ভূমিকা : যেদিন নবজাতকের চোখের তারায় আলোকরেখা তীক্ষ্ণতা প্রদর্শন করেছিল; তারও বহু পূর্বে নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ পৃথিবীতে আগমনের মতই একদিন তাকে হারিয়ে যেতে হবে। যে মুহূর্তে সদ্য প্রসূত নবজাতকের কোমল ত্বক স্পর্শ করেছে ভূবনের স্নিগ্ধ হাওয়া, সেদিনই অদৃশ্য ঘড়িতে শুরু হয়ে গেছে কাঁটাগুলোর ব্যস্ত ঘূর্ণন। প্রতিটি ক্ষণ ঠিক ঠিক হিসাব মতই আবর্তন করে যাচ্ছে জীবনের কক্ষপথের শেষ সীমানার লক্ষ্যে। এভাবেই ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে নবজাতকের প্রতিটি ক্ষণ। কৈশোর, যৌবন, প্রেŠঢ়ত্ব আর বার্ধক্যের যাত্রা শেষে একদিন দেখে, যেন ক্ষণকাল পূর্বে জন্ম নেয়া শিশুটি আজ মৃত্যুশয্যায় গভীর ভাবনায় শায়িত। অদৃশ্য ঘড়ির শেষ মুহূর্তের টিকটিক আওয়াজ সে উপলব্ধি করতে শুরু করেছে আপন চেতনায়। সহসাই দুর্বল চোখ দু’টো বুজে হারিয়ে যায় ওপারের জগতে। এপারের মিছে মায়া ভুলে তাকে রবের অদৃশ্য ইশারায় চলে যেতে হয় প্রভুর দরবারে। রহমানের রহমতপূর্ণ জান্নাতে, নতুবা আগুনের লেলিহান শিখাতলে। মাতৃপ্রদত্ত সুন্দর নাম ছিল তার; হঠাৎই এই জগতে সে বনে যায় ‘লাশ’। বেদনার সমারোহে চলে স্বজনের দ্রুত প্রস্ত্ততি- মাটিচাপা দিতে হবে অদূরের ঐ গোরস্থানে!
হায়াতের দিনগুলো : জীবন! অক্ষরের হিসাবে মাত্র তিন, ধ্বনির গণনায় এক, আর উচ্চারণে সহজতর একখানি সরল শব্দ। অ আ ক খ শেখার কাল হ’তে কতবার এই শব্দটি মানুষের মুখে শুনি, বইয়ের পৃষ্ঠায় দেখি, খাতায় লিখি, তবে পৃথিবীর হিসাবে নিতান্তই অবিশেষায়িত রূপে! কারণ সে জীবনের যে বোধ, হায়াতের যে রূপ; সে রূপের সৌন্দর্যে বড্ড একটা চোখ মেলে তাকানো হয়নি কখনো। কিংবা মওতের ক্ষণ গণনার যে ভয়াবহতা তা উপলব্ধিতে আনার ফুরসত খুব একটা মেলেনি। শত সহস্র কর্মব্যস্ততায় হয়ত প্রভুর সাথে ইবাদতের লেনা-দেনায় রোজনামচা খুলে হিসাব কষা হয়নি বহুদিন! আজ ‘এটা’ কাল ‘ওটা’-র অজুহাতে হায়াতের ক্ষণগুলো প্রকৃতপক্ষে অপচয়ে কাটাচ্ছি। অথচ জীবন মানেই প্রতিক্ষণে মৃত্যুর দিকে দ্রুততম গতিবেগে ছুটে চলা, সে জীবনবোধ আজ নেই বললেই চলে।
