বাহ্যিকভাবে পরস্পর বিরোধী আয়াত সমূহের সমন্বয়

كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا اٰيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ-

‘এটি এক বরকতমন্ডিত কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি। যাতে লোকেরা এর আয়াত সমূহ অনুধাবন করে এবং জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করে’ (ছোয়াদ-মাক্কী ৩৮/২৯)

কুরআনের অনেক আয়াত রয়েছে যা বাহ্যিকভাবে পরস্পর বিরোধী। কিন্তু তার মর্ম অনুধাবন করলে উক্ত বাহ্যিক বিরোধ সমন্বয় করা সম্ভব। ফলে আর বিরোধ থাকে না। উদাহরণ স্বরূপ :

(১) আল্লাহ বলেন, وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ اللهِ حَدِيثًا- ‘আর আল্লাহর চাইতে অধিক সত্যবাদী আর কে আছে? (নিসা-মাদানী ৪/৮৭)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ اللهِ قِيلاً- ‘আর আল্লাহর চাইতে কথায় অধিক সত্যবাদী আর কে আছে? (নিসা-মাদানী ৪/১২২)

দু’টি আয়াতের মর্ম একই। অতএব দ্বিতীয়টি প্রথমটির নাসেখ বা হুকুম রহিতকারী। কেননা আল্লাহ বলেছেন,مَا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا ‘আমরা কোন আয়াত রহিত করলে কিংবা তা ভুলিয়ে দিলে তদপেক্ষা উত্তম অথবা তদনুরূপ আয়াত আনয়ন করি’ (বাক্বারাহ-মাদানী ২/১০৬)। অতএব দুই আয়াতের মধ্যে কোন বিরোধ রইল না।

(২) আল্লাহ কুরআন সম্পর্কে বলেন, هُدًى لِلْمُتَّقِينَ- ‘আল্লাহভীরুদের জন্য পথ প্রদর্শক’ (বাক্বারাহ-মাদানী ২/২)। অন্যত্র তিনি বলেন,شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ، ‘রামাযান হ’ল সেই মাস, যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে। যা মানুষের জন্য পথ প্রদর্শক’ (বাক্বারাহ-মাদানী ২/১৮৫)। ১ম আয়াতে ‘মুত্তাক্বীদের জন্য’ খাছ করা হয়েছে। পরের আয়াতে সাধারণভাবে ‘সকল মানুষকে’ বুঝানো হয়েছে। উভয় আয়াতের সমন্বয় এই যে, প্রথমটি হ’ল هداية التوفيق والانتفاع ‘তাওফীক ও উপকার লাভের’ হেদায়াত। দ্বিতীয়টি হ’ল هداية التبيين والإرشاد ‘ব্যাখ্যা ও সুপথ প্রদর্শনের’ হেদায়াত।

(৩) একই দৃষ্টান্ত রয়েছে নিম্নের দু’টি আয়াতে। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ، ‘নিশ্চয়ই তুমি হেদায়াত করতে পারো না যাকে তুমি ভালবাস। বরং আল্লাহই যাকে চান তাকে হেদায়াত করে থাকেন’ (ক্বাছাছ-মাক্কী ২৮/৫৬)। অন্যত্র তিনি বলেন,وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ ‘আর নিশ্চয়ই তুমি প্রদর্শন করে থাক সরল পথ’ (শূরা-মাক্কী ৪২/৫২)। উভয় আয়াতের সমন্বয় এই যে, প্রথমটি হ’ল هداية التوفيق والانتفاع ‘তাওফীক ও উপকার লাভের’ হেদায়াত। দ্বিতীয়টি হ’লهداية التبيين والإرشاد ‘ব্যাখ্যা ও সুপথ প্রদর্শনের’ হেদায়াত।

(৪) আল্লাহ বলেন,شَهِدَ اللهُ أَنَّهُ لآ إِلٰهَ إِلاَّ هُوَ وَالْمَلآئِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ، ‘আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আর ফেরেশতামন্ডলী ও ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগণও’ (আলে ইমরান-মাদানী ৩/১৮)। অন্যত্র তিনি বলেন, إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْقَصَصُ الْحَقُّ وَمَا مِنْ إِلٰهٍ إِلاَّ اللهُ، ‘নিশ্চয় এটিই হ’ল যথার্থ বিবরণ। বস্ত্তত আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’ (আলে ইমরান-মাদানী ৩/৬২)। পক্ষান্তরে আল্লাহ বলেন, فَلاَ تَدْعُ مَعَ اللهِ إِلَهًا آخَرَ، ‘অতএব তুমি আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যকে আহবান করোনা’ (শো‘আরা-মাক্কী ২৬/২১৩)। অন্যত্র তিনি বলেন,فَمَا أَغْنَتْ عَنْهُمْ اٰلِهَتُهُمُ الَّتِي يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللهِ مِنْ شَيْءٍ، ‘অথচ যখন তোমার পালনকর্তার নির্দেশ এসে গেল, তখন তাদের উপাস্যরা তাদের কোন কাজে আসেনি যাদেরকে তারা ডাকত আল্লাহকে ছেড়ে’ (হূদ-মাক্কী ১১/১০১)

