শুরুর কথা : মানব সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই মানুষের চিন্তা-চেতনা ভিন্ন রকম। ব্যক্তির জেনেটিক কোড যেমন ভিন্ন ঠিক তেমনি চিন্তা-চেতনার সাদৃশ্য থাকলেও তা হয়তো পুরোপুরি মেলে না। প্রত্যেক মানুষই, হোক সে শিক্ষিত কিংবা মূর্খ, স্ব স্ব দিনলিপি রচনা করে স্বীয় চেতনায়। ডায়েরী লিখা সেই চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। কলম ধরতে শেখার বয়স থেকে কেউ কেউ আমৃত্যু সেই অভ্যাস পালন করে থাকে। কেউ তা করে না। কিন্তু নিজের দৈনিক কার্যাবলী ঠিকই নিজেদের চেতনায় ছাপিয়ে তোলে। একজন কবি ছন্দবদ্ধ ভাষায়, সাহিত্যিক সৌকর্যমন্ডিত নিপুণ বাক্যশৈলীতে, শিক্ষক গভীর জ্ঞানতাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণে, ব্যবসায়ী লাভ-লোকসানের গাণিতিক হিসাবে আর দিন এনে দিন খাওয়া লোকেরা চকচকে দু’টো দুনিয়াবী নোটের দিনলিপি হৃদয় অঙ্গনে ঠিকই রচনা করে। দিনলিপি কালিবদ্ধ হ’তে হবে এমন নির্দেশনা নয়। একজন মুখলেছ তাক্বওয়াশীল ব্যক্তির দিনলিপি হয় খানিকটা ভিন্নতর। আদর্শ চিন্তা-চেতনায় তাঁদের হৃদয় যেমন পরিপূর্ণ থাকে ঠিক তেমনি সমাজ সংস্কারে তাদের পদচিহ্ন বেশ স্পষ্টতই চোখে পড়ে। আজ আমরা দেখব দু’টি দিনলিপি।
আজ আমরা সাহিত্যাঙ্গনের বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে দেখব দু’প্রান্তের দু’জন ব্যক্তির, দু’ধরণের মন-মানসিকতা এবং দু’ধরনর সংস্কৃতির কিছু শব্দচিত্র এবং বাক্যের চলন্ত বিন্যাস। দিন শেষে দু’টি দিনলিপিতে ফুটে উঠবে বর্তমান যামানায় ‘নববর্ষ’ এবং ‘বর্ষবরণ’ সংস্কৃতি নিয়ে আমার কিছু চিন্তা-ভাবনা; কিছু বাকস্বাধীন সুষ্ঠু চেতনা। মুক্ত কলামে রচিত হবে অপসংস্কৃতি দূরীকরণের শব্দে অাঁকা প্রচেষ্টা।
দৃশ্যপট- ১ : মুনতাহিম ঊনিশের ঘরে পা দেওয়া দেশের স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠের একজন জ্ঞানসন্ধিৎসু ছাত্র। চুল কাটানোর ধরণ দেখে তার ধর্ম ঠাহর করা বেশ মুশকিল। চেহারাবয়ব মরুভূমির মত, নববী সুন্নাত দাঁড়ির ছিটাফোঁটা তাতে নেই। নববর্ষের রঙ্গোৎসবে রং মেখে তার সমগ্র দেহের কি হাল তা বর্ণনা করতে চাই না, কারণ আমাদের কলমের পবিত্র কালি সে বর্ণনা দিতে অপারগ।
ভোর তখন চারটা বেজে সাতাশ মিনিট। ডিসেম্বরের শেষ দিন। বৎসরেরও শেষ দিন বটে। মাত্র নববর্ষের বর্ণাঢ্য রাত্রি শেষ করে সে ঘরে ফিরেছে। স্বভাববশতই টেবিলে বসে তার পেটমোটা ডায়েরীটা বের করেছে। আজ সারাদিন বেশ কেটেছে তার। এমন দিনের রোজনামচা না লিখলেই নয়। অপসংস্কৃতিকে সুশীল সংস্কৃতি জ্ঞান করে তার পেছনে সারাদিন এবং সারা রাত্রি, বিশেষত মহান প্রভুর প্রথম আসমানে নেমে আসার সময় অবধি পাপাচারে লিপ্ত থেকে সে আজ বড্ড ক্লান্ত। কোনমতে ফ্রেশ হয়েই টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে বসেছে সে আজকের স্মৃতি রোমন্থন করতে। চলুন পাঠক! সুশীল সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর আবিষ্কৃত অপসংস্কৃতিতে মত্ত একজন যুবকের রোজনামচায় তবে উঁকি মেরে দেখা যাক, কি লিখছে সে! ডায়েরীর নীল দাগ কাটা সাদা সাদা পৃষ্ঠায় মুনতাহিম দ্রুতবেগে ঘুরিয়ে চলেছে তার কলম। পৃষ্ঠার সাথে কলমের ঘর্ষণে উৎপন্ন শব্দ ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দ ছাপিয়ে মুনতাহিমের হৃদয়ে জাগিয়ে তুলেছ নববর্ষের প্রতি এক মোহনীয় মায়া।
ডিসেম্বর ৩১, ২০২৪; রাত ৪ : ২৭ মিনিট।
শুভ নববর্ষ। এই দিনের অপেক্ষাতে আমরা চাতকের মতো চেয়ে থাকি দীর্ঘ বয়সের ভারে নুইয়ে যাওয়া বর্ষপঞ্জিকার শেষ পাতায়। অবশেষে তুমি এলে হে প্রিয় নববর্ষ! আজ এ দিনটির কথা বিশেষভাবে না লিখলেই নয়। আয়োজনের বিলাসিতা, খাদ্যের প্রাচুর্য, প্রেয়সীর উপস্থিতি এবং নানাবিধ আয়োজন ও শিল্পীদের মন-মাতানো গান যেন হৃদয়ে দোলা দেয়। একে একে সবই চলবে হে ডায়েরী! চুপচাপ শ্রোতার মতো গল্পের স্বাদে সবটুকু কালি শুষে নাও। ক্যাম্পাসে আজ বেশ আনন্দ হ’ল। সকাল থেকেই সাজানো গোছানোর সমস্তটা সম্পন্ন করতে হয়েছিল। নববর্ষ তুমি আসবে বলে যেন আমরা নতুন উদ্যম পেয়েছিলাম। সাজানো শেষে ক্যাম্পাস চমৎকার দেখাচ্ছিল। বাহারী রকমের ফুল, সুশোভিত মরিচ বাতি এবং দামী সব পারফিউমের ব্যবহারে আয়োজন যেন ভিন্ন মাত্রা পায়। বিশেষত তিন ফুট দূরে দূরে জ্বালানো লণ্ঠনগুলির বিলাসী আলো রঙিন করে তুলেছিল মায়াময় ক্যাম্পাস। গত বছর সম্ভব না হ’লেও এ বছর দ্বিগুণ খরচে আমরা মোটাফোম বিশিষ্ট গদি-চেয়ার বসার ব্যবস্থা করেছিলাম। প্যান্ডেল ডেকোরেশনের কাজ অত্যন্ত মাধুর্যময় ছিল। বন্ধু রাফিদের হিসাবে প্যান্ডেল ডেকোরেশনেই শুধু লাখ টাকার বেশী লেগেছে।
খাবার কথা কি আর বলব? খাবার নয়, যেন অমৃত স্বাদ! কত আয়োজন। গোশত-রুটি, ভাত-পোলাও, সন্দেশ-ক্ষীর তার কোনটাই রাঁধতে বাকী রাখিনি আমরা। ভেজে রান্না করা ইলিশ মাছগুলির রং গোলাপী ছিল। চমৎকার স্বাদের মাত্রা বৃদ্ধি করেছিল শেষেরটুকু। শেষখানে আমরা নিজেরাই কিছু কোল্ড-ড্রিংকস পান করি। সেই অপূর্ব স্বাদ কি ভোলা যায়? লোভে পড়ে আমি শেষবার যদিও দ্বিগুণ গোশত-মাছ প্লেটে নিয়োছিলাম কিন্তু খেতে পারিনি। পরিস্কারকর্মীকে দিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি। শুধু আমিই নই, আমার অন্যান্য বন্ধুরাও একই কাজ করেছে। তারপর কি হ’ল? কনসার্ট শুরুর পূর্বেই কোথা থেকে দলবেধে সব বস্তির ছোকরাগুলি এসে ডাস্টবিন থেকে খেতে শুরু করল। আয়োজনের মাঝপথে সকলের মনটাই বিষিয়ে দিল। যদিও আমরা ওদেরকে শেষে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। যতসব ঝামেলা! একদিন তো এমন হ’তেই পারে, তাই না?
