পৃথিবীর যে অঞ্চলে আদীবের বসবাস, আদীবের মন ও মনন বিন্যস্ত, ভাবনা পরিব্যক্ত, সে অঞ্চলে তখন অপরাহ্ন গড়িয়ে সন্ধ্যার শীত শীত বাতাস বইছে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে লাইব্রেরী রুমে আবদ্ধ অন্ধকার। সে প্রদীব ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালে তাকাল। পাঁচটা বেজে তেত্রিশ মিনিট। সন্ধ্যা হ’তে বেশী বাকী নেই। একমাস পেরিয়ে পঁচিশের বর্ষপঞ্জিকায় উচ্ছল কৌশরের মতো রুনে আছে ফেব্রুয়ারীর তের তারিখ। প্রবন্ধের কিছু নতুন প্রকরণ নিয়ে গবেষণায় গত দশ তারিখ আদীব সাহিত্যমনস্কের লাইব্রেরীতে ঢুকেছিল। তারপর খুব একটা বের হওয়া হয়নি। গবেষণা সমাপ্তির পর্যায়ে এসেছে। আজ আদীব নিজের ছোট্ট নীড়ে ফিরবে।

সাহিত্যমনস্কের মূল ভবন পেরিয়ে সদর ফটকের সামনে রিকশা নিয়ে একটানে গলির মাথায় নামল সে। গলি থেকে মিনিট চারেক পায়দল পথ-যাত্রার শেষবিন্দুতে তার আলয়। গলির মুখে বেশ বড়সড় আকারের ফুলের বাগানে আদীব প্রায়ই যাতায়াত করে। বাগানের উদ্যোক্তা আরাফ তার বন্ধু। ব্যস্ত আদীব দ্রুতপদে ঘরে ফিরছিল, হঠাৎ তার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়ের সাহায্যে উপলব্ধি করে যে, ফুলের বাগান কেমন যেন খালি খালি, ফুল নেই বেশিরভাগ গাছে। কোথাও যেন ফুল বোঝাই পিকআপ ভ্যানও সে ফিরতি পথে লক্ষ্য করেছে। সে ভাবনায় মন না দিয়ে আদীব ঘরে ঢুকল।

তিনদিন ধরে বন্ধ ঘরে পুরনো বইপত্রের বাসি গন্ধ। জানালা খুলতে খুলতে সে স্থির করল, সন্ধ্যার পূর্ব সময়টুকু সে অনলাইনেই কিছু টুকিটাকি কাজ সেরে নেবে। অনলাইনে হরেক রকম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের খবরে একনজর চোখ বুলাতে বুলাতে তার চোখে পড়ল একটি বিশেষ নিউজ। বোল্ড ফন্টে লেখা লাল রংঙের শিরোনামের লেখাটুকু দেখে বিস্মিত হবার বদলে সে কিঞ্চিত শিহরিত হ’ল। ‘১৪ই ফেব্রুয়ারী : আগামীকাল বিশ্ব জুড়ে পালিত হবে ভালবাসা দিবস’। শিরোনাম দেখে হঠাৎ আরাফের বাগান থেকে পিকআপ বোঝাই ফুলের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়জাত সমস্যা দিবালোকের চাইতেও বেশী পরিস্কার হয়ে উঠল। কুঞ্চিত কপালের রেখাপাতে আদীব অস্ফুট কণ্ঠে আওয়াজ তুলে বলল, ‘পৃথিবী যাকে ভালবাসা দিবস হিসাবে বরণ করে, সে নোংরা দিনটি কাল? ১৪ তারিখ। অর্থাৎ আগামীকালই মধ্য ফেব্রুয়ারীতে ঘটে যাবে সভ্য সংস্কৃতির অন্যতম বড় বিপর্যয়? মধ্য ফেব্রুয়ারী মূলত সংস্কৃতির কবরচিহ্ন’...।

মাগরিবের আযান হচ্ছে। আযানের বাক্য জওয়াব দিতে দিতে আদীব মসজিদ পানে রওনা দিল। অস্পষ্ট চিন্তার আড় তখনো তার মস্তিষ্কে দোলা দিয়ে যাচ্ছে একটিমাত্র বাক্য, ‘ফেব্রুয়ারী সংস্কৃতির কবরহ্নি’!

