ড. মুহাম্মাদ ইউনূস তাঁর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে জনগণ বিপুল আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু মাস কয়েক যেতেই সে আশা যেন ফিঁকে হ’তে বসেছে। যে তরুণ ও ছাত্রদের শতভাগ সমর্থন ও ম্যান্ডেট নিয়ে তিনি নেতৃত্বে এসেছিলেন, আমেরিকার সেবাদাস ও এনজিও সদস্য এবং নিজ যেলার অদক্ষ লোকদের উপদেষ্টা বানিয়ে তিনি আজ বিপ্লবী ও সংস্কারকামী তরুণ ও সাধারণ মানুষের স্বপ্নগুলো ধুলিস্যাৎ করে দিতে বসেছেন। এমন এক মেরুদন্ডহীন সরকার গঠন করেছেন, যারা আমেরিকা ও ভারতের দেখানো পথ ছাড়া এক পা চলতে পারে না, এদেশের মাটি ও মানুষের হৃদয়ের কথা উপলব্ধি করতে পারে না। ফলে ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণঅভ্যুথান যেন পথ হারিয়ে আজ অজানা গন্তব্যের পথে।
এই পরিস্থিতিতে জনগণের করণীয় কী! দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে কোন রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় আনলে কি সমাধান আসবে! নাকি তাতে পুরানো স্বৈরশাসন, ফ্যাসিবাদই নতুন মোড়কে হাযির হবে! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে গত দেড় যুগ ধরে নিপীড়নের শিকার রাজনৈতিক দলগুলো এখন বুভুক্ষু হায়েনার মত হামলে পড়তে চাইবে। দেশের সম্পদগুলো লুটেপুটে খেয়ে পুরো দেশটাকে দেউলিয়া বানিয়ে ছাড়বে। দুর্নীতিতে আবার দেশকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বানাবে। অন্যদিকে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোও পিছিয়ে নেই। ইসলামের নাম ও লেবাস নিয়ে তারাও পশ্চিমা গণতন্ত্রেই মুক্তি খুঁজছে। প্রচলিত যুলুমবাজী রাজনীতিকে সম্বল করে তারাও পথ চলছে। সুতরাং তাদের উপরও জনগণের আস্থা রাখার সুযোগ নেই। এক্ষণে প্রশ্ন হচ্ছে বিকল্প কোথায়?
আমরা স্পষ্টভাবেই বলতে চাই, ইসলামের কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ ব্যতীত কোন দেশেই মুসলিম জাতির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কোন ক্ষেত্রেই স্থায়ী মুক্তি ও সাফল্য আসতে পারে না। সুতরাং মুক্তি পেতে হ’লে, গণতন্ত্র নয়, একমাত্র ইসলামের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। একমাত্র পথ প্রচলিত পশ্চিমা রাজনীতির পরিবর্তে ইসলামী খেলাফতের কাছে ফিরে আসতে হবে। সুতরাং গণতন্ত্র নয়, ইসলামী খেলাফতই কাম্য।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ইসলামী দলগুলো আপোষকামিতার পথ অবলম্বন করে চলছে, যা আমাদের ভীষণভাবে হতাশ করে। ইসলামী খেলাফত বাক্যটি পর্যন্ত তাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে না। তারা বলতে চান যে, আমরাও গণতন্ত্র মানি না, কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সম্পূর্ণ ভালো উদ্দেশ্যেই আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাচ্ছি। ইসলামের পক্ষে কিছু করতে না পারলেও অন্ততঃ বিরোধিতাকে তো রুখতে পারব! কিছুটা হ’লেও ইসলামী চিন্তার বিকাশ তো ঘটাতে পারব! তাদের এ বিশুদ্ধ নিয়তকে কিছু ফিক্বহী সূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত করে তারা যুক্তিযুক্ত করতে চেয়েছেন। আমরা বলব, নিয়ত সঠিক হওয়াই যথেষ্ট নয়, নীতি সঠিক হওয়াও আবশ্যক। মানবেতিহাসের শুরু থেকেই মানুষ ভাল মনেই করেই তো মূর্তি স্থাপন করেছে, দরগা বানিয়েছে। তাদের কাছে বিপদাপদে মুক্তি চেয়েছে। আবু জেহেলরাও বলেছে যে, তারা আল্লাহ্কেই একক স্বত্তা বলে বিশ্বাস করে। কিন্তু মূর্তিগুলো এজন্যই পুজা করে যে তারা তাদেরকে আল্লাহর কাছে পেঁŠছে দেবে। আজকের যুগেও যারা হরহামেশা শিরক-বিদ‘আত করছে, তারা কিন্তু একই সৎ নিয়তের কথা প্রকাশ করে বলছে যে, তারা নিখাদ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই এসব করছে। কিন্তু এসব সৎ নিয়ত কি তাদের আমলের সঠিকতা প্রমাণে সক্ষম?
