় কাউকে দান করো না’। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) বর্ণিত এই অর্থটিই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। যেকোন মহৎ লোকের জন্য এই গুণটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবুঅতের সুমহান মর্যাদার বিনিময়ে রাসূল (ছাঃ) যেন কারো নিকটে কিছু কামনা না করেন, সে বিষয়ে তাঁকে হুঁশিয়ার করা হয়েছে অত্র আয়াতে। অনুরূপভাবে কাউকে কিছু উপকার করলে তার প্রতিদান কেবল আল্লাহর কাছ থেকেই কামনা করতে হবে। তার বিনিময়ে কিছু বেশী পাওয়ার আশা কোন মানুষের নিকটে করা যাবে না। কিংবা উপকারের ফলে কাউকে খোটা দেওয়া চলবে না। এর ফলে যাবতীয় নেকী বরবাদ হয়ে যাবে। যেমন আল্লাহপাক অন্যত্র বলেন,لاَ تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالْأَذَى، ‘খোটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমরা তোমাদের দানগুলিকে বিনষ্ট করো না’ (বাক্বারাহ ২/২৬৪)।
وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ- ‘আর তোমার প্রতিপালকের সন্তুষ্টির জন্য ছবর কর’। صَبْرٌ অর্থ টিকে থাকা, ধৈর্য ধারণ করা। এখানে তিন প্রকার ছবর-এর সব কয়টিই প্রযোজ্য হ’তে পারে। অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতে টিকে থাকা, বিপদ ও মুছীবতে ধৈর্য ধরা, হারাম ও কবীরা গোনাহ হ’তে বিরত থাকা। এর মধ্যে প্রথমটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ নবীকে পূর্বে বর্ণিত গুণগুলি পূর্ণভাবে অর্জন ও নবুঅতের গুরুদায়িত্ব পালন করতে গেলে জনগণের পক্ষ হ’তে বিভিন্ন রূপী কষ্ট ও মুছীবতের সম্মুখীন হ’তে হবে। সেই সকল বিপদে ধৈর্য ধারন করে নবুঅতের মিশনকে সম্মুখে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে নবীকে আগেই হুঁশিয়ার করে দেওয়া হ’ল। স্মরণ করা যেতে পারে যে, প্রথম জিব্রীলের আগমনের পরে খাদীজার চাচাতো ভাই ইহূদী পন্ডিত অরাক্বা বিন নওফেল রাসূল (ছাঃ)-কে বলেছিলেন, যেদিন তোমার কওম তোমাকে বহিস্কার করবে, যদি সেদিন আমি বেঁচে থাকি, তবে আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব। কেননা ‘তুমি যে দাওয়াত নিয়ে এসেছ এই দাওয়াত নিয়ে ইতিপূর্বে যিনিই এসেছেন, তিনিই বিরোধীদের দুশমনীর সম্মুখীন হয়েছেন’।[3]
উপসংহার :
উপরে বর্ণিত সাতটি আয়াতের আলোকে সমাজ সংস্কারক মুমিনদের জন্য আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলিকে অপরিহার্য গুণ হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি।
(১) তাকে সর্বদা সক্রিয় থাকতে হবে। অলস হওয়া চলবে না।
(২) জাহান্নামের ভয় ও জান্নাতের সুসংবাদ শুনাতে হবে।
(৩) জীবনের সকল দিক ও বিভাগে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ঘোষণা ও তার প্রেরিত অহি-র বিধানকে চূড়ান্ত সত্য হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।
(৪) ভিতর ও বাইরে পবিত্র হ’তে হবে।
(৫) গোপন ও প্রকাশ্য সর্ব প্রকারের অশ্লীলতা ও অপবিত্রতা হ’তে দূরে থাকতে হবে।
(৬) সকল ধরণের উপকার রিয়ামুক্ত ও নিঃস্বার্থ হ’তে হবে।
(৭) কষ্ট ও মুছীবতে ছবর করতে হবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে দৃঢ় থাকতে হবে।
অতএব আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ ‘অহি’ ভিত্তিক শান্তিময় সমাজ কায়েমের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হে হাদীছপন্থী বিদ্বান, মুরববী, যুবক, মা-বোন ও ছোট্ট সোনামণিরা!
উঠে দাঁড়াও! অলসতার চাদর ছুঁড়ে ফেল। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ঝান্ডা হাতে নিয়ে এগিয়ে চল। তুচ্ছ দুনিয়াবী স্বার্থ ও ভোগ-বিলাসের মায়া ছাড়। অলসদের উপরে মুজাহিদগণের সম্মান আল্লাহ বৃদ্ধি করেছেন (নিসা ৪/৯৫)।
ঐ দেখ! জান্নাত যে তোমায় ডাকছে বারবার হাতছানি দিয়ে। নীল-সিয়াহ আসমানের দিকে একবার তাকিয়ে দেখ...। আর দেরী নয়, উঠে দাঁড়াও! দাওয়াত ও জিহাদের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়![4]
[1]. বুখারী হা/৪৯২৬; মুসলিম হা/১৬১; মিশকাত হা/৫৮৪৩, রাবী জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ)।
[2]. বুখারী হা/৪৯২২; মিশকাত হা/৫৮৫১; কুরতুবী।
[3]. বুখারী হা/৬৯৮২; মুসলিম হা/১৬০; মিশকাত হা/৫৮৪১, রাবী আয়েশা (রাঃ)।
[4]. মাসিক আত-তাহরীক (রাজশাহী), দরসে কুরআন, ১/৩ সংখ্যা, নভেম্বর ১৯৯৭।