বাদ ফজর আদীব রওনা দিয়েছে রিযওয়ান সাবিবরের বাড়ীর দিকে। মসজিদ থেকে হাঁটাপথে মিনিট দশেক। রিযওয়ানের বাসায় ভোরবেলা সমসাময়িক বিষয়ের চিন্তা-চেতনা ও তারুণ্যের সম্ভাবনাময়ী আলোচনায় কফির আড্ডাটা বেশ জমে ওঠে। কাল সন্ধ্যে থেকে মাথায় ঘুরপাক খাওয়া চেতনাগুলি রিযওয়ানের সাথে বেশ আলাপ করা যাবে। রিযওয়ান সাবিবর অতিথিদের বসার রুমে কী যেন একটা বই নিতে এসেছিল। দরজায় মিষ্টি সালাম শুনে বুঝতে বাকী রইল না যে আদীব এসেছে। দু’জনে বসে কুশল বিনিময় করল একে অপরে। আদীব চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী জিজ্ঞেস করে ফেলল, বলতো এই সপ্তাহ জুড়ে বিশ্বব্যাপী কী চলছে? হঠাৎ প্রশ্নে রেযওয়ানের ভ্রু কুঁচকে গেল, পরক্ষণেই চোখ পড়ল বর্ষপঞ্জিকায়। জবাব দিল, তুই ‘ভালবাসা সপ্তাহের কথা বলছিস?’ আদীবের প্রশ্নের উত্তর ঠিক ধরেছিল রেযওয়ান। সপ্তাহ কেন বললাম জানিস? কারণ, চূড়ান্ত ভালবাসা দিবস পালনের পূর্বে সপ্তাহ ধরে চলে ছোট ছোট দিবস পালনের মাধ্যমে সেটার প্রস্ত্ততি! যেমন ধরতে পারিস মানুষ চূড়ান্ত ভুল করার আগে যেমন ছোট ছোট ভুল করে তেমনই।

রিযওয়ান আলোচনা জমানোর চেষ্টা করল, বলল, সপ্তাহের প্রথমেই যা শুরু হয় তা হ’ল ‘রোজ ডে!’ বা গোলাপ দিবস। হুট করে জমে যাওয়া আলোচনায় আদীব খুশী হ’ল। বলল, ঠিক ধরছিস! ‘রোজ ডে’তে যা চলে তা হ’ল একজন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে গোলাপ উপহার দেওয়ার মাধ্যমে তাকে ভালবাসা জানায়। ফুলকে যে ভালবাসার প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হয় তা সত্য করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানো হয়। পুরো পৃথিবী জুড়ে কতশত যুবক-যুবতী যে এই কান্ড ঘটায় তা বেহিসাব। চিন্তা করে দেখ, যেখানে একজন মুসলিম ব্যক্তি তার সবটা ইবাদত এবং দেহ-প্রাণ আল্লাহর কাছে সমর্পণ করে এবং আল্লাহ ব্যতীত কারো কাছে মাথা নত করে না, সেখানে একজন মুসলিম যুবক কিভাবে হাঁটু গেড়ে বসে তার প্রেমিকার হাতে ফুল তুলে দেয়? এ প্রশ্নের জবাবে হয়তো ওরা ধীরকণ্ঠে বলার চেষ্টা করে, এটা তো ইবাদতের হাঁটু গাঁড়া নয়, ভালবাসা নিবেদনের জন্য। তাহ’লে এখানে ধর্মের প্রশ্ন টেনে আনার কী হ’ল? কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, ওরা কি চায় ক্বিয়ামতের দিন তার এই পাপাচার পৃথিবীর সব মানুষের সামনে দেখানো হৌক! যারা আল্লাহর ভালবাসায় রুকু ও সিজদার জন্য নত হ’তে পারে না, যারা বৃদ্ধ পিতা-মাতা কিংবা রাস্তায় মন্থর পদে হেঁটে চলা বৃদ্ধকে সাহায্যের জন্য বাঁকা হ’তে পারে না, তার এই ভালবাসার বাঁকা হয়ে ঠ্যাংভাঙ্গা লোকের ন্যায় মাথা নুইয়ে গোলাপ সমর্পণ করার মধ্যে সাফল্য কোথায়? যে অর্থ ও ভালবাসা সে পরের কন্যার জন্য ব্যয় করে সে ভালবাসা তার ঘরের ছোট ভাইবোন কিংবা বৃদ্ধ বাবা-মা কেন পায় না? ওরা হয়তো মনে করে যে ‘রোজ ডে’তে ঘটা করে প্রেমিকাকে গোলাপ দিতে পারাটাই বীরত্ব। কিন্তু ওরা কী কখনো ভেবেছে, বেগানা এক নারীর জন্য হাঁটু গেড়ে বসাটা শুধু কাপুরুষদের লক্ষণই নয়; বরং পুরুষত্বের স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও মহত্ব নারীর পদতলে বিলিয়ে দেয়া?

