রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের প্রফেসর (অব.) ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রণীত ‘সীরাতুর রাসূল (ছাঃ)’ গ্রন্থটি রাসূল (ছাঃ)-এর জীবন চরিত রচনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তুলনামূলকভাবে একটি নতুন সংযোজন। আরবী ‘সীরাত’ শব্দটি এসেছে ‘সারা-ইয়াসীরু’ থেকে। যার অর্থ ‘ভ্রমণ করা’। সেই অর্থে, আমরা যখন ‘সীরাতুর রাসূল (ছাঃ)’ গ্রন্থটি পাঠ করি, তখন যেন আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর জীবন সফরে ভ্রমণ করি। পবিত্র কুরআন ও নবী করীম (ছাঃ)-এর জীবন পরস্পরে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। একটিকে বুঝতে ও অনুসরণ করতে অন্যটি অপরিহার্য। তাই গবেষক ও লেখকগণ ছাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সীরাত সংকলন ও তার গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন।

‘সীরাতুর রাসূল (ছাঃ)’-এর বৈশিষ্ট্য সমূহ :

(১) বিশুদ্ধতম সূত্র সমূহ থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। (২) অমুসলিম ও মুসলিমদের মধ্য থেকে সীরাতের সমালোচকদের বুদ্ধিবৃত্তিক জবাব দেওয়া হয়েছে। (৩) অধ্যায় শেষে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে এবং প্রধান প্রধান ঘটনা শেষে ‘পর্যালোচনা’ পেশ করা হয়েছে। (৪) সীরাতের বিষয়বস্ত্ত সমূহ ব্যাপকভাবে শামিল করা হয়েছে। (৫) অতীতের সীরাত গ্রন্থ সমূহে বর্ণিত অনেক প্রসিদ্ধ ঘটনা, যা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়, সেগুলি শনাক্ত করা হয়েছে। নিম্নে ‘সীরাতুর রাসূল (ছাঃ)’-এর বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা করা হ’ল।- 

১. বিশুদ্ধ তথ্য সূত্র সমূহ : গ্রন্থকার অত্র ‘সীরাত’ গ্রন্থটিকে সাধ্যমত বিশুদ্ধ করার শর্ত করেছেন এবং সেজন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। সেকারণ গ্রন্থটির মূল তথ্য উৎস হচ্ছে পবিত্র কুরআন, ছহীহ হাদীছ এবং প্রসিদ্ধ রেফারেন্স গ্রন্থসমূহ।

উদাহরণ স্বরূপ : (১) পবিত্র কুরআনকে প্রধান উৎস হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। কেননা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যেমন (ক) বদর যুদ্ধ সম্পর্কে সূরা আনফাল ১-৪৯ মোট ৫০টি আয়াত; (খ) ওহোদ যুদ্ধ সম্পর্কে সূরা আলে ইমরান ১২১-১৭৯ মোট  ৬০টি  আয়াত; (গ) ‘হোনায়েন যুদ্ধ’ সম্পর্কে সূরা তওবা ২৫-২৭ মোট ৩টি আয়াত; (ঘ) খন্দক ও বনু কুরায়যা যুদ্ধ সম্পর্কে সূরা আহযাব ৯-২৭

মোট ১৯টি আয়াত এবং (ঙ) হোদায়বিয়ার সন্ধি ও মক্কা বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে সূরা ফাৎহ প্রথম দু’টি আয়াত এবং পরবর্তী ‘খায়বর যুদ্ধ’ ও সেখান থেকে অগণিত গণীমত প্রাপ্তির ভবিষ্যদ্বাণী, মুনাফিকদের তৎপরতা ও ছাহাবায়ে কেরামের উচ্চমর্যাদা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে সূরা ফাৎহের ২৯টি আয়াতে। ফলে আলোচ্য সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) গ্রন্থটি কুরআন বুঝার জন্য অপরিহার্য।