যদি ধরে নেওয়া হয় যে, ইসলামের জাগতিক অস্তিত্বের স্বার্থে বাতিলের সাথে সাময়িক আপোষ করা যায়, তবে আমরা নযর দেব বিগত ৬০ বছরে মিসর, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মরোক্কো, মেŠরিতানিয়া, তিউনিসিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও সম্প্রতি মালদ্বীপের গণতন্ত্রের ইতিহাসের দিকে। এসব দেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা একচেটিয়া। এমনকি মিসর, আলজেরিয়া ও পাকিস্তানসহ কতিপয় দেশে কিছু আহলেহাদীছ ও সালাফী সংগঠনও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তারপরও কোন দেশেই কি রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের কোন চিত্র ফুটে উঠেছে? বরং দিন দিন পরিস্থিতি আরো প্রতিকুলে যাচ্ছে। তুরস্কের মত এখন তিউনিশিয়া, মরোক্কোতে ব্যাপকভাবে ডি-ইসলামাইজেশন চলছে। অন্য দেশগুলোকেও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও জীবনদর্শন ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে।
মরক্কোতে ২০০২ সালের নির্বাচনে ৩২৫টি আসনের মধ্যে ৪২টি আসন পেয়েছিল জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আদালত) নামক ইসলামিক পার্টি। কিন্তু দেখা গেছে যে, তারা ইসলামী রাষ্ট্র গঠন বা ইসলামী শরী‘আত বাস্তবায়নের দাবী না তুলে তুরস্কের মডেলে কেবল গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়েছে। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর মত ক্ষমতাসম্পন্ন বৃহৎ দলকেও রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামীর শরী‘আত বাস্তবায়নের দাবী করতে দেখা যায় না। তুরস্কে ইসলামিক পার্টি দীর্ঘদিন যাবৎ ক্ষমতাসীন থাকলেও তাদেরও একই দূরবস্থা। লক্ষণীয় যে, এ সমস্ত পার্টির নিয়ত হয়তবা সৎ থাকলেও এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনগণ তাদের পক্ষ নিলেও তারা এই ধর্মনিরপেক্ষ সিস্টেমে ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠার উপায়ই খুঁজে পাচ্ছে না। যেমন তুর্কী প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, ‘গণতন্ত্র হ’ল ক্ষমতার রাজপথে একটা কারের মত, যখন তা গন্তব্যে পেঁŠছাবে তখন তাকে আমরা পরিত্যাগ করব (Democracy is like a streetcar. When you come to your stop, you get off)।
বোঝাই যাচ্ছে তিনি শুদ্ধ নিয়তে ও সচেতনভাবে এই পশ্চিমা রাজনীতির পথকে হারাম মনে করেই এ পথে নেমেছেন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর এ পথকে তিনি আর পরিত্যাগ করতে পারলেন না, বিপুল জনসমর্থন নিয়েও তিনি আজ পর্যন্ত ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার কোন উদ্যোগ নিতে পারলেন না। তেমনিভাবে মিসরে ৯৯ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ৮২ শতাংশ মানুষ ইসলামী শরী‘আত বাস্তবায়নের পক্ষে থাকলেও বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তার বাস্তবতা কল্পনাতীত। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, চিন্তা যতই মহৎ হৌক না কেন, বাতিল পথ অবলম্বন করে ইসলামকে কখনো সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। এতে কিছু ক্ষমতাবান ‘মডারেট’ ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিমই হয়তো তৈরী হবে। যারা কিনা একজন বিধর্মীর চেয়ে উম্মাহর জন্য অধিক ক্ষতিকর বলেই প্রমাণিত।