উত্তর : তাক্বদীর
শব্দটির অর্থ নির্ধারণ করা বা অনুমান করা। শারঈ পরিভাষায় তাক্বদীর হ’ল,
আল্লাহ কর্তৃক বান্দার ভবিষ্যত নির্ধারণ করা। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক
মানুষের তাক্বদীর লিপিবদ্ধ করেছেন আসমান-যমীন সৃষ্টির ৫০ হাযার বছর পূর্বে
এবং তিনি যার ভাগ্যে যা লিপিবদ্ধ করেছেন তাই ঘটবে (ছহীহ মুসলিম, মিশকাত হা/৭৯)।
তাক্বদীর সম্পূর্ণ গোপনীয় বিষয়। আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং তাক্বদীরের জ্ঞান
তাঁর সৃষ্টিকুল থেকে গোপন রেখেছেন। এজন্য রাসূল (ছাঃ) এ প্রসঙ্গে অহেতুক
বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে নিষেধ করেছেন (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত হা/৯৮)।
একদিন ছাহাবায়ে কেরাম তাকে কেবল তাক্বদীরের উপর ভরসা করে সকল আমল ছেড়ে
দেওয়ার আবেদন জানালে রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমরা সৎকর্ম করে যাও। কেননা যাকে
যেজন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তার পক্ষে সে কাজ সহজসাধ্য হবে। যারা
সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত, তাদের জন্য সেরূপ আমল এবং যারা দুর্ভাগাদের
অন্তর্ভুক্ত তাদের জন্য সেরূপ আমল সহজ করে দেওয়া হয়েছে (বুখারী হা/৪৯৪৯)।
‘তাক্বদীরের প্রতি বিশ্বাস’ মুমিনের মৌলিক ও অপরিহার্য ছয়টি আক্বীদার অন্তর্ভুক্ত। তাক্বদীর একটি গায়েবী বিষয়, যার রহস্য মহান আল্লাহ ব্যতীত কেউ অবগত নন। এজন্য সাধারণভাবে বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, যেমন একজন লোকের সামনে ফলের রস ভর্তি গ্লাস রাখা রয়েছে। সে ইচ্ছা করলে তা পান করতে পারে, নাও পারে। অর্থাৎ সে পান করতে বাধ্য নয়। অতঃপর যদি সে পান করে, তবে তা আল্লাহর জ্ঞানে পূর্ব থেকেই রক্ষিত রয়েছে। আবার যদি পান না করে, তবুও তা আল্লাহর জ্ঞানে আগে থেকেই রক্ষিত আছে। যদি বলা হয় এর ব্যাখ্যা কি? এর জবাব এতটুকুই দেওয়া যায় যে, অসীম জ্ঞানের অধিকারী মহান আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য মানুষের স্বল্পজ্ঞান দিয়ে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। মানুষের সৎ-অসৎ যাবতীয় কর্মের ক্ষেত্রেও অনুরূপ বক্তব্যই প্রযোজ্য। একজন পাপাচারী পাপকর্মের দিকে প্রবৃত্ত হয় এবং নিজ হাতে তা বাস্তবায়ন করে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, নিজ ইচ্ছা ও ক্ষমতা প্রয়োগ করে সে পাপাচারে লিপ্ত হচ্ছে। কিন্তু একই সাথে আল্লাহর জ্ঞান বা পূর্বনির্ধারণ থেকে বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা তার নেই। এটা আল্লাহ তা‘আলার অপরিসীম ক্ষমতা ও হিকমতের বহিঃপ্রকাশ। এক্ষণে বান্দা যেহেতু নিজের তাক্বদীর জানে না, সেহেতু তাকে মন্দ কর্ম হ’তে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে হবে এবং সর্বদা আল্লাহর বিধান মেনে কাজ করে সুন্দর পরিণতি লাভের চেষ্টা করতে হবে। তার সাধ্যমত চেষ্টার পরেও যেটা ঘটবে, বুঝতে হবে সেটাই ছিল তার তাক্বদীরের লিখন।
মূলতঃ আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করে বিবেক-বুদ্ধি দান করে, ভালো আর মন্দ দু’টি পথ দেখিয়ে এক মহাপরীক্ষার মধ্যে ফেলেছেন। আর ভালো পথের জন্য জান্নাত আর মন্দ পথের জন্য জাহান্নাম নির্ধারণ করে রেখেছেন। ফলে বিবেক দিয়ে নিজ স্বাধীনতাকে ব্যবহার করে মানুষ এ পৃথিবীতে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত যা কিছু করবে, আল্লাহ তাঁর অগ্রিম জ্ঞানে সেগুলোর সব কিছু সম্পর্কে জানেন এবং সেগুলোই তিনি লিখে রেখেছেন।
স্মর্তব্য যে, আল্লাহ তাক্বদীরের মন্দকে পরিবর্তন করে দিতে পারেন। তিনি তাক্বদীরের ভাল-মন্দকে ইচ্ছা করলে মিটিয়ে দিতে পারেন এবং বহালও রাখতে পারেন (রা‘দ ৩৯)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মানুষ পাপকর্মের কারণে রূযী থেকে বঞ্চিত হয়। দো‘আর মাধ্যমে তাক্বদীর পরিবর্তন হয় এবং নেকীর মাধ্যমে বয়স বৃদ্ধি পায় (নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, হা/৪৯২৪; মিশকাত হা/৪৯২৫)। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি স্বীয় জীবিকায় প্রশস্ততা ও মৃত্যুতে বিলম্ব কামনা করে, সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সাথে উত্তম ব্যবহার করে’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯১৮)।
কেউ কেউ ‘ভাগ্যে যা আছে তাই হবে, আমার কিছু করার নেই’ বলে নিজেকে বিভ্রান্তির পথে টেনে নিয়ে যায়। অথচ দুনিয়ায় তারা না খেয়ে বসে থাকে না, পরীক্ষার জন্য প্রস্ত্ততি না নিয়ে পরীক্ষা দেয় না, পিপাসা লাগলে পানি না খেয়ে ভরসা করে না। অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী জীবনের জন্য তারা ভাগ্যের উপর ভরসা না করে চেষ্টা করে। কিন্তু যত ভরসা কেবল চিরস্থায়ী জীবনের ক্ষেত্রেই করে! এরূপ অপযুক্তির মাধ্যমে মানুষ কেবল নিজেকে ধ্বংসেই নিক্ষেপ করে। ভ্রান্ত ফের্কা অদৃষ্টবাদী জাবরিয়াগণ এরূপ ভেবে থাকেন। অথচ আল্লাহ বান্দার তাক্বদীর জানেন। কিন্তু বান্দা তা জানেনা। তাই তাকে সাধ্যমত আল্লাহর পথে কাজ করে যেতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘বান্দা কেবল সেটাই পায়, যেটার জন্য সে চেষ্টা করে’ (নাজম ৫৩/৩৯)।