ততক্ষণে কফি এসে গেছে। ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিয়ে রিযওয়ান বলে উঠল, বাহ, বেশ চিন্তা তো! এভাবে কখনো ভাবিনি তো! রোজ ডে-র পরে আসে প্রেপোজ ডে, অর্থাৎ প্রেমিক তার প্রেমিকাকে নিজের ভালবাসার কথা জানায়। প্রস্তাব দেয় ভালবাসার। এবার তুই এটাকে কি বলবি? কফির মগে চতুর্থ চুমুক দিয়ে আদীব বলতে শুরু করল- এদিনের চেতনাকে তুই এভাবে কল্পনা করতে পারিস যে, একজন প্রেমিক পুরুষ তার পসন্দের নারীকে পরস্পর হারাম বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আমন্ত্রণ জানাবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে পরস্পর পরস্পরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করবে। অর্থাৎ, ঘোষণা দিয়ে পাপে লিপ্ত হবার মত বিষয়টা। মানুষ গোপনে পাপ করে আবার কখনো না জেনেও পাপ করে। পাপকালীন সময়ে কারো কাছে ধরা পড়লে ন্যূনতম চক্ষুলজ্জার কারণে হ’লেও সে লজ্জিত হয়। কিন্তু এই দিন যে ব্যাপারটা ঘটে তা হ’ল প্রকাশ্য দিবালোকে পরস্পরের প্রতি পাপাচারের আহবান করা। তুই কি এর অন্তরালের বোধ জানিস? যেখানে একজন মুসলিম পুরুষের চক্ষু অবনমিত রাখা সরাসরি কুরআনের বার্তা, সেখানে ওরা পরস্পরের প্রতি কিভাবে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে? তারা কি মুসলিম নয়, নাকি তারা শুধু মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করাটাকেই ইসলাম মনে করে? গোপন পাপের কথা মানুষ জানে, কিন্তু এরূপ ঘোষণাপত্র দিয়ে পাপের বিষয়টাকে তুই কি বলবি?

এরা শুধু এখানেই ক্ষান্ত হয় না। গণমাধ্যম ও যোগাযোগ মাধ্যম দূষিত করতেও ছাড়ে না। আদীব কফির মগে চুমুক দিতেই রিযওয়ান পরের দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়ার কিঞ্চিত চেষ্টা করলেও আদীব ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলতে শুরু করল, ‘এরপর দুইদিন পর্যায়ক্রমে প্রেমিক-প্রেমিকাযুগল পালন করে ‘চকলেট ডে’ এবং ‘টেডি বিয়ার ডে’। কেমন অদ্ভূত চিন্তা করেছিস? ভালবাসার মধ্যে সব খাদ্য ছেড়ে খানিকটা অখাদ্য চকলেট, আর সব উপহার বাদ দিয়ে কেন ভাল্লুকের পুতুল উপহার দিতে হবে? এটা কোন সংস্কৃতি? চকলেট কি এতই সুস্বাদু এবং মুখরোচক খাদ্য যে, চকলেট কিনে দিতে এবং ঘটা করে চকলেট খাবার জন্য একটি দিন নির্দিষ্ট করতে হবে? আর সব ছেড়ে টেডি বিয়ার কেন দিতে হবে? কেন উপহার সামগ্রী হিসাবে অন্য কিছুর কথা মাথায় না এসে বিয়ারের আইডিয়া মাথায় এল?

একজন তাক্বওয়াশীল ব্যক্তি যেখানে বাজার থেকে কিনে আনা পণ্যের দৈনিক পেপার দিয়ে তৈরী প্যাকেটে থাকা মানুষ ও জন্তুর ছবি ঘরে থাকায় ফেরেশতা প্রবেশ করা নিয়ে চিন্তিত থাকেন সেখানে এই প্রজন্ম কী শুরু করেছে? তারা বিড়াল-কুকুর এবং এ জাতীয় জন্তুর পুতুল টাকা দিয়ে কিনে বাসায় শোভাবর্ধক হিসাবে ব্যবহার করছে। তবে হ্যাঁ! যাদের চেতনা ঘুনে ধরা, তারা নিজদের চেতনার সদৃশ্য কুকুর ও বিড়ালসহ জন্তুগুলোকেই উপহার হিসাবে দেখতে পাবে, উত্তম জিনিস যে পশুত্বময় হৃদয়ে অনুধাবিত হবে না সেটাতে আর বৈচিত্র্য কী? একজন যেনাকারিনী মহিলা কুকুরকে পানি পান করানোর মাধ্যমে জান্নাতবাসী হয়েছিলেন। আর বর্তমানের যেনাকার ও যেনাকারিনীরা ‘টেডি বিয়ার’কে আগলে রেখেই শান্ত্ব হয়।

তুই চিন্তা করে দ্যাখ, এই এক্সপেনসিভ টেডি বিয়ারগুলি না কিনে যদি সমপরিমাণ অর্থের পশুখাদ্য কুকুর-বিড়ালকে খাওয়াত, তবে নিজ নিজ এলাকার একটি পশুও অভুক্ত থাকত না। পশুর উপমা তো বহু দূরে। গাযার দিকে চেয়েও কী ওদের অন্তরে মায়ার উদ্রেক হয় না? তবে ওদের ভালবাসা কোথায়? রক্তাক্ত লাশ আর ধ্বংসস্ত্তপের নীচে পড়ে থাকা শিশুর কচি হাতের আঙ্গুল দেখেও যাদের মন পাষাণ হয়ে থাকে, তাদের এই নারীপ্রীতি ও ভালবাসা মিথ্যে-ভন্ডামী বৈ আর কি!

মনোযোগী শ্রোতা রিযওয়ানের কপালে কুঞ্জিত রেখাপাত আর ছোট হয়ে আসা চোখ দু’টো স্বাভাবিক পর্যায়ে আসার মত সময় নিয়ে আদীব তার ঠান্ডা হয়ে আসা কফির মগে শেষ চুকুম দিল। রিযওয়ান বলল, এরপর আসে ‘প্রমিজ ডে’। অর্থাৎ ওয়াদা দেয়া-নেয়ার দিন। তোর দর্শন এই দিনকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছে বল দেখি!’ আদীব ট্রেতে মগ রাখতে রাখতে শুরু করল- ‘বেশ প্রশ্ন করেছিস! এই দিন নগ্ন সংস্কৃতির অর্ধ-উলঙ্গ প্রেমিক-প্রেমিকারা পরস্পর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে, তারা একে অপরে কখনোই আলাদা হবে না। চিরদিন একসাথে থাকবে। এরা চিরকাল এক সাথে থাকার প্রতিজ্ঞার ফাঁকে মূলতঃ চিরকাল অবৈধ পাপাচারে লিপ্ত থাকার ওয়াদা সম্পন্ন করে।

মাত্র দুইদিন আগে একে অপরকে পসন্দ করে কথিত propose day পালন করে দুইদিন পরে কেন ঘটা করে promise নিতে হবে? বলি কি! যদি এই সংস্কৃতি ও ওয়াদা নেয়ার পিচ্ছিল পাপাচার ওদেরকে পালন করতেই হয়, তবে ঘৃণ্য propose day-র মধ্যেই কি একইদিনে একে অপরকে প্রতিজ্ঞাদানের চলমান পাপাচার সমাধা করা যেত না? একইদিনে পসন্দ ও প্রতিজ্ঞার কার্য সম্পাদন করে ফেললে অন্তত পাপাচারের দিন একটি কমে যেত। কথার মধ্যে হঠাৎ রিযওয়ান হেসে উঠল। বিরক্তিমুখে আলোচনার বিঘ্নতায় আদীব প্রশ্ন করল, তোর কী হ’ল? রিযওয়ানের উত্তর, তোর সাথে থেকে আমিও খানিকটা সাহিত্যিক হয়েছি বটে।