হায়াতের ক্ষণ আর কতইবা! আজকাল বয়সের হিসাবে ৬০-এর ঘরে পৌঁছাতে পারাটাই বড় জটিল। নানান রোগ আর তাক্বদীরের লিখনে এর কত আগেই ওপারে পাড়ি জমাতে হয়। সুতরাং এই জীবনকে দৈর্ঘ্যের হিসাবে ক্ষুদ্রতর বলাটা দোষণীয় নয়। কারণ মুসাফির স্বল্পদৈর্ঘ্যের ভ্রমণে বের হয়, এককালে ফিরে যেতে হয় আপন নীড়ে। গণিত শাস্ত্রের সাথে সাহিত্যের কিঞ্চিৎ বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও গণিতের হিসাবে ন্যূনতম ছ’ঘণ্টা যদি আমরা নিদ্রারত থাকি তবে জীবনের এক-চতুর্থাংশ কেবল কেটে যাচ্ছে আয়েশের আয়োজনে। বাকী তিনটি ভাগ? সেই তিন ভাগের কিয়দংশই কেবল ইবাদতে কাটাই। জীবনের নানান ব্যস্ততার আয়োজনে আর প্রয়োজনের ছোটাছুটিতে কখনো সেটুকুও আবার হয়ে ওঠে না প্রতিদিন।
দুনিয়ার সৌন্দর্যে মত্ত হয়ে ভুলে যাই আমরা হায়াতের দিনের হিসাব। সমীকরণের অজানা রাশির মান কত হ’তে পারে তা জানা নেই কারোরই। তবে যতদিনই পাইনা কেন হায়াতের দিন, রিযিকের সন্ধানে ছোটার পূর্বে যাচাই করে নেয়া চাই প্রভুর দুয়ারে হাযিরার হিসাব। কই! তবুও তো হায়াতের দিনগুলো কাটিয়ে দিচ্ছি অবাধ পাপাচারে, প্রভুপ্রদত্ত মস্তিষ্কে আর হৃদয়ে ক্ষণিকের জন্যও আন্দোলিত হচ্ছে না হায়াতের মূল লক্ষ্য কি? কেন শতমোড়পূর্ণ জীবনের পথে সংগ্রাম করা, আর কারইবা দয়ায় রোজ রোজ পথ চলা? সেই চেতনার পরিস্ফুটন ঘটাতে হ’লে প্রয়োজন স্বচ্ছ ভাবুক অন্তর। যেখানে সহজেই রোপণ করা যায় প্রভুর বাণীর তাযা বীজ। যে বীজ দেড় সহস্র বছর পূর্বেই বপিত হয়েছে অনেক আরব-অনারবের অন্তরে।
ক্ষণিকের মুসাফির হিসাবে জীবন যাত্রায় সহসাই আমি ভুলে যাই আমার আসল পথ ও পরিচয়। জীবনের প্রকৃত সরণির পাশে বয়ে চলা পাপ সাগরের একজন দক্ষ নাবিক হয়ে উঠি ধীরে ধীরে। প্রতিটি পাপ যদি জাহায হয় তবে জাহাযের পাল তোলায় আমার হাত পরিপক্ব, মাস্ত্তল নিয়ন্ত্রণে ক্ষণিকের জন্যও কাঁপেনা হাত ও হৃদয়। শত জাহায আর নাবিকের ভিড়ে অগ্রে চলতে থাকি। অথচ যে জাহাযের নাবিক হয়েছি তা-যে কলঙ্কময় সে ইশারার অর্থ বুঝতে কেন দেরী? একদিন তো হারিয়ে যেতেই হবে, আসমান ছেড়ে বহু দূর, শূন্য হ’তে মহাশূন্যের প্রান্তে গিয়ে মিলবে ঠাঁই।
পরিশুদ্ধতার আহবান : হে পথহারা মুসাফির! যে পথের শেষ দেখার ইচ্ছায় অবাধ পাপাচারে জাহায চালিয়েছি তীরের দিক, সেই তীর দর্শনের পূর্বেই যদি ডাক আসে ওপারের, তবে মাঝ সাগরে কূলহীনে তোমার কি অবস্থা হবে? অন্তরে তোমার পাপাচারের মরিচা। আমলের খাতা শূন্যের কাছাকাছি। বেশভূষায় তুমি হয়তোবা বেশ চঞ্চল আর খানিকটা অবাধ্য স্বভাবের। দ্বীন আর হায়াতের মাধুর্যময় ছন্দে হয়তোবা তুমি বিরক্ত। কিন্তু আজই সঠিক সময়। তোমার বোধকে জাগ্রত করার। যে হৃদয় এতকাল আত্মকেন্দ্রিক নির্দেশনার অনুসরণ করেছে, সে অন্তরেই তোমাকে নব উদ্যমে দ্বীনের স্নিগ্ধ মুগ্ধতা জাগাতে