এরপর বাজি পোড়ানো শুরু হ’ল। আমি নিজেই তো হাযার তিনেক টাকার বাজি নববর্ষের শুভকামনায় পোড়ালাম। শুনলাম যারা বাজি পোড়াচ্ছে সেখানে নাকি এমন বাজি আছে যেগুলোর প্রতিটি পোড়াতেই গুনতে হবে পাঁচ থেকে সাতশত টাকা। বাজি পোড়ানোর সময় নববর্ষের মঙ্গল কামনায় আমরা প্রার্থনা করছিলাম। নববর্ষকে স্বাগত জানানোর জন্য সমবেত কণ্ঠে পাঠ করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের ‘এসো এসো হে...’ গানটি। এককথায় বহু স্মৃতি আমার হৃদয়ে জমা হয়েছে। ধীরে ধীরে সবটাই বলছি শোনো। এরপর এলো আরো জানার চুম্বকাংশ। সম্মিলিত নাচ এবং নববর্ষের গান। খোলা আকাশের নীচে শুরু হ’ল সবার কাঙ্খিত কনসার্ট। ক্লাসের ভালো সুরের দু’জন বন্ধু এবং দু’জন বান্ধবী পালা করে গান করছিল এবং আমরাও যেন মত্ত-উন্মাতাল হয়ে নাচছিলাম। সকলেই প্রায় পসন্দমতো জুটি করে নাচছিল, গাইছিল লাফালাফি করছিল। ছেলে-ছেলে, ছেলে-মেয়ে, মেয়ে-মেয়ে একসাথে নাচার দৃশ্যটাই আমাকে অন্যরকম লেগেছিল। বিশেষত বাজারে নতুন আসা পোষাক, যেগুলি বর্তমানে উচ্চতম স্থানে এবং দামে চড়া, প্রায় সবাই সেই ফ্যাশনেবল ড্রেসগুলি ক্রয় করেছিল। একই রকম ড্রেস এবং সাজ-সজ্জা নাচের অন্তর্মিলে বিশিষ্টতা দান করেছিল। বিভিন্ন রকমের প্রেমোচ্ছল এবং মহববতপূর্ণ উচ্চ বাজনার সংগীত আমাদেরকে পরস্পর নাচার ও বাহবা দেয়ার অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছিল। প্রতিটি গানের কথা যেন মন ছুঁয়ে দেয়। হৃদয়ে শিহরণ জাগায়। গান শেষে মাঠে বসে থেকে আমাদের খোশগল্প শুরু হ’ল। তারপর এইতো বারটা পনের মিনিট অবধি আমরা গোল হয়ে বসে বসে বিভিন্ন প্রকার আড্ডা দিলাম। একসাথে সকলে বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা চালাতে পারস্পরিক পরিচিতি এবং নারী-পুরুষ একে অপরের প্রতি জানাশোনা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ বৃদ্ধি পাবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দেয়ার কারণে আমাদের শরীরে ক্লান্তি ভর করেছিল। ছেলে-মেয়েরা অনেকে একা ফিরতে সাহস না করায় আমরা একে অপরকে তাদের রুম অবধি এগিয়ে দিলাম এবং নিজেরাও রুমে ফিরলাম।
আয়োজনের সবটাই যে আনন্দময় ছিল তা কিন্তু মোটেও নয়। গানের মাঝখানে কয়েকজন ছেলে-মেয়েকে দেখা গেল পড়ে যেতে। আমরা ক’জন ধরাধরি করে হাসপাতালে নিতেই কর্তব্যরত চিকিৎসক জানালেন অতিরিক্ত ড্রিংকস নেবার ফলে এবং উচ্চ আওয়াযে কনসার্ট সহ নাচার কারণে নাকি ওদের দেহে চাপ পড়েছে। এই বর্ণাঢ্য আয়োজনে এমনটা হওয়া বেদনাময় হ’লেও আমরা মনে প্রাণে এই বিশ্বাস লালন করি যে, ছোটখাট দুর্ঘটনা আয়োজনের সৌন্দর্য উপলব্ধিতে বিশেষ সহায়ক হয়। সবটা প্রকাশ করা যরূরী নয় হে ডায়েরী! আমরা আজ বিভিন্ন উপায়ে আয়োজনটি উপভোগ করেছি। থাক না কিছু গোপন কথা! যাই হোক, আজকের নববর্ষের আয়োজন অত্যন্ত সুখকর ও প্রীতিকর ছিল। সর্বাঙ্গ সাফল্যমন্ডিত হওয়ার ফলে আমরা এই নবাগত নতুন বছরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
