ভূমিকা
‘ইসরা’ অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। ‘মি‘রাজ’ অর্থ উর্ধারোহনের বাহন। মক্কার মাসজিদুল হারাম থেকে যেরুযালেমের বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রাত্রিকালীন সফরকে ‘ইসরা’ বলে এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাস থেকে সপ্তাকাশ ভ্রমণ ও আল্লাহ্র দীদার লাভ পর্যন্ত ঘটনাকে ‘মি‘রাজ’ বলে। যেহেতু মি‘রাজের ঘটনাটিই মুখ্য, সেকারণ পুরা সফরটিই ‘মি‘রাজ’ নামে পরিচিত হয়েছে। সূরা বনু ইস্রাঈলের ১ম আয়াতে ‘ইসরা’ এবং সূরা নাজমের ১৩ থেকে ১৮ আয়াত পর্যন্ত ৬টি আয়াতে ‘মি‘রাজে’র ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এতদ্ব্যতীত ২৫ জন ছাহাবী কর্তৃক বুখারী ও মুসলিম সহ কুতুবে সিত্তাহ্র প্রায় সকল হাদীছ গ্রন্থে ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ে মি‘রাজের ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। অতএব মি‘রাজ অকাট্যভাবে প্রমাণিত সত্য ঘটনা।
ইসরা ও মি‘রাজ মাত্র একবার হয়েছিল এবং এটি হিজরতের প্রায় এক বছর পূর্বে জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে ও সজ্ঞানে হয়েছিল, ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্নের মাধ্যমে নয়। যদিও নবীদের স্বপ্ন সত্য হয়ে থাকে। স্বপ্নে হ’লে এটি কোন বড় বিষয় হ’ত না। সশরীরে ও জাগ্রত অবস্থায় হয়েছিল বলেই মক্কার নেতারা এটাকে অবিশ্বাস করেছিল এবং সর্বত্র বদনাম রটনার সুযোগ পেয়েছিল। আর একারণেই বহু মুসলমান রাসূল (ছাঃ)-কে মিথ্যা নবী মনে করে ‘মুরতাদ’ হয়ে পুনরায় কুফরীতে ফিরে গিয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ ‘আব্দ’ বা বান্দা বলতে দেহ ও আত্মা মিলিতভাবে বুঝায়, শুধুমাত্র আত্মাকে নয়। তৃতীয়তঃ তাকে বোরাকে আরোহন করতে হয়েছিল। আরোহন করার জন্য দেহ প্রয়োজন। আত্মা কখনো আরোহন করে না।
মি‘রাজের ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে তো বটেই, বরং পুরা নবুঅতের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। কোন নবীই এই সৌভাগ্য লাভ করেননি। যা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) লাভ করেছিলেন। আর সেকারণেই তিনি হ’লেন শ্রেষ্ঠ নবী। কোন উম্মতই এতবড় কঠিন ঈমানী সংকটে পতিত হয়নি, যতবড় কঠিন সংকটে পতিত হয়েছিলেন প্রাথমিক যুগের মুমিনগণ! ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, মি‘রাজের ঘটনাবলীকে অবিশ্বাস করে একদল মুসলমান ‘মুরতাদ’ হয়ে যায় এবং তারা পরবর্তীতে আবু জাহলের সাথে বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে নিহত হয়। অন্যদিকে লোকেরা যখন গিয়ে আবুবকর (রাঃ)-কে এই ঘটনা শুনায়, তখন তিনি নির্দ্বিধায় বলে ওঠেন, এর চাইতে অলৌকিক কোন আসমানী খবর যদি মুহাম্মাদ বলেন, আমি তা অবশ্যই বিশ্বাস করব। এদিন থেকেই আবুবকর পরিচিত হ’লেন ‘আবুবকর ছিদ্দীক’ রূপে। ছিদ্দীক অর্থ সত্যায়নকারী। শুধু তাই নয় তিনি বরিত হ’লেন উম্মতের সেরা ব্যক্তিরূপে। অতএব দেখা যাচ্ছে যে, মি‘রাজের ঘটনা অবিশ্বাস করার কারণে দুর্বল ঈমানদারগণ ‘মুরতাদ’ হয়ে গেল। পক্ষান্তরে সবল ঈমানদারগণের ঈমান আরও বর্ধিত হয়ে সর্বোচ্চে পেঁŠছে গেল।
আল্লাহ বলেন,سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ- ‘মহাপবিত্র তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রিবেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আক্বছায়, যার চতুস্পার্শ্বকে আমরা বরকতময় করেছি, তাকে আমাদের নিদর্শনসমূহ দেখাবার জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/১)।
مِعْرَاجٌ (মি‘রাজ) করণ কারক, অর্থ- যার দ্বারা আরোহন করা হয়, অর্থাৎ সিঁড়ি। যা عُرُوجٌ (উরূজুন) মূল ধাতু হ’তে উৎপন্ন। যার অর্থ ‘আরোহন করা’। শারঈ অর্থে বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদ থেকে যে অলৌকিক সিঁড়ির মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সপ্তাকাশের উপরে আরশের নিকটে আল্লাহ্র সান্নিধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই সিঁড়িকে ‘মি‘রাজ’ বলা হয়। পারিভাষিক অর্থে, হিজরতের পূর্বে একটি বিশেষ রাতের শেষ প্রহরে বায়তুল্লাহ হ’তে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত বোরাকে ভ্রমণ, অতঃপর সেখান থেকে অলৌকিক সিঁড়ির মাধ্যমে সপ্তাকাশ পেরিয়ে আরশে আল্লাহ্র সান্নিধ্যে গমন ও পুনরায় বায়তুল মুক্বাদ্দাস হয়ে বোরাকে আরোহন করে প্রভাতের আগেই মক্কায় নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তনের ঘটনাকে মি‘রাজ বলা হয়।
أَسْرَى ক্রিয়াটি إِسْرَاءٌ মূল ধাতু হ’তে উৎপন্ন। অর্থ ‘রাত্রিতে চলা’। سَارِيَةٌ অর্থ ‘রাত্রিকালীন বৃষ্টি’। এরপর لَيْلاً শব্দটি যোগ করায় আরও স্পষ্টভাবে এ অর্থ ফুটে উঠেছে। لَيْلاً শব্দটি نكرة বা অনির্দিষ্ট বাচক ব্যবহার করে এদিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, সমগ্র ঘটনায় সম্পূর্ণ রাত্রি নয়, বরং রাত্রির একটা অংশ ব্যয়িত হয়েছে। আয়াতে উল্লেখিত মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আক্বছা পর্যন্ত সফরকে ‘ইসরা’ বলা হয় এবং সেখান থেকে সপ্তম আকাশের ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত সফরকে মি‘রাজ বলা হয়। ‘ইসরা’ অত্র আয়াতে এবং ‘মি‘রাজ’ সূরা নাজম ১৩-১৮ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে এবং যা বহু ‘মুতাওয়াতির’ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত।[1]
সূরা নাজমের আয়াতগুলি নিম্নরূপ :
وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى- عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى- عِنْدَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَى- إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَى- مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَى- لَقَدْ رَأَى مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى- ‘নিশ্চয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিল’ (১৩)। ‘সিদরাতুল মুনতাহার নিকটে’ (১৪)। ‘তার নিকটে আছে জান্নাতুল মাওয়া’ (১৫)। ‘যখন বৃক্ষটিকে আচ্ছাদিত করে রেখেছিল যা তাকে আচ্ছাদিত করে’ (১৬)। ‘এতে তার দৃষ্টি বিভ্রম ঘটেনি বা তা সীমালংঘনও করেনি’ (১৭)। ‘অবশ্যই সে তার প্রতিপালকের মহান নিদর্শন সমূহ থেকে কিছু দেখেছিল’ (নাজম ৫৩/১৩-১৮)।
অত্র সূরার ৫ থেকে ১১ আয়াত পর্যন্ত স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে যে,عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَى- ذُو مِرَّةٍ فَاسْتَوَى- وَهُوَ بِالْأُفُقِ الْأَعْلَى- ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى- فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى- فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى- مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى- ‘তাকে শিক্ষাদান করে মহা শক্তিশালী (একজন ফেরেশতা)’ (৫)। ‘মহা শক্তিধর। অতঃপর সে নিজ আকৃতিতে প্রকাশ পেল’ (৬)। ‘তখন সে সর্বোচ্চ দিগন্তে ছিল’ (৭)। ‘অতঃপর সে নিকটবর্তী হ’ল। তারপর আরও কাছাকাছি হ’ল’ (৮)। ‘ফলে তাদের মাঝে দুই ধনুকের ব্যবধান রইল বা তারও কম’ (৯)। ‘অতঃপর আল্লাহ (জিব্রীলের মাধ্যমে) তার বান্দার নিকট যা অহী করার তা করলেন’ (১০)। ‘তার হৃদয় মিথ্যা বলেনি, যা সে দেখেছে’ (নাজম ৫৩/৫-১১)।
আনাস ও ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত ভাষ্যে এগুলি মি‘রাজ রজনীতে আল্লাহ্র সঙ্গে তাঁর রাসূলের সরাসরি কথোপকথন ও শিক্ষা লাভের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ছাহাবী এবং ছহীহ হাদীছ সমূহের বর্ণনা ও সর্বোপরি আয়াতগুলির পূর্বাপর বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে এটা পরিষ্কার বুঝা যায় যে, এগুলি জিব্রীল (আঃ) সম্পর্কে বলা হয়েছে। যাতে বলে দেওয়া হয়েছে যে, রাসূলের নিকটে প্রেরিত অহি-তে কোনরূপ সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নেই। জিব্রীল আল্লাহ্র নিকট থেকে সরাসরি ‘অহি’ নিয়ে যথাযথভাবে তা পৌঁছে দিয়ে থাকেন। যেখানে কোনরূপ যোগ-বিয়োগের অবকাশ নেই।
اَسْرَى بِعَبْدِهِ বলার মাধ্যমে একথা বুঝানো হয়েছে যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) নিজস্ব ক্ষমতা বলে ভ্রমণ করেননি। বরং তাঁকে ভ্রমণ করানো হয়েছে। নিঃসন্দেহে এর মধ্যে যেমন আল্লাহ্র সর্বোচ্চ ক্ষমতা ও বান্দার অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে, তেমনি আল্লাহ্র রহমত হ’লে বান্দা যে ফেরেশতাদের ডিঙিয়ে যেতে পারে এবং উন্নতির সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছতে পারে, তারও ইঙ্গিত রয়েছে। লক্ষণীয় যে, এখানে اَسْرَى بِرُوْحِهِ না বলে اَسْرَى بِعَبْدِهِ বলা হয়েছে। এতে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে যে, এই ভ্রমণ স্বপ্নযোগে ছিল, বরং আত্মা ও দেহের সমন্বয়ে বান্দার সশরীরে ছিল। আর সশরীরে না হ’লে বিস্ময়েরই বা কি আছে? সাধারণ মানুষ তা হর-হামেশা স্বপ্নযোগে মক্কা-মদীনা এমনকি কেউ মঙ্গল গ্রহে ঘুরে আসছে।
সম্মান ও গৌরবের স্তরে بِعَبْدِهِ শব্দটি একটি বিশেষ প্রেমময়তার ইঙ্গিত বহন করে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং কাউকে ‘আমার বান্দা’ বললে এর চাইতে বড় সম্মান মানুষের জন্যে আর কিছুই হ’তে পারে না।
মি‘রাজ : সশরীরে না স্বপ্নযোগে?
ইসরা ও মি‘রাজের সমগ্র সফর যে আত্মিক ছিল না, বরং দৈহিক ছিল, একথা কুরআনের স্পষ্ট আয়াত ও অনেক মুতাওয়াতির হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত।
হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, অধিকাংশ বিদ্বান এ বিষয়ে একমত যে, মি‘রাজ দৈহিক ছিল, আত্মিক নয়। জাগ্রত অবস্থায় ছিল, ঘুমন্ত অবস্থায় নয়। তাছাড়া এ বিষয়ে সকলে একমত যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রথমে যদি ঘুমন্তু অবস্থায় কোন স্বপ্ন দেখতেন, অতঃপর জাগ্রত অবস্থায় তা পুনরায় বাস্তবে দেখতে পেতেন। কেননা তিনি এমন কোন স্বপ্ন দেখতেন না, যা আলোকোজ্জ্বল প্রভাতের মত সত্য প্রমাণিত না হ’ত। আলাচ্যে আয়াতের শুরুতে سُبْحَانَ শব্দের মধ্যে এদিকেই ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা এ শব্দটি আশ্চর্যজনক ও বিরাট কোন বিষয়ের জন্যে ব্যবহৃত হয়। মি‘রাজ যদি শুধু আত্মিক অর্থাৎ স্বপ্নজগতে সংঘটিত হ’ত, তবে তাতে আশ্চর্যের বিষয় কিছু ছিল না। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মি‘রাজের ঘটনা হযরত উম্মে হানী (রাঃ)-এর কাছে বর্ণনা করলেন, তখন তিনি পরামর্শ দিলেন যে, আপনি কারও কাছে একথা প্রকাশ করবেন না। প্রকাশ করলে কাফেররা আপনার প্রতি আরও বেশী মিথ্যারোপ করবে। অতএব ব্যাপারটি যদি নিছক স্বপ্নই হ’ত, তাহ’লে এ ধরণের পরামর্শ দেওয়ার কি কারণ ছিল? এবং মিথ্যারোপ করারই বা কি কারণ ছিল? উল্লেখ্য যে, মি‘রাজের রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় চাচাতো বোন উম্মে হানী বিনতে আবু ত্বালিব-এর বাড়ীতে ঘুমিয়ে ছিলেন এবং সেখান থেকেই রাত্রির শেষ প্রহরে তিনি উঠে যান।[2]