(২) ছহীহ হাদীছকে দ্বিতীয় উৎস হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন (ক) ছহীহ হাদীছের বর্ণনা অনুযায়ী রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম ও মৃত্যু দু’টিই সোমবার হয়েছিল। তাই সোমবারকে ঠিক রেখে এ বিষয়ে মতভেদ নিরসন করা হয়েছে।[1] (খ) অতঃপর বিষয়বস্ত্তর পূর্ণতার জন্য ‘হাসান’ বা তার নিকটবর্তী স্তরের হাদীছ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন ত্বায়েফ দুর্গ অবরোধ কালে রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষ হ’তে একটি ঘোষণা প্রচার করা হয়, যে গোলাম আমাদের নিকটে এসে আত্মসমর্পণ করবে, সে মুক্ত হয়ে যাবে’।[2]  (গ) কেবলমাত্র বৈষয়িক বা উন্নত চরিত্র বা অনুরূপ বিষয়ের ক্ষেত্রে যখন কোন শক্তিশালী বর্ণনা পাওয়া যায়নি, তখন বিশ্বস্ত জীবনীকারগণ কর্তৃক গৃহীত ও বিশুদ্ধতার কাছাকাছি যঈফ হাদীছ গ্রহণ করা হয়েছে এবং তা টীকাতে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ত্বায়েফ দুর্গের অবরোধ উঠিয়ে নেওয়ার সময় রাসূল (ছাঃ)-কে বনু ছাক্বীফদের বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করতে বলা হ’ল। কিন্তু তিনি হেদায়াতের দো‘আ করে বললেন- হে আল্লাহ! তুমি ছাক্বীফদের হেদায়াত কর এবং তাদেরকে নিয়ে এসো।[3]

(৩) বিশ্বস্ত সীরাত ও এ সম্পর্কিত গ্রন্থ সমূহ। যেমন মানছূরপুরীর ‘রহমাতুল্লিল আলামীন’, মুবারকপুরীর ‘আর-রাহীকুল মাখতূম’, তালীক্ব আর-রাহীকুল মাখতূম, ইরাকের ড. আকরাম যিয়া উমরীর সীরাত আন-নববিইয়াহ আছ-ছহীহাহ, রিয়াদের আল-ঊশানের বই ‘মা শা‘আ’, ইবনুল ক্বাইয়িমের ‘যাদুল মা‘আদ’, শায়েখ আলবানীর তাহকীক কৃত সীরাহ সমূহ, তাহকীক ইবনু হিশাম, আল-মাকতাবাতুশ শামেলাহ প্রভৃতি।

২. সীরাত সমালোচকদের বুদ্ধিবৃত্তিক জবাব দান : অমুসলিমদের যেমন স্কটিশ প্রাচ্যবিদ উইলিয়াম মূর, জার্মান প্রাচ্যবিদ ড. স্প্রেঙ্গার, বৃটিশ প্রাচ্যবিদ স্যামুয়েল মার্গোলিয়থ  এমনকি মুসলিমদের মধ্য থেকেও অনেকে যেমন অতি যুক্তিবাদী, নারীবাদী, অতি উদারতাবাদী, কথিত মানবতাবাদী ব্যক্তিগণ রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে সমালোচনা করে থাকেন। বিশেষ করে আয়েশা (রাঃ)-এর সাথে বিবাহ, একাধিক বিবাহ এবং অভিযান ও যুদ্ধসমূহের ব্যাপারে। আলোচ্য সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) গ্রন্থটিতে এসবের বুদ্ধিবৃত্তিক জবাব দেওয়া হয়েছে।

৩. শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ এবং প্রধান প্রধান ঘটনা শেষে ‘পর্যালোচনা’ পেশ : গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়ের আলোচনা শেষে সম্মানিত লেখক ‘শিক্ষণীয় বিষয়’ শিরোনামে  পৃথকভাবে মোট ২০৯টি আলোচনা করেছেন। যা অত্যন্ত ফলদায়ক। যার মধ্যে ৮টি নবুঅত-পূর্ব জীবনের, ৯০টি মাক্কী জীবনের ও ১১১টি মাদানী জীবনের। এছাড়াও প্রধান প্রধান ঘটনা বিবৃত করার পর সেসবের একটি ‘পর্যালোচনা’ পেশ করা হয়েছে। পাঠক এবং গবেষকগণ কেবল এই শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ এবং পর্যালোচনাসমূহ থেকেই অনেক কিছু জানতে পারবেন। তাছাড়া তাঁরা এসবের ভিত্তিতে সমসাময়িক চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলায় খোরাক সংগ্রহ করতে পারবেন।

৪. বিষয়বস্ত্ত সমূহের ব্যাপকতা : ‘সীরাতুর রাসূল (ছাঃ)’ নবী করীম (ছাঃ)-এর জীবনের উল্লেখযোগ্য প্রায় সব ঘটনাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা সচরাচর অন্য গ্রন্থে পাওয়া যায় না। সীরাত পাঠক ও গবেষকদের জন্য এটি একটি বিশুদ্ধ তথ্য সমূহের ভান্ডার বলা যায়। গ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি সংক্ষেপে নিম্নরূপ।-   

(১) সীরাত শাস্ত্রের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ : শুরুতে সীরাত শাস্ত্রের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচনায় ৩ জন ছাহাবী, ৭ জন তাবেঈ, ১৯ জন তাবে-তাবেঈ এবং আরও ৬ জন জীবনীকারের কথা বলা হয়েছে, যাদের অধিকাংশ রচনাসমূহ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে তাবে-তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক (৮৫-১৫১ হি.) ও তাঁর সীরাতের পরিমার্জিত সংস্করণ সীরাতে ইবনু হিশাম (মৃ. ২১৮ হি.)-এর গ্রন্থ প্রাচীনতম উৎস হিসাবে গৃহীত হয়েছে।

(২) আরব জাতির অবস্থা : নবুঅতের কেন্দ্রস্থল হিসাবে আরব জাতির ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সংক্ষেপে চিত্রিত হয়েছে। তাছাড়া ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশ, যমযম কূয়া, শিরক-বিদ‘আতের প্রসার, ইয়াছরিবের ইহূদী-নাছারাদের অবস্থা ইত্যাদি।

(৩) নবুঅত-পূর্ব জীবন (৫৭১-৬১০ খৃ.) : এই ৪০ বছরের সময়কালে সীরাতের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি যেমন রাসূল (ছাঃ)-এর লালন-পালন, দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব ও চাচা আবু তালিবের অভিভাবকত্ব, বক্ষ বিদারণ ও অন্যান্য বরকতময় নিদর্শন। সিরিয়ায় ব্যবসায়িক সফর, ফিজার যুদ্ধ এবং হিলফুল ফুযূল গঠন, আল-আমীন উপাধি, তাঁর নিষ্পাপত্ব, খাদীজার সাথে বিবাহ ও সন্তান-সন্ততি, কা‘বাগৃহ পুনর্নির্মাণে মতবিরোধ নিরসন, নিঃসঙ্গপ্রিয়তা, হেরা গুহায় একান্ত সাধনা, সত্যস্বপ্ন ইত্যাদি।

(৪) মাক্কী জীবন (৬১০-৬২২ খৃ.) : এই ১৩ বছরে নবুঅতী জীবনের প্রসিদ্ধ ঘটনাবলী যেমন (ক) নুযূলে কুরআন ও নবুঅত লাভ ও তার প্রতিক্রিয়া (খ) খাদীজার বিচক্ষণতা (গ) ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পরিচিতদের নিকট ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াত প্রদান (ঘ) ছাফা পাহাড়ের চূড়া থেকে কুরায়েশ বংশের সকল গোত্রকে প্রকাশ্যে দাওয়াত (ঙ) মক্কাবাসী এবং বহিরাগত ও হজ্জে আগতদের নিকটে দাওয়াত দান (চ) কোন কোন সীরাত লেখক নবীগণের দাওয়াতকে গোপনে ও প্রকাশ্যে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। কিন্তু সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) গ্রন্থটি কুরআনের আলোকে দাবী করেছে যে নবীদের দাওয়াতকে দু’ভাগে ভাগ করার কোন সুযোগ নেই (পৃ. ৯৫)। যেমন আল্লাহ বলেছেন, ‘হে আমার কওম! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই’ (আ‘রাফ-মাক্কী ৭/৫৯, ৬৫, ৭৩, ৮৫)। আমাদের নবীও বলেছেন, হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল (আ‘রাফ ৭/১৫৮)

এ প্রসঙ্গে গ্রন্থকার বলেছেন শুরুতে দাওয়াত ছিল ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে। কিন্তু গোপনে নয়। তাঁর নতুন দাওয়াতের খবর নেতারা জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু এটাকে তারা হুমকি মনে করেননি। মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে গেলে তিন বছর পর এটি নেতাদের আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয় এবং অনেকে তাদের হাতে নির্যাতিত হন (৯৬-৯৭ পৃ.)

(৫) বিরোধিতার কৌশল সমূহ : আবু তালেবের হস্তক্ষেপ কামনা, হজ্জের সময় দাওয়াতে বাধাদান, মদীনায় ১টি সহ মোট ১৬টি অপবাদ দান (যেমন পাগল, কবি, জাদুকর, মিথ্যাবাদী ইত্যাদি), নাচ-গানের আসর বসানো, ব্যঙ্গ কবিতা পাঠ, অতীত কাহিনী সম্পর্কে প্রশ্ন করা, চাঁদ দ্বিখন্ডিত করণ, কিছু গ্রহণ ও কিছু বর্জন-এর ভিত্তিতে আপোষ প্রস্তাব, লোভনীয় প্রস্তাব ও উদ্ভট দাবী সমূহ এবং বিভিন্ন অপযুক্তি।

(৬) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবীদের উপর নানামুখী অত্যাচার : যেমন হাবশায় হিজরত (১ম ও ২য়); হামযা ও ওমরের ইসলাম গ্রহণ; সর্বাত্মক বয়কট; আবু তালিব ও খাদীজা (রাঃ)-এর মৃত্যু; ত্বায়েফ সফর ও নির্যাতন ভোগ, জিনদের ইসলাম গ্রহণ; আক্বাবাহর বায়‘আত (১ম, ২য় ও ৩য়); ইসরা ও মি‘রাজ; ইয়াছরিবে ছাহাবীদের হিজরত; রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ইয়াছরিবে হিজরত।

(৭) মাদানী জীবন (৬২২-৬৩২ খৃ.) : ১০ বছরের মাদানী জীবনের ঘটনা সমূহ যেমন তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব লাভ; ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার গোড়াপত্তন; আনছার ও মুহাজিরগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন; যুদ্ধের অনুমতি লাভ ও অভিযান সমূহ প্রেরণ; ২৯টি গাযওয়া ও ৬১টি সারিইয়াহ সহ মোট ৯০টি যুদ্ধ (মার্চ ৬২৩ খৃ. হ’তে জুন ৬৩২ পর্যন্ত)। ১০ বছরে রাসূল (ছাঃ)-এর ৭৮১ দিন তথা দু’বছরের বেশী সময় যুদ্ধের ময়দানে অবস্থান। 

(৮) অভিযান ও যুদ্ধ সমূহের কারণ ও কৌশল : প্রতিরক্ষামূলক (যেমন বদর ও ওহোদ), সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করা (যেমন বনু ক্বায়নুক্বা ও মুতা), শক্তি থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধ এড়াতে সন্ধি চুক্তি করা (যেমন হোদায়বিয়ার সন্ধি), চুক্তি লঙ্ঘনের প্রতিশোধমূলক যুদ্ধ (যেমন মক্কা বিজয়), শত্রুর অর্থনৈতিক ভিত্তি ও মনোবল দুর্বল করা (যেমন সিরিয়াগামী মক্কার কুরায়েশ কাফেলা সমূহ আক্রমণ); ৬ষ্ঠ হিজরীতে হোদায়বিয়া সন্ধির পর বাদশাহদের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ (রোম, পারস্য, মিসর, ইয়ামামা, বালক্বা, বাহরায়েন, ওমান, হাবশা, ইয়ামন, হিমইয়ার); মক্কা বিজয়ের পর আরব উপদ্বীপের ৩৭টি গোত্রের প্রতিনিধি দল সমূহের আগমন ও ইসলাম গ্রহণ (শাওয়াল ৮ম হি. থেকে মুহাররম ১১ হি. পর্যন্ত); বিদায় হজ্জ (২৪শে যুলক্বা‘দাহ ১০ম হি. থেকে ২১শে যিলহজ্জ ১০ম হি.); নবী জীবনের শেষ অধ্যায় (রবীঊল আউয়াল, ১১ হি.); অসুখের সুচনা ও মৃত্যু; শোকাবহ প্রতিক্রিয়া, আবুবকরের বিচক্ষণ ভূমিকা, পরিত্যক্ত সম্পদ, খলীফা নির্বাচন, গোসল ও কাফন-দাফন, জানাযা।

(৯) অন্যান্য তথ্য সমূহ : নবী পরিবার, উম্মাহাতুল মুমিনীন (১১ জন), একাধিক বিবাহ পর্যালোচনা, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দেহ সৌষ্ঠব, তাঁর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য; ছেড়ে যাওয়া দু’টি আলোকস্তম্ভ; রাসূল চরিত পর্যালোচনা; পরিশিষ্ট-১ অহি লেখক (১৬ জন) ও অন্যান্য বিষয়ে লেখক (৩৪ জন), দাস-দাসী-খাদেম (৮১ জন), উট (৪টি), ঘোড়া (৭টি), খচ্চর (৩টি), গাধা (২টি), তরবারি (৯টি), বর্ম (৭টি), দূত (১০ জন), মুওয়াযযিন (৪ জন), আমীর (১১ জন), হজ্জ (১টি) ও ওমরাহ (৪টি হিজরতের পর), মু‘জেযা সমূহ (৫০টি)। প্রসিদ্ধ কিন্তু বিশুদ্ধ নয় (১৬৭টি)। পরিশিষ্ট-২ গ্রন্থপঞ্জী (৪০ টি); পৃষ্ঠা সংখ্যা মোট ৮৫৪।

সর্বোপরি সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) গ্রন্থটির গবেষণার ব্যাপকতা প্রকাশ পায় এই গ্রন্থের ১৩০৭টি টীকা ও ৪০টি অমূল্য গ্রন্থের রেফারেন্স সমূহের মাধ্যমে।

৫. প্রসিদ্ধ কিন্তু বিশুদ্ধ নয় : বিগত সীরাত গ্রন্থসমূহে বর্ণিত এমন ১৬৭টি প্রসিদ্ধ ঘটনা শনাক্ত করা হয়েছে, যা বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। বিদগ্ধ পাঠক ও গবেষকদের জন্য যেগুলি অত্যন্ত মূল্যবান তথ্যের সংযোজন। যেমন মক্কা ও ইসমাঈল বংশের আলোচনায় বলা হয়েছে, বনু জুরহুম মক্কা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় যমযম কূয়ায় দু’টি সোনার হরিণ, বর্ম, তরবারী ইত্যাদি ফেলে যায়। অতঃপর উক্ত তরবারী উঠিয়ে আব্দুল মুত্ত্বালিব কা‘বাগৃহের দরজা ঢালাই করেন এবং হরিণ দু’টিকে দরজার সামনে রেখে দেন। (২) শিশুকালে তাঁর অসীলায় আবু তালিবের বৃষ্টি প্রার্থনা, শৈশবে ফিজার যুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ। (৩) ‘ইনশাআল্লাহ’ না বলায় পনের দিন অহি নাযিল বন্ধ থাকা, ওমরের ইসলাম  গ্রহণ বিষয়ে প্রসিদ্ধ কাহিনী সমূহ, ছওর গিরিগুহায় প্রবেশের পর আবুবকর (রাঃ)-এর নিজের পায়জামা ছিঁড়ে গুহার ছিদ্র সমূহ বন্ধ করা, তাঁকে সাপে বা বিচ্ছুতে দংশন করা, সেখানে মাকড়সার জাল বোনা; একটি বৃক্ষের জন্ম নেওয়া ও সেখানে এসে কবুতরে ডিম পাড়া ইত্যাদি। (৪) হিজরতের পরপরই নবগঠিত ইসলামী সমাজের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য মদীনার সনদ রচনা, পারস্য থেকে হিজরতকারী ছাহাবী সালমান ফারেসী-এর পরামর্শক্রমে খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননের নতুন কৌশল নির্ধারণ ইত্যাদি। (৫) রাসূল (ছাঃ) বলতেন, তোমরা দ্বীনের অর্ধাংশ আয়েশার নিকট থেকে গ্রহণ করো (৭৬৪ পৃ.)। আর-রাহীকুল মাখতূমে রাসূল (ছাঃ)-এর দেহ সৌষ্ঠব সম্পর্কে বর্ণিত ৬টি যঈফ হাদীছ (৭৮০ পৃ.) ইত্যাদি।

এছাড়াও গ্রন্থটিতে দেখানো হয়েছে যে, ১০ বছরে মোট ৯০টি অভিযান ও যুদ্ধে উভয় পক্ষের নিহতের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩৪২ জন। সেখানে Collateral damage বা আনুষঙ্গিক ধ্বংসের নামে অগণিত ভৌত কাঠামো এবং নির্দোষ অসামরিক জনগণ, মহিলা ও শিশু হত্যার মত ঘটনা ছিল না। অভিযান ও যুদ্ধগুলি ছিল অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক, চুক্তি ভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ, শত্রুপক্ষের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করা এবং শত্রুপক্ষের আর্থিক ভিত ও মনোবল দুর্বল করার জন্য। Cost-benefit (লাভ-ক্ষতি) Analysis বা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, এসব অভিযান ও যুদ্ধ সমূহ ছিল অনেক বেশী ন্যায়ানুগ, যুলুমমুক্ত, উন্নত মূল্যবোধ সম্পন্ন, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য সম্পন্ন ও মানবাধিকার নিশ্চিতকারী। তার Cost তথা জান ও মালের অনিবার্য ক্ষয়-ক্ষতি ছিল অতীব নগণ্য। এভাবে সমালোচকদের বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে অত্র গ্রন্থে।  

উপসংহার :

পশ্চিমা প্রভাবিত মিডিয়া সমূহ আমাদের শিশু-কিশোর ও আবাল-বৃদ্ধ বণিতার মগজ-ধোলাই করে যাচ্ছে। এসব ধ্যান-ধারণাকে প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক, ব্যক্তিগত এবং সামাজিকভাবে উপকারী, প্রগতিশীল, জীবন সমৃদ্ধকারী ও জীবন পরিপূর্ণকারী হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।

এগুলিকে মোকাবিলা করার জন্য মুসলিম স্কলারদের তরফ থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক জবাব দেওয়ার জন্য যেরূপ গবেষণা প্রয়োজন ছিল তা খুবই অপ্রতুল। কেননা বর্তমানের এইসব তথাকথিত আধুনিক মতবাদগুলির মূল উদ্দেশ্য হ’ল আল্লাহর অহি-কে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার বা উপেক্ষা করা। অতঃপর অহি-র বিধানের পরিবর্তে মানুষের ধারণাপ্রসূত সিদ্ধান্তের উপর জীবন পরিচালনা করা। যা সর্বদা পরিবর্তনশীল এবং ধ্বংসাত্মক ও স্রেফ প্রবৃত্তিপূজা মাত্র। এগুলির নগদ সুবিধার আড়ালে রয়েছে বহুমুখী ও দীর্ঘমেয়াদী ধ্বংস।

পরিশেষে বলব, অত্যন্ত সম্মানিত, সুপ্রতিষ্ঠিত ও ব্যাপকভাবে স্বীকৃত লেখক মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবের ‘সীরাতুর রাসূল (ছাঃ)’ গ্রন্থটি সীরাত গবেষক ও সীরাতে আগ্রহী পাঠকদের কেবল প্রত্যাশাই পূরণ করবে না, বরং তাদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হবে ইনশাআল্লাহ।

গ্রন্থটি অত্যন্ত সাবলীল, উন্নত ভাষাশৈলী সম্পন্ন, ব্যাপক গবেষণা ও তথ্য সমৃদ্ধ এবং ইতিপূর্বে বর্ণিত মূল্যবান বৈশিষ্ট্য সমূহে ভূষিত। গ্রন্থটি আমার এত ভাল লেগেছে যে, আমি আনন্দের সাথে গ্রন্থটির ইংরেজী অনুবাদ করেছি। যাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিদগ্ধ পাঠকগণ উপকৃত হন। আমি মনে করি ‘সীরাতুর রাসূল (ছাঃ)’ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সীরাত গ্রন্থ হিসাবে আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি পাবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সম্মানিত লেখককে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন এবং আমাদেরকে পরকালে রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আত লাভের সৌভাগ্য দান করুন- আমীন! 

প্রফেসর (অব.) ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া*

 আলোচ্য গ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদক। যা সত্বর প্রকাশিতব্য। প্রফেসর (অব.), লুইজিয়ানা টেক ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা; কিং ফাহাদ ইউনিভার্সিটি অফ পেট্রোলিয়াম এ্যান্ড মিনারেলস্, সঊদীআরব; সুলতান ক্বাবূস ইউনিভার্সিটি, ওমান।






আরও
আরও
.