আজ নবম-দশম শ্রেণীতে পাঠ করার দিনগুলি বিশেষভাবে হঠাৎ মনে পড়ল। কেন তা কেইবা জানে? হয়তোবা কবীর চৌধুরী রচিত ‘পহেলা বৈশাখ’ প্রবন্ধের নববর্ষের বোধটুকু চেতনায় জাগ্রত করার জন্যই। ইংরেজ কবির কবিতার নববর্ষের ভাব নিয়েই তো রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো!’ এখন সেই বৈশাখ না এলেও আমাদের জীবনে আসছে তো ২০২৫, সেই ২৫-ই ঘুচিয়ে দিক জীবনের জরা। রবীন্দ্রনাথের চেতনায় শুচি হৌক ধরা। যত প্রকার বাধা-বিপত্তি আছে, যত আনন্দের শেষে দীর্ঘ বেদনা আছে, তার সবটাই ফুরিয়ে যাক। নববর্ষ আমাদের জীবনে আসুক তার উজ্জ্বল মঙ্গল নিয়ে। নববর্ষ আমাদের অগ্নিস্নান করিয়ে এই পৃথিবীকে পবিত্র করে তুলুক। হে ডায়েরী! শেষটাতে তোমাকে আবারও বলে রাখি, নতুন বছর এসেছে ধরায়, অকল্যাণ দূরীভূত হৌক, কল্যাণ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনুক নতুন বছর। শুভ নববর্ষ ২০২৫।
মুনতাহিম ডায়েরী এই পর্যন্ত লিখেই সমাপ্তি টানে। এক বছরের সমাপ্তি শেষে যেন তার দেহ ক্লান্ত কিন্তু নতুন বর্ষের আগমনে হৃদয় প্রাণবন্ত। পেটমোটা ডায়েরীর শেষ পৃষ্ঠা অবধি লিখে সে ডায়েরীও শেষ করেছে। ডায়েরী বন্ধ করে একবার ডায়েরীটা বুকে চেপে ধরে। নতুন বছরে পদার্পণের আনন্দে আর একটি বছরের দুঃখ-সুখ গাঁথা স্মরণ করে তার দু’কপোল অশ্রুসজল হয়। মুনতাহিম বড্ড ক্লান্ত। যেন ঘুম মাত্র চোখ দু’টো বোজার অপেক্ষায় আছে। সারা রাতের আড্ডাক্লান্ত এবং নাচ-পরিশ্রান্ত দেহ যেন একটু ঘুমিয়ে নিতে চায় এ বেলায়। মুনতাহিম মনে মনে শুভ নববর্ষ পাঠ করে কয়েকবার। আনমনে সে স্মরণ করে নেয় তার পুরনো স্মৃতি। হৃদয়ের অন্তরালে একা একাই রোমন্থন করে যেন। তারপর বুকে চেপে রাখা ডায়েরীটা শেল্ফের উপরে ২০২৩ সালের ডায়েরীর সাথে রেখে দেয়। কাল থেকে নতুন ডায়েরীতে নব উদ্যমে শুরু হবে তার জীবনের পথচলা।
মুনতাহিমের যাবতীয় কর্মকান্ড শেষ করে যখন শুতে যাবার প্রাক্কালে টেবিল ল্যাম্পর মৃদু আলো নিভায়, ঘড়ির কাটা জানান দেয় তখন বাজে ভোর পাঁচটা। মুনতাহিম জানে মাত্র কিছুক্ষণ পরেই ফজরের আযান হবে, কিন্তু তার দেহে ও মনে ভর করে শয়তানী ওয়াসওয়াসা। যখন মুওয়াযযিন আযান শুরু করেন ‘আল্লাহু আকবর’... তখন মুনতাহিম গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকে। কেইবা জানে? কত মুনতাহিম এমন করেই শেষরাতে বাসায় ফিরেছে আজ! তারপর ডায়েরীতে স্মৃতি রোমন্থন শেষে ফজরের আযানের প্রাক্কালে ঘুমিয়ে গেছে। তারা নববর্ষের মঙ্গল কামনা করে এবং নববর্ষের কাছে মঙ্গল চায়, মহান প্রভুর কথা বেমা‘লূম ভুলে গিয়ে তলিয়ে যায় গভীর ঘুমের গহীন প্রান্তরে।
