সন্ত্রাস সন্ত্রাস আর সন্ত্রাস। সর্বত্র সন্ত্রাস। ৯০-এর দশকের আগে কখনো এত অধিকহারে সন্ত্রাসের বিষয়টি নযরে আসেনি। বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবগতভাবেই শান্তিপ্রিয়। সহিংসতা এদের স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু এখন অতি সীমিত সংখ্যক ব্যক্তি হ’লেও তাদের পেশা হ’ল সন্ত্রাস। আগে সন্ত্রাস লুকিয়ে-ছাপিয়ে করা হ’ত। এখন তা চলছে বুক ফুলিয়ে সর্বসমক্ষে। কিন্তু সন্ত্রাসের এই বিস্তার ও ব্যাপকতার কারণ কি? দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক কলামিষ্টগণ প্রায় সকলেই যে কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলতে চেয়েছেন তার সার-সংক্ষেপ হ’ল : (১) বিভিন্ন রাজনৈতিক দল স্ব স্ব নির্বাচনী স্বার্থে দলীয় সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছে (২) স্বাভাবিকভাবেই সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হ’ল সরকারের মন্ত্রী-এমপি বা দলনেতাগণ (৩) যেহেতু প্রতি মেয়েদান্তে সরকার পরিবর্তন হয়, সেকারণ বিরোধী দলে সন্ত্রাসীদের কদর হয় বেশী (৪) অনেক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীরাই মন্ত্রী-এমপি নির্বাচিত হয়। কেননা এইসব গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য যোগ্যতা, সততা, দক্ষতা ইত্যাদির চাইতে দলীয় লোককেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে (৫) ছাত্রনেতা নামধারী উচ্চ ডিগ্রীপ্রাপ্ত দলীয় ক্যাডাররা বিভিন্ন সরকারী গুরুত্বপূর্ণ চাকুরীতে প্রবেশ করে। বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, প্রশাসন বিভাগ এমনকি সেনাবাহিনীতেও। ফলে দলীয় সন্ত্রাস এখন সমাজদেহের উপরে-নীচে, শিরা-উপশিরায় সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে (৬) প্রতিবেশী বন্ধু (?) রাষ্ট্রটির অনবরত উস্কানি ও তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী ও চালান করা অস্ত্রের মাধ্যমে দেশে পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হচ্ছে (৭) স্বাধীনতার পক্ষশক্তির লেবেল আঁটা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের খয়েরখাহ বলে পরিচিত দলটির প্রকাশ্য ও গোপন সমর্থনে সন্ত্রাসের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

অতঃপর সন্ত্রাসের প্রতিকার হিসাবে তাঁরা যেসব কথা বলেছেন, সেগুলির সার-সংক্ষেপ হ’ল : (১) রাজনীতির সাথে অপরাধ জগতের নাড়ি বিচ্ছিন্ন করতে হবে (২) চিহ্নিত নেতাদের ও তাদের মদদপুষ্ট রাষ্ট্রদ্রোহী শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেফতার ও বিচার করতে হবে (৩) প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ও কঠোর হ’তে হবে (৪) সরকারী দল থেকে সন্ত্রাসীদের বের করে ও শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে (৫) স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ বাদ দিয়ে মেধা, সততা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পুরা প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে (৬) সীমান্ত এলাকায় কঠোরভাবে নিশ্ছিদ্র প্রহরা বসাতে হবে এবং এজন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সমূহ কাজে লাগাতে হবে।

উপরোক্ত কারণ ও প্রস্তাবিত প্রতিকার ব্যবস্থাগুলির সঙ্গে আমরা একমত। কিন্তু কথায় বলে যে সর্ষে দিয়ে ভূত ঝাড়াবেন, সেই সর্ষের মধ্যেই রয়েছে ভূত। কার কাছে আমরা প্রতিকার দাবী করছি? গণতন্ত্রের নামে যে বিভেদাত্মক রাজনৈতিক ব্যবস্থা আমাদের দেশে চালু হয়েছে, তা কখনোই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে কি? দলবাজির মাধ্যমে সহজে নেতা হবার যে সুড়সুড়ি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রয়েছে, তার দ্বারা মেধাহীন, যোগ্যতাহীন, অসৎ ও অপদার্থ লোকদের রাষ্ট্র ও সমাজনেতা হ’তে কোন বাধা আছে কি? সূদ, ঘুষ, চাঁদাবাজি, চোরাকারবারী ও জুয়া-লটারীর মাধ্যমে সহজে বড় লোক হওয়ার যে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা এদেশে চালু আছে, তার মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের চিন্তা স্বপ্নবিলাস নয় কি? ধর্মহীন ও জাতীয় লক্ষ্যহীন যে শিক্ষা ব্যবস্থা এদেশে চালু আছে, তার মাধ্যমে সৎ, ধার্মিক ও দেশপ্রেমিক নেতা ও কর্মকর্তা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব কি? এডভোকেট নামীয় ব্যক্তিদের কূট তর্ক, বৃটিশ আমলের দীর্ঘসূত্রী বিচার ব্যবস্থা, দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই নির্দোষ মানুষকে বছরের পর বছর হাজতে পুরে রাখার যে ‘খোয়াড়ে’ আইন এদেশে চালু আছে, তার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবার কল্পনা করা যায় কি? পর্ণো সাহিত্য, নগ্ন ও মারদাঙ্গা ছবি সর্বস্ব সিনেমা-টিভি, ভিসিআর-ভিসিপি চালু রেখে দেশে উদ্যমী ও কর্মনিষ্ঠ, শিক্ষিত ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন তরুণ প্রজন্ম সৃষ্টির সরকারী হিতোপদেশ খোলা রসগোল্লার উপরে মাছি বসতে মানা করার ন্যায় প্রতারণা নয় কি?

আমরা বলতে চাই যে, সন্ত্রাসী যুবকটি মূল সন্ত্রাসী নয়। সে নোংরা পরিবেশের অসহায় শিকার এবং নেপথ্য গডফাদারদের বাহন মাত্র। দেশের মাথায় পচন ধরেছে। তা এখন পুরা সমাজদেহকে ক্যান্সারের মত গ্রাস করেছে। অতএব যে সিস্টেম-এর কারণে দেশে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে, যে পদ্ধতি অনুসরণের ফলে সন্ত্রাসী কিংবা সন্ত্রাসের লালনকারীরা দেশের ও সমাজের নেতা হচ্ছে, ঐ সিস্টেম-এর পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তাহ’লে অন্যান্য ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। এজন্য আমাদের প্রস্তাব সমূহ নিম্নরূপ :

(১) প্রথমেই সন্ত্রাসী ও তার লালনকারীকে একথা বিশ্বাস করতে হবে যে, সে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর হাতে গড়া প্রিয় সৃষ্টি ও তার বাপ-মায়ের অতি আদরের সন্তান। যেকোন সময়ে স্রষ্টার আহবানে তাকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে ও সেখানে তাকে পূর্ব জীবনের পূর্ণ হিসাব দিতে হবে। উক্ত বিশ্বাস সৃষ্টি ও তা লালনের জন্য দেশে আখেরাতমুখী একক জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

(২) প্রচলিত দল ও প্রার্থীভিত্তিক নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে এবং প্রশাসন ও বিচার বিভাগের ন্যায় রাষ্ট্রের ৩য় স্তম্ভ আইন সভা তথা জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচনের বিষয়টিও দেশের প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরামর্শ সভার মনোনয়নের উপরে ছেড়ে দিতে হবে। ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ের প্রশাসনিক ইউনিট যেলা প্রশাসকের অধীনে ন্যস্ত করা যেতে পারে। এই ব্যবস্থা আনতে পারলে দেশে শোষক ও সন্ত্রাসীর সংখ্যা আপনা থেকেই কমে যাবে।

(৩) দেশে শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করতে হবে এবং কেবল প্রেসিডেন্ট জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হবেন। প্রেসিডেন্ট জাতীয় ভিত্তিক বৃহৎ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দল সমূহ থেকে প্রতিনিধি নিয়ে এবং বিভিন্ন বিষয়ে যোগ্য ও বরেণ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি পরামর্শসভা গঠন করবেন। সাথে সাথে বিচার বিভাগকে প্রশাসন থেকে পৃথক ও স্বাধীন করে দিতে হবে এবং সেখানে সকল বিভাগের যেকোন ব্যক্তির জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকতে হবে। সকল স্তরের ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান রেখে পৃথক আইন পাস করতে হবে। একই সাথে উক্ত তিনটি বিভাগে নৈতিক প্রশিক্ষণ যোরদার করতে হবে ও অপরাধ প্রমাণের জন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