প্রথম দু’টি আয়াতে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উলূহিয়াত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরের দু’টি আয়াতে অন্যের জন্য উলূহিয়াত সিদ্ধ করা হয়েছে। উভয়ের সমন্বয় এই যে, প্রথম দু’টিতে উলূহিয়াতকে আল্লাহর সত্য উলূহিয়াতের সাথে খাছ করা হয়েছে। শেষের দু’টিতে মিথ্যা উলূহিয়াত সাব্যস্ত করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,ذَلِكَ بِأَنَّ اللهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ هُوَ الْبَاطِلُ، ‘এটা একারণেও যে, কেবলমাত্র আল্লাহই সত্য এবং তিনি ব্যতীত যাকে তারা ডাকে সবই মিথ্যা’ (হজ্জ-মাদানী ২২/৬২)

(৫) আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنَّ اللهَ لاَ يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ، ‘তুমি বল, আল্লাহ কখনো অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেন না’ (আ‘রাফ-মাক্কী ৭/২৮)। অন্যত্র তিনি বলেন,وَإِذَا أَرَدْنَا أَنْ نُهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيهَا فَفَسَقُوا فِيهَا، ‘যখন আমরা কোন জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি, তখন আমরা সেখানকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নির্দেশ দেই। তখন তারা সেখানে পাপাচারে মেতে ওঠে’ (ইসরা-মাক্কী ১৭/১৬)

প্রথমোক্ত আয়াতে আল্লাহ ফাহেশা কাজে নির্দেশ দেননা বলা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় আয়াতের প্রকাশ্য অর্থে বুঝা যায় যে, আল্লাহ ফাসেকী কাজের নির্দেশ দেন। উভয় আয়াতের সমন্বয় এই যে, প্রথম আয়াতে ‘শারঈ বিধান’ প্রদত্ত হয়েছে। যেমন তিনি বলেছেন,إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ، ‘নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন এবং অশ্লীলতা, অন্যায় ও অবাধ্যতা হ’তে নিষেধ করেন’ (নাহল-মাক্কী ১৬/৯০)। দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহর الأمر الكوني বা ‘সার্বজনীন বিধান’ বর্ণিত হয়েছে। যেমন তিনি বলেন,إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ- ‘যখন তিনি কিছু করতে ইচ্ছা করেন তখন তাকে কেবল বলেন, হও। অতঃপর তা হয়ে যায়’ (ইয়াসীন-মাক্কী ৩৬/৮২)। অতএব উভয় আয়াতের মধ্যে কোন বিরোধ নেই।

(৬) আল্লাহ বলেন,وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ- ‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার বা শাসন করেনা, তারা কাফের’ (মায়েদাহ ৫/৪৪)। এর পরে ৪৫ আয়াতে রয়েছে ‘তারা যালেম’ এবং ৪৭ আয়াতে রয়েছে, ‘তারা ফাসেক’। একই অপরাধের তিন রকম পরিণতি : কাফের, যালেম ও ফাসেক। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে অস্বীকার করল সে কাফের। আর যে ব্যক্তি তা স্বীকার করল, কিন্তু সে অনুযায়ী বিচার করল না সে যালেম ও ফাসেক। সে ইসলামের গন্ডী থেকে বহির্ভূত নয়’।

(৭) আল্লাহ বলেন, قَالَ مَا مَنَعَكَ أَلاَّ تَسْجُدَ إِذْ أَمَرْتُكَ، ‘আল্লাহ বললেন, আমি যখন তোমাকে নির্দেশ দিলাম, তখন কোন্ বস্ত্ত তোমাকে বাধা দিল যে তুমি সিজদা করলে না?’ (আ‘রাফ-মাক্কী ৭/১২)। অথচ অন্যত্র এসেছে,مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ ‘আমি যাকে আমার দু’হাত দিয়ে সৃষ্টি করেছি, তাকে সিজদা করতে কোন বস্ত্ত তোমাকে বাধা দিল? (ছোয়াদ-মাক্কী ৩৮/৭৫)। প্রথম আয়াতে لاَ শব্দটি ‘অতিরিক্ত’ হিসাবে এসেছে। যেমনটি এসেছে সূরা বালাদে।لاَ أُقْسِمُ بِهَذَا الْبَلَدِ ‘আমি শপথ করছি এই নগরীর’ (বালাদ-মাক্কী ৯০/১)। অর্থ أنا أقسم بهذا البلد ‘আমি এই নগরীর শপথ করে বলছি’। বাক্যের শুরুতে لاَ ‘না’ বোধক নয়। বরং ‘অতিরিক্ত’ হিসাবে আনা হয়েছে তম্বীহ ও তাকীদের জন্য এবং প্রতিপক্ষের ভ্রান্ত ধারণা জোরালোভাবে খন্ডন করার জন্য।