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, গণতন্ত্রে নির্বাচন মূল কথা নয়। বরং পুরো প্রক্রিয়াটি এমন একটি ভিত্তির উপর রচিত, যা মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবনের জন্য একটি মূল্যবোধ ও আদর্শ নির্ধারণ করে দেয়। আর তা অবশ্যই আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রতি সংশয়বাদী ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষ নিজেই তাঁর কর্তব্য বিধায়ক। আপন বিবেকের মাধ্যমেই সে সমস্ত কর্তব্য প্রতিপালন করবে।
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, গণতন্ত্র একটি পূর্ণাঙ্গ সেক্যুলার জীবনব্যবস্থার নাম; কেবল নির্বাচন ব্যবস্থা নয়। প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতি এই ধর্মনিরপেক্ষ জীবনব্যবস্থারই একটি আবশ্যিক অনুষঙ্গ ও প্রধান সহায়ক। সেখানে বহু মতের স্বাধীনতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত দলসমূহ একত্রে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। সকল মতের অংশগ্রহণকে সেখানে মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ বলে প্রশংসা করা হয়। যার অন্তর্নিহিত সুর ও আইনগত ভিত্তি হ’ল, সমস্ত মতই সঠিক। সুতরাং সকল মতের সমন্বয় ঘটিয়ে সকলের ঐক্যমতে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। নির্দিষ্ট কোন একটি মত সেখানে কোনক্রমেই প্রাধান্য পাবে না-এটাই বহুদলীয় গণতন্ত্রের মূলকথা। সুতরাং যদি কোন ইসলামী দল সেখানে নির্বাচিত হয় তবুও তাদের সেখানে নিজস্ব ধর্ম তথা ইসলামী শরী‘আত বাস্তবায়নের কোন সুযোগ নেই।
কেননা মতামত হিসাবে ইসলামী শরী‘আত অন্য দল বা ধর্মীয় মতেরই সমমানসম্পন্ন। তাই এ পদ্ধতিতে জনগণ একটি দলকে ক্ষমতায় বসাতে পারলেও কোন একক মত বা আদর্শকে কখনো প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। সুতরাং গণতন্ত্রকে যারা কেবল নির্বাচনব্যবস্থা বলছেন, তারা হয় এই মৌলিক বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন নতুবা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছেন। আর যারা বিশেষ প্রয়োজনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বলেছেন তাঁরা হয় বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নন, না হয় মূল তত্ত্বগত দিকটা লক্ষ্য করেননি। সুতরাং গণতন্ত্র তা পাশ্চাত্য আর প্রতীচ্য হোক, হোক তা ইসলামী বা খৃষ্টানী, সবগুলোরই মূলকথা হ’ল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। এছাড়া গণতন্ত্র ও নির্বাচনের ভিন্ন কোন পরিচয় এর প্রবক্তা খোদ পশ্চিমাদের কাছেই নেই। তাই এ দু’টোকে আলাদা করে দেখারও সুযোগ নেই।
জনৈক কলামিস্ট পার গোমা‘গণতন্ত্রের ইসলামীকরণ নাকি ইসলামের গণতান্ত্রিকীকরণ?’ শিরোনামের প্রবন্ধে বিষয়টি সুস্পষ্ট করে বলেন, ‘গণতন্ত্রের গঠন ও প্রকৃতি বিভিন্ন রকম হ’তে পারে। এর উপাদানগুলো বিভিন্ন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। কিন্তু মূলতঃ এর প্রধান যে মূলনীতি তা মরুভূমির বুকে গ্রীষ্ম মধ্যাহ্ণের সূর্যের মত সুস্পষ্ট। আর তা হলো, ব্যষ্টি ও সমষ্টিকে সকল প্রকার বলপূর্বক জবরদস্তি এমনকি ধর্মের বাধ্যবাধকতা থেকেও স্বাধীনতা দেওয়া। তাই গণতন্ত্র সার্বজনীন যে কোন প্রকারের আদর্শ (ইসলাম) যা নিরংকুশ আত্মসমার্পন ও আনুগত্যের দাবী রাখে তার পরিপন্থী। ধর্ম যেমন যুগ যুগ ধরে পরিদৃষ্ট হচ্ছে (অর্থাৎ সার্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করেছে) গণতন্ত্রও তেমন কেবল নিজের সাথে তুলনীয় (অর্থাৎ অন্য একটি সার্বজনীন নীতি)। তাই সামাজিক কাঠামো ও আচরণ পরিধিতে ধর্মনিরপেক্ষতা রহিত গণতন্ত্র সকল প্রকারের ধর্মানুসারীদের একটি কপোলকল্পিত অতিকথা মাত্র। এজন্য গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতারই নামান্তর। অন্যান্য কোন নীতিকাঠামোকে ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত করা যেতে পারে কিন্তু গণতন্ত্রের কথা স্বতন্ত্র। এটি ভিন্ন তার আর কোন নাম বা রূপকাঠামো নেই।’[1]
অনুরূপই অপর একজন আমেরিকান লেখক R.W. Baker বলেন, The democracy is foundamentally different and contrary to Islam because of having its root in western liberalism ‘গণতন্ত্র ভিত্তিগতভাবে ইসলামের সাথে পৃথক ও বৈপরিত্যপূর্ণ আদর্শ। কেননা এর শেকড় হ’ল পশ্চিমা উদারতাবাদ’।[2]
আমাদের দেশের খ্যাতনামা আহলেহাদীছ বিদ্বান মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কোরায়শী ইসলামী দলগুলোর গণতন্ত্র নিয়ে শিথিলতার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, (পাকিস্তানের প্রস্তাবিত ‘ইসলামের নির্দেশিত গণতন্ত্র’ সম্পর্কে) ‘বর্তমান সময়ে ওয়াইন এন্ড ফুডের হোটেল, রেস্তোরাঁ, বিড়ি, সূদী লেনদেনের প্রতিষ্ঠান ... থেকে আরম্ভ করিয়া ন্যাশনালিজম ও সোশিয়ালিজম পর্যন্ত ‘ইছলামি’ সাইনবোর্ড ও লেবেলে সুশোভিত হইয়া উঠিয়াছে। সুতরাং ইসলামী ও কুফরী ব্যভিচার, ইসলাম ও কুফরী ন্যাশনালিজম ও সোশিয়ালিজমের মধ্যে প্রভেদ করা যেরূপ অসম্ভব, সেইরূপ ইছলামি ও কুফরী গণতন্ত্রের আকৃতি ও প্রকৃতি সম্বন্ধে সম্যক ধারণা সুগঠিত না হওয়া পর্যন্ত ইছলামি গণতন্ত্রের স্বরূপ উপলব্ধি করা কাহারো সাধ্যায়াত্ম নয়’।[3]
তিনি আরো বলেন, ‘দুনিয়ার বাযারে গণতন্ত্রের যে বেসাতির তেজারৎ চলিতেছে, ইছলামের সহিত তাহার আপোষহীন বৈষম্যের জন্য তাহাকে ইছলামি মার্কা দিয়া স্বতন্ত্র করিয়া দেখাইবার প্রয়োজন, উদ্দেশ্য প্রস্তাবের রচয়িতাগণ বোধ করিয়া থাকিলে, সেরূপ গণতন্ত্রকে টানিয়া হেঁচড়াইয়া শুদ্ধি করাইবার আবশ্যক কি ছিল? প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রসমূহ কেবল গণতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, পুরোহিততন্ত্র ও রাজতন্ত্রে বিভক্ত নয়, পঞ্চমশ্রেণীর আর এক প্রকার রাষ্ট্র আছে যাহার নাম ইছলামি রাষ্ট্র। ইছলামি রিয়াছৎ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন, উহা রাজতান্ত্রিক, সামন্ততান্ত্রিক ও পুরোহিত তান্ত্রিক নয়, এই পঞ্চবিধ রাষ্ট্রের অমিশ্রযোগের প্রচেষ্টা নিরর্থক’।[4]
