ব্যক্তিগত
অপারগতা ও অজ্ঞতা; অপরদিকে সামাজিক অবিচার ও অনাচার- মূলতঃ এ দু’টি কারণ
মানুষকে একদিকে যেমন জীবনযুদ্ধে অসহায় ও বিপন্ন করে তোলে, অন্যদিকে সমাজের
বিরুদ্ধে করে তোলে বিক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী। আর এখান থেকেই ধীরে ধীরে
পুঞ্জিভূত হয় হতাশা আর বেদনার এক অবিচ্ছেদ্য মেঘকাব্য। যা কখনও একাকীত্বের
বেদনায় মুষড়ে পড়ে গুমরে গুমরে কাঁদে আবার কখনওবা ক্ষোভের বিজলী বর্ষণে
অবিরল ধারায় ঝরে পড়ে। মানুষের এই জীবনগতি প্রায় সবার ক্ষেত্রে একই রকম। তবে
মূল পার্থক্য ঘটে বোধের জায়গায় এবং নীতির প্রতি অবিচলতায়। যারা ঈমানদার
তারা ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাসকে নিত্য সাথী করে সাধ্যমত আদর্শের পথে নিজেকে
পরিচালনা করেন। কিন্তু যারা ঈমানহীন তারা প্রায়শই এই যুদ্ধের ময়দানে
নিঃশর্ত আত্মসমার্পণ করে স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। আর এই দ্বৈরথের
মাঝে অতিক্রান্ত হচ্ছে মানব সমাজের দৈনন্দিন জীবনাচার।
বাংলাদেশ সহ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বস্ত্তগত উন্নয়নের জোয়ার ক্রমবর্ধমান হ’লেও মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে হতাশার বিস্তার কিন্তু ধীরে ধীরে বাড়ছে। কারণ আধুনিক মিডিয়া ও মার্কেটিং-এর সীমাহীন হাইপে মানুষের ব্যক্তিগত প্রত্যাশার জায়গা যেই উত্তুঙ্গ হারে বাড়ছে, প্রাপ্তির জায়গা নিঃসন্দেহে সেই হারে বাড়ছে না। ফলে মানুষ দ্রুতই নিজেকে প্রতিযোগিতার ময়দানে পরাজিত এবং পশ্চাদপদ ভেবে হতোদ্যম হয়ে পড়ছে। একটা সময় হতাশার গ্রাস থেকে তারা আর নিজেকে বের করে আনতে পারছে না। ফলে অধিকাংশ সময় নেতিবাচক সিদ্ধান্তেই সে মুক্তি খুঁজে নিতে চাচ্ছে। কেউ ক্ষণিকের মিথ্যা সুখের জন্য বেছে নিচ্ছে অনৈতিক সিদ্ধান্ত কিংবা মাদকের মত নীল দংশন, কেউবা চূড়ান্ত পর্যায়ে বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কিছু আত্মহত্যার ঘটনা সবাইকে নাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে ঢাকার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী আবু মুহসিন খান (৫৮)-এর ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা এবং তৎপূর্ববর্তী বক্তব্যসমূহ যথেষ্ট ভাবনার খোরাক যুগিয়েছে এবং ফুটিয়ে তুলেছে দৃশ্যত চাকচিক্যপূর্ণ বর্তমান সমাজব্যবস্থার ভয়াবহ ফাঁপা দিকগুলো। জনাব আবু মুহসিনের কিছু কথা এতটাই বাস্তব ও রূঢ় সত্য, যা আমাদের সমাজ জেনেশুনেই চেপে রাখছে। যেমন- প্রথমতঃ এখান থেকে স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে যে, মানুষ একে অপরের প্রতি দায়িত্ববোধ দিন দিন ভুলে যাচ্ছে এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। শিথিল হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। মানুষ হয়ে পড়ছে নিঃসঙ্গ। সবকিছু থেকেও না থাকার বেদনায় বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে উঠছে তাদের অনেকের কাছেই।
পাশ্চাত্যের প্রচারণায় প্রলুব্ধ সমাজ এখন সন্তান গ্রহণে আগ্রহী নয়। ছেলে হোক, মেয়ে হোক দু’টি সন্তানই যথেষ্ট-এই শ্লোগান ছিল বাংলাদেশে আশির দশকের আর বিংশ শতাব্দীর শ্লোগান হ’ল- ‘দু’টি সন্তানের বেশী নয়, একটি হ’লে ভালো হয়’। এমনকি ২০১২ সালে এক সন্তান নীতি গ্রহণের জন্যও প্রস্তাব উঠেছিল। এই প্রচারণার সামাজিক ক্ষতি হ’ল মানুষ এখন সন্তান নিতে এমন অনাগ্রহী হয়ে উঠেছে যে, দুইয়ের বেশী সন্তান বর্তমানে খুব কম সংখ্যক পরিবারেই রয়েছে। এই দু’একটি সন্তান আবার যখন বড় হচ্ছে খুব স্বাভাবিকভাবেই পড়াশোনা কিংবা জীবিকার তাকীদে তারা পিতা-মাতা থেকে দূর-দূরান্তে চলে যাচ্ছে। তারপর বছরে হয়তো একবার বা দু’বার ঈদ কিংবা বার্ষিক ছুটিতে তাদের সাথে পিতা-মাতার দেখা হয়। আর যারা বিদেশে চলে যায়, তাদের সাথে এই ব্যবধানটা আরো দীর্ঘ হয়। কখনো কয়েক বছর চলে যায়। আর এভাবে সন্তানের অনুপস্থিতিতে একসময় প্রেŠঢ়ত্বে উপনীত হওয়া পিতা-মাতা ভুগতে থাকেন নিঃসঙ্গতায়। একাকিত্বের প্রহরগুলো তাদের জন্য হয়ে ওঠে চরম যন্ত্রণার। ইন্টারনেটের বদৌলতে যোগাযোগব্যবস্থা সহজলভ্য হ’লেও কৃত্রিমতার আবরণ ছেদ করে সেই যোগাযোগ কখনও সন্তানকে পাশে পাওয়ার বিকল্প হয় না। হাজারো মানুষের ভিড়ে প্রিয়জনকে খুঁজে পেতে তাদের অব্যক্ত হৃদয় সদা ব্যাকুল থাকে।
ফলে বাহ্যতঃ সন্তানরা কে কোন দেশে থাকে বা কোথায় বড় বড় চাকুরী করে, তা নিয়ে পিতা-মাতার গর্বভরা কণ্ঠের আড়ালে যে দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে থাকে, তা অদেখাই থেকে যায়। মুখোশের আড়ালে থেকে যায় বেদনার এক অশ্রুঝরা উপাখ্যান। এভাবে আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলো যেমন নড়বড়ে হচ্ছে, তেমনি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বেড়ে উঠছে গুরুজনদের নিবিড় স্নেহ-ভালোবাসার পবিত্র বন্ধন থেকে বঞ্চিত এক কুপমন্ডুক পরিবেশে। এভাবে পাশ্চাত্যের মত আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলো শিথিল হ’তে হ’তে বিচ্ছিন্নতা ও একাকিত্বের ঘেরাটোপে বাধা পড়ছে আমাদের পৌঢ় জীবন।
অর্থ-বিত্তের ঝনঝনানি আর সামাজিক স্ট্যাটাস যে কখনই মানুষকে প্রকৃত শান্তি দিতে পারে না তার বাস্তব উদাহরণ আবু মুহসিন। তার আর্তনাদ- একা থাকা যে কী কষ্ট-যারা একা থাকেন তারাই একমাত্র বলতে পারেন বা বোঝেন। এই আর্তনাদ কেবল আবু মুহসিনের নয়, বরং বর্তমান আধুনিক ও শিক্ষিত সমাজের ঘরে ঘরে কান পাতলে আজ এই আর্তনাদ শোনা যায়। আগামীতে হয়তো আরো শোনা যাবে। যদি না তথাকথিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির আশংকায় সন্তান গ্রহণকে নিরুৎসাহিত করার প্রকৃতিবিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত থেকে আমরা সরে না আসি। আশার কথা যে, চীন, জাপানসহ ইউরোপীয় দেশগুলো ইতিমধ্যে এই নীতির সামাজিক অপকারিতা বুঝতে পেরে পিছু হটেছে এবং জনসংখ্যাকে জনশক্তি হিসাবে বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে আমাদের দেশের সরকারেরও কিছুটা বোধোদয় ঘটেছে এবং জনসংখ্যাকে জাতীয় দুর্যোগ হিসাবে প্রচারের হঠকারিতাও কমিয়ে দিয়েছে। মূলতঃ আল্লাহর আইন বিরোধী কোন পদক্ষেপই সমাজে প্রকৃত শান্তি আনতে পারে না। এই বোধ যত জাগ্রত হবে, ততই আমরা ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের পথে ধাবিত হ’তে পারব ইনশাআল্লাহ।