ফযরের আযান শেষ হয়, ইমামের সুললিত কণ্ঠে তেলাওয়াত শেষ হয়, নতুন বছরের সূর্য গৎবাঁধা নিয়মেই উদিত হয়। কিন্তু অপসংস্কৃতিতে ক্লান্ত এবং সুশীলদের সেবাদাস মুনতাহিমেরা ঘুমিয়েই থাকে। না তাদের দেহ জাগ্রত হয়, না তাদের চেতনা ও মন মনন জাগ্রত হয়। মুনতাহিমদের যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন দুপুর গড়িয়ে গোধূলি নেমে আসে পৃথিবীতে। চোখ মেলে ওরা গোধূলির সৌন্দর্য দেখায় ব্যস্ত থাকে। প্রভুর স্মরণ ভুলে যায়, মস্তিষ্ক নুয়ে আসে নফসে লাউয়ামার পদতলে।
দৃশ্যপট- ২ : আদীব জীবনের সতেরটি বসন্ত পেরিয়ে তারুণ্যের হেমন্তে পদচারণাকারী একজন খুদে সাহিত্যিক। কোমল, স্নিগ্ধ শান্ত তার মুখাবয়ব। চেহারায় যেন ফুটে উঠে সংস্কারমুখী চেতনার দীপ্তিমান আভা। নিত্যই সমাজের অপকীর্তি এবং অশ্লীল সংস্কৃতিকে শব্দের হাতুড়ীতে বিচূর্ণ করতে যেন তার এই পৃথিবীতে আসা। নিত্যই তার লেখায় ফুটে উঠে অশ্লীল সমাজের নববী সংস্কারের জ্যেৎস্নামাখা শব্দগাঁথা।
তখন নিশুতি রাত। বারটা পেরিয়ে চুয়াল্লিশ মিনিট। ঘুমিয়ে পড়েছিল আদীব। চারিদিকে অশ্লীলতার বাজিময় বিস্ফোরণের বিকট শব্দ তার ঘুম কেড়ে নিল যেন। চারিদিকে শুরু হয়েছে নববর্ষের বাজি পোড়ানো। আদীবের চিত্ত হঠাৎ শব্দের হাতুড়ী পেটানোর সংকল্পে দৃঢ় হ’ল। সে সিদ্ধান্ত নিল আজ নববর্ষের বোধ নিয়ে কিছু লিখা যাক! আদীব সোনালী হলুদ রঙ্গের ল্যম্প জ্বালিয়ে বসে গেল তার নড়বড়ে টেবিলে। বের করল বহুদিনের পুরনো ও বয়সের ভারে কভার চটে যাওয়া নোটবুক। কত-শত বোধ, কত-শত সাহিত্য আর অযুত-লক্ষ্য শব্দের মযবূত গাঁথুনি দেয়া যার প্রত্যেক পৃষ্ঠার পরতে পরতে।
বাম হাতের তালুতে তার মুখমন্ডল সমর্পিত করে একদৃষ্টে সোনালী হলুদ বাতির দিকে চেয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হ’ল। ধীরে ধীরে সোনালী-হলুদ আলো ঝাপসা লাগতে শুরু হ’ল। আদীব তার ডায়েরীর হলদেটে যমীনে ধাবমান অশ্বের মতো দ্রুতগতিতে ঘোরাতে শুরু করেছে তার কলম। রোজনামচা লিখছে সেও। কি লিখছে তাতে?
৩১শে ডিসেম্বর, রাত ১২:৫৬ : আজ আমার অন্তর বড়ই শোকার্ত এবং মস্তিস্ক চিন্তাক্লিষ্ট। বাইরে ক্রমাগত ফুটছে অপসংস্কৃতির রঙিন বাজি। এদিকে ঘরে বসে কেন থাকব চুপ? রাত-বিরাত হৌক, তবু কিছু সংস্কারমুখী চিন্তা-চেতনা তোমার সাথেই আলোচনা হৌক হে ডায়েরী! দুনিয়া যখন মেতেছে কুফুরীর রঙ্গোৎসবে তখন আমার মনোযোগী শ্রোতা পাওয়া দুষ্কর। তবে হয়েই যাক না তোমার সাথেই খানিক বোধগল্প!