হাসল আদীবও! হাত পা ছেড়ে দেহের আড়মোড়া ভেঙ্গে আদীব সোজা হয়ে বসে শুরু করল তার পরের ইনভেস্টিগেশন! ‘এরপর দুইদিন নগ্ন সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় চাল। ক্রমাগত দু’দিন প্রেমিকযুগল পালন করে হারাম স্পর্শের ‘Hug day এবং Kiss day’। আস্তাগফিরুল্লাহ। এই দুইদিনের নোংরা সংস্কৃতি কি ব্যাখ্যা করা লাগে? এই দিনগুলোর প্রচারণা চালায় পত্র-পত্রিকাতেও। আমি বেশ কিছু পত্রিকার এই বিষয়ে অভিব্যক্তি পড়েছি। ওরাও নিজেদের মেরুদন্ড ‘সংস্কৃতি’ নামাঙ্কিত অপসংস্কৃতির হাতে তুলে দিয়ে তাদের পদলেহনে ব্যস্তত থাকে। যেমন ভাবে অধিকাংশ পত্রপত্রিকায় যে বাণীটুকু কমন সেটা হ’ল ‘আপনার ভালবাসার ব্যক্তিটিকে আপনি আজ উষ্ণ আলিঙ্গন করতে পারেন, কপালে এঁকে দিতে পারেন চুম্বন, তবে অবশ্যই অনুমতি নিয়ে’। চিন্তা করে দেখ, এখানে প্রভুর হারামকৃত বিষয়কে কোথাকার কোন গর্দভ যুবক-যুবতীর অনুমতি নিয়ে হালাল করে নেয়। পরস্পরের অনুমতির ভিত্তিতে হাগ এবং কিস যদি ‘যেনা’ হিসাবে তারা আখ্যায়িত না করে তবে যদি কারো অনুমোদন নিয়ে ঐসব সুশীলদের শির নিপাত করা হয় তবে সেটা খুন হিসাবে বিবেচিত হবে কেন?

এটা কেন বললাম জানিস? কারণ, সন্তানের পিতা-মাতা তার সন্তানকে এবং দেশমাতৃকা তার নাগরিককে ফেব্রুয়ারীর অপসংস্কৃতিতে গা ডোবানোর জন্য তিলে তিলে গঠন করে না। এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্যই গঠন করে। এ দু’দিনের বিষয়ে শুধু এতটুকুই বলতে পারি যে, এই দিন রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে পার্ক রেঁস্তোরায় যে পরিমাণ পাপাচার চলে তা ঘৃণা করার মত খুব কম লোকই এখন অবশিষ্ট আছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, মানুষ ঘৃণা করতে করতে যখন দেখে, এটাই চলছে এবং পালিত হচ্ছে নবোদ্যমে তখন সেই ঘৃণার হৃদয়েই ফুটে ওঠে এসবের পক্ষে মৃদু ভালবাসা। ঘৃণাকারী তরুণ-তরুণীরাই ধীরে ধীরে মিশে যায় তাতে। অপসংস্কৃতির কালো হাত তাদের টেনে নেয় গহীনে। যদি ধীরে ধীরে এমন দিবস চলতেই থাকে এবং মানুষের উপস্থিতি বেশী হ’তেই থাকে তবে এমন এক সময় আসবে যখন তুই আমিও এই সংস্কৃতির বিপরীতে কথা বলার মতো পরিবেশে পাবো না। ক্রমাগত অশ্লীল হয়ে পড়া সমাজকে কে রক্ষা করবে? রিযওয়ান জবাব দিতে চাইল না, পারল না। কারণ যদি পরিবেশ সত্যিই এমন হ’তে থাকে তবে এর জবাব হয়তো কারো কাছেই নেই।

তারপর কিছুক্ষণের নীরবতা ঘরে বিরাজ করল। না আদীব কথা বলছে, না রিযওয়ান। দু’জনেই চিন্তামগ্ন। ঘড়ির টিকটিক আওয়ায ছাপিয়ে আদীবের কণ্ঠ শোনা গেল- ‘এরপর আসে চূড়ান্ত দিন। আর সেই দিন হ’ল আজকের দিন। ১৪ই ফেব্রুয়ারী। বিশ্ব যাকে ভালবাসা দিবস হিসাবে চেনে, পালন করে। পার্কের ধারে, ব্যস্ত নগরীর ফাঁকে মেলা বসে। ভালবাসা দিবসের মেলা। রাস্তার ধারে ধারে অস্থায়ী শত শত দোকানে ফুলেল সৌন্দর্য ধরা পড়ে। রাস্তাঘাটে নগ্ন সাজে সাজা ছেলে মেয়েদের জোড়ার উপস্থিতির পরিসংখ্যান এক লাফে শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে ফেলে। বছর জুড়ে মন্দা চলতে থাকা হোটেল-রেসেঁতারাগুলো যেন অন্তত একদিনের জন্য হ’লেও প্রাণ ফিরে পায়। নদীর ধারে পার্টি হয়। আরও কত কী? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমোচ্চারিত আর একটি শব্দের বিদ্যালয়ে রূপ নেয়। পালিত হয় ভালবাসার র‌্যালি।