এই সামাজিক অবক্ষয়ের অপর এক চিত্র আমরা দেখেছি গত ১০ই ফেব্রুয়ারী’২২ রাজধানীর বাড্ডাতে। এক হতভাগ্য পিতা তার ছোট সন্তানকে প্রায় সব সম্পত্তি লিখে দেয়ার পরও তার হাতে নিয়মিত শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত মারা গেছেন। এতেই শেষ হয়নি। সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে দুই সন্তানের কাটাকাটিতে পিতার লাশ ২৪ ঘন্টা বাড়ির গ্যারেজে পড়ে থাকার পর পুলিশ এসে দাফনের ব্যবস্থা করে। দ্বীন শিক্ষার অভাব ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সঠিক চর্চা না থাকায় মানুষ বিশেষ সহায়-সম্পত্তির ব্যাপারে যেন পশুরও অধমে পরিণত হচ্ছে। সামান্য সম্পত্তির লোভে পরিবারগুলোতে জ্বলছে ক্ষোভের আগুন। ভাই-বোনের মধ্যে ভাঙছে সম্পর্ক, দূরত্ব তৈরী হচ্ছে পিতা-মাতার সাথে সন্তানের, নিত্য কলহ চলছে প্রতিবেশীদের মধ্যে। দ্বীনদারী আর সব জায়গায় থাকলেও সহায়-সম্পত্তির আগ্রাসী লোভ তাদের খেয়ে ফেলছে নেকড়ের মত। হিংস্র পশুর চেয়ে তারা ভয়ংকর হয়ে উঠছে সময়ে সময়ে।
দ্বিতীয়তঃ সমাজে ধর্মীয় জ্ঞানের অপপ্রয়োগও প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে এখানে। একজন ব্যক্তি যখন একই সাথে কালেমা পাঠ করে, এমনকি ওমরায় পরিহিত ইহরামের কাপড় দিয়ে কাফন দেয়ার জন্য অছিয়ত করে, আবার দ্বিধাহীন চিত্তে আত্মহননের মত মহাপাপ করে, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে- এখানে তার অভাবটা কিসের? আল্লাহর উপর বিশ্বাস বা ভরসার দুর্বলতা না-কি দ্বীন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের? মানুষ হিসাবে প্রত্যেকের জীবনে কঠিন মুহূর্ত আসতেই পারে, কিন্তু ঈমানদারদের জন্য সেটা কাটিয়ে ওঠা বিশেষ কষ্টসাধ্য নয় যদি আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও ভরসা থাকে। তাছাড়া প্রকৃতপক্ষে যারা দ্বীন বোঝেন, যাদের জীবনটা আল্লাহর সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত, তারা কখনও এমন অবসর খুঁজে পান না যে, একাকিত্বের বেদনায় জীবনটাকে অকেজো করে তুলবেন। বরং এই নিঃসঙ্গ সময়কে তারা আল্লাহর ইবাদতে নিবিষ্ট থাকার মোক্ষম উপলক্ষ হিসাবে নেন। দুনিয়াবী ব্যস্ততা থেকে মুক্ত থেকে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলার এই সুযোগকে বরং তারা সানন্দেই গ্রহণ করেন। যারা মহান প্রভুর সাথে সম্পর্কের এই স্বাদ আস্বাদন করতে পারেনি, একাকী জীবন তাদের জন্য দুর্বিষহ হ’তে পারে, কিন্তু একজন প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তির জন্য তা মোটেই প্রত্যাশিত নয়। এতে বোঝা যায়, এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বীনের প্রতি যথেষ্ট ভালোবাসা রয়েছে, কিন্তু দ্বীন সম্পর্কে ভয়াবহ অজ্ঞতার কারণে অধিকাংশ মানুষ ডুবে আছে কুসংস্কার ও বিভ্রান্তির অতল তলে।
সর্বোপরি বর্তমান প্রেক্ষাপটে যে প্রশ্নটি বার বার আমাদের মনে ধাক্কা দিচ্ছে তা হ’ল, হাজারো ইতিবাচক দিক পেছনে ঠেলে অধিকাংশ মানুষ কেন নেতিবাচক সিদ্ধান্তকেই অগ্রাধিকার দেয়? কেন শত প্রাপ্তির মাঝেও নিজের অপ্রাপ্তিগুলোকেই বড় করে দেখে? কেন হতাশায় মুহ্যমান হয়ে পড়ে অবশেষে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়ার মত চূড়ান্ত পরিকল্পনা পর্যন্ত করে? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা কয়েকটি বিষয়কে সামনে আনতে পারি-
