তাযকিয়াহ ও তারবিয়াহর নীতি সমূহ :

(৯) ঐসব কাজ হ’তে বিরত থাকা, যার কারণে দাওয়াত বাধাপ্রাপ্ত হয় :

যেমন ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাসে হোনায়েন যুদ্ধের গণীমত বণ্টনের সময় জনৈক অসন্তুষ্ট ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, يَا مُحَمَّدُ اعْدِلْ. قَالَ: وَيْلَكَ وَمَنْ يَعْدِلُ إِذَا لَمْ أَكُنْ أَعْدِلُ، لَقَدْ خِبْتَ وَخَسِرْتَ إِنْ لَمْ أَكُنْ أَعْدِلُ  ‘হে মুহাম্মাদ! ন্যায় বিচার করুন! জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমার ধ্বংস হৌক! যদি আমি ন্যায়বিচার না করি, তবে কে ন্যায়বিচার করবে? যদি আমি ন্যায় বিচার না করি, তাহ’লে তুমি নিরাশ হবে ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে’। তখন ওমর (রাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন, دَعْنِى يَا رَسُولَ اللهِ فَأَقْتُلَ هَذَا الْمُنَافِقَ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে ছেড়ে দিন, এই মুনাফিকটার গর্দান উড়িয়ে দিই। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,مَعَاذَ اللهِ أَنْ يَتَحَدَّثَ النَّاسُ أَنِّى أَقْتُلُ أَصْحَابِى إِنَّ هَذَا وَأَصْحَابَهُ يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ يَمْرُقُونَ مِنْهُ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ ‘আল্লাহর নিকট পানাহ চাই! লোকেরা বলবে, আমি আমার সাথীদের হত্যা করছি। নিশ্চয় এই ব্যক্তি ও তার সাথীরা কুরআন তেলাওয়াত করে। যা তাদের কণ্ঠনালি অতিক্রম করে না। তারা সেখান থেকে বেরিয়ে যায়, যেমন শিকার হ’তে তীর বেরিয়ে যায়’।[1] উক্ত ব্যক্তি যুল-খুইয়াইছিরাহ তামীমী-কে পরবর্তীতে আলী (রাঃ)-এর খেলাফতকালে (৩৫-৪১ হিঃ) সৃষ্ট চরমপন্থী জঙ্গীদল ‘খারেজীদের মূল’(أَصْلُ الْخَوَارِجِ) বলা হয়।[2]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একই নীতি অবলম্বন করেন প্রকাশ্যে ইসলাম কবুলকারী মুনাফিকদের প্রতি। যারা ৩য় হিজরীতে ওহোদ যুদ্ধকালে, ৬ষ্ঠ হিজরীতে বনু মুছতালিক্ব যুদ্ধকালে, ৯ম হিজরীতে তাবূক অভিযানকালে প্রকাশ্যভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এমনকি ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয় অভিযানের খবর ফাঁসকারী ব্যক্তিকেও তিনি ক্ষমা করে দেন, মুসলিম হওয়ার কারণে। যাতে অন্যেরা না বলতে পারে যে, মুহাম্মাদ তাঁর নিজের সাথীদের হত্যা করছেন।

(১০) নিজেকে নিজ দাওয়াতের আদর্শ হিসাবে গড়ে তোলা এবং যাবতীয় কপটতা হ’তে বিরত থাকা :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন কুরআনের বাস্তব রূপকার। যেমন এক প্রশ্নের উত্তরে মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَ ‘তাঁর চরিত্র ছিল কুরআন’।[3] আল্লাহ বলেন,لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيُ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসকে কামনা করে ও অধিকহারে আল্লাহকে স্মরণ করে’ (আহযাব ৩৩/২১)। তিনি ও তাঁর সাথী ছাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلاً مِنَ اللهِ وَرِضْوَانًا سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُودِ،  ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। আর যারা তার সাথী, তারা অবিশ্বাসীদের প্রতি কঠোর ও নিজেদের মধ্যে রহমদিল। তুমি তাদেরকে দেখবে আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় রুকুকারী ও সিজদাকারী। তাদের চেহারা সমূহে সিজদার চিহ্ন থাকবে’ (ফাৎহ ৪৮/২৯)

কেবল ব্যক্তি নয়, বরং সংগঠনের সকলে একই বৈশিষ্ট্য দ্বারা পরিচিত হয়ে থাকেন। যেমন আল্লাহ বলেন,وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ‘মুহাজির ও আনছারগণের মধ্যে যারা অগ্রবর্তী ও প্রথম দিককার এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে নিষ্ঠার সাথে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তষ্ট। তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর এটাই হ’ল মহা সফলতা’ (তওবা ৯/১০০)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِى ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ‘শ্রেষ্ঠ মানুষ হ’ল আমার যুগের। অতঃপর তার পরের যুগের। অতঃপর তার পরের যুগের’।[4] এ কারণেই ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীন পরবর্তী যুগের মুসলমানদের নিকট সর্বাধিক শ্রদ্ধেয় ও অনুসরনীয়।

পরবর্তী যুগের মানুষদেরকেও মুত্তাক্বীদের আদর্শ হওয়ার ও মুত্তাক্বী সন্তান কামনা করার জন্য দো‘আ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا- ‘আর যারা এই বলে প্রার্থনা করে যে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের স্ত্রীদের ও সন্তানদের মাধ্যমে চক্ষুশীতলকারী বংশধারা দান কর এবং আমাদেরকে আল্লাহভীরুদের জন্য আদর্শ বানাও’ (ফুরক্বান ২৫/৭৪)

