এক সময়ের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র আরাকান বর্তমানে মিয়ানমারের একটি প্রদেশ। এর উত্তর-পশ্চিমে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, উত্তর-পূর্বে মিয়ানমারের চিন রাজ্যের পাহাড় যা আরাকানকে মিয়ানমারের মূল ভূখন্ড থেকে পৃথক করেছে। পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ পানিরাশি এবং পূর্বে সুদীর্ঘ ও দুর্গম ইয়োমা পর্বতমালা আরাকানকে মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন করে অভেদ্য প্রাকৃতিক দুর্গ হিসাবে রক্ষা করেছে। ভৌগলিকভাবে মিয়ানমারের সাথে আরাকান বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে ইতিহাসের পাতায় স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বাতন্ত্র ও গৌরবময় মর্যাদার অধিকারী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে।

আরাকানের সাথে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ভৌগলিক এবং ঐতিহাসিক সম্পর্ক বিদ্যমান। বঙ্গোপসাগরের বর্ধিত অংশ নাফ নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তে, বার্মা সীমান্তে প্রবাহিত হয়ে কক্সবাজার যেলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণ দিয়ে সাগরে মিলিত হয়। এই নদীর ডান তীরে টেকনাফ এবং বাম তীরে আরাকান প্রদেশের আকিয়াব বন্দর অবস্থিত। নাফ নদী কার্যত আরাকান থেকে কক্সবাজার যেলাকে বিভক্ত করেছে। চট্টগ্রাম ও আরাকান বর্তমানে ভিন্ন দুটি দেশের অংশ হ’লেও প্রাচীনকালে চট্টগ্রাম আরাকানের শাসনাধীন ছিল। খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতক পর্যন্ত চট্টগ্রাম-আরাকান একটি অখন্ড রাজ্য হিসেবে চন্দ্রসূর্য বংশ কর্তৃক শাসিত হয়। অতঃপর ষষ্ঠ শতকে চট্টগ্রাম অঞ্চল আরাকান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সমতটের খড়গ রাজবংশের শাসনাধীনে চলে যায়। দীর্ঘ ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের পরে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৬ সালে মাত্র ৩৬ ঘণ্টার ব্যবধানে চট্টগ্রাম বিজয় করেন।[1]

চট্টগ্রাম ও আরাকানে ইসলামের আগমন ইতিহাস পরস্পরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। ঠিক কখন এই দুই অঞ্চলে ইসলাম প্রবেশ করে তার সঠিক সময় নিরূপণ করা কোন ঐতিহাসিকের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে ঐতিহাসিক বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে, চট্টগ্রাম ও আরাকানের আকিয়াব বন্দরে আরবীয় বণিকগণ ব্যবসার উদ্দেশ্যে নোঙ্গর করত। ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই এই উপকূলীয় অঞ্চলে আরব বণিকদের বাণিজ্যিক ও দাওয়াতী তৎপরতা ছিল। ফলে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর বলতে গেলে আরব হরদে পরিণত হয়েছিল।[2] অনেক আরব বণিক ব্যবসার উদ্দেশ্যে এসে উপকূলীয় অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। তাদের দাওয়াতেই এতদ্বাঞ্চলে ইসলাম সম্প্রসারিত হয়।

ড. মুহাম্মাদ ইউনুস লিখেছেন, ‘বাংলার মূল ভূখন্ডে ইসলাম আসার ৫০০ বছর পূর্বে চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল ও আরাকানে ইসলাম প্রবেশ করে’।[3] সে হিসেবে ধারণা করা যায় যে, ৭ম শতকে ছাহাবায়ে কেরামের সোনালী যুগে আরাকানে ইসলাম প্রবেশ করে। এছাড়াও একটি দুর্বল হাদীছের ভিত্তিতে অনেকেই বলতে চেয়েছেন যে, রাসূল (ছাঃ)-এর যামানাতেই আরাকানে ইসলাম প্রবেশ করে।

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছটিতে রয়েছে যে, ‘হিন্দুস্তানের রাজা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য এক কলস আদা উপঢৌকন হিসাবে পাঠিয়েছিলেন। যা তিনি এক টুকরা করে খেতে ছাহাবীগণের মধ্যে বণ্টন করে দেন’।[4] এই হাদীছের ব্যাখ্যায় উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম কাযী আতহার মুবারকপুরী (১৯১৬-১৯৯৬ খৃ.) বলেন, ‘সম্ভবত হিজরতের পর যখন ইসলাম সর্বত্র প্রচারিত হচ্ছিল এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে তাঁর প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন ভারতীয় কোন রাজার পক্ষ থেকে এই উপহার পাঠানো হয়। বাংলার ‘রাহ্মী’ (رهمي) বংশীয় রাজাগণ প্রাচীনকাল থেকেই ইরানের রাজাদের কাছে মূল্যবান উপহার সামগ্রী পাঠাতেন। তাই ধারণা করা যায় এই বংশের কোন রাজা হয়তো নবীজীর সেবায় এই উপহার পাঠিয়েছিলেন’।[5] ঐতিহাসিক তথ্য মতে, যেহেতু ১২০৪ সালে ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজীর (১১৫০ -১২০৬ খৃ.) বাংলা বিজয়ের পূর্বে বাংলার মূল ভূখন্ডে ইসলাম বিস্তার লাভ করেনি সেহেতু ধারণা করা যায় যে, হিন্দুস্তানের রাহ্মী রাজা হয়তো অখন্ড চট্টগ্রাম-আরাকানের কোন অঞ্চলে রাজত্ব করতেন।