(১) আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের দুর্বলতা : যে ব্যক্তি তার সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে না বা আস্থা রাখে না; সে কখনই জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, সঠিক পথে পরিচালিত হ’তে পারে না। কেননা সে তার জীবনের মূল ভরকেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিশ্বাসে, নিঃশ্বাসে যার যোগ আল্লাহর সাথে, সঠিক পথের যাত্রী হওয়ার নছীব কেবল তারই হয় (আলে ইমরান ৩/১০১)।
(২) জীবনের মূল্য সম্পর্কে অজ্ঞতা : মানুষকে আল্লাহ খুব সংক্ষিপ্ত একটি সময় দিয়েছেন তাকে পরীক্ষা করার জন্য। একজন পরীক্ষার্থী যেমন তার পরীক্ষার মূল্য বুঝে বলে পরীক্ষার হ’লে ভালো ফলাফলের জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করে, শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে; ঠিক তেমনি এই জীবন পরীক্ষাগারের মূল্য সম্পর্কে জ্ঞাত ব্যক্তি প্রতিটি মুহূর্তকে গুরুত্বপূর্ণ ভেবে পরকালীন সাফল্যের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। শুরু কিংবা মধ্যটা খারাপ গেলেও শেষটা ভাল করার জন্য যারপরনেই ইচ্ছা তাকে ব্যতিব্যস্ত রাখে। কিন্তু যে ব্যক্তি অজ্ঞ সে শিশু, পাগল কিংবা চতুষ্পদ জন্তুর মতই উদাসীন থেকে যায়। এই পরীক্ষার হল তার জন্য কেবল সময় পার করার স্থান হয়। জীবনের প্রকৃত মূল্য সে জানে না, অনুধাবনও করতে পারে না। তাই এর বিনাশ সাধনেও সে কুন্ঠাবোধ করে না।
(৩) জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে অসচেতনতা : আল্লাহর দাসত্বকে যে জীবনের মূল লক্ষ্য বানাতে পারেনি, সে নিঃসন্দেহে লক্ষ্যহীন কিংবা ভুল লক্ষ্যপানে ছুটে চলা ব্যক্তি (যারিয়াত ৫১/৫৬)। সে আল্লাহর দাসত্বের মূল অংক মেলানোর কাজ ভুলে সর্বদা ভুল অংক মেলাতে সচেষ্ট হয়। তারপর কোন অংক না মেলাতে পারলে খুব সহজেই সে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
(৪) ধৈর্যের অভাব : পার্থিব জীবন আমাদের পরীক্ষার জীবন। যে কোন সময় যে কোন ধরনের পরীক্ষা আমাদের উপর নেমে আসবে। কখনও সে পরীক্ষা কঠিন থেকে কঠিনতর হবে, কিন্তু কোন অবস্থাতেই হাল ছেড়ে দেয়া মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। সর্বাবস্থায় সে আল্লাহর উপর ভরসা রাখবে এবং ধৈর্য সহকারে সুসময়ের জন্য অপেক্ষা করবে, এটাই ঈমানের দাবী। যারা এই ধৈর্যের নীতি অবলম্বন করে না, তারা অতি সহজেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।
(৫) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ : আধুনিক সমাজব্যবস্থায় প্রত্যেক মানুষ পৃথক এন্টিটি হিসাবে বসবাস করতে চায়। যে যার মত স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে, কেউ কারো ব্যাপারে নাক গলাবে না- এটাই আধুনিক জগতের মূলনীতি। ফলে একে অপরের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া এখানে যরূরী নয়। স্বার্থপরতা, অসামাজিকতা, আত্মকেন্দ্রিকতা এই সমাজব্যবস্থার আবশ্যিক অনুষঙ্গ। একে অপরের অতি কাছে থেকেও তারা একেকজন বসবাস করে অবরুদ্ধ জানালা লাগিয়ে। ফলে ফিতরাতবিরোধী এই সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ সহজেই হতাশা ও বিষণ্ণতাগ্রস্ত হচ্ছে।