দুনিয়াবী আয়োজনে ওদের প্রফুল্ল চিত্তের মত্ততা দেখো, অথচ আখেরাত সাজানোর শ্রেষ্ঠ আয়োজনে ওদের অনুপস্থিতি চরমে। দুনিয়ার অশ্লীল আয়োজনে ওদের উল্লাস দেখে মনে হয় যেন ‘মৃত্যু’, ‘পুরুত্থান’, ‘কবর’ নামক শব্দগুলি ওদের অভিধানে সাজানো নেই। থরে থরে সাজানো আছে কেবল দুনিয়ার জৌলুস এবং উচ্ছল প্রাণবন্ত জীবনের তৃপ্ত হাস্যোজ্বল বদনের প্রশান্তিটুকু। ওদের জ্বালানো আলো তো দুনিয়ার রঙ মাত্র, কবরের কালো অন্ধকার কি ওদের স্মরণ হয় না? ওদের কি একবার স্মরণ হয় না সেইসব জনপদের কথা, যারা নিজেদের অশ্লীলতায় ধ্বংস হয়েছিল? কিন্তু আমি তো এই নির্লজ্জতার আয়োজনে খুঁজে ফিরি সেই হারানো শ্লীলতা। এহেন অপসংস্কৃতির রঙিন আয়োজনে মত্ত হ’তে চাই না দুনিয়াবী জৌলুসে। আবছা আলো-অন্ধকারে জীবনটুকু কাটাতে চাই রবের সন্তুষ্টিতে! হে পাঠক! তুমিও কি চাও না সেই পথ? তবে আজ ছুটে চলো অভ্রান্ত সত্যের পথে...। যে অভ্রান্ত পথে নেই এরূপ নববর্ষের মতো ঘৃণ্য ত্বাগূতের সূচালো কাঁটা। ওরা দেশের সংস্কৃতিকে চাঙ্গা রাখার জন্য অযুত-লক্ষ টাকা দিয়ে বর্ণিল আয়োজন করতেই পারে। তবে আমরা নববী সুন্নাত পালন করে যাব যুগ-যুগান্তরে। ওরা এই আয়োজনে পেতে চায় হরেক সুঘ্রাণশোভিত পারফিউম এবং বিশিষ্ট গদিওয়ালা চেয়ার। কিন্তু আমরা তো সেই সৈনিক, যারা জান্নাতপানে ছুটে যেতে চাই অফুরন্ত সুঘ্রাণের পানে।
দুনিয়াবী খাদ্যের আয়োজনে আর সুশীলদের আবিষ্কৃত নববর্ষের প্রয়োজনে ওদের বাহারি রান্না দেখো! স্বাদে ভরপুর, সুগন্ধে ম্রিয়মান এবং দর্শনে জিভে পানি আসা সেসব খাদ্য ওরা কিভাবে মুখে তুলে? যাতে প্রথমত লেগে আছে বর্ষবরণের কলঙ্কিত মশলা এবং যে খাদ্য রাঁধা হয়েছে কেবলি অপ্রয়োজনে!
ভেবে দেখো হে ডায়েরী! আজ প্রিয়ভূমি ফিলিস্তীনের গাযা বিধ্বস্ত, ফুলের মত অযুত নিষ্পাপ শিশুর করুণ চাহনিতে ক্ষুধার স্পষ্ট প্রতিবিম্ব দৃশ্যমান। ওরা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে। খাবারের গামলা হাতে দিগ্বিদিক দৌড়ায় ত্রাণের ট্রাকের শব্দ শ্রবণে! অথচ অপসংস্কৃতির অপ্রয়োজনে রেঁধেছে ওরা কত খাদ্য। আজ রাস্তার ধারে দু’খন্ড পলিথিনের ছাদঘেরা ছেঁড়া গৃহগুলি দেখো! অযুত পথশিশুর নিষ্পাপ করুন চাহনিতে একবার চোখ মেলে চেয়ে দেখো। ওদের হৃদয় কি গোশতপিন্ড নাকি প্রস্তরখন্ড একবার ভেবে দেখো। ওরা খাবার অপচয় করছে, ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে তথাপি ছেড়ে দেয় না কোন আইটেম। ডাস্টবিন থেকে তুলে খেতে থাকা ক্ষুধার্তকে ওরা তাড়িয়ে দেয়। ওরা কি পাষাণ না মানুষ? ভুবনজুড়ে অগণিত আবাল-বৃদ্ধ বণিতার ক্ষুধার্ত উদরের আকুল আর্তচিৎকার কি ওরা শুনতে পায় না?
প্রিয় নবীজি যেখানে খাদ্য খাওয়ানোকে ইসলামের সৌন্দর্য আখ্যা দিলেন সেখানে ওরা কেমন করে মত্ত হয় বর্ষবরণের উচ্ছিষ্ট খাদ্যাংশ খেতে আসা পথশিশুর দলকে তাড়াতে? হে ডায়েরী, বিবেকের একবিন্দু প্রশ্ন রেখে দিলাম তোমার কাছে সযতনে।
ওরা আজ নাচ-গানে অশ্লীলতায় মগ্ন। উন্মাদের মতো ওরা মদ্যপান করে এবং লাফায়, চিৎকার চেচামেচি করে দিগ্বিদিক নাচের তান্ডব ছড়ায়। হঠাৎ কেন যেন আমার কল্পনায় ওদের ভবিষ্যৎটুকু একঝলক দেখা দিল। বিবেক জাগ্রত হয়, পৃথিবীতে অশ্লীল কর্মসাধনকারীরা যেমন করে উলঙ্গ অবস্থায় জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। আগুনের যন্ত্রণায় ঠিক এভাবেই চিৎকার চেচামেচি করবে। উন্মাদ অবস্থায় ছোটাছুটি-লাফালাফি করবে। ঠিক সেই কর্মের যেন অনুশীলন ওরা দুনিয়াতে প্রতি বছর করে আসছে।
যে তরুণ প্রজন্ম আজ এহেন অপসংস্কৃতিতে মত্ত, তাদের দ্বারা অদূর ভবিষ্যতে আগত সন্তানেরা কোন চেতনাধারী হবে? তারাও কি সমচেতনায় বরং অধিক বেশী নোংরা চেতনায় এমন অপকর্মে লিপ্ত হবে না? গানের যতগুলি যৌনসুড়সুড়ি উদ্রেককারী অশ্লীল শব্দ তারা শ্রবণ করছে দীর্ঘ সময় ধরে, সমপরিমাণ সময়ে যদি তারা তাসবীহ-তাহলীল করত তবে কি সমৃদ্ধ হ’ত না ওদের পুণ্যভান্ডার? ওদের শোনা বাজনা যেমন শ্রবণেন্দ্রীয়ে প্রবেশ করে। ঠিক তদ্রূপ গরম গলিত সীসা কী তারা সহ্য করতে পারবে?
মহামহিম পরওয়ারদিগার প্রভু যখন রাত্রির শেষ প্রহরে নেমে আসেন দুনিয়ার আসমানে ঠিক ততক্ষণ অবধি এবং পুরো রাত্রি জুড়ে যারা খোলামাঠে আড্ডা দেয় অপ্রীতিকর ও অশ্লীল অবস্থায়, যারা রহমানের উদাত্ত আহবানের মর্ম উপলব্ধি না করে মত্ত থাকে গান বাজনায়, তারা কী শেষরাতে একবারের জন্যও প্রভুর আহবানে সাড়া দেয়? নাকি প্রভুর আহবান উপেক্ষা করেই নিজেদের মাঝে তোলে হাসির রোল? বর্ষবরণের রাত্রিটা নতুন প্রভাত দেখার জন্য অপেক্ষা করা ঐ মত্ত ছেলে-মেয়েরা কেন বুঝে না যে এই অপেক্ষা তার মৃত্যুরও তো হ’তে পারে!
হে ডায়েরী, আমার দৃষ্টিতে যতটুকু ধরা পড়ে ততটুকু যদি বলি তবে শোন! দিন যেমন মহাদিবসের দিকে ধাবিত হচ্ছে সময়ের বদলে বদলে, ঠিক তেমনিই তো যেন নববর্ষ কেন্দ্রীক অশ্লীলতা ক্রমাগত চূড়ান্ত অপকর্মের পথ ধরে দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে! যে প্রজন্ম নারী-পুরুষের পরস্পর পর্দাশীলতা মেনে চলে না, যে প্রজন্মের ছেলেরা অপসংস্কৃতির ঘৃণ্য আয়োজনে মেতে ওঠে, যে প্রজন্মের মেয়েরা নববর্ষের নতুন সাজে নেচে উঠে গানের তালে তালে, যে প্রজন্ম সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের অঙ্গনে পা ছুঁইয়েও বিদ্যা-বুদ্ধির শূন্যতায় ভুগে, যে প্রজন্ম মুসলিম হয়েও খ্রীষ্টানদের রীতি মেনে চলে সে প্রজন্ম আর যাই হোক না কেন, আগামীর মুসলিম উম্মাতের জন্য শুধু হুমকিস্বরূপই নয়, বরং ওরা পরোক্ষভাবে ইসলাম নিধনে তৈরী হওয়া গোলাবারুদ।
আদীব তার রোজনামচা লেখা শেষ করেছে। দীর্ঘক্ষণের চিন্তাপ্রসূত লেখা শেষ করে তার চেহারায় একই সাথে ক্লান্তি এবং দীপ্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গোছানো বইপত্রের ফাঁকা ডায়েরীটা গুঁজে দিয়ে আদীব দাঁড়ায় জানালার ধারে। পাল্লা মেলে ধরতেই শীতের একপশলা দমকা হাওয়া তার গায়ে লাগে। জানালার কাছেই বিরাট শিমুল তুলোর গাছের সৌন্দর্য আজ তার চোখে কেন যেন ধরা পড়ছে না। আকাশে তখনো নববর্ষের বাজি ফুটেই চলেছে। ক্ষণিকের জন্য বাজির আলো আলোকিত করে শহর। আবার রাত্রির অন্ধকার নেমে আসে। আদীব সমস্ত চিন্তা-চেতনার ঊর্ধ্বে তখন ভাবতে থাকে কবরের অন্ধকার এবং পুলছিরাতের আলো। আসমানে
আশা, স্বপ্ন ও চেতনা : সুপ্রিয় পাঠক! আমরা বিশেষভাবে আশা করি যে, দু’জন ভিন্ন চেতনার চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন এবং বর্ষবরণ নিয়ে উভয়ের বোধ নিপুণভাবে লক্ষ্য করেছেন। যেহেতু মহান প্রভূ মানুষকে বিবেকসহই দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন, সেহেতু সেই বিবেক যথার্থ প্রয়োগের দায়িত্ব মানুষের। আপনি যদি অপসংস্কৃতিতে মত্ত থেকে প্রভুর অসন্তুষ্টি বিনামূল্যে ক্রয় করতে চান, সিদ্ধান্ত আপনার উপরই ছেড়ে দিলাম। আর খালেছ মুমিনের বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়ে যদি যিন্দেগী কাটাতে চান ও সকল পাপাচার হ’তে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নেন, তবে আপনাকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
আমাদের স্বপ্ন হ’ল মুনতাহিমের মতো চেতনার অধিকারী তরুণ সমাজ বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধ থেকে সত্য পথের উপলব্ধি করবে এবং তা গ্রহণে শান্তি পাবে এবং আদীবের মতো অযুত-নিযুত সাহিত্যিক তাদের মতাদর্শকে সত্যজ্ঞান করেই তাদের সংস্কারধর্মী কলম দিয়ে পৃথিবীর অন্যায়-অশুচির বিরুদ্ধে কলম চালাবে। একেকজন হয়ে উঠবে বাতিল দূরীকরণে অভেদ্য দূর্গের কলমি পাহারাদার।
আর আমাদের চেতনা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর অভ্রান্ত সত্য পথের চেতনা। ‘আমাদের চেতনা আদীবের চেতনা’। আমরণ এই চেতনা আমরা ধরে রাখতে চাই। পদদলিত করতে চাই শির উুঁচে দাঁড়ানো ত্বাগূতের পতাকাকে। মিশিয়ে দিতে চাই ধূলির সাগরে। আল্লাহ তুমি কবুল করো- আমীন!
শিক্ষার্থী, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।