(৮) আল্লাহ বলেন, فَيَوْمَئِذٍ لَا يُسْأَلُ عَنْ ذَنْبِهِ إِنْسٌ وَلَا جَانٌّ- ‘সেদিন মানুষ ও জিন তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে না’ (রহমান-মাক্কী ৫৫/৩৯)। অন্যত্র বলা হয়েছে,وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ- ‘যেদিন জীবন্ত প্রোথিত কন্যা সন্তান জিজ্ঞাসিত হবে’ (তাকভীর-মাক্কী ৮১/৮)। এর অর্থالإستخبار والإستعلام ‘খবর নেওয়া’ এবং ‘কারণ কি সে বিষয়ে জ্ঞাত হওয়া’ (শানক্বীত্বী)। নিরপরাধ মযলূম মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করার অর্থ হ’ল যালেম পিতা-মাতাকে তার সামনে ধিক্কার দেওয়া। অথবা হত্যাকারীকে মেয়েটির সামনে ডেকে এনে ধমক দিয়ে বলা হবে, তুমি বলো, কেন মেয়েটি নিহত হ’ল? (ক্বাসেমী)

(৯) আল্লাহ বলেন, قَالَ أَنْظِرْنِي إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ- قَالَ إِنَّكَ مِنَ الْمُنْظَرِينَ ‘সে বলল, আমাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন’। ‘আল্লাহ বললেন, তোমাকে অবকাশ দেওয়া হ’ল’ (আ‘রাফ-মাক্কী ৭/১৪-১৫)। অন্যত্র বলা হয়েছে,إِلَى يَوْمِ الْوَقْتِ الْمَعْلُومِ- ‘অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত’ (হিজর-মাক্কী ১৫/৩৮)। অধিকাংশ বিদ্বানগণের মতে এর অর্থ হ’ল ক্বিয়ামতের দিন প্রথম শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া (শানক্বীত্বী)

(১০) আল্লাহ বলেন,وَإِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً قَالُوا وَجَدْنَا عَلَيْهَا آبَاءَنَا، ‘যখন তারা কোন অশ্লীল কর্ম করে তখন বলে, আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের এরূপ করতে দেখেছি’ (আ‘রাফ-মাক্কী ৭/২৮)। কাফেররা তাদের অশ্লীল কর্মের পক্ষে এভাবে দলীল দিত। এটি ছিল তাদের তাক্বলীদী গোঁড়ামী বা অন্ধ অনুসরণ মাত্র। যেমনটি আল্লাহ অন্যত্র বলেন,إِنَّهُمْ أَلْفَوْا آبَاءَهُمْ ضَالِّينَ- فَهُمْ عَلَى آثَارِهِمْ يُهْرَعُونَ- ‘তারা তাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছিল পথভ্রষ্ট রূপে’। ‘ফলে তারা তাদের পদাংক অনুসরণের প্রতি দ্রুত ধাবিত হয়েছিল’ (ছাফফাত-মাক্কী ৩৭/৬৯-৭০)

(১১) আল্লাহ বলেন,أَلَمْ يَرَوْا أَنَّهُ لاَ يُكَلِّمُهُمْ وَلاَ يَهْدِيهِمْ سَبِيلاً اتَّخَذُوهُ وَكَانُوا ظَالِمِينَ- ‘অথচ তারা কি দেখে না যে সে তাদের সাথে কথা বলে না এবং তাদের কোন পথও দেখায় না? তারা সেটিকে উপাস্য বানিয়ে নিল। বস্ত্তত তারা ছিল সীমালংঘনকারী’ (আ‘রাফ-মাক্কী ৭/১৪৮)। অত্র আয়াতে মূসা (আঃ)-এর কওমের গোবৎস পূজার বিরুদ্ধে ধিক্কার দেওয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ পরের আয়াতেই বলেছেন,وَلَمَّا سُقِطَ فِي أَيْدِيهِمْ وَرَأَوْا أَنَّهُمْ قَدْ ضَلُّوا قَالُوا لَئِنْ لَمْ يَرْحَمْنَا رَبُّنَا وَيَغْفِرْ لَنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ- ‘আর যখন তারা তাদের কৃতকর্মের কারণে লজ্জিত হ’ল এবং দেখল যে, তারা নিশ্চিতভাবেই পথভ্রষ্ট হয়েছে, তখন তারা বলল, আমাদের প্রতিপালক যদি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন এবং আমাদের ক্ষমা না করেন, তাহ’লে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (আ‘রাফ-মাক্কী ৭/১৪৯)। অন্য আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, أَلَمْ يَعِدْكُمْ رَبُّكُمْ وَعْدًا حَسَنًا أَفَطَالَ عَلَيْكُمُ الْعَهْدُ أَمْ أَرَدْتُمْ أَنْ يَحِلَّ عَلَيْكُمْ غَضَبٌ مِنْ رَبِّكُمْ فَأَخْلَفْتُمْ مَوْعِدِي- قَالُوا مَا أَخْلَفْنَا مَوْعِدَكَ بِمَلْكِنَا، ‘তোমাদের প্রতিপালক কি তোমাদেরকে এক উত্তম প্রতিশ্রুতি দেননি? তবে কি প্রতিশ্রুতির সময়কাল তোমাদের নিকট দীর্ঘ হয়ে গেছে? না কি তোমরা চেয়েছ যে, তোমাদের উপর তোমাদের প্রতিপালকের ক্রোধ অবধারিত হয়ে যাক। যে কারণে তোমরা আমার সাথে অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে? (৮৫)। ‘তারা বলল, আমরা আপনার নিকট কৃত অঙ্গীকার স্বেচ্ছায় ভঙ্গ করিনি’ (ত্বোয়াহা-মাক্কী ২০/৮৫-৮৬)

তাদের লজ্জিত হওয়ার পর গোবৎস পূজার শাস্তি হিসাবে আল্লাহ নাযিল করেন। যেমন তিনি বলেন,وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ يَاقَوْمِ إِنَّكُمْ ظَلَمْتُمْ أَنْفُسَكُمْ بِاتِّخَاذِكُمُ الْعِجْلَ فَتُوبُوا إِلَى بَارِئِكُمْ فَاقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ عِنْدَ بَارِئِكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ- ‘আর (স্মরণ কর) যখন মূসা তার সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! নিশ্চয়ই তোমরা গোবৎস পূজার মাধ্যমে নিজেদের উপর যুলুম করেছ। অতএব এখন তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তার নিকট তওবা কর এবং (শাস্তি স্বরূপ) পরস্পরকে হত্যা কর। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর তোমাদের সৃষ্টিকর্তার নিকট। অতঃপর তিনি তোমাদের তওবা কবুল করলেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বাধিক তওবা কবুলকারী ও দয়াবান’ (বাক্বারাহ-মাদানী ২/৫৪)

কেবল মূসা (আঃ)-এর কওমের গোবৎস পূজারীরা নয়, বরং প্রাচীন ও বর্তমান যুগের সকল মূর্তিপূজারী, কবরপূজারী, ভাষ্কর্যপূজারী, ছবি ও প্রতিকৃতি পূজারী সকলের অবস্থা একই। বর্তমান যুগে সভ্যতার সর্বোচ্চ স্তরে এসেও নামধারী জ্ঞানী মানুষদের ধিক্কার দিয়ে কবি ‘আমর বিন মা‘দীকারিব (হি. পূ ৭৫-২১ হি.) বলেন,

لقد أسمعتَ لو ناديتَ حَيًّا + ولكن لا حياة لمن تنادي

ولو نارا نفختَ بها أضاءتْ+ ولكن أنتَ تنفخُ في الرماد

‘যদি তুমি জীবিত ব্যক্তিকে ডাকতে, তাহ’লে তুমি তাকে শুনাতে পারতে + কিন্তু যাকে তুমি ডাকছ তার কোন প্রাণ নেই’। ‘যদি তুমি আগুনে ফুঁক দিতে তাহ’লে সে আলো দিত + কিন্তু তুমি ফুঁক দিচ্ছ ছাইয়ের মধ্যে’।

(১২) আল্লাহ বলেন, فَلَنَقُصَّنَّ عَلَيْهِمْ بِعِلْمٍ وَمَا كُنَّا غَائِبِينَ- ‘অতঃপর আমরা তাদের নিকট সবকিছু বর্ণনা করব পূর্ণজ্ঞান সহকারে। আর আমরা তো তাদের থেকে অনুপস্থিত ছিলাম না’ (আ‘রাফ-মাক্কী ৭/১৪৯)। অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন,وَمَا تَكُونُ فِي شَأْنٍ وَمَا تَتْلُو مِنْهُ مِنْ قُرْآنٍ وَلَا تَعْمَلُونَ مِنْ عَمَلٍ إِلَّا كُنَّا عَلَيْكُمْ شُهُودًا إِذْ تُفِيضُونَ فِيهِ وَمَا يَعْزُبُ عَنْ رَبِّكَ مِنْ مِثْقَالِ ذَرَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَلَا أَصْغَرَ مِنْ ذَلِكَ وَلَا أَكْبَرَ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ- ‘আর যে অবস্থায় তুমি থাক না কেন, কিংবা যে প্রেক্ষিতে তুমি কুরআনের কোন অংশ পাঠ কর না কেন এবং যে কাজই তোমরা কর না কেন, আমরা সেখানে হাযির থাকি যখন তোমরা সে কাজে রত হও। বস্ত্তত নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের এক কণা পরিমাণও তোমার প্রতিপালকের অগোচরে নেই। তার চাইতে ছোট বা বড় সকল বস্ত্তই স্পষ্ট কিতাবে (লওহে মাহফূযে) লিপিবদ্ধ রয়েছে’ (ইউনুস-মাক্কী ১০/৬১)। অত্র আয়াত এবং অন্যান্য বহু আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি বান্দার গোপন ও প্রকাশ্য ছোট ও বড় সককিছুর পূর্ণ খবর রাখেন। তার জানার বাইরে বান্দা কিছুই করতে পারেন না। তিনি সৃষ্টি জগতের সব কিছুর ব্যাপারে সদা প্রহরী। কেবল লওহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ রয়েছে তা নয়, বরং সর্বদা যখনই বান্দা কোন কাজ করে, তখনই আল্লাহ সেখানে হাযির থাকেন এবং তা জানতে পারেন। অত্র আয়াতে আল্লাহ তার ‘ইলম’ গুণকে নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন।

অত্র আয়াতে মু‘তাযিলাদের ভ্রান্ত আক্বীদার প্রতিবাদ রয়েছে। যারা আল্লাহর গুণাবলীকে অস্বীকার করেন। একইভাবে তারা আল্লাহর ক্বাদের, মুরীদ, সামী‘, বাছীর, মুতাকাল্লিম সকলগুণকে অস্বীকার করেন। অথচ এগুলি অত্র আয়াতে এবং অন্যান্য আয়াতে তিনি নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন।

(১৩) আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ مَكَّنَّاكُمْ فِي الْأَرْضِ وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيهَا مَعَايِشَ قَلِيلاً مَا تَشْكُرُونَ- ‘আর আমরা তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তোমাদের জন্য সেখানে জীবিকা সমূহ প্রদান করেছি। কিন্তু তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে থাক’ (আ‘রাফ-মাক্কী ৭/১০)। অত্র আয়াতে জীবিকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ব্যাখ্যা এসেছে অন্যান্য আয়াতে। যেমন আল্লাহ বলেন,فَلْيَنْظُرِ الْإِنْسَانُ إِلَى طَعَامِهِ- أَنَّا صَبَبْنَا الْمَاءَ صَبًّا- ثُمَّ شَقَقْنَا الْأَرْضَ شَقًّا- فَأَنْبَتْنَا فِيهَا حَبًّا- وَعِنَبًا وَقَضْبًا- وَزَيْتُونًا وَنَخْلًا- وَحَدَائِقَ غُلْبًا- وَفَاكِهَةً وَأَبًّا- مَتَاعًا لَكُمْ وَلِأَنْعَامِكُمْ- ‘অতঃপর মানুষ লক্ষ্য করুক তার খাদ্যের দিকে’ (২৪)। ‘আমরাই প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করি’ (২৫)। ‘অতঃপর ভূমিকে উত্তমভাবে বিদীর্ণ করি’ (২৬)। ‘অতঃপর তাতে উৎপন্ন করি খাদ্য-শস্য’ (২৭)। ‘আঙ্গুর ও শাক-সবজি’ (২৮)। ‘যায়তূন ও খর্জুর’ (২৯)। ‘ঘন পল্লবিত উদ্যানরাজি’ (৩১)। ‘এবং ফল-মূল ও ঘাস-পাতা’ (৩১)। ‘তোমাদের ও তোমাদের গবাদিপশুর ভোগ্যবস্ত্ত হিসাবে’ (‘আবাসা-মাক্কী ৮০/২৪-৩২)। অন্য আয়াতে এসেছে,وَالْأَنْعَامَ خَلَقَهَا لَكُمْ فِيهَا دِفْءٌ وَمَنَافِعُ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ- ‘তিনি গবাদিপশু সৃষ্টি করেছেন। তাতে তোমাদের জন্য শীত নিবারণের উপকরণ ও অন্যান্য কল্যাণ রয়েছে এবং সেসব থেকে তোমরা ভক্ষণ করে থাকো’ (নাহল-মাক্কী ১৬/৫)। রয়েছে মৌমাছি থেকে মানুষের জন্য খাদ্য সরবরাহের চমৎকার বিবরণ। যেমন আল্লাহ বলেন,وَأَوْحَى رَبُّكَ إِلَى النَّحْلِ أَنِ اتَّخِذِي مِنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا وَمِنَ الشَّجَرِ وَمِمَّا يَعْرِشُونَ- ثُمَّ كُلِي مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ فَاسْلُكِي سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلاً يَخْرُجُ مِنْ بُطُونِهَا شَرَابٌ مُخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ فِيهِ شِفَاءٌ لِلنَّاسِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَةً لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ- ‘আর তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে প্রত্যাদেশ করলেন যে, তুমি তোমার গৃহ নির্মাণ কর পাহাড়ে, গাছে ও যেখানে মানুষ মাচান নির্মাণ করে’ (৬৮)। ‘অতঃপর তুমি সর্বপ্রকার ফল-মূল হ’তে ভক্ষণ কর। এরপর তোমার প্রভুর দেখানো পথ সমূহে প্রবেশ কর বিনীত ভাবে। তার পেট থেকে নির্গত হয় নানা রংয়ের পানীয়। যার মধ্যে মানুষের জন্য রয়েছে আরোগ্য। নিশ্চয়ই এর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য’ (নাহল-মাক্কী ১৬/৬৮-৬৯)

(১৪) ইবলীসের জওয়াব উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন,قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ- ‘সে বলল, আমি তার চেয়ে উত্তম। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আগুন থেকে এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে’ (আ‘রাফ-মাক্কী ৭/১২)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,وَخَلَقَ الْجَانَّ مِنْ مَارِجٍ مِنْ نَارٍ- ‘এবং জিনকে সৃষ্টি করেছেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হ’তে’ (রহমান-মাক্কী ৫৫/১৫)। ‘অগ্নিস্ফুলিঙ্গ’ কথাটি কেবল ‘আগুন’ হ’তে বিশেষ বৈশিষ্ট্য মন্ডিত। অতএব দু’টি পৃথক। যা থেকে জিন জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

(১৫) আল্লাহ বলেন,قَالَ فَاهْبِطْ مِنْهَا فَمَا يَكُونُ لَكَ أَنْ تَتَكَبَّرَ فِيهَا فَاخْرُجْ إِنَّكَ مِنَ الصَّاغِرِينَ- ‘আল্লাহ বললেন, এখান থেকে তুমি নেমে যাও। এখানে তুমি অহংকার করবে, তা হবে না। অতএব তুমি বেরিয়ে যাও। তুমি লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত’ (আ‘রাফ-মাক্কী ৭/১৩)। الصغار বা ‘লাঞ্ছনা’ কথাটিالذل والهوان বা ‘দীনতা’ ও ‘হীনতা’ হ’তে কঠিন। এর দ্বারা ‘নেমে যাও’ আদেশটির কঠোরতা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন অন্য আয়াতে এসেছে,قَالَ اخْرُجْ مِنْهَا مَذْءُومًا مَدْحُورًا لَمَنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنْكُمْ أَجْمَعِينَ- ‘আল্লাহ বললেন, তুমি এখান থেকে বেরিয়ে যাও ধিকৃত ও বিতাড়িত অবস্থায়। তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সকলকে দিয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করব’ (আ‘রাফ-মাক্কী ৭/১৮)। অত্র আয়াতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, অহংকারী ব্যক্তি তার কাম্যবস্ত্ত বড়ত্ব ও অহমিকা কখনই অর্জন করতে পারবে না। বরং সে তার বিপরীতটিই পাবে। যেমন আল্লাহ বলেছেন,أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِلْمُتَكَبِّرِينَ- ‘বস্ত্তত দাম্ভিকদের ঠিকানা কি জাহান্নামে নয়? (যুমার-মাক্কী ৩৯/৬০)

(১৬) আল্লাহ বলেন,يَابَنِي آدَمَ لاَ يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ كَمَا أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِنَ الْجَنَّةِ، ‘হে আদম সন্তান! শয়তান যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত না করে। যেমন সে তোমাদের আদি পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল’ (আ‘রাফ-মাক্কী ৭/২৭)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, فَقُلْنَا يَاآدَمُ إِنَّ هَذَا عَدُوٌّ لَكَ وَلِزَوْجِكَ فَلَا يُخْرِجَنَّكُمَا مِنَ الْجَنَّةِ فَتَشْقَى- ‘অতঃপর আমরা বললাম, হে আদম! এটি তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু। অতএব সে যেন কিছুতেই তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বের না করে দেয়। তাহ’লে তুমি কষ্টে পতিত হবে’ (ত্বোয়াহা-মাক্কী ২০/১১৭)। প্রথম আয়াতে আদম সন্তান এবং পরের আয়াতে আদম বলে একই বিষয়ে বান্দাকে সাবধান করা হয়েছে। আর সেটি হ’ল শয়তানের ধোঁকা থেকে বেঁচে থাকা। যেটাতে আদম ব্যর্থ হয়েছে। তাকে আগেই সতর্ক করা সত্ত্বে সে সতর্ক হ’তে পারেনি। বান্দা যেন শয়তান থেকে সাবধান হয়।

(১৭) আল্লাহ বলেন,وَأَخَذَ بِرَأْسِ أَخِيهِ يَجُرُّهُ إِلَيْهِ قَالَ ابْنَ أُمَّ إِنَّ الْقَوْمَ اسْتَضْعَفُونِي، ‘এবং তার ভাইয়ের মাথা ধরে নিজের দিকে টানতে লাগল। তখন ভাই বলল, হে আমার সহোদর! সম্প্রদায়ের লোকেরা আমাকে দুর্বল ভেবেছিল’ (আ‘রাফ-মাক্কী ৭/১৫০)। অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা অন্য আয়াতে এসেছে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ قَالَ لَهُمْ هَارُونُ مِنْ قَبْلُ يَاقَوْمِ إِنَّمَا فُتِنْتُمْ بِهِ وَإِنَّ رَبَّكُمُ الرَّحْمَنُ فَاتَّبِعُونِي وَأَطِيعُوا أَمْرِي- قَالُوا لَنْ نَبْرَحَ عَلَيْهِ عَاكِفِينَ حَتَّى يَرْجِعَ إِلَيْنَا مُوسَى- ‘আর অবশ্যই হারূণ তাদের আগেই বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! এর দ্বারা তোমরা একটা পরীক্ষায় পতিত হয়েছ। তোমাদের প্রতিপালক দয়াময়। অতএব তোমরা আমার অনুসরণ কর এবং আমার আদেশ মেনে চল’ (৯০)। তারা বলল, মূসা আমাদের নিকট ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এর পূজাতেই লেগে থাকব’ (ত্বোয়াহা-মাক্কী ২০/৯০-৯১)। অত্র আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ বনু ইস্রাঈলের পথভ্রষ্টতার ব্যাপারে নবী হারূণ (আঃ)-এর নিষ্পাপত্ব ও দায়মুক্তি বর্ণনা করেছেন।

(১৮) আল্লাহ বলেন,قُلْ يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا، ‘তুমি বল, হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল’ (আ‘রাফ-মাক্কী ৭/১৫৮)। এর দ্বারা শেষনবী (ছাঃ)-এর রিসালাতকে তৎকালীন আরবসহ আহলে কিতাবদের জন্য শামিল করা হয়েছে। যেমন অন্য আয়াতে তার ব্যাখ্যা এসেছে,وَقُلْ لِلَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ فَإِنْ أَسْلَمُوا فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلَاغُ، ‘আর তুমি আহলে কিতাব ও (মুশরিক) উম্মীদের বল, তোমরা কি ইসলাম কবুল করলে? যদি করে, তবে তারা সরল পথ প্রাপ্ত হ’ল। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহ’লে তোমার দায়িত্ব কেবল পৌঁছে দেওয়া’ (আলে ইমরান-মাদানী ৩/২০)। অন্য আয়াতে তার রিসালাত পৌঁছার সাথে সাথে কুরআন পৌঁছার কথা বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَأُوحِيَ إِلَيَّ هَذَا الْقُرْآنُ لِأُنْذِرَكُمْ بِهِ وَمَنْ بَلَغَ، ‘আর আমার নিকট অহি করা হয়েছে এই কুরআন, যাতে এর দ্বারা আমি সতর্ক করি তোমাদের ও যাদের নিকট এটি পৌঁছবে’ (আন‘আম-মাক্কী ৬/১৯)। এর দ্বারা পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে যে কোন রং, বর্ণ, ভাষা ও অঞ্চলের মানুষের জন্য কুরআন একমাত্র এলাহী গ্রন্থ এবং শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) একমাত্র রাসূল হিসাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত হয়েছেন।