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন ঘটনা প্রকাশ করলেন, তখন কাফেররা যথারীতি মিথ্যারোপ করল এবং ঠাট্টা-বিদ্রুপ করল। এমনকি কতক নও-মুসলিম এ সংবাদ শুনে ‘মুরতাদ’ বা ধর্মত্যাগী হয়ে গেল। যদি ব্যাপারটি কেবল স্বপ্নের হ’ত, তাহ’লে এতসব তুলকালাম কান্ড ঘটার সম্ভাবনা ছিল কি? অবশ্য এ ঘটনার আগে স্বপ্নের আকারে কোন আত্মিক মি‘রাজ হয়ে থাকলে তা এর পরিপন্থী নয়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, মি‘রাজকে অবিশ্বাস করে যেসব মুসলমান তখন ‘মুরতাদ’ হয়ে গিয়েছিল, তাদের প্রতি ইঙ্গিত করে নাযিল হয়, وَمَا جَعَلْنَا الرُّؤْيَا الَّتِي أَرَيْنَاكَ إِلاَّ فِتْنَةً لِّلنَّاسِ، ‘আমরা তোমাকে (মি‘রাজের রাতে) যে দৃশ্য দেখিয়েছি এবং কুরআনে বর্ণিত যে অভিশপ্ত (যাক্কুম) বৃক্ষ দেখিয়েছি, তা ছিল কেবল মানুষের (ঈমান) পরীক্ষার জন্য’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৬০)। নিঃসন্দেহে উক্ত পরীক্ষায় অবিশ্বাসীরা ব্যর্থ হয়েছে। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, هِيَ رُؤْيَا عَيْنٍ أُرِيهَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْلَةَ أُسْرِيَ بِهِ- ‘এটি হ’ল প্রত্যক্ষ দর্শন, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মি‘রাজের রাত্রিতে স্বচক্ষে দেখানো হয়েছিল’ (ইবনু কাছীর)। কারণ এটা প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা চলে যে, বিষয়টি স্রেফ স্বপ্ন হ’লে কোন মুসলমান ‘মুরতাদ’ হয়ে যেত না।
এখানে رُؤْيَا বা ‘স্বপ্ন’ বলে رُؤْيَةٌ বা ‘চোখে দেখা’ বুঝানো হয়েছে। কিন্তু একে رُؤْيَا শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করার কারণ এই হ’তে পারে যে, এ ব্যাপারটিকে রূপক অর্থে رُؤْيَا বলা হয়েছে। অর্থাৎ মি‘রাজের বাস্তব ঘটনার দৃষ্টান্ত এমন, যেমন কেউ স্বপ্ন দেখে। পক্ষান্তরে এর অর্থ যদি ‘স্বপ্ন’ই নেওয়া হয়, তবে এমনটিও অসম্ভব নয়। কারণ মি‘রাজের ঘটনাটি দৈহিক হওয়া ছাড়াও এর আগে আত্মিক বা স্বপ্নযোগেও হয়ে থাকতে পারে। এ কারণে আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস এবং আয়েশা (রাঃ) থেকে যে স্বপ্নযোগে মি‘রাজ হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে, তাও যথাস্থানে নির্ভুল হবে। কিন্তু এতে দৈহিক মি‘রাজ না হওয়া প্রমাণিত হয় না।
হাফেয ইবনু কাছীর স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে মি‘রাজ সংক্রান্ত রেওয়ায়াত সমূহ সনদ সহ বর্ণনা করেছেন। অতঃপর বর্ণনাকারী পঁচিশ জন ছাহাবীর নাম পৃথকভাবে উল্লেখ করেছেন। তারা হ’লেন, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব, আলী ইবনু আবী ত্বালিব, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, আবু যার গিফারী, মালেক ইবনু ছা‘ছা, আবু হুরায়রা, আবু সাঈদ খুদরী, আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস, শাদ্দাদ ইবনে আউস, উবাই ইবনে কা‘ব, আব্দুর রহমান ইবনে কুর্ত্ব, আবু হাববাহ এবং আবু লায়লা আনছারী, আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর, জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ, হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান, বুরায়দাহ, আবু আইয়ুব আনছারী, আবু উমামা, সামুরা ইবনে জুনদুব, আবুল হামরা, ছোহায়েব রূমী, উম্মে হানী, আয়েশা ও আসমা বিনতে আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)।
অতঃপর ইবনু কাছীর বলেন,فَحَدِيثُ الْإِسْرَاءِ أَجْمَعَ عَلَيْهِ الْمُسْلِمُونَ، وَاعْتَرَضَ فِيهِ الزَّنَادِقَةُ الْمُلْحِدُونَ- ‘মি‘রাজ’ সম্পর্কে সব মুসলমানের ঐক্যমত রয়েছে। শুধু যিন্দীক ও ধর্মদ্রোহীরা একে মানেনি’।[3]
মি‘রাজের সংক্ষিপ্ত ঘটনা ও কুদরতের নিদর্শনাবলী :
হাফেয আবুল ফিদা ইমাদুদ্দীন ইসমাঈল ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হি.) স্বীয় জগদ্বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থে আলাচ্যে আয়াতের সংশ্লিষ্ট মি‘রাজ বিষয়ক হাদীছসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা শেষে বলেন,
‘সত্য কথা এই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইসরা-র সফর জাগ্রত অবস্থায় করেন, স্বপ্নে নয়। মক্কা মুকাররমা হ’তে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত রাত্রিকালীন এ সফর বোরাক্ব যোগে করেন। বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দ্বারে উপনীত হয়ে তিনি বোরাক্বটি অদূরে বেঁধে দেন ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের মসজিদে প্রবেশ করেন। অতঃপর ক্বিবলার দিকে মুখ করে দু’রাক‘আত ‘তাহিইয়াতুল মাসজিদ’ ছালাত আদায় করেন। অতঃপর সিঁড়ি আনা হয়, যাতে নীচে থেকে উপরে যাওয়ার জন্যে ধাপ বানানো ছিল। তিনি উক্ত সিঁড়ির সাহায্যে প্রথম আকাশে, অতঃপর সপ্ত আকাশসমূহে গমন করেন (এ সিঁড়িটি কি এবং কিরূপ ছিল, তার প্রকৃত স্বরূপ আল্লাহ ভাল জানেন। ইদানিংকালেও স্বয়ংক্রিয় লিফট ছাড়াও অনেক প্রকার সিঁড়ি পৃথিবীতে প্রচলিত রয়েছে। অতএব এই অলৌকিক সিঁড়ি সম্পর্কে সন্দেহ ও দ্বিধার কোন কারণ নেই)। প্রত্যেক আকাশে নিকটবর্তী ফেরেশতারা তাকে অভ্যর্থনা জানায় এবং প্রত্যেক আকাশে স্ব স্ব স্থানে অবস্থানরত পয়গম্বরগণকে তিনি সালাম দেন। এভাবে ষষ্ঠ আসমানে মূসা (আঃ) এবং সপ্তম আসমানে ইব্রাহীম (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। অতঃপর তিনি পয়গম্বরগণের স্থানসমূহ অতিক্রম করে এমন এক ময়দানে পেঁŠছেন, যেখানে ভাগ্যলিপি লেখার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। অতঃপর তার উপরে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’য় নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে আল্লাহ্র নির্দেশে স্বর্ণের প্রজাপতি এবং বিভিন্ন রঙ-এর প্রজাপতি সমূহ ইতস্ততঃ ছুটাছুটি করছিল। ফেরেশতারা স্থানটিকে ঘিরে রেখেছিল। এখানে তিনি জিব্রাঈলকে তার ৬০০ ডানা সহ স্বরূপে দেখেন। সেখানে তিনি একটি দিগন্ত বেষ্টিত সবুজ রঙের ‘রফরফ’ দেখতে পান। সবুজ রঙের গদিবিশিষ্ট পাল্কীকে ‘রফরফ’ বলা হয়। অতঃপর তার উপরে ‘বায়তুল মা‘মূর’ দেখানো হয়। তিনি সেখানে সাথীদের নিয়ে ছালাত আদায় করেন। দুনিয়ায় কা‘বার প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ‘বায়তুল মা‘মূরে’র প্রাচীর গাত্রে হেলান দিয়ে উপবিষ্ট ছিলেন। কেননা এটি হ’ল আসমানের কা‘বা। বায়তুল মা‘মূরে দৈনিক সত্তর হাযার ফেরেশতা প্রবেশ করে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাদের সেখানে পুনর্বার প্রবেশ করার পালা আসবে না’।