মুক্তির পথ :
এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে চাইলে করণীয় হ’ল-
প্রথমতঃ ইতিবাচক জীবন যাপন করা : মনে রাখতে হবে, মানুষের জীবন ভালো-মন্দ, সহজ-কঠিন, ইতি আর নেতির বিচিত্র সমাহার। জীবনে কখনো ভালো সময় আসবে, কখনও মন্দ সময় আসবে এটাই জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। অতএব একজন মুমিন ব্যক্তি সর্বদা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে তার জীবন পরিচালনা করবে। এমনভাবে যে, আনন্দের সময় সে আত্মহারা হবে না, আবার দুঃখের সময় শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়বে না। জীবনের সকল অবস্থায় শোকর ও ছবরের মাধ্যমে ভারসাম্য বজায় রাখবে। সবকিছুকে যথাসম্ভব ইতিবাচকভাবে নেবে। যেমন ওহুদ যুদ্ধের সাময়িক পরাজয়ে যেন মুসলমানরা অধিক শোকাকুল না হয়, সেজন্য ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালনের জন্য আল্লাহ রাববুল আলামীনের সান্ত্বনা সূচক বক্তব্য, ‘তোমাদেরকে যদি আঘাত লেগে থাকে, অনুরূপ আঘাত (বদর যুদ্ধে) তো তাদেরও লেগেছে এবং মানুষের মধ্যে এ (বিপদের) দিনগুলিকে পর্যায়ক্রমে অদল-বদল করে থাকি’ (আলে ইমরান ৩/১৪০)। ঈমানদারের পরিচয় দিতে গিয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মুমিনের অবস্থা বিস্ময়কর। সকল কাজই তার জন্য কল্যাণকর। মুমিন ছাড়া অন্য কেউ এ বৈশিষ্ট্য লাভ করতে পারে না। যখন তারা কল্যাণ ও মঙ্গলের মধ্যে থাকে, তখন শোকর গোযার থাকে। আর যখন অসচ্ছলতা কিংবা বিপদাপদে আক্রান্ত হয়, তখন ধৈর্য ধারণ করে। ফলে প্রতিটি অবস্থাই তার জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়’ (মুসলিম হা/৭৩৯০)।
দ্বিতীয়তঃ হতাশাকে প্রশ্রয় না দেয়া : আমাদের যাপিত জীবনে সুখ-দুঃখের সাথে হতাশার যোগ খুবই ওতপ্রোত। যে কোন অপ্রত্যাশিত কথায় ও কাজে কিংবা অপ্রাপ্তির বেদনায় আমাদের মধ্যে হতাশা আসতেই পারে। কিন্তু একজন বিশ্বাসী মানুষ তা নিজের মধ্যে জিইয়ে রাখতে পারে না। তার চেষ্টা থাকে যে কোন মূল্যে তা দূরীভুত করা কিংবা ভুলে যাওয়া। কেননা আল্লাহর বাণী হ’ল- ‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া পথভ্রষ্ট লোকদের কাজ’ (হিজর ৫৬)। কুরআনে অন্যত্র এসেছে, তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই অবিশ্বাসীরা ব্যতীত কেউই আল্লাহর করুণা থেকে নিরাশ হয় না (ইউসুফ ১২/৮৭)। আল্লাহ বলেন, এই পৃথিবীতে কিংবা তোমাদের ব্যক্তিজীবনে যে সকল বিপদাপদ আসে, তা ঘটার আগেই আমি তা কিতাবে (তাকদীরে) লিপিবদ্ধ করে রেখেছি। নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর পক্ষে খুব সহজ। এটা এজন্য যে, তোমরা যা হারিয়েছ তাতে যেন তোমরা বিমর্ষ না হও এবং যা তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন তার জন্য আনন্দে উদ্বেলিত না হও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পসন্দ করেন না কোন উদ্ধত-অহংকারীকে (হাদীদ ৫৭/২২-২৩)। সর্বাবস্থায় আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকাই ঈমানদারের পরিচয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘সে ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ পেয়েছে যে, আল্লাহকে রব, ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে রাসূল হিসাবে পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছে’ (মুসলিম হা/৫৭)।
