উত্তর : কেবল ভোগের সামগ্রী নয়। বরং তাদের সামাজিক নিরাপত্তাই এখানে প্রধান। আর যুদ্ধবন্দীদের এই বিধান ইসলামপূর্ব যামানা থেকেই চালু ছিল। ইসলাম সেটা বাতিল করেনি। আল্লাহ বলেন, তবে তাদের স্ত্রীগণ ও মালিকানাধীন দাসীরা ব্যতীত। কেননা এতে তারা নিন্দিত হবে না’ (মুমিনুন ২৩/৬)। এর পিছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন- (১) এর মাধ্যমে বিজিত অঞ্চলের অসহায়, অভিভাবকহীন নারীদের জন্য আশ্রয় ও ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা এবং প্রায় স্ত্রীর সমান মর্যাদা দিয়ে তাদেরকে রক্ষণাবেক্ষণ ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। কেননা এসব নারী তার পুরুষ অভিভাবকের অনুপস্থিতিতে যে কোন মুহূর্তে ধর্ষণের শিকার হ’তে পারে। (২) বন্দীত্ব বরণ সত্ত্বেও তাদের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা। (৩) নারী হিসাবে তার শারিরীক ও মানসিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা রাখা। কেননা এরূপ সুযোগ না পেলে হয়ত একাধিক ব্যক্তির সাথে যেনায় লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। (৪) তার সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা। কেননা যদি তার গর্ভে সন্তান জন্ম গ্রহণ করে তবে সে উম্মে ওয়ালাদ হবে। যে মনিবের মৃত্যুর সাথে সাথে স্বাধীন হয়ে যাবে। অর্থাৎ সে স্বাধীনা নারীর মত মর্যাদা লাভ করবে। (৫) মুসলমানদের সংস্পর্শে রেখে তাদের ইসলাম গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা।
উল্লেখ্য যে, যুদ্ধবন্দী সম্পর্কে ইসলামে যে বিধান রয়েছে, তাতে শাসক বা সেনাপতির অনুমতি ছাড়া ঢালাওভাবে কোন যুদ্ধবন্দীনীকে দাসী হিসাবে গ্রহণ করার অধিকার নেই। আবার কোন নারীর পূর্ব স্বামী থাকলে ইদ্দত শেষ হওয়ার পূর্বে তার সাথে সহবাস করা বৈধ নয়। তেমনি একমাত্র মনিব ভিন্ন অন্য কেউ সেই দাসীর সাথে মিলন করতে পারবে না (আবুদাউদ হা/২১৫৮; মিশকাত হা/৩৩৩৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৫০৭)। এছাড়া কোন গর্ভবতী বন্দীনীর সাথে তার সন্তান প্রসবের আগে সহবাস নিষিদ্ধ (তিরমিযী হা/১৫৬৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৪৭৯)। সুতরাং এই আইনে যুদ্ধাবস্থাতেও নারীর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদান করা হয়েছে।
এতদ্ব্যতীত যুদ্ধবন্দীনী মাত্রই যে দাসী হবে তা নয়। কেননা ইসলামী শাসক বা তার পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ইসলামের স্বার্থে কল্যাণকর মনে করলে চারটি সিদ্ধান্তের যে কোনটি গ্রহণ করতে পারে- (১) বন্দীকে ক্ষমা করে মুক্ত করে দেওয়া (২) নির্দিষ্ট সম্পদের বিনিময়ে মুক্ত করে দেওয়া অথবা বন্দী বিনিময় করে নেওয়া (৩) দাস/দাসী হিসাবে গণ্য করা (৪) অথবা বন্দীকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা (ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ, পৃ. ৩/৯৯; ৫/৬০)। তবে নারী ও শিশু বন্দীদের ক্ষেত্রে হত্যার বিধান প্রযোজ্য নয়।
স্মর্তব্য যে, এই দাসত্ববরণ চিরস্থায়ী নয়। বরং মনিব চাইলে তাকে যে কোন সময় মুক্ত করে দিতে পারে। ইসলামী শরী‘আত বিভিন্ন ছোট-খাট অন্যায় বা ইবাদতের ত্রুটি মোচন কিংবা বিশেষ ফযীলত কিংবা ছওয়াব লাভের মাধ্যম হিসাবে দাস/দাসী মুক্ত করাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। আবার চাইলে মনিব তাকে বিবাহ করে স্ত্রীর মর্যাদাও দিতে পারে। ইসলামে এ ব্যাপারেও উৎসাহিত করা হয়েছে (বাক্বারাহ ২/২২১)।
সুতরাং এটাই স্বতঃসিদ্ধ যে, অমুসলিম সমাজে যেভাবে যুদ্ধবন্দীনীদেরকে স্রেফ ভোগের সামগ্রী ও যৌনদাসী হিসাবে গণ্য করা হ’ত, তার সাথে ইসলামের বিধান কোনভাবেই তুলনীয় নয়। কেননা ইসলাম সর্বাবস্থায় মৌলিক মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। যুদ্ধবন্দী করার উদ্দেশ্য ছিল- শত্রুদের শক্তি ও মনোবল ভেঙ্গে দেয়া, তাদের অন্যায়কে প্রতিহত করা এবং তাদেরকে যুদ্ধের ময়দান থেকে বিতাড়িত করা। যদি সে উদ্দেশ্য অন্যভাবে পূরণ হয়ে যেত, তাহ’লে রাসূল (ছাঃ) শত্রুকে যুদ্ধবন্দী না করে মুক্ত করে দিতেন। যেমন তিনি মক্কা বিজয়ের যুদ্ধবন্দীদের ও বনী মুছত্বালিক্ব এবং হুনাইনের যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করে দিয়েছিলেন (ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৬৮৮)। অতএব যুদ্ধকালীন বাস্তবতা, সামাজিক পরিস্থিতি, মানবাধিকার সুরক্ষা প্রভৃতি বিষয় মাথায় রেখে ইসলাম এক্ষেত্রে যে ভারসাম্যপূর্ণ বিধান দিয়েছে, তার কোন বিকল্প নেই। যে কোন বিবেকবান মানুষ তা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন (বিস্ত্তারিত দ্রঃ: মুহাম্মাদ কুতুব, ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম)।