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, এমন সময় সকল প্রকার রং বিশিষ্ট একটি মেঘ আমাকে ঢেকে ফেলে। তখন জিব্রীল আমাকে ছেড়ে যায় এবং আমি আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে সিজদায় পড়ে যাই। তখন আল্লাহ আমাকে বলেন, হে মুহাম্মাদ! আসমান ও যমীন সৃষ্টির শুরু থেকে আমি তোমার উম্মতের জন্য ৫০ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেছি। অতএব তুমি ও তোমার উম্মত তা গ্রহণ কর’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, অতঃপর মেঘটি সরে গেল এবং চারিদিক পরিষ্কার হয়ে গেল। তখন জিব্রীল এসে আমার হাত ধরল। আমি দ্রুত ইব্রাহীমের কাছে চলে এলাম। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। তখন মূসার কাছে নেমে এলাম, তিনি আমাকে পুনরায় ফিরে গিয়ে ছালাতের পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য পীড়াপীড়ি করলেন’। মূসা (আঃ)-এর পরামর্শক্রমে রাসূল (ছাঃ) কয়েকবার আল্লাহ্র নিকটে যান ও ছালাতের ওয়াক্তের পরিমাণ কমানোর অনুরোধ করেন। অতঃপর তা অনুগ্রহ বশে হ্রাস করে পাঁচ ওয়াক্ত করে দেওয়া হয়, যা ৫০ ওয়াক্তের শামিল হবে।
এর দ্বারা সব ইবাদতের মধ্যে ছালাতের বিশেষ গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বচক্ষে জান্নাত-জাহান্নাম, মাক্বামে মাহমূদ, হাউয কাওছার ইত্যাদি পরিদর্শন করেন। অতঃপর তিনি ‘বায়তুল মুক্বাদ্দাসে’ ফিরে আসেন এবং বিভিন্ন আসমানে যে সকল পয়গম্বরের সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছিল, তাঁরাও তাঁর সাথে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে অবতরণ করেন। তখন ছালাতের সময় হয়ে যায় এবং তিনি পয়গম্বরগণকে সাথে নিয়ে ছালাত আদায় করেন। সম্ভবতঃ সেটা সেদিনকার ফজরের ছালাত ছিল।
ইবনু কাছীর বলেন, ছালাতে পয়গম্বরগণের ইমামতি করার এ ঘটনাটি কারও কারও মতে আসমানে ওঠার পূর্বে সংঘটিত হয়। কিন্তু বাহ্যতঃ এ ঘটনাটি সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের পরে ঘটে। কেননা আসমানে পয়গম্বরগণের সাথে সাক্ষাতের ঘটনায় একথাও বর্ণিত রয়েছে যে, জিব্রাঈল (আঃ) পয়গম্বরগণের সাথে তাঁকে পৃথক পৃথকভাবে পরিচয় করিয়ে দেন। ইমামতির ঘটনা প্রথমে হয়ে থাকলে এখানে পুনরায় পরিচয় করিয়ে দেয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না। এছাড়া সফরের আসল উদ্দেশ্য ছিল ঊর্ধ্ব জগতে গমন করা। কাজেই একাজটি প্রথমে সেরে নেওয়াই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। আসল কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর সব পয়গম্বর বিদায় দানের জন্যে তাঁর সাথে ‘বায়তুল মুক্বাদ্দাস’ পর্যন্ত আসেন এবং জিব্রীলের ইঙ্গিতে তাঁকে সবাই ইমাম বানিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে কার্যতঃ তাঁর নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দেওয়া হয়। তাকে শুরুতে ‘বায়তুল মুক্বাদ্দাসে’ ও শেষে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’তে দুধ, মদ ও মধু দ্বারা আপ্যায়ন করা হয়। কিন্তু তিনি কেবল দুধ গ্রহণ করেন। ‘বায়তুল মুক্বাদ্দাসে’ বিদায়ী ছালাত শেষে তাঁকে জাহান্নামের দারোগা ‘মালেক’ ফেরেশতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় এবং তিনি রাসূলকে প্রথমে সালাম করেন। এরপর তিনি বায়তুল মুক্বাদ্দাস থেকে বিদায় নেন এবং বোরাক্বে সওয়ার হয়ে অন্ধকার থাকতেই মক্কা মুকাররমায় ফিরে আসেন। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।[4]
কুরতুবী বলেন, এ বিষয়ে বিদ্বানগণের মধ্যে কোন মতভেদ নেই যে, মি‘রাজের পরদিন দুপুরে সূর্য ঢলে পড়ার সময় জিব্রীল (আঃ) নেমে আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ছালাতের ওয়াক্ত সমূহ নির্ধারণ করে দেন ও ছালাতের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দেন।[5]
উল্লেখ্য যে, নবীগণের মধ্যে ১ম আসমানে আদম (আঃ), ২য় আসমানে ইয়াহইয়া ও ঈসা (আঃ) দুই খালাতো ভাই, ৩য় আসমানে ইউসুফ (আঃ), ৪র্থ আসমানে ইদ্রীস (আঃ), ৫ম আসমানে হারূণ (আঃ), ৬ষ্ঠ আসমানে মূসা (আঃ) এবং ৭ম আসমানে ইব্রাহীম (আঃ)-এর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। ৭ম আসমানের উপরে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ এবং তারও উপরে ‘আরশ’।[6]
কি কি নিয়ে আসেন :
মি‘রাজে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তিনটি বস্ত্ত প্রদান করা হয়। (১) পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত (২) সূরা বাক্বারাহ্র শেষ ২৮৫-২৮৬ দুই আয়াত (৩) উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যে যারা শিরক করেনি, তাদেরকে ক্ষমা করার সুসংবাদ’।[7]
উল্লেখ্য যে, সূরা বাক্বারাহ মাদানী সূরার অন্তর্ভুক্ত। অথচ মি‘রাজ হয়েছে মক্কাতে। যেখানে সূরা বাক্বারাহ্র শেষ দুই আয়াত নাযিল হয়েছে। এর জবাব এই যে, জিব্রীলের মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি এ দু’টি আয়াত রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি অবতীর্ণ হয় তাঁকে প্রার্থনা শিক্ষা দেওয়ার জন্য, যাতে আল্লাহ তাঁর দো‘আ কবুল করতে পারেন। অতঃপর জিব্রীলের মাধ্যমে পুনরায় এ আয়াত দু’টি সূরা বাক্বারাহ্র বাকী আয়াতগুলির সাথে মদীনায় নাযিল হয়। এভাবে সমস্ত কুরআন জিব্রীলের মাধ্যমে নাযিল হয়। তাছাড়া এ আয়াত দু’টি এমনই মর্যাদাপূর্ণ যে সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, দু’টি এমন নূর আমাকে দেওয়া হয়েছে, যা ইতিপূর্বে কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। একটি হ’ল, সূরা ফাতিহা। অন্যটি হ’ল বাক্বারাহ্র শেষ দু’টি আয়াত। যে ব্যক্তি এ দু’টি পাঠ করবে, তাকে তা দেওয়া হবে।[8] অর্থাৎ সূরা ফাতিহা ও এ দু’টি আয়াত থেকে তার প্রার্থনা অনুযায়ী দেওয়া হবে। যেমন ‘ছিরাতে মুস্তাক্বীম’ ‘ভুলের ক্ষমা’ ইত্যাদি।