পরিশেষে বলব, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির সেরারূপে সম্মানিত করেছেন (বনু ইসরাঈল ১৭/৭০)। বিবেক-বুদ্ধি ও চেতনা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব লাভের প্রধান কারণ। এর মাধ্যমে সে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পসন্দ-অপসন্দ জেনে নিয়ে তাঁর পসন্দের অনুসরণ করে ও অপসন্দ থেকে বিরত হয়। সাধারণ জীব-জন্তুর মধ্যে কামনা-বাসনা আছে, কিন্তু বুদ্ধি ও চেতনা নেই। ফেরেশতাদের মধ্যে বুদ্ধি ও চেতনা আছে, কিন্তু কামনা-বাসনা নেই। জিন জাতির মধ্যে কামনা-বাসনা ও বুদ্ধি-চেতনা আছে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে তা খুবই নগণ্য। পক্ষান্তরে মানুষের মধ্যে উভয়টিই রয়েছে প্রখরভাবে। সে তার বিবেক ও চেতনার সাহায্যে স্বীয় কামনা-বাসনাকে পরাভূত করে এবং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অপসন্দনীয় বিষয়াদি থেকে নিজেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়। আর তখন সে ফেরেশতার চাইতেও উচ্চ মর্যাদায় আসীন হয়। কিন্তু যখনই ষড় রিপুর তাড়নায় ও শয়তানের প্ররোচনায় তার বিচারবোধ ও চেতনা আচ্ছন্ন হয় এবং নিজেকে কামনা-বাসনার কাছে সমর্পণ করে দেয়, তখনই সে মানবতার সর্বোচ্চ শিখর থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে জন্তু-জানোয়ারের চাইতে নিম্নে পতিত হয় (তীন ৯৫/৪-৫)। তখন সে হৃদয় থাকতেও বুঝে না, চোখ থাকতেও দেখে না, কান থাকতেও শোনে না (আ‘রাফ ৭/১৭৯)। মানুষের এই অধঃপতিত অবস্থায় সে হয় সবধরনের অন্যায়কারী ও সন্ত্রাসী। তাকে ঐ অধঃপতিত অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য চাই সর্বদা আখেরাতমুখী নৈতিক প্রশিক্ষণ এবং কঠোর ও নিরপেক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা। ইনশাআল্লাহ তবেই দেশে ফিরে আসবে সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ ও নিরাপদ জনজীবন।

হে সন্ত্রাসী! তুমি জন্মগতভাবে ছিলে ফুলের মত সুন্দর একটি ফুটফুটে মানব শিশু। যৌবনে তুমি হয়েছ সন্ত্রাসী নামক সমাজের ঘৃণ্য জীব। তওবা কর সন্ত্রাস থেকে। ফিরে চল তোমার প্রভু পালনকর্তার দিকে। কষ্টের হালাল রূযীর উপরে সন্তুষ্ট থাকো। তোমার নিষ্পাপ সন্তানের শ্রদ্ধেয় পিতা হবার চেষ্টা কর। সমাজের সর্বাধিক কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত কর। মনে রেখ, তোমার কর্ণ, তোমার চক্ষু, তোমার হৃদয় ও বিবেক-বুদ্ধি সবকিছুই ক্বিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে (বনু ইসরাঈল ১৭/৩৬)। কি জবাব দেবে তুমি সেদিন? তুমি কি পারবে জাহান্নামের কঠিন আযাব একদিন ভোগ করতে? তুমি কি চাওনা দুনিয়াতে সৎকর্মের বিনিময়ে জান্নাতের চিরস্থায়ী শান্তি লাভ করতে? অতএব ফিরে এসো প্রভুর পানে। তওবা কর খালেছ মনে। অনুতপ্ত হও আল্লাহর কাছে ও বান্দার কাছে। মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ আসার আগেই নিজেকে সংশোধন করে নাও। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন![1]


[1]. ৬ষ্ঠ বর্ষ, ৯ম সংখ্যা, জুন ২০০৩।






বিষয়সমূহ: পরকাল
অহি-র বিধান বনাম মানব রচিত বিধান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পার্থক্যকারী মানদন্ড - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
স্বাধীনতা দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হে ছায়েম অনুধাবন কর! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হে সন্ত্রাসী! আল্লাহকে ভয় কর - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিশ্বের শাসন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর তাকীদ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নদীর ভাঙ্গনে দেশের মানচিত্র বদলে যাচ্ছে - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পিওর ও পপুলার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
জম্মু-কাশ্মীরের রূহ কবয করা হ’ল! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নির্বাচনী দ্বন্দ্ব নিরসনে আমাদের প্রস্তাব - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নৈতিকতা ও উন্নয়ন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সংস্কারের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.