সুতরাং বিকল্প খোঁজা নয়; এ মুহূর্তে আমাদের কর্তব্য হ’ল নববী পদ্ধতিতে সমাজ সংস্কারের কাজ অব্যাহত রাখা। সকল বিধান বাতিল করে অহির বিধান কায়েমের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া। আর এজন্য প্রয়োজন প্রথমতঃ দৃঢ়ভাবে দ্বীনকে অাঁকড়ে ধরে থাকা। কেননা মুসলমানদের আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রকৃতরূপে ইসলামের কাছে ফিরে আসা। তবেই তারা গ্লোবাল ওয়েস্টার্ন কালচার তথা বিশ্বব্যাপী পশ্চিমাদের সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জ মুকাবিলা করার নৈতিক যোগ্যতা লাভ করবে। এজন্য আমাদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন নিজেদেরকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং নেক্সট জেনারেশনকে সে আক্বীদার উপর উত্তম রূপে গড়ে তোলা। কারো অপেক্ষা না করে আমাদের নিজ থেকেই এই চর্চা শুরু করতে হবে। আমাদের প্রত্যেকেরই এ ক্ষেত্রে আবদান রাখার সমান সুযোগ রয়েছে। এভাবেই আমরা সামষ্টিক প্রচেষ্টার (Collective Effort) মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রে একটা সামগ্রিক পরিবর্তন (Collective Change) আনতে সমর্থ হব ইনশাআল্লাহ।
দ্বিতীয়তঃ পথভোলা মানুষকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনা। শায়খ আলবানী (রহঃ) এই তৎপরতাকে ‘আত্মশুদ্ধি এবং সমাজশুদ্ধি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আর এটাই নববী পথ। এ পথে যাবতীয় বাধাকে বিপুল সাহস ও জ্ঞানের সাথে আমাদের মুকাবিলা করতে হবে। এভাবে ক্ষুদ্র পরিসর থেকে বৃহত্তর পরিসরে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ। এর বাইরে কোন বাতিল পথ ও পদ্ধতিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নয়। আল্লাহ বলেন, وَأَنْ أَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ- وَلَا تَدْعُ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِينَ ‘..(আমি নির্দেশিত হয়েছি যে) আমি যেন সত্য দ্বীনের উপর দৃঢ়পদ হই এবং তুমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। তুমি আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে আহবান করো না যা তোমার কোন উপকার করে না ক্ষতিও করে না। যদি তুমি তা কর তাহলে তুমিও যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (ইউনুস ১০/১০৪, ১০৫, ১০৬)।’ পশ্চিমাদের ফাঁদে পা দিয়ে আমরা যেন কোন অবস্থাতেই আদর্শ বিচ্যুত না হই। আল্লাহ বলেন, وَلَا يَصُدُّنَّكَ عَنْ آَيَاتِ اللَّهِ بَعْدَ إِذْ أُنْزِلَتْ إِلَيْكَ وَادْعُ إِلَى رَبِّكَ وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ- وَلَا تَدْعُ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آَخَرَ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ لَهُ الْحُكْمُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ-‘কাফেররা যেন আপনাকে আপনার প্রতি নাযিল হওয়া আল্লাহর আয়াতসমূহ থেকে বিমূখ না করে। আপনি মানুষকে আহবান করুন আপনার প্রভুর দিকে। আর আপনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না। আপনি আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্যকে আহবান করবেন না। তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে কেবল তার সত্ত্বা ছাড়া। বিধান তাঁরই, তোমাদেরকে তাঁর কাছেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে (ক্বাছাছ ২৮/৮৭, ৮৮)।
তারবিয়াহ বা সমাজ সংস্কারের অংশ হিসাবে নেতৃত্ব সংস্কারের জন্য এই মুহূর্তে ইসলামী দলগুলোর কর্তব্য হবে দল ও প্রার্থীবিহীন নির্বাচন ব্যবস্থার দাবী তোলা, যার মাধ্যমে ইসলামী খেলাফতের আদলে শান্তি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। ধৈর্য ধরে জাতিকে এই বাস্তবতা বোঝানো কষ্টসাধ্য হ’লেও আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কেননা রাষ্ট্র সংস্কারের যে পরিবেশ বর্তমানে চলমান, তাতে এই বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলার এখনই সময়। যদিও আজ সে চিন্তা কারো মাথাতেই যেন ধরতে চায় না। মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কোরায়শী বহু আগেই আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণবৃত্তি আমাদের মানসলোক এতদূর বিকৃত করিয়া ফেলিয়াছে যে,অদলীয় শাসনরীতির (No party system)কথা আমরা কল্পনা করিতে চাইনা, কিন্তু রাষ্ট্রের ভিতরে নানা দলের অস্তিত্ব ও তাহাদের পরস্পর বিরোধী কর্মসূচির দরুন অধিকার ও ক্ষমতা লাভের যে অপরিসীম দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম আরম্ভ হইয়া যায় এবং বর্তমান গণতন্ত্রের যাহা অনিবার্য শোচনীয় পরিণতি তাহা কাহারো পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভবপর নয়।..ইউরোপ ও আমেরিকার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ প্রচলিত গণতন্ত্রের বিষময় ফলের কথা ক্রমশঃ স্বীকার করিয়া লইতেছেন।[5]
একই কথা বলেছিলেন মাওলানা আকরাম খাঁ। তিনি বহু পূর্বেই জাতিকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘কোরআনের জীবন্ত জলন্ত ব্যাপক ও শাশ্বত স্বরূপকে উপেক্ষা করিয়া, বিশ্বমানবের এই আল্লাহ-প্রদত্ত অধিকারকে অস্বীকার করিয়া মুছলমান নিজের, এছলামের এবং বিশ্বমানবের ঘোর অনিষ্ট সাধন করিয়া চলিয়াছে। বর্তমানের সমস্ত স্থবিরতা এবং সমস্ত অধঃপতনের মূল এইখানে।.. সাবধান! পশ্চাতে ‘ভূতের মায়া কাঁদন, সম্মুখে আলেয়ার জলন্ত মোহ। সাবধান![6]
মহান আল্লাহ বলেন, وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُصِيبَهُمْ بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ- أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ- ‘আপনি তাদের পারস্পারিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী ফয়সালা করুন। তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না এবং তাদের থেকে সতর্ক থাকুন, যেন তারা আপনাকে এমন বিষয় থেকে বিচ্যুত না করে যা আল্লাহ আপনার প্রতি নাযিল করেছেন। তদুপুরি যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে জেনে রাখুন আল্লাহ তাদের পাপের কিছু শাস্তি দিতে চেয়েছেন। মানুষের মধ্যে অনেকেই নাফরমান। তারা কি জাহেলী যুগের নীতিমালা কামনা করে? আল্লাহর চেয়ে কে উত্তম নীতিমালা দানকারী?’ (মায়েদাহ ৫/৪৯-৫০)। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সর্বাবস্থায় সঠিক নীতি ও পন্থার উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফীক দান করুন- আমীন!
[1]. Islamizing Democracy Or Democratizing Islam- Par Ghoma, 23 August 2006- www. nawaat.org).
[2]. Islam without feer, R.W. Baker, USA, 2005.
[3]. গণতন্ত্রের প্রকৃতি ও আকৃতি, তর্জুমানুল হাদীছ ১/২ সংখ্যা, ১৯৪৯ইং, পৃ. ৮৫।
[4]. ঐ, পৃ. ৮৬।
[5]. ঐ, পৃ. ৮৭।
[6]. মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস, পৃ. ২২৪।