মাক্কী জীবনে মি‘রাজে এবং মাদানী জীবনে পরপর দু’বার নাযিলের মাধ্যমে অত্র আয়াত দু’টির উচ্চ মর্যাদা ও অধিক গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে (মিরক্বাত)।
উল্লেখ্য যে, মি‘রাজে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘আত্তাহিইয়াতু’ প্রাপ্ত হয়েছিলেন বলে ব্যাপকভাবে একটি কথা চালু আছে, যা মিরক্বাত, রাদ্দুল মুহতার, মিসকুল খিতাম প্রভৃতি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। বর্ণনাটি নিম্নরূপ :
ইবনুল মালেক বলেন, বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মি‘রাজে গিয়ে ‘আত্তাহিইয়াতু’-র মাধ্যমে আল্লাহ্র প্রশংসা করেন। জবাবে আল্লাহ বলেন, আসসালামু ‘আলায়কা... ‘হে নবী! আপনার উপরে শান্তি, আল্লাহ্র রহমত ও বরকত সমূহ নাযিল হৌক। তখন রাসূল (ছাঃ) বলেন, আসসালামু ‘আলায়না... আমাদের উপরে এবং আল্লাহ্র নেককার বান্দাদের উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক! তখন জিব্রীল বলেন, আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু... ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল’।
উপরাক্তে বর্ণনাটির কোনরূপ সনদ বা সূত্র যাচাই না করেই ছাহেবে মিরক্বাত মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (মৃ. ১০১৪ হি.) মন্তব্য করেন যে, এ বক্তব্যের দ্বারা তাশাহহুদে রাসূলকে (হে নবী! বলে) সম্বোধন করার কারণ প্রকাশিত হয়েছে। আর এর মাধ্যমে ছালাতের শেষে রাসূল (ছাঃ)-এর মি‘রাজের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা মুমিনদের জন্য মি‘রাজ স্বরূপ (মিরক্বাত)। সম্ভবতঃ তাঁকে অনুকরণ করেই পরবর্তী লেখকগণ স্ব স্ব গ্রন্থে এটা উদ্ধৃত করে গেছেন। বিংশ শতকের সূক্ষ্মদর্শী ভাষ্যকার আল্লামা ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (১৩২২-১৪১৪ হি./১৯০৪-১৯৯৪ খৃ.) উক্ত বর্ণনাটি উল্লেখ করে মন্তব্য করেন,وهذا المروي لم أقف على سنده، فإن كان ثابتاً فنعم التوجيه هذا- ‘বর্ণনাটির সূত্র আমি খুঁজে পাইনি। যদি এটা প্রমাণিত হ’ত, তবে কতই না সুন্দর ব্যাখ্যা হ’ত এটা’।[9] অতএব ভিত্তিহীন। বক্তব্য থেকে বিরত থাকাই উত্তম।
‘ছিদ্দীক্ব’ উপাধি লাভ :
আয়েশা (রাঃ) বলেন, একরাতেই বায়তুল্লাহ থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাস যাতায়াতের অকল্পনীয় খবর শুনে নওমুসলিম অনেকে মুরতাদ হয়ে যায় (কেননা মক্কা থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাস যেতে তখন কমপক্ষে এক মাস সময় লাগত)। তাদের অনেকে আবু বকর (রাঃ)-এর নিকটে এসে বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করল, আপনার সাথীর কিছু হয়েছে কি? তিনি একরাতেই বায়তুল মুক্বাদ্দাস সফর করে এসেছেন বলে দাবী করছেন? আবু বকর বললেন, হ্যাঁ। যদি তিনি একথা বলে থাকেন, তবে তা অবশ্যই সত্য। এর চাইতে আরও দূরবর্তী আসমানের খবর আমি সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর কাছ থেকে শুনি ও বিশ্বাস করি’’। আয়েশা বলেন, সেদিন থেকেই তাঁকে ‘আছ-ছিদ্দীক্ব’ বা ‘অতীব সত্যবাদী’ নামকরণ করা হয়।[10]
উল্লেখ্য যে, আবু জাহলের প্রস্তাবক্রমে মক্কার নেতাদেরকে কা‘বা চত্বরে ডাকা হয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের প্রশ্নসমূহের উত্তর দিতে থাকেন। যাতে তারা নিশ্চিত হয় যে,রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)অবশ্যই স্বচক্ষে তা দর্শন করে এসেছেন। ‘এসময় আল্লাহ পাক তাঁর চোখের সম্মুখে বায়তুল মুক্বাদ্দাসকে তুলে ধরেছিলেন’।[11] এতদসত্বেও তারা ঈমান আনেনি।
উল্লেখ্য যে, মি‘রাজকে বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করার অহেতুক কসরত করার চেয়ে নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করার মধ্যেই আত্মিক প্রশান্তি ও বৈজ্ঞানিক উন্নতি নিহিত রয়েছে। যে যুগের লোকেরা এটা বিশ্বাস করে মুমিন হয়েছেন, আজকের রকেট ও ইন্টারনেটের যুগের তুলনায় সেটা খুবই কষ্টকর ছিল। আগামী দিনে বিজ্ঞান হয়তো আরও এগিয়ে যাবে। কিন্তু তখন আমরা থাকব না। অতএব বিজ্ঞানের প্রমাণের অপেক্ষায় না থেকে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে মৃত্যু বরণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
মি‘রাজ অবিশ্বাসীদের পরিণাম:
মুসনাদে আহমাদে ছহীহ সনদে ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, মি‘রাজের ঘটনাকে অবিশ্বাসকারী মুরতাদ কাফিরগুলি আবু জাহলের সাথে (বদরের যুদ্ধে) নিহত হয়’।[12]
মি‘রাজে কি রাসূল স্বীয় প্রভুকে দেখেছিলেন?
এ বিষয়ে চূড়ান্ত জবাব এই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আল্লাহকে স্বরূপে দেখেননি। অনুরূপ কথা কোন ছাহাবীও কখনো বলেননি।[13] বরং তিনি আল্লাহ্র নূর দেখেছিলেন।[14] আয়েশা (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি বলবে মুহাম্মাদ আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখেছেন বা তিনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, তার কিছু লুকিয়েছেন বা আল্লাহ্র জন্য নির্ধারিত পাঁচটি অদৃশ্য বিষয় তিনি জানেন, ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে বড় অপবাদ দিয়েছে। বরং তিনি জিব্রীলকে দু’বার দেখেছিলেন। শেষবার সিদরাতুল মুনতাহায় এবং প্রথমবার নিম্ন মক্কায় ‘আজিয়াদ’ নামক স্থানে (প্রথম অহী নাযিলের সময়) ৬০০ ডানা বিশিষ্ট তার মূল চেহারায়, যা দিগন্ত ঢেকে নিয়েছিল।[15] মৃত্যুর পূর্বে দুনিয়াতে কেউ আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখতে পারবে না (আন‘আম ১০৪, আ‘রাফ ১৪৩)।