(১৯) আল্লাহ বলেন,وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّى نَبْعَثَ رَسُولاً- ‘আর আমরা রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেই না’ (বনু ইস্রাঈল-মাক্কী ১৭/১৫)। অত্র আয়াতে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক জাতির নিকট নবী পৌঁছেছেন এবং তাদেরকে জাহান্নাম থেকে সতর্ক করেছেন। অথচ আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا فِي كُلِّ قَرْيَةٍ أَكَابِرَ مُجْرِمِيهَا لِيَمْكُرُوا فِيهَا وَمَا يَمْكُرُونَ إِلَّا بِأَنْفُسِهِمْ وَمَا يَشْعُرُونَ- ‘আর এভাবেই আমরা প্রত্যেক জনপদের শীর্ষ পাপীদের অনুমতি দেই যাতে তারা সেখানে চক্রান্ত করে। অথচ এর দ্বারা তারা কেবল নিজেদেরকেই প্রতারিত করে। কিন্তু তারা তা বুঝতে পারে না’ (আন‘আম-মাক্কী ৬/১২৩)। একদিকে আল্লাহ রাসূল পাঠাচ্ছেন, অন্যদিকে সেখানকার শীর্ষ পাপীদের পাপ কাজের অনুমতি দিচ্ছেন। এর অর্থ অনুমতি নয়, বরং পাপীদের পরীক্ষা করা। এজন্যেই বলা হয়ে থাকে, لِكُلِّ فِرْعَوْنَ مُوسَى ‘প্রত্যেক ফেরাউনের জন্য মূসা রয়েছেন’।[1] যারা ফেরাউনদের উপদেশ দেন। যাতে তারা আল্লাহর পথে ফিরে আসে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَلَنُذِيقَنَّهُمْ مِنَ الْعَذَابِ الْأَدْنَى دُونَ الْعَذَابِ الْأَكْبَرِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ- ‘আর অবশ্যই আমরা তাদেরকে (আখেরাতে) কঠিন শাস্তির পূর্বে (দুনিয়াতে) লঘু শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাবো। যাতে তারা (আল্লাহর পথে) ফিরে আসে’ (সাজদাহ-মাক্কী ৩২/২১)

শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) এসেছিলেন বিশ্বনবী হিসাবে ক্বিয়ামত অবধি বিশ্বের সকল মানুষের নিকটে। এমতাবস্থায় যদি কেউ তার নবুঅত ও রিসালাতকে অস্বীকার করে এবং ইসলামকে অমান্য করে, সে জাহান্নামী হবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يَسْمَعُ بِى أَحَدٌ مِّنْ هٰذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِىٌّ وَلاَ نَصْرَانِىٌّ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِى أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ- ‘যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ তাঁর কসম করে বলছি, ইহূদী হৌক বা নাছারা হৌক এই উম্মতের যে কেউ আমার আগমনের খবর শুনেছে, অতঃপর মৃত্যুবরণ করেছে, অথচ আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি, তার উপরে ঈমান আনেনি, সে অবশ্যই জাহানণামবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (মুসলিম হা/১৫৩; মিশকাত হা/১০)। অতএব কুরআনের উপরোক্ত পরস্পর বিরোধী আয়াত সমূহ আদৌ পরস্পর বিরোধী নয়। বরং পরস্পরের ব্যাখ্যা ও পরিপূরক।

আল্লাহ আমাদেরকে সার্বিক জীবনে তাঁর পূর্ণ অনুসারী হওয়ার তওফীক দিন।-আমীন!


[1]. মিরক্বাত হা/৪৯৮৫-এর আলোচনা, ৮/৩১২৩ পৃ.।






সমাজ পরিবর্তনের স্থায়ী কর্মসূচী (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আছহাবে কাহফ-এর শিক্ষা
আলোর পথ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল্লাহকে উত্তম ঋণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
দ্বীনের উপর দৃঢ়তা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
কুরআন অনুধাবন (প্রথম কিস্তি) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
এক্সিডেন্ট - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
অধিক পাওয়ার আকাংখা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বাহ্যিকভাবে পরস্পর বিরোধী আয়াত সমূহের সমন্বয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
উঠে দাঁড়াও - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মাপে ও ওযনে ফাঁকি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সূদ থেকে বিরত হৌন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.