নারী পুরুষের অবাধ মিশ্রণে সে র‌্যালিতেই কতকিছু ঘটে যায় তার ইয়ত্তা নেই। এসকল ‘যেনা’র কর্মকান্ড মিডিয়ার সুশীলরা আবার ‘দুর্ঘটনা’ শিরোনামে ফলাও করে প্রচার করে। এই এক সপ্তাহে প্রেমিকযুগল কী একবার ভেবেছে যে, গাযায় কতজন শিশুর প্রাণ গেছে? তারা কি জানে, কত অযুত পথশিশু এই এক সপ্তাহ অভুক্ত আছে? তারা কি জানে যে, এই এক সপ্তাহে কতগুলি গোনাহ তারা সঞ্চয় করেছে? না, তাদের জানা নেই; কারণ তারা কেবল ব্যস্ত ছিল রাস্তাঘাটে কুকুরের মতো আচরণে। তারা নফসে লাউয়ামার পদতলে নফসে মুতমাইন্না বলি দিয়েছে। আচ্ছা রিযওয়ান, তুই কি শফিক রেহমান কে চিনিস? উত্তর এল, ‘হ্যাঁ তো! একজন সাংবাদিক হিসাবে তাকে চিনি’।

আদীব গলা ঝেড়ে আবার শুরু করল- এই শফিক রেহমানই বাংলাদেশে ভালবাসা দিবসের আমদানি করেছে পশ্চাত্য সংস্কৃতি থেকে। নিজে একজন মুসলিম হয়েও অমুসলিমদের অপসংস্কৃতিকে নিজের দেশে নিয়ে এসেছে। ভালবাসা দিবস কী তা বাঙ্গালীর অস্থিমজ্জায় জোর করে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ২৮ দিনের ফেব্রুয়ারীর ১৪ তারিখে তথা মধ্য ফেব্রুয়ারীতে সকল শ্লীল সংস্কৃতির কবরচিহ্ন রচনা করে দেয় এই দিবস।

আজ (১৪/২/২৫) শুক্রবার। সপ্তাহের পবিত্রতম দিন, যেদিন মৃত্যুবরণ করাটাও চরম প্রাপ্তি, এই দিনেই দেখ ওরা মেতেছে কুফরীর বঙ্গোৎসবে! লজিক্যালি যদি চিন্তা করিস তাহ’লে দেখবি, এই তরুণ-তরুণীদের পরের যে প্রজন্ম আসবে তারা কতটা অশ্লীল হবে? যাদের মূলে সমস্যা তারা কিভাবে ভাল ফল দেবে?

আদীব এবং রিযওয়ান দুজনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আগত প্রজন্মের দিশা হয়ে শূন্য তেপান্তরে দ্বীন-ধর্মহীনে ছুটে বেড়ানো যেন দেখতে পায় ওরা। ততক্ষণে ভোরের কুয়াশা ভেদ করে পূর্ব দিগন্তে সূর্য তার সৌন্দর্যে জ্বলে আছে। দুই বন্ধুই বের হয়েছে সেই সৌন্দর্যে খানিক রোদ লাগাতে। ঘর থেকে বের হ’তেই আদীব জানাল, সে আরাফের সাথে দেখা করবে; সেই বাগানের উদ্যেক্তা! দশ মিনিটের পর্বজুড়ে তারা খানিক গল্প করে নেয়। আদীব আজকের দিনে এক বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। রিযওয়ান শুনে বিস্মিত হয়। গল্প করতে করতে ওরা এসে পড়ে আরাফের বাগানের সামনে; ভাগ্যগুণে আরাফের সাথে দেখাও হয়। ওকে বেশ খুশী দেখাচ্ছিল।