মি‘রাজ কয়বার ও কখন হয়েছে:
এ বিষয়ে ইবনু কাছীর বলেন, মি‘রাজ সম্পর্কে বর্ণিত ছহীহ, হাসান, যঈফ সকল প্রকারের বর্ণনা একত্রিত করলে তার সারকথা দাঁড়ায় এই যে, মক্কা থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে ‘ইসরা’ অর্থাৎ মি‘রাজের উদ্দেশ্যে রাত্রিকালীন সফর মাত্র একবার হয়েছিল, একাধিকবার নয়। যদি একাধিকবার হ’ত, তা’হলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সে বিষয়ে উম্মতকে অবহিত করে যেতেন। খ্যাতনামা জ্যেষ্ঠ তাবেঈ ইবনু শিহাব যুহরীর বরাতে তিনি বলেন যে, হিজরতের এক বছর পূর্বে মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল’।
ছফিউর রহমান মুবারকপুরী এ বিষয়ে ৬টি মতামত উল্লেখ করেছেন। যথ: (১) নবুঅত প্রাপ্তির বছর। এটি ইমাম ইবনু জারীর ত্বাবারীর মত (২) ৫ম নববী বর্ষে। এটাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন ইমাম নববী ও ইমাম কুরতুবী (৩) ১০ম নববী বর্ষে ২৭শে রজবের রাতে। এটা পসন্দ করেছেন সুলায়মান মানছূরপুরী (৪) কেউ বলেছেন, হিজরতের ১৬ মাস পূর্বে ১২ নববী বর্ষের রামাযান মাসে (৫) কেউ বলেছেন, হিজরতের ১৪ মাস পূর্বে ১৩ নববী বর্ষের মুহাররম মাসে (৬) কেউ বলেছেন, হিজরতের এক বছর পূর্বে ১৩ নববী বর্ষের রবীউল আউয়াল মাসে।
অতঃপর মুবারকপুরী বলেন, প্রথম তিনটি মত গ্রহণযোগ্য নয় একারণে যে, খাদীজা (রাঃ) ১০ম নববী বর্ষের রামাযান মাসে মারা গেছেন, তখন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয হয়নি। আর এ বিষয়ে সকলে একমত যে, ছালাত ফরয হয়েছে মি‘রাজের রাত্রিতে (অতএব ২৭শে রজব তারিখে মি‘রাজ হয়েছে বলে যে কথা চালু আছে, তার কোন ভিত্তি নেই)। বাকী তিনটি মত সম্পর্কে তিনি বলেন, এগুলির কোন্টিকে আমি অগ্রাধিকার দেব ভেবে পাইনা। তবে সূরা বনী ইসরাঈলে বর্ণিত আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, ইসরা-র ঘটনাটি খুবই শেষের দিকে হয়েছিল’।[16]
বলা বাহুল্য যে, আল্লামা মুবারকপুরীর এ মন্তব্য পূর্বে বর্ণিত তাবেঈ বিদ্বান মুহাম্মাদ বিন মুসলিম ওরফে ইবনু শিহাব যুহরী (৫০-১২৪ হিঃ)-এর বরাতে ইবনু কাছীরের বক্তব্যকে সমর্থন করে। অর্থাৎ হিজরতের এক বছর পূর্বে মি‘রাজ হয়েছে। তবে সঠিক তারিখ বা দিনক্ষণ জানা যায় না। আর সঠিক দিন-তারিখ অন্ধকারে রাখার কারণ এটাই, যাতে মুসলমান মি‘রাজের শিক্ষা ও তাৎপর্য ভুলে একে কেবল আনুষ্ঠানিকতায় বেঁধে না ফেলে এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহ্র আনুগত্যে থেকে আত্মিক ও জাগতিক উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহনের চেষ্টায় রত থাকে। দুর্ভাগ্য যে, এখন সেটাই হচ্ছে। আমরা এখন মি‘রাজের মূল শিক্ষা বাদ দিয়ে অনুষ্ঠান সর্বস্ব হয়ে পড়েছি। আমরা এখন উন্নয়ন মুখী না হয়ে নিম্নমুখী হয়েছি। মি‘রাজের রূহ হারিয়ে তার অনুষ্ঠান নামক কফিন নিয়ে আমরা মেতে উঠেছি।
মি‘রাজের শিক্ষা ও তাৎপর্য:
সূরা বনু ইসরাঈলের শুরুতে মাত্র একটি আয়াতে আল্লাহ পাক ইসরা ও মি‘রাজের এ ঘটনা ও তার উদ্দেশ্য অতীব সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর ইহুদীদের অপকীর্তি সমূহের ভবিষ্যৎ পরিণাম ফল বর্ণনা করেছেন। এখানে মক্কা থেকে বায়তুল মুক্কাদ্দাসে ভ্রমণ করানোর তৎপর্য হ’তে পারে এই যে, অতি সত্ত্বর পৃথিবী হ’তে ইহুদীদের কর্তৃত্ব ধবংস হয়ে যাবে এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাসে ও পৃথিবী ব্যাপী সর্বত্র মুসলমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। ১৫ হিজরীতে এটা বাস্তবায়িত হয় ওমর ফারূকের হাতে বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয়ের মাধ্যমে রাসূলের মৃত্যুর মাত্র চার বছরের মাথায়। উল্লেখ্য যে, ইহুদী থেকে মুসলমান হওয়া ছাহাবী কা‘ব আল-আহবারের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে ওমর ফারুক (রাঃ) ছাখরাকে পিছনে রেখে ক্বিবলার দিকে এগিয়ে গিয়ে সেখানেই ছালাত আদায় করেন, যেখানে মি‘রাজের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত আদায় করেছিলেন’।[17] অত:পর তৎকালীন বিশ্বের সকল পরাশক্তি মুসলিম বাহিনীর কাছে পরাজয় স্বীকারে বাধ্য হয়। অতঃপর উমাইয়া, আববাসীয়, স্পেনের উমাইয়া ও মিসরের ফাতেমীয় খেলাফত সারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে। সর্বশেষ তুরষ্কের ওছমানী খেলাফত বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মাত্র ১৯২৪ খৃষ্টাব্দে শেষ হ’ল। মুসলমান আবারও তার হারানো কর্তৃত্ব ফিরে পাবে, যদি সে ইসলামের পথে ফিরে আসে।
সূরা ইসরায় বিশ্ব বিজয়ের এই ইঙ্গিতটি দেওয়া হয়েছিল এমন একটি সময়ে, যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জনগণ কর্তৃক নিন্দিত ও পরিত্যক্ত অবস্থায় মক্কার পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। এতে বুঝা যায় যে, মূল বিজয় নিহিত থাকে সঠিক আক্বীদা ও আমলের মধ্যে। অর্থ-বিত্ত, জনশক্তি ও ক্ষাত্র শক্তির মধ্যে নয়।
২য় তাৎপর্য- মি‘রাজের ঘটনা সংঘটিত হয় ১২ নববী বর্ষের হজ্জের মওসুমে আক্বাবায়ে কুবরার পূর্বে। অর্থাৎ মি‘রাজের ঘটনার পরপরই ইসলামী বিপ্লবের পূর্বশর্ত হিসাবে ইমারত ও বায়‘আতের ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয় মিনা প্রান্তরে এবং তার পরেই তিনি মদীনায় হিজরত করেন। অত:পর সেখানে ইসলামী সমাজের রূপরেখা বাস্তবায়িত হয়।
৩য়- মি‘রাজের উদ্দেশ্য বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন, ‘যাতে আমি তাকে আমার কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই’। এটা একারণে যে, ليس الخبر كالمعاينة ‘সংবাদ কখনো স্বচক্ষে দেখার মত হয় না’। এর মধ্যে দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় প্রতিভাত হয় যে, ইতিপূর্বে ইবরাহীম ও মূসাকে দুনিয়াতেই আল্লাহ স্বীয় কুদরতের কিছু নমুনা দেখিয়েছেন (আন‘আম ৬/৭৬, ত্বোহা ২০/২৩)। কিন্তু কোন নবীকে আখেরাতের দৃশ্য স্বচক্ষে না দেখিয়ে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে প্রত্যক্ষ করানোর মাধ্যমে এটাই বুঝিয়ে দেওয়া হ’ল যে তিনিই সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। আর কেউ এই সুযোগ পায়নি এবং পাবেও না। তৃতীয়ত: অদৃশ্য জগতের যেসব খবর নবীদের মাধ্যমে জগদ্বাসীর নিকটে পৌঁছানো হয়, অহি-র মাধ্যমে প্রাপ্ত সেই সব খবরের সত্যতা স্বচক্ষে যাচাইয়ের মাধ্যমে শেষনবীসহ বিশ্ববাসীকে নিশ্চিতভাবে আশ্বস্ত করা হ’ল। চতুর্থত: এর দ্বারা এটাও প্রমাণিত হয় যে, মানব জাতির জন্য অনুসরণীয় আল্লাহ প্রদত্ত সর্বশেষ দ্বীন হ’ল ইসলাম ও সর্বশেষ নবী হ’লেন মুহাম্মাদ (ছাঃ)।
৪র্থ- এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ইঙ্গিত রয়েছে মানবজাতির উন্নতিকামী প্রতিভাবান, চিন্তাশীল ও কর্মঠ ব্যক্তিদের জন্য এ বিষয়ে যে, কুরআন-হাদীছ গবেষণা ও তা অনুসরণের মাধ্যমেই কেবল দুনিয়ায় সর্বোচ্চ উন্নতি ও আখেরাতে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। অন্য কোন পথে মানবজাতির সত্যিকারের উন্নতি ও মঙ্গল নিহিত নেই। বস্ত্তত: মি‘রাজের পথ ধরেই মানুষ দুনিয়াতে কেবল চন্দ্র বিজয় নয়, সৌর বিজয়ের পথে উৎসাহিত হ’তে পারে। একইভাবে সে আখেরাতে জান্নাতুল ফেরদৌস লাভে ধন্য হ’তে পারে।
৫ম- মি‘রাজের ঘটনায় একথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আল্লাহ নিজ সত্তায় সপ্ত আসমানের উপরে নিজ আরশে সমাসীন। তাঁর সত্তা সর্বত্র বিরাজমান নয়, বরং তাঁর ইল্ম ও কুদরত সর্বত্র বিরাজমান। তিনি নিরাকার নন, বরং তাঁর নিজস্ব আকার আছে। তবে তা কারু সাথে তুলনীয় নয়। তিনি কথা বলেন, তিনি শোনেন ও দেখেন।
৬ষ্ঠ- মি‘রাজে নিজ সান্নিধ্যে ডেকে নিয়ে আল্লাহ পাক মানব জাতির জন্য পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের যে তোহফা প্রদান করলেন, এর দ্বারা একথাই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ্র প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও ভীতিপূর্ণ ভালোবাসার মাধ্যমেই কেবল প্রকৃত সৎ মানুষ তৈরী হ’তে পারে এবং প্রকৃত অর্থে সামাজিক শান্তি, উন্নতি ও অগ্রগতি সম্ভব হ’তে পারে। অতএব সমাজ বিপ্লবের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হ’ল মানুষের নিজের মধ্যেকার আত্মিক ও নৈতিক বিপ্লব সাধন। ছালাতই হ’ল আত্ম সংশোধনের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান। অতএব ‘তাযকিয়ায়ে নাফ্স’ বা আত্মশুদ্ধির নামে কথিত অলি-আউলিয়া ও পীর-মাশায়েখদের তৈরী হরেক রকমের মা‘রেফতী ও ছূফীবাদী তরীকা সমূহ দ্বীনের মধ্যে সৃষ্ট বিদ‘আত বৈ কিছু নয়। যা থেকে দূরে থাকা কর্তব্য।
রজব মাসের ফযীলত:
এ মাসের সবচাইতে বড় ফযীলত এই যে, এটি চারটি সম্মানিত মাসের অন্যতম। বাকী তিনটি হ’ল যুলক্বা‘দাহ, যুলহিজ্জাহ ও মহররম। এ চার মাসে মারামারি, খুনা-খুনি নিষিদ্ধ। জাহেলী আরবরাও এ চার মাসের সম্মান আপোষে ঝগড়া-ফাসাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ রাখত। ইসলামেও তা বহাল রাখা হয়েছে (তওবা ৯/৩৬)। অতএব এ মাসের সম্মান মারামারি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে দূরে থাকাই বড় নেকীর কাজ।
উল্লেখ্য যে, জাহেলী যুগে আরবরা রজব মাসের বরকত হাছিলের জন্য তার প্রথম দশকে তাদের দেব-দেবীর নামে একটি করে কুরবানী করত। ‘আতীরাহ’ বা ‘রাজাবিয়াহ’ (العتيرة او الرجبية) বলা হ’ত। ইমাম তিরমিযী বলেন, রজব মাসের সম্মানে তারা এ কুরবানী দিত। কেননা এটি ছিল চারটি নিরাপদ ও সম্মানিত মাসের প্রথম মাস’। কেউ কেউ তাদের পালিত পশুর প্রথম বাছুর দেব-দেবীর নামে কুরবানী দিত। তাদের মাল-সম্পদে প্রবৃদ্ধি লাভের উদ্দেশ্যে, যাকে ফারা‘ (فرع) বলা হ’ত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এগুলিকে নিষেধ করে দেন’।[18] দুর্ভাগ্য আজকের মুসলমানেরা জাহেলী আরবদের অনুকরণে রজব মাসের নামে হরেক রকমের বিদ‘আত করছে। অথচ আল্লহ্র হুকুম মেনে তার সম্মান আপোষে হানাহানি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ রাখতে পারেনি।
রজব মাসের বিদ‘আত সমূহ:
রজব মাসের জন্য বিশেষ ছিয়াম পালন করা, ২৭শে রজবের রাত্রিকে শবে মি‘রাজ ধারণা করে ঐ রাতকে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা, উক্ত উদ্দেশ্যে বিশেষ কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা, যিকর-আযকার, শাবীনা খতম ও দো‘আর অনুষ্ঠান করা, মীলাদ ও ওয়ায মাহফিল করা, ঐ রাতের ছওয়াব লাভের উদ্দেশ্যে সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা, সরকারী ছুটি ঘোষণা করা ও তার ফলে জাতীয় অর্থনীতির বিশাল অংকের ক্ষতি করা, ছহীহ হাদীছ বাদ দিয়ে মি‘রাজের নামে উদ্ভট সব গল্পবাজি করা, মি‘রাজকে বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণ করতে গিয়ে অনুমান ভিত্তিক কথা বলা, ঐদিন আতশবাজি, আলোক সজ্জা, কবর যিয়ারত, দান-খয়রাত, এ মাসের বিশেষ ফযীলত লাভের আশায় ওমরাহ পালন ইত্যাদি সবই বিদ‘আতের পর্যায়ভুক্ত। অনেক রাজনৈতিক মুফাসসিরে কুরআন বলেন, এ রাতে ইসলামী শাসনতন্ত্রের ১৪ দফা মূলনীতি নাযিল হয়েছে। দলীল হিসাবে তাঁরা সূরা বনু ইসরাঈলের ২৩ থেকে ৩৫ আয়াত পর্যন্ত পড়তে বলেন। অথচ ঐ মুফাসসির এতটুকু নিশ্চয়ই জানেন যে, মি‘রাজে মূলত: কেবল পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতই ফরয করা হয়েছিল।
