
শফীক ছাহেব খুব চিন্তিত। পার্কে বসে বসে ভাবছেন, তাঁর ১৪ বছর বয়সী ছেলে রফীকের পড়াশোনা দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। গল্প, উপন্যাস, ছড়া-কবিতা, সাইন্স ফিকশন তো দূরে থাক, ছেলেটা স্কুলের বইও এখন পড়তে চায় না। কি করে যে ছেলেটাকে পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ করা যায়। প্রথমে তিনি এর কারণ খুঁজতে শুরু করলেন। অনেকক্ষণ চিন্তার পর বুঝতে পারলেন, ছেলেটা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন গেমস ও খারাপ বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়েছে। গেমস আর আড্ডার পাশাপাশি নির্দিষ্ট কিছু টিভি চ্যানেলের প্রতিও রয়েছে তার দারুন আসক্তি।
এই সমস্যা সমাধানের জন্যে তিনি উপায় খুঁজতে শুরু করলেন। তাৎক্ষণিক শফীক ছাহেবের মাথায় চমৎকার একটা আইডিয়া চলে আসল। তিনি তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসলেন। বাসায় এসেই তিনি ছেলেকে ডেকে বললেন, শোন বাবা, তুমি যদি প্রতি সপ্তাহে স্কুলের পড়ার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস বা সাইন্স ফিকশনের নতুন একটি বই পড়ে শেষ করতে পারো তাহ’লে তোমাকে প্রতি সপ্তাহে সুন্দর একটা গিফট দিব।
ছেলে বাবার কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল, ঠিক আছে, আমাকে যদি একটা আইপ্যাড কিনে দেন, তাহ’লেই আমি প্রতি সপ্তাহে একটি করে বই শেষ করব। শফীক ছাহেব তো মহা খুশি। কারণ তিনি চেয়েছেন তার সন্তানের মনে বই পড়ার প্রতি ভালোবাসা তৈরি করবেন। তাই তিনি পরের দিনই ছেলের জন্য একটি আইপ্যাড কিনে নিয়ে আসলেন আর সাথে আনলেন কিছু বই।
ছেলেটা প্রথম দুই-তিন দিন দুই-চার পৃষ্ঠা করে পড়লেও ধীরে ধীরে আবার আগের মতই সারাদিন গেমস ও বন্ধুদের সাথে আড্ডা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে শুরু করল। উল্টো আইপ্যাড পেয়ে তার আগের থেকেও বেশী অবনতি হয়ে গেল। ফলে শফীক ছাহেব বুঝতে পারলেন, ছোটবেলায় তিনি যে অবহেলা করেছেন তার প্রভাব বর্তমানে ছেলের উপর পড়েছে। ছোটবেলায় তিনি সন্তানকে বই পড়ার ব্যাপারে কখনোই উদ্বুদ্ধ করেননি বরং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস দিয়েই সন্তানকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। সুতরাং এখন চাইলেও সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে না।
গল্পটা শুধু একজন বাবার নয়, আমাদের আশেপাশে এমন বাবা আর সন্তানের অভাব নেই। আমরা সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে শিখিনি। একারণে অভিভাবকদের বলব, বাচ্চার শৈশবের এই সময়টা আর ফিরে পাবেন না। সন্তানদের পড়ার অভ্যাস তৈরি করার সুযোগটা খুব সীমিত। একবার সেটা হারিয়ে গেলে, পরে গড়ে তোলা ভীষণ কঠিন।
সুতরাং আমরা যদি চাই আমাদের সন্তান পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠুক তবে বই পড়াকে আমাদের পারিবারিক সংস্কৃতি হিসাবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এই বিষয়েই আজ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিব ইনশাআল্লাহ।
সফল ও প্রতিভাবান সন্তান গড়ে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ রহস্য হ’ল, বই পড়াকে পারিবারিক সংস্কৃতি হিসাবে গড়ে তোলা। বইয়ের সাথে সম্পর্ক তৈরী করা। বই পড়ার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখার অনেক কারণ রয়েছে। বই আমাদের জ্ঞান বাড়ায়। বই পড়ার মাধ্যমে বাচ্চারা নতুন নতুন জিনিস শিখতে পারে। তাদের জ্ঞানের গভীরতা বৃদ্ধি পায়। তাদের চিন্তার জগৎ বিস্তৃত হয়। পাশাপাশি বই আমাদের কল্পনা শক্তি বাড়ায়। বইয়ের গল্পের মাধ্যমে বাচ্চারা নতুন নতুন জিনিস কল্পনা করতে শিখে। অনেক সমস্যার সমাধান করতে শিখে।
আপনি অবশ্যই চাইবেন, আপনার শিশু সুন্দর ভাষা শিখুক। এই দিকটা লক্ষ্য করলেও আমরা বই পড়াকে প্রাধান্য দিতে পারি। কারণ বই পড়ার মাধ্যমে বাচ্চারা নতুন শব্দ শিখে এবং তাদের ভাষা দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। এ পর্যায়ে আমরা বই পড়াকে পারিবারিক সংস্কৃতি হিসাবে গড়ে তুলতে আমাদের কিছু করণীয় আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