আদীবের কুশল বিনিময় শেষে জিজ্ঞাসা- ‘তুই এত খুশী আজ?’ আরাফ বলে, ভালবাসা দিবস উপলক্ষ্যে চড়া দামে সব ফুলগুলি বেঁচতে পেরেছি। হাতে গরম টাকা, খুশী হব না? আদীব মাথা ঝাঁকায়, বলে আজ ভালাবাসা দিবস নয়, আজ সুস্থ সংস্কৃতির কবর রচনার দিবস। ভালবাসা দিবসে যে অশ্লীলতা চলে আর যে পরিমাণ পাপাচার সমগ্র দিন প্রভুর আসমানে দুর্গন্ধ হয়ে উঠে সেই দিবসের মূল আকর্ষণ ফুল। তুই সেই ফুল ভালবাসা দিবস উপলক্ষ্যে বিক্রি করেছিস; তার অর্থ এই অপসংস্কৃতিকে তুই সাদর আমন্ত্রণই জানাসনি বরং ত্বরান্বিত করার জন্য সাহায্য করেছিস। হারাম এই দিবসে হারাম কান্ড সাধনে ফুল বিক্রি করা টাকাকে তুই হালাল বলবি? হালাল বিষয়কে হারাম উপলক্ষ্যে ব্যবহার করলে তা হালাল থাকে? এই অর্থ কখনোই বরকত আনে না। তুইও বন্ধু পাপের ভাগ নিচ্ছিস।’

আদীবের উপস্থিত বিশ্লেষণে আরাফ লজ্জিত হয়। বুঝতে পেরে বলে- আমি এত গভীরভাবে চিন্তা করিনি বন্ধু! আস্তাগফিরুল্লাহ। এমন কাজ ভবিষ্যতে কখনো হবে না। আর কখনোই কোন দিবসে ফুল বিক্রয় করে অর্থ হাতাব না, ইনশআল্লাহ। এই ফুলকেন্দ্রিক ভালবাসা দিবসে ফুল বিক্রেতাকেও সঠিক পথ বোঝাতে বাকী রাখে না আদীব। সেই দৃশ্য দেখে রিযওয়ান দ্বিতীয়বার বিস্মিত হয়।

১৪ই ফেব্রুয়ারী ২০২৫, শুক্রবার। জুম‘আর পরে হাল্কা খেয়ে আদীব আর রিযওয়ান রওনা দিয়েছে এলাকার যে স্থানগুলোকে কেন্দ্র করে দিবস জমে ওঠে সেই স্থানগুলোতে। উদ্দেশ্য হ’ল ভালবাসা দিবসে আগত উচ্ছল তারুণ্যে গা ডোবানো প্রেমিকযুগল এবং দু’টো দুনিয়াবী নোটের আশায় আগত মেলার ব্যবসায়ীদের ভালবাসা দিবসের অন্তর্গত পাপের কথা স্মরণ করিয়ে দ্বীনের পথে আনা। চারটি পা ধীরে ধীরে চিন্তিত অথচ উদ্যমী চেহারায় হেঁটে চলে পার্ক এবং মধ্য বাগানের দিকে। কারণ তারা জানে, আলোর গতিবেগের চাইতে অধিক দ্রুতবেগে বিপথে ছুটতে তরুণ-তরুণীদের হিদায়াতের অভ্রান্ত পথে আনতে এর বিকল্প রাস্তা নেই। রাতে মাহফিল শেষে ফযরে ঘুমানো জাতিকে উপদেশ দেবার দিন শেষ হয়েছে। এখন পাপাচারে লিপ্ত জাতিকে পাপের মূর্হূতেই বাধা দিতে হবে। ফিরিয়ে আনতেই হবে ওদেরকে দ্বীনের সুশীতল বৃক্ষতলে।

হে পাঠক! আমরা স্বপ্ন দেখি এমন এক সমাজের, যেখানে থাকবে আদীবের মতো সাহসী সেনানী। রিযওয়ানের মতো দৃপ্ত মনোবলের বন্ধু এবং আরাফের মতো সত্য মেনে নেওয়া সমাজ। যারা বিপথে ছুটন্ত সমাজের নতুন রাহবার হয়ে দ্বীনের কূলে ফেরাবে ওদের মহাসমুদ্র যাত্রা। পাশ্চাত্য ভালবাসা দিবস নর্দমায় ছুঁড়ে দিয়ে শান্ত হৃদয়ে, পুষ্ট বদনে প্রাণখুলে দু’হাত ক্বিবলায় প্রসারিত করে আমরা দো‘আ করি, ‘রববানা হাবলানা মিন আযওয়াজিনা ও যুর্রিয়া-তিনা কুররাতা আ‘য়ুন ওয়া জা‘আলনা লিল মুত্তাকীনা ইমা-মা’

মুহাম্মাদ মুবাশশিরুল ইসলাম

 শিক্ষার্থী, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।






আরও
আরও
.