মূলত ৮ম শতাব্দী থেকে আরাকানের উপকূলীয় অঞ্চলে আরব মুসলিমদের বসতির ঘন ঘন উল্লেখ পাওয়া যায়। মুসলিম বণিক ও নাবিকরা মিসর ও মাদাগাস্কার থেকে চীন পর্যন্ত পূর্ব সাগরে ছড়িয়ে পড়ে এবং সুবিধাজনক স্থানে বাণিজ্যিক বসতি স্থাপন করে, তখন বার্মার উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতেও বসতি স্থাপিত হয়।[6] আরাকানের চন্দ্র-সূর্য বংশের প্রথম রাজা মহৎ ইঙ্গ চন্দ্র (৭৮৮-৮১০ খৃ.)-এর উদারতার কারণে মুসলমানরা ইসলাম প্রচারের ব্যাপক সুযোগ পায়। এ রাজার শাসনামলেই কয়েকটি বাণিজ্যবহর ‘রামব্রী’ দ্বীপের পাশে বিধ্বস্ত হ’লে জাহাযের আরোহীরা ‘রহম’ (رحم) বা দয়া বলে চিৎকার করতে থাকে। এ সময় স্থানীয় লোকজন তাদেরকে উদ্ধার করে রাজার কাছে নিয়ে যায়। রাজা তাদের বুদ্ধিমত্তা ও উন্নত আচরণে মুগ্ধ হয়ে আরাকানেই স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি প্রদান করেন। ফলে তারা সেখানে দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে।[7]

বসবাসের অনুমতি পেয়ে তারা এ স্থানটিকে ‘রহম বর্রী’ (رحمة بري) বা করুণার ভূমি নামে অভিহিত করেন। আরব ভূগোলবিদদের ৯ম ও ১০ম শতাব্দীতে উল্লিখিত ‘জাযিরাতুর রাহমী’ (جزيرة الرحمي) সম্ভবত সেই রাজ্যকেই নির্দেশ করে। রহম শব্দটি এখনো বার্মিজ ভাষায় ‘রামব্রে’ এবং ইংরেজীতে ‘রামব্রী’ রূপে প্রচলিত। পরবর্তীতে এটি রোয়াং/রোহাং/রোসাঙ্গ নামে পরিচিত হয়।[8] আর সেই প্রাচীন রোসাঙ্গ অঞ্চলের বাসিন্দাদেরই বিশ্বব্যাপী পরিচিত ও নির্যাতিত রোহিঙ্গা জাতি বলা হয়। আরাকানে মুসলমানদের সংখ্যা এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৫ সালে বার্মাদের আক্রমণের আগ পর্যন্ত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আরাকান সাড়ে তিনশ’ বছরের অধিক কাল যাবৎ একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল।[9] বড়ই পরিতাপের বিষয় হ’ল, আজ সেই আরাকানী রোহিঙ্গারা শুধুমাত্র মুসলিম হওয়ার কারণে নিগৃহীত, নিষ্পেষিত ও উদ্বাস্ত্ত শরণার্থী।

মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ

শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী


[1].ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ, আরাকানের মুসলমানদের ইতিহাস (চট্টগ্রাম-ঢাকা : বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ, মে ২০১৯), পৃ. ২৯-৩০, ৪৩।

[2]. সৈয়দ আমীরুল ইসলাম, বাংলাদেশ ও ইসলাম : ইতিহাসের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা (ঢাকা : সাহিত্যিকা প্রকাশনী, অক্টোবর ১৯৯৯), পৃ. ২১।

[3]. Dr. Mohammad Yunus, A History of Arakan past & Present (Chittagong : Magenta Colour, First Published 1994), P. 1

[4]. হাকেম হা/৭১৯০, সনদ দুর্বল।

[5]. কাযী আতহার মুবারকপুরী, আরব ওয়া হিন্দ আহদে রিসালাত মেঁ (লাহোর : তাখলিকাত প্রকাশনী, ২০০৪), পৃ. ১৪৮।

[6]. Mohammad Ashraf Alam, A Short Historical Background of Arakan (Chittagong : Arakan Historical Society, December 1999), P. 8

[7].আরাকানের মুসলমানদের ইতিহাস, পৃ. ৩৫।

[8]. A History of Arakan past & Present, P. 7.

[9]. A Short Historical Background of Arakan, P. 11






আরও
আরও
.