উত্তর : ৩৬ হিজরীতে সংঘটিত উষ্ট্রের যুদ্ধের ন্যায় ৩৭ হিজরীর ছিফফীন যুদ্ধেরও মূল কারণ ছিল ওছমান (রাঃ)-এর হত্যাকারী বিদ্রোহীদের গভীর ষড়যন্ত্র। ৩৫ হিজরীর যিলহাজ্জ মাসে ওছমান (রাঃ) শাহাদত বরণ করলে লোকেরা আলী (রাঃ)-এর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করে। বিদ্রোহীরাও আলী (রাঃ)-এর হাতে বায়‘আত নেয়। আলী (রাঃ) প্রথমে রাষ্ট্রীয় শৃংখলা ফিরিয়ে আনার জন্য এবং বিদ্রোহীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে বিরূপ বাস্তবতার নিরিখে বাধ্য হয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কিছুটা বিলম্ব করেন। এতে ওছমান (রাঃ)-এর চাচাতো ভাই সিরিয়ার আমীর মু‘আবিয়া (রাঃ) ও তার সাথীরা তাঁর প্রতি রুষ্ট হন। যদিও মু‘আবিয়া হযরত আলী (রাঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্বকে দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করতেন। কিন্তু তিনি ওছমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত বায়‘আত করতে অস্বীকার করেন। ফলে আলী (রাঃ) ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মধ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
আলী (রাঃ)-এর খেলাফত ছিল সর্বসম্মত। আর কারো অবাধ্যতার জন্য খেলাফত ত্যাগ করা হাদীছ সম্মত নয়। কেননা তাতে খেলাফতের ঐক্য বিনষ্ট হয়। যেমন ওছমান (রাঃ)-এর প্রতি অছিয়ত করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছিলেন, ‘হয়ত আল্লাহ তোমাকে একটি জামা পরিধান করাবেন। পরে যদি লোকেরা তোমার সেই জামাটি খুলে নিতে চায়, তখন তুমি তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী জামাটি খুলে ফেলো না’ (তিরমিযী হা/৩৭০৫; ইবনু মাজাহ হা/১১২; মিশকাত হা/৬০৬৮)। এখানে জামাটি অর্থ খেলাফত (মিরক্বাত)।
অতঃপর ৩৭ হিজরীর ছফর মাসে ছিফফীন যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাবেঈ বিদ্বান মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (৩৩-১১০ হি.)-এর ধারণা মতে, তিন দিন তিন রাতের এই যুদ্ধে ৭০ হাযার মুসলমান নিহত হন। প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুর রহমান বিন আবযী বলেন, লোকেরা ধারণা করে যে, ৭০ হাযারের মধ্যে ৪৫ হাযার সিরীয় পক্ষে এবং ২৫ হাযার ইরাকীদের পক্ষে নিহত হন (আকরাম যিয়া, ‘আছরুল খিলাফাহ ৪৭১-৭২ পৃ.)। নিঃসন্দেহে এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসে একটি মহা বিপর্যয়কর ঘটনা।
ছিফফীন যুদ্ধের কারণ : (১) ওছমান হত্যাকারীদের বিচারে বিলম্ব করা। (২) দ্রুত বিচারের জন্য যিদ করা। (৩) ওছমান হত্যাকারীদের গোপন ষড়যন্ত্র। যাতে তারা বেঁচে যেতে পারে। (৪) হাদীছের সঠিক ব্যাখ্যা বুঝতে না পারা। যেমন (ক) জুবায়ের বিন নুফায়ের বলেন, ওছমান হত্যার পর আমরা মু‘আবিয়ার সেনাবাহিনীতে ছিলাম। অতঃপর একদিন কা‘ব বিন মুররা আল-বাহযী দাঁড়িয়ে বলেন, আমি যদি রাসূল (ছাঃ)-এর একটি হাদীছ না শুনতাম তাহ’লে এ স্থানে যুদ্ধ করতে আসতাম না। রাসূল (ছাঃ)-এর নাম শুনে লোকেরা তার চার পাশে বসে পড়ল। তখন তিনি বললেন, একদা আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বসা ছিলাম। এমন সময় ওছমান (রাঃ) পায়ে হেঁটে অতিক্রম করছিলেন। তখন আল্লাহর রাসূল বললেন, অবশ্যই এই পদদ্বয়ের নিচ থেকে ফিৎনার আবির্ভাব ঘটবে। সেদিন এই ব্যক্তি ও তার অনুসারীরা হেদায়াতের উপর থাকবে। তিনি বলেন, আমি উঠে গিয়ে ওছমানের কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, ইনি কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। সেদিন এই ব্যক্তি ও তার অনুসারীরা হেদায়াতের উপর থাকবে। এমন সময় আব্দুল্লাহ ইবনু হাওয়ালা আনছারী মিম্বরের কাছ থেকে উঠে গিয়ে বললেন, আপনি নিজে এটা শুনেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আল্লাহর কসম! আমি ঐ মজলিসে উপস্থিত ছিলাম। আমি যদি জানতাম যে, সৈন্যদের মাঝে আমার কোন সত্যায়নকারী হবে, তাহ’লে আমি প্রথমেই এ বিষয়ে কথা বলতাম’ (ত্বাবারাণী কাবীর হা/৭৫৩; আহমাদ হা/১৮০৯২; ছহীহাহ হা/৩১১৯)। অর্থাৎ ওছমান (রাঃ) হক-এর উপর ছিলেন বলেই তাঁর পক্ষ অবলম্বনকারী মু‘আবিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছি।
(খ) গৃহবন্দী অবস্থায় অনুমতি নিয়ে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) খলীফার নিকট গেলে সেখানে দাঁড়িয়ে হাম্দ ও ছানার পর তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, আমার পরে সত্বর তোমরা বহু মতভেদ ও ফিৎনায় জড়িয়ে পড়বে। তখন লোকদের মধ্যে একজন বলল, হে আল্লাহর রাসূল! সে অবস্থায় আপনি আমাদের কি নির্দেশ দিচ্ছেন? তিনি ওছমানের দিকে ইশারা করে বললেন, তোমরা আমীর ও তাঁর সাথীদের সাথে থাকবে’ (হাকেম হা/৮৩৩৫ ৪/৪৮০; মিশকাত হা/৬০৭৩, সনদ ছহীহ)। মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে, ‘আমীন’ (বিশ্বস্ত) (আহমাদ হা/৮৫২২)।
(গ) গৃহবন্দীত্বকালে ওছমান (রাঃ)-এর গোলাম আবু সাহলাহ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, আমরা কি আপনার পক্ষে যুদ্ধ করবো না? জবাবে তিনি বললেন, না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে একটি বিষয়ে অছিয়ত করেছেন। অতএব আমি নিজেকে তার উপরে অবিচল রাখব’ (হাকেম হা/৪৫৪৩; মিশকাত হা/৬০৭২, সনদ ছহীহ)। অর্থাৎ আমি যেন খেলাফত পরিত্যাগ না করি এবং তা রক্ষার জন্য যুদ্ধ না করি (মিরক্বাত)।
পর্যালোচনা : উপরোক্ত হাদীছগুলির কারণে অনেক ছাহাবী ওছমান হত্যার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেন। কারণ তারা ভেবেছিলেন যে, ওছমানের পক্ষ হওয়ায় তারা হেদায়াতের উপর আছেন। কিন্তু এজন্য আলী (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া তাঁদের সঠিক হয় নি। কেননা এ সময় খলীফা ছিলেন আলী (রাঃ)। সর্বাগ্রে তাঁর প্রতি শর্তহীন আনুগত্য অপরিহার্য ছিল। তাছাড়া ওছমান (রাঃ) নিজে স্বীয় খেলাফত বা জীবন রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেননি এবং অন্যদের অনুমতি দেননি। আর হত্যায় উদ্যত ব্যক্তির বিরুদ্ধে করণীয় কি হবে, সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ)-এর এমন এক প্রশ্নের উত্তরে রাসূল (ছাঃ) বলেছিলেন, তুমি আদমের উত্তম সন্তানটির মত হও’ (আবুদাঊদ হা/৪২৫৭)। ফিৎনার সময় করণীয় কি হবে, এমন প্রশ্নের উত্তরেও রাসূল (ছাঃ) একই কথা বলেছিলেন (আবুদাঊদ হা/৪২৫৯; মিশকাত হা/৫৩৯৯)। এজন্য বহু ছাহাবী যুদ্ধ হ’তে বিরত ছিলেন।
ভুল যখন ভাঙল :
ওছমান (রাঃ) হত্যার প্রতিশোধকামী ছাহাবীগণের ভুল ভাঙ্গে তখন, যখন (ক) ‘আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) ছিফফীন যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। কারণ রাসূল (ছাঃ) ‘আম্মারের বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘আম্মারের জন্য দুঃখ! তাকে বিদ্রোহী দলের লোকেরা হত্যা করবে। সে লোকদের জান্নাতের পথে আহবান করবে। আর তারা তাকে জাহান্নামের দিকে ডাকবে। ‘আম্মার (রাঃ) বলতেন, আমি আল্লাহর নিকট ফিৎনা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি (বুখারী হা/৪৪৭; আহমাদ হা/১১৮৭৯)।
(খ) অতঃপর ছিফফীন যুদ্ধ থেকে ফিরে কূফার অনতিদূরে ‘নাহরোওয়ান’ নামক স্থানে ৩৮ হিজরীর মুহাররম মাসে আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহাব রাসেবী-র নেতৃত্বে ৪ হাযার খারেজী বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধ হয়। সেখানে তাদের অন্যতম নেতা ত্রুটিপূর্ণ হাতের অধিকারী ‘মুখদাজ’ নিহত হয়। যুদ্ধ শেষে আলী (রাঃ) তাকে খুঁজে বের করতে বলেন। তখন নিহতদের মধ্যে তার লাশ পাওয়া যায়। এটা দেখে আলী (রাঃ) তাকবীর ধ্বনি করেন এবং বলেন, আল্লাহ ও তার রাসূল সত্য কথা বলেছেন। অতঃপর তিনি শুকরিয়ার সিজদা করেন এবং বলেন, তোমরা সবাই সুসংবাদ গ্রহণ কর। এ সময় লোকেরা তাকবীর ধ্বনি করে ওঠে। কেননা এরা যে ইসলাম থেকে বহির্গত দল, তার নিদর্শন হিসাবে উক্ত ব্যক্তির কথা রাসূল (ছাঃ) বলে গিয়েছিলেন। আলী (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! আমি মিথ্যা বলিনি এবং আমাকেও মিথ্যা বলা হয়নি’ (মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৭৯২৭; আহমাদ হা/৬৭২, সনদ হাসান লেগায়রিহী)। অত্র যুদ্ধে মাসঊদীর হিসাব মতে, খারেজীদের সবাই নিহত হয়। মাত্র কয়েকজন পালিয়ে বাঁচে। যাদের সংখ্যা দশ-এর কম। আর আলী (রাঃ)-এর পক্ষে দু’জন বা তার কিছু বেশী নিহত হন। এতে বুঝা গেল যে, মু‘আবিয়ার বিরুদ্ধে ছিফফীন ও খারেজীদের বিরুদ্ধে নাহরাওয়ান উভয় যুদ্ধে আলী (রাঃ) হক-এর উপর ছিলেন।
উভয় দলের অবস্থা :
এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী উভয় দল ইসলামের উপরেই কায়েম ছিল। তারা কেউ কাউকে কাফের বলেননি। (ক) আবু বাকরা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নবী (ছাঃ)-কে মিম্বরের উপর বলতে শুনেছি, ঐ সময় হাসান (রাঃ) তাঁর পার্শ্বে ছিলেন। তিনি একবার উপস্থিত লোকদের দিকে আবার হাসান (রাঃ)-এর দিকে তাকালেন এবং বললেন, আমার এই সন্তান হচ্ছে নেতা। আল্লাহ তা‘আলা তার মাধ্যমে বিবদমান বিরাট দু’দল মুসলমানের মধ্যে সমঝোতা করিয়ে দিবেন (বুখারী হা/৩৭৪৬; আবুদাউদ হা/৪৬৬২)। আলী (রাঃ)-এর শাহাদতের পর হাসান (রাঃ)-এর মাধ্যমে বিবদমান দু’দলের মাঝে সমাধান হয়েছিল এবং সমঝোতার ভিত্তিতে মু‘আবিয়া পরবর্তী খলীফা হন। (খ) ছিফফীন যুদ্ধের দিন জনৈক ব্যক্তি সিরীয়দের লা‘নত করলে আলী (রাঃ) বলেন, ‘সিরীয়দের গালি দিয়ো না। কেননা তাদের মধ্যে রয়েছেন বহু ‘আবদাল’ (৩ বার)’ (মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/২০৪৫৫, সনদ ছহীহ)। (গ) এ সময় জনৈক ব্যক্তি সিরীয়দের কাফের বললে ‘আম্মার বিন ইয়াসির বলেন, কখনো এরূপ বলো না। আমাদের নবী ও তাদের নবী এক। আমাদের ক্বিবলা ও তাদের ক্বিবলা এক। কিন্তু তারা ফিৎনায় পড়ে গেছে এবং সত্যভ্রষ্ট হয়েছে। ফলে আমাদের উপর কর্তব্য হয়ে গেছে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। যাতে তারা সত্যের দিকে ফিরে আসে’ (মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৮৯৯৬, সনদ হাসান লেগায়রিহী)।
এই অনাকাংখিত যুদ্ধের জন্য প্রথমতঃ খারেজীদের গোপন ষড়যন্ত্র এবং দ্বিতীয়তঃ ওছমান (রাঃ) হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ নিয়ে ছাহাবীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিই ছিল মূলতঃ দায়ী।