তৃতীয়তঃ মানুষের সাথে সুসম্পর্ক রাখা : মানুষের সাথে মিশতে পারা এবং তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে পারা হতাশা ও বিষণ্ণতা থেকে বেরিয়ে আসার অন্যতম কার্যকর মহৌষধ। এজন্য রাসূল (ছাঃ) আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখাকে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছেন। আত্মকেন্দ্রিক ও অসামাজিক মানুষ বরাবরই নিজের কষ্টের সময়গুলো মানুষের সাথে ভাগাভাগি করতে না পেরে নিদারুণ মানসিক কষ্টে আপতিত হয়। সুতরাং সমাজের ভালো মানুষদের সংস্পর্শে থাকা, সংঘবদ্ধ ও সাংগঠনিক জীবন যাপন করা মানুষের জন্য খুবই যরূরী এবং ইসলামের অন্যতম নির্দেশনা। একাকী বিচ্ছিন্ন জীবন ইসলামের কাম্য নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, জামা‘আতবদ্ধ জীবন রহমত আর বিচ্ছিন্ন জীবন হ’ল আযাব (ছহীহুল জামে‘ হা/৩১০৯)। তিনি আরো বলেন, তোমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বসবাস কর। বিচ্ছিন্নতা থেকে সাবধান থাক। কেননা শয়তান বিচ্ছিন্নজনের সাথে থাকে এবং সে দু’জন (ঐক্যবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ) মানুষ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। যে লোক জান্নাতের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম জায়গার ইচ্ছা পোষণ করে সে যেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকে’ (তিরমিযী হা/২১৬৫)।
চতুর্থতঃ শয়তানী কুমন্ত্রণার ব্যাপারে সতর্ক থাকা : শয়তান মানুষের চূড়ান্ত শত্রু। সে সর্বদা কুমন্ত্রণা যোগায় মানুষকে অন্যায় পথে নেয়ার জন্য। আল্লাহ বলেন, ‘শয়তান তোমাদের দারিদ্রের ভয় দেখায় এবং অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেয়। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন’ (বাক্বারাহ ২/২৬৮)। এজন্য সর্বদা শয়তানের ফেরেব থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক।
পঞ্চমতঃ তাক্বদীর ও তাওয়াক্কুল অবলম্বন করা : আল্লাহর উপর ভরসা ও তাক্বদীরে বিশ্বাস যে কোন মানুষের জন্য অফুরন্ত আত্মবিশ্বাস ও সৃদৃঢ় মনোবলের খোরাক। কেননা সে জানে যে, সবকিছুর নিয়ন্তা আল্লাহ রাববুল আলামীন। বিশ্বাসী বান্দার একান্ত মঙ্গলের জন্যই তাঁর কর্মপরিকল্পনা। এই বিশ্বাস তাকে কখনও পথ হারাতে দেয় না। আশার প্রদীপ নেভাতে দেয় না। বরং বুক ভরে প্রশান্তির নিঃশ্বাসে সে সর্বাবস্থায় বলতে পারে- আলহামদুলিল্লাহ। সুতরাং আল্লাহর প্রতি এই দৃঢ় ঈমান ও ইস্তিকামাত যে কোন হতাশা থেকে মুক্তির অব্যর্থ মাধ্যম।
আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের সকলকে দুনিয়াবী পরীক্ষার মঞ্চে সদা-সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের উপর অবিচল রাখুন এবং যাবতীয় হতাশা থেকে মুক্ত থেকে আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রেখে জীবন পরিচালনার তাওফীক দিন। আমীন!