বাড়িতে লাইব্রেরী তৈরি করা : বাড়িতে বিভিন্ন রকমের বই সংগ্রহ করে লাইব্রেরী তৈরি করুন। বিশেষ করে নবী-রাসূল, ছাহাবী ও মনীষীদের জীবনী, সাইন্স ফিকশন, সাধারণ জ্ঞান, ছড়া-কবিতা ও শিক্ষামূলক বই রাখার চেষ্টা করবেন। তবে চেষ্টা করবেন রূপকথার গল্পের বই কেনা থেকে বিরত থাকতে। কারণ রূপকথার গল্পে কোন শিক্ষা থাকে না। রূপকথা হ’ল কল্পনা মাত্র। বাস্তব কোনদিন ওর ধারে কাছেও যায় না। বরং এসব গল্পের মাধ্যমে তারা সত্যিকার মানুষ হিসাবে নিজেকে গড়ে তোলার পরিবর্তে একটা কাল্পনিক সুপার পাওয়ারের অপেক্ষায় থাকে। যা কখনোই সম্ভব নয়।
তহবিল গঠন : পরিবারের সবাই মিলে বই কেনার জন্য টাকা জমা করুন। মাস শেষে ঐ টাকা দিয়ে পসন্দের বই কিনুন। মাসে ২টি করে বই কিনলে বছরে ২৪টি, ১০ বছরে ২৪০টি বইয়ের বড় একটা লাইব্রেরী এমনিতেই হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ইভেন্ট কেন্দ্রিক বই কেনার আয়োজন করতে পারেন। যেমন রামাযানে কিছু ছিয়াম-ক্বিয়াম, ই‘তেকাফ, যাকাত-ছাদাক্বা ইত্যাদি সংক্রান্ত বই কিনলেন।
বইমেলা ও লাইব্রেরীতে ঘুরতে যাওয়া : প্রতিবছর একবার হ’লেও বাচ্চাদের নিয়ে বই মেলায় ঘুরে আসুন। তবে বেশী ভাল হয় আশেপাশের বইয়ের দোকানগুলোতে বাচ্চাদের নিয়ে মাঝে মাঝেই ঘুরতে যাওয়া। বই দেখা, বই পসন্দ করে রাখা ইত্যাদি। যেন তারা বুঝতে পারে, বই আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্ত্ত।
শুধুমাত্র পাঠ্যবই ও শিক্ষকদের সাজেস্ট করা বই কেনা থেকে বিরত থাকুন : অধিকাংশ অভিভাবক বাচ্চাদের জন্য বই কিনতে কৃপণতা করেন। তারা শুধুমাত্র স্কুলের পাঠ্যবই, গাইড বই ও শিক্ষকদের সাজেস্টকৃত বই ছাড়া অন্য বই পড়াকে সময় অপচয় ও টাকা নষ্ট হবে বলে ধারণা করেন। যা সঠিক চিন্তা নয়। বই কিনতে কখনো কৃপণতা করবেন না। সামর্থ্য অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বইগুলো কিনুন।
দৃষ্টান্ত স্থাপন : আপনি নিজেও বই পড়ুন। এতে বাচ্চা আপনাকে অনুকরণ করবে। অর্থাৎ আপনি যদি সারাদিন মোবাইল, টেলিভিশন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, সন্তানদের সামনে সারাক্ষণ ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব নিয়ে পড়ে থাকেন তাহ’লে আপনার সন্তান কখনোই বই পড়াকে অভ্যাসে পরিণত করতে পারবে না। বরং আপনার অনুকরণে তারাও ইলেকট্রনিক ডিভাইসে আসক্ত হয়ে পড়বে। তাই সবার আগে বই পড়ার অভ্যাসটা নিজের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে।
পড়ার পরিবেশ তৈরি করুন : শিশুদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করার জন্য একটি আনন্দময় এবং উৎসাহবর্ধক পরিবেশ গড়ে তোলা খুবই যরূরী। বাড়িতে একটি জায়গা পড়ার জন্য নির্বাচন করুন। অবশ্যই জায়গাটি আকর্ষণীয় ও আরামদায়ক হওয়া উচিত। এছাড়া জায়গাটি যেন শান্ত ও আলোকিত হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
বই পড়ার জন্য সময় নির্ধারণ করুন : প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় পাঠ্যবইয়ের বাইরে অতিরিক্ত (গল্প-উপন্যাস, ছড়া-কবিতার) বই পড়ার জন্য নির্ধারণ করুন। ঐ সময়ে পরিবারের সবাই মিলে বই পড়ুন। এই পদ্ধতি কিছুটা কঠিন হ’লেও বেশ ফলদায়ক।
বাচ্চার সাথে আলোচনা করুন : বই পড়ার পরে বাচ্চার সাথে বই সম্পর্কে আলোচনা করুন। বই থেকে কোন শিক্ষামূলক ঘটনা থাকলে তাকে বুঝিয়ে বলুন। বই সম্পর্কে তার মন্তব্য কি সেটা জানতে চান। শিশুর মনে কোন প্রশ্নের উদ্রেক হ’লেসেটা সমাধান করার চেষ্টা করুন। এভাবে পাঠকে সর্বদা আলোচনায় রাখুন।
পারিবারিক প্রতিযোগিতা ও পুরষ্কারের আয়োজন করুন : যেকোন একটি বই সিলেক্ট করে বইটি নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারেন। যেমন ৩-৫ দিনের মধ্যে বইটি পড়ে শেষ করা, বই থেকে কুইজের আয়োজন করা ইত্যাদি।
পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা শিশুর সার্বিক বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শিশুর ভাষা, চিন্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি এবং জ্ঞানের বিকাশ ঘটাবে। বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুললে তারা ভবিষ্যতে সহজেই সফল হ’তে পারবে ইনশাআল্লাহ। তাই বাড়িতে বই পড়ার পরিবেশ তৈরি করুন এবং বাচ্চাদের মোবাইল ফোন কম ব্যবহার করার জন্য উৎসাহিত করুন। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন!
জাহিদ হাসান
সহকারী শিক্ষক, শান্তি নিকেতন ইন্সটিটিউট, ফেনী।