অনেক জাহিল কুরআনের কিছু আয়াত ও কিছু ছহীহ হাদীছের দোহাই পেড়ে নিজেদের আবিষ্কৃত বিদ‘আত সমূহকে প্রমাণসিদ্ধ করতে চান। যেমন আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيرًا- وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ কর এবং সকাল-সন্ধ্যা তাঁর গুণগান কর’ (আহযাব ৪১-৪২)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا-‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতা মন্ডলী নবীর উপরে রহমত বর্ষণ করে থাকেন। অতএব হে ঈমানদারগণ! তোমরা তাঁর উপরে বেশী বেশী দরূদ ও সালাম পেশ কর’ (আহযাব ৫৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ- ‘যখন তোমাকে আমার বান্দারা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, (তখন বলে দাও যে,)আমি (তার) অত্যন্ত নিকটবর্তী। আমি আহবানকারীর আহবানে সাড়া দিয়ে থাকি, যখন সে আমাকে আহবান করে’ (বাক্বারাহ ১৮৬)।وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ- ‘তোমরা আমাকে ডাক। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব’ (গাফের/মু’মিন) ৬০)। একটি ছহীহ হাদীছে রয়েছে, الصلاة خير موضوع، فمن استطاع أن يستكثر فليستكثر- ‘ছালাত আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তৈরী করা সর্বোত্তম বস্ত্ত। অতএব যে ব্যক্তি ক্ষমতা রাখে, সে যেন বেশী বেশী তা করে’ (অর্থাৎ যেন বেশী বেশী নফল ছালাত আদায় করে)।[19]
উপরোক্ত সাধারণ নির্দেশাবলী সম্বলিত আয়াত ও হাদীছের দোহাই দিয়ে রাসূলের সুন্নাত ও বাস্তব আমলের তোয়াক্কা না করে অসংখ্য ভিত্তিহীন যিকর, দো‘আ ও ছালাত এদেশে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং তা সমাজে ব্যাপকভাবে চালু হয়েছে কিছু সংখ্যক বিদ‘আতী মৌলবী ও রেওয়াজপন্থী সমাজনেতাদের মাধ্যমে। অথচ তারা একবারও ভাবে না যে, এইসব আয়াত যে নবীর উপরে নাযিল হয়েছে এবং উক্ত হাদীছ যে, নবীর মুখ দিয়ে বের হয়েছে, তিনি কখনো এসব বিদ‘আতী অনুষ্ঠানের ধারে কাছে যাননি। অনেক বিদ‘আতপন্থী ব্যক্তি বলে থাকে যে, ‘রাসূল তো নিষেধ করেন নি’। অথচ শুরুতেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এসব থেকে নিষেধ করে গেছেন এই বলে যে,من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد- ‘যে ব্যক্তি এমন আমল করল, যে বিষয়ে আমাদের হুকুম নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[20] তিনি মৌলিকভাবে সকল প্রকার বিদ‘আতকে নিষেধ করে গেছেন, নাম ধরে ধরে নয়। কেননা ক্বিয়ামত পর্যন্ত নানা রকমের বিদ‘আত আবিষ্কৃত হবে। সে সবের নাম জানা কারু পক্ষে সম্ভব নয়।
অতএব বল হে দুনিয়াপূজারী বিদ‘আতীরা! যে রাসূল মি‘রাজে গিয়েছিলেন, তিনি কি কখনো এজন্য বিশেষ কোন দো‘আ, ছালাত, ছিয়াম, ওয়ায মাহফিল, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, ওমরাহ পালন, দান-খয়রাত, কবর-যিয়ারত, ভাল খানা-পিনার ব্যবস্থা, রকমারি সাজ-সজ্জা, লেখাপড়া, কাজ-কাম সব বাদ দিয়ে ঘরে বসে ছুটি পালন ইত্যাদি করেছেন? তা’হলে তিনি কি উপরে বর্ণিত আয়াত সমূহের নিদেশ লংঘন করে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেছেন? তাঁর শ্রেষ্ঠ চার জন খলীফাও কি ঐ আয়াত গুলির মর্মার্থ বুঝেন নি?
অতএব শারঈ বিষয়ে এ মূলনীতিটি সর্বদা মনে রাখা উচিত যে, যে সকল ইবাদত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যেভাবে করেছেন, সেগুলি সেভাবে করাটাই সুন্নাত। অনুরূপভাবে যে সকল ইবাদত তিনি পরিত্যাগ করেছেন, সেগুলি পরিত্যাগ করাটাই সুন্নাত। যেমন সফরে তিনি যোহর-আছর এবং মাগরিব-এশা জমা ও ক্বছর করেছেন, সুন্নাত পড়েননি। আমাদেরও সেটা করা সুন্নাত। নিজের জন্ম দিবস তিনি কখনোই পালন করেননি। আমাদেরও তা মীলাদের নামে পালন না করাটাই সুন্নাত। শা‘বানে তিনি অধিকহারে ছিয়াম পালন করেছেন। আমরা সেটা করব। কিন্তু তিনি প্রচলিত ‘শবেবরাত’ পালন করেননি। খাছ করে ১৪ই শা‘বান দিবাগত রাতে নফল ইবাদত ও ১৫ই শা‘বান দিবসে নফল ছিয়াম পালন করেননি, করতে বলেননি। ছাহাবীগণও করেননি। অতএব আমাদের তা না করাটাই সুন্নাত। মি‘রাজ উপলক্ষে তিনি কোন বাড়তি ইবাদত বা কোন অনুষ্ঠানাদি করেননি। অতএব আমাদেরও কিছু না করাটাই হবে সুন্নাত। আর করাটা হবে বিদ‘আত। মোটকথা সুন্নাতের অনুসরণের মধ্যেই জান্নাত রয়েছে, বিদ‘আতের মধ্যে নয়।
(মাসিক আত-তাহরীক, ৭ম বর্ষ ১২ তম সংখ্যা সেপ্টেম্বর ২০০৪-এ প্রকাশিত)
[1]. বুখারী হা/৩৮৮৭; মুসলিম হা/১৬২; মিশকাত হা/৫৮৬২-৬৬।
[2]. ত্বাবারাণী, তাফসীর ইবনে কাছীর ৩/২৪।
[3]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বনু ইস্রাঈল ১ম আয়াত।
[4]. ঐ, তাফসীর ৩/৮-২৫; বুখারী হা/৩৮৮৭; মুসলিম হা/১৬২; মিশকাত হা/৫৮৬২-৬৬।
[5]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা বনু ইস্রাঈল ১ম আয়াত ১০/২১১ পৃ.।
[6]. বুখারী হা/৩৮৮৭; মুসলিম হা/১৬২; মিশকাত হা/৫৮৬২ মি‘রাজ অনুচ্ছেদ।
[7]. মুসলিম হা/১৭৩; মিশকাত হা/৫৮৬৫।
[8]. মুসলিম হা/৮০৬; মিশকাত হা/২১২৪।
[9]. মির‘আত হা/৯১৫-এর ব্যাখ্যা ‘তাশাহহুদ’ অনুচ্ছেদ।
[10] . বায়হাক্বী, তাফসীরে ইবনে কাছীর ৩/২৪; আর-রাহীকুল মাখতুম পৃ: ১৪০।
[11] . মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮৬৬-৫৮৬৭; তাফসীর ইবনু কাছীর ৩/২৩।
[12] . তাফসীর ইবনু কাছীর ৩/১৬।
[13] . আর-রাহীক্ব পৃ: ১৩৯।
[14] . মুসলিম, মিশকাত হা/৫৬৫৯ ‘আল্লাহ দর্শন’ অনুচ্ছেদ।
[15] . তিরমিযী, মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৬৬১-৬২; আর-রাহীক্ব পৃ: ১৩৯।
[16] . আর-রাহীকুল মাখতূম পৃ: ১৩৭।
[17] . আহমাদ, তাফসীরে ইবনে কাছীর ৩/১৯।
[18] . মুত্তাফাক্ব আলাইহ মিশকাত হা/১৪৭৭; মির‘আত হা/১৪৯১-এর ভাষ্য।
[19] . ত্বাবারাণী আওসাত্ব, হাদীছ হাসান, ছহীহুল জামে‘ হা/৩৮৭০।
[20]. মুসলিম হা/১৭১৮ ‘বিচার কার্য সমূহ’ অধ্যায়।