হবে। অনুভবের তরঙ্গদোলায় আর মস্তিষ্কের নির্দেশনার লাল-নীল সংকেতে তোমাকেই আপন হাতে চালাতে হবে ছন্দপতনের ছুরি। অবাধ্যতা আর ক্রমাগত বেড়ে চলা দম্ভের সমাপ্তি টানতে হবে একান্ত আপনাতেই। তোমাকে হ’তে হবে আত্মচেতনায় উচ্ছ্বাসিত আর দ্বীনের অমিছে দর্শনে উদ্বেলিত মুজাহিদ। যে তার ধারালো তলোয়ার উত্তোলন করবে অবাধ্যতার রুক্ষ্ম ছন্দপতনে। তাই স্তব্ধ হও, ধীরে ধীরে মস্তিষ্কে জমে থাকা ধুলোর আস্তরণ ঝেড়ে ফেল সময়ের আবর্তনে। তোমার জীবনতরীকে শত মোড় ঘুরিয়ে মৃত্যুমোড়ে যাবার আগেই ভেড়াতে হবে দ্বীনের স্টপেজে। সেই বোধ একবার জাগাও।
শেষকথা : আমাদের এই জীবন; সে তো মৃত্যুর পথে নিরন্তর ছুটে চলা। মাঝখানে কেবল রচনা করি পাপ-পূণ্যের হিসাবে ভরা পেটমোটা একখানি রোজনামচা। যা মূল্যায়ন শেষে ফিরে আসবে রহমত কিংবা আযাব হয়েই। আমি যেদিন থাকব না... জানি! আজকের মতো সেদিনও এই পথে ফুল ঝরে পড়বে। শিমুলের শুভ্র শরতের পেঁজা তুলোর মত মেঘমালা পৃথিবীর প্রান্ত জুড়ে তার ভ্রমণ সমাপ্ত করবে। দমকা হাওয়ায় বৃক্ষের পাতায় পাতায় ঘর্ষণের দ্যোতনায় পৃথিবীতে ঘুমিয়ে রবে স্নিগ্ধ কতগুলি প্রাণ।
হে পাপাচারে লিপ্ত মন! স্নিগ্ধ গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রতাপের উত্তাপ, শীতের সকালে ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু, বর্ষায় থৈ থৈ করা বিস্তীর্ণ বিল, শরতের আকাশে চোখভরা মুগ্ধতা কিংবা বাতাসে ভেসে বেড়ানো নাম নাজানা অযুত ফুলের সুঘ্রাণে যে বসন্ত তার কোনটিই তোমার জন্য নয়। বাইরের অবয়বে কোন স্বার্থকতা নেই, ভেতরেরটুকু যদি ভালো হয় তবেই তোমার ক্ষুদ্র ঘর গ্রীষ্ম হ’তে বসন্তের সব মৌসুমই অনুভব করবে বসন্তের স্নিগ্ধতা আর শীতের হিমেল পরশ। এটাই বাস্তবতা! এই পৃথিবীতে তরুমর্মরের কড়কড় শব্দ রয়ে যাবে, শ্যামল মাটির তরে উর্বর পরশ আর সূর্য তার স্বকীয় তির্যক আলো নিয়ে হয়তো শেষ দিবসের পূর্ব অবধি রয়ে যাবে, কিন্তু! জীবনের জ্বালানী শেষে তুমি সেই উর্বর মাটির নীচে চাপা পড়ে রবে, কোমল চাপে অথবা অসহ্য যন্ত্রণা ক্বিয়ামত অবধি সয়ে যেতে হবে গগণবিদারী চিৎকারে। তাই এবার বোধ যে তোমার জাগাতেই হবে। সেই বোধের কামনায় দ্বীনের চর্চা করো আর অবাধ কলঙ্কময় অধ্যায় ভুলে যাও, মুছে দাও মন থেকে তোমার পূর্ব ইতিহাস..., মানুষ হবার পরও মানুষকে ছাড়িয়ে স্বপ্ন দেখো নতুনরূপে মানুষ হবার।
মুহাম্মাদ মুবাশশিরুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।