ইবনু ওমর (রাঃ) নিজের জন্য দো‘আ করতেন,اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِنْ أَئِمَّةِ الْمُتَّقِينَ ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে আল্লাহভীরুদের জন্য আদর্শ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত কর’।[5]

(১১) যাদেরকে দাওয়াত দেওয়া হবে, তাদের প্রতি দরদী হওয়া। যাতে তারা হক শ্রবণ করে :

সকল নবীই উক্ত গুণের অধিকারী ছিলেন। শেষনবী (ছাঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ ‘নিশ্চয়ই  তোমাদের নিকট এসেছেন তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল, যার নিকট তোমাদের দুঃখ-কষ্ট বড়ই দুঃসহ। তিনি তোমাদের কল্যাণের আকাংখী। তিনি মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়াপরায়ণ’ (তওবা ৯/১২৮)। এমনকি কওমের অবাধ্যতায় অতিষ্ঠ নবীকে সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ বলেন,لَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَفْسَكَ أَلاَّ يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ ‘তারা এতে বিশ্বাস স্থাপন করেনা বিধায় তুমি হয়ত মর্মবেদনায় নিজেকে শেষ করে ফেলবে’ (শো‘আরা ২৬/৩)

(১২) কষ্ট বরণে ও ধৈর্য ধারণে খর্জুর বৃক্ষের ন্যায় হওয়া :

খেজুর গাছে ঢিল মারলে সেখান থেকে খেজুর পতিত হয়। একইভাবে আল্লাহর পথের দাঈকে কষ্ট দিলে উত্তম ছবরের বিনিময়ে তার আমলনামায় ছওয়াব যুক্ত হয়। একেই বলা হয়, تُلقى بالحجر وتَلقى بالتمر ‘পাথর নিক্ষিপ্ত হয় ও খেজুর পতিত হয়’।

আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে বসেছিলাম। এমন সময় তিনি আমাদের বললেন, তোমরা আমাকে এমন একটি বৃক্ষ সম্পর্কে বল, যার পাতা পড়ে না এবং অমুক অমুক অমুকগুলি পতিত হয় না। যা সর্বদা খাদ্য প্রদান করে থাকে। ইবনু ওমর বলেন, আমার মনে ধারণা হ’ল যে, এটি খেজুর গাছ। কিন্তু আমি দেখলাম যে, আবুবকর ও ওমর কিছুই বলছেন না। তখন আমি কিছু বলাটা অপসন্দনীয় মনে করলাম। যখন তারা কিছুই বললেন না, তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, সেটি হ’ল খেজুর গাছ। অতঃপর যখন আমরা উঠলাম, তখন আমি ওমরকে বললাম, হে আববা! আল্লাহর কসম! আমার মনে একথাই উদয় হয়েছিল যে, ওটা খেজুর গাছ। তখন তিনি আমাকে বললেন, مَا مَنَعَكَ أَنْ تَكَلَّمَ ‘কোন বস্ত্ত তোমাকে বলতে নিষেধ করেছিল?’ আমি বললাম, আপনারা কিছু বলছেন না দেখে আমি কিছু বলাটা অপসন্দনীয় মনে করেছিলাম। তখন ওমর বললেন, لأَنْ تَكُونَ قُلْتَهَا أَحَبُّ إِلَىَّ مِنْ كَذَا وَكَذَا ‘তোমার বলাটা আমার নিকটে সবচেয়ে প্রিয় ছিল অমুক অমুক বিষয়ের চাইতে’ (বুখারী হা/৪৬৯৮)। ইবনু ওমর বলেন, أَحْسَبُهُ قَالَ: حُمْرِ النَّعَمِ ‘আমি ধারণা করি, তিনি বলেছিলেন, সর্বোত্তম লাল উট কুরবানী করার চাইতে’ (ছহীহ ইবনু হিববান হা/২৪৩)

এর মধ্যে কতগুলো শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। যেমন (১) শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রদের পরীক্ষা নেওয়া। (২) ছাত্র বা শিষ্যদের মেধা যাচাই করা। (৩) কঠিন বিষয়ে বুঝ হাছিলে উৎসাহিত করা। (৪) সঠিক উত্তর প্রদানে লজ্জা না করা।  (৫) খর্জুর বৃক্ষের কান্ড, মাথা, পাতা, ফল, রস সবই যে বরকত মন্ডিত সেটি ব্যাখ্যা করা। (৬) খেজুর গাছ ঝোড়া জায়েয প্রমাণিত হওয়া। কেননা এটি অপচয় নয়, বরং সেখান থেকে রস আস্বাদন করা হয়। (৭) এই বৃক্ষের সাথে কালেমা ত্বইয়েবা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর সামঞ্জস্য বর্ণনা করা। কারণ এই কালেমায় বিশ্বাসের উপর মুমিন জীবন দন্ডায়মান থাকে। যেমন খর্জুর বৃক্ষ যেকোন অবস্থায় সর্বদা দন্ডায়মান থাকে। (৮) এই বৃক্ষের সাথে মুমিনের জীবনের তুলনা করা। কারণ শত ঝড়-ঝঞ্ঝাতেও খেজুর গাছের শাখা পতিত হয় না। তেমনি শত বিপদেও মুমিনের জীবন থেকে ঈমান ও নেক আমল পতিত হয় না। (৯) খেজুর গাছের মাথায় ঢিল মারলে খেজুর পতিত হয়। মুমিনকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দিলে এবং তাতে আল্লাহর জন্য ছবর করলে তার আমলনামায় ছওয়াব পতিত হয়। (১০) খর্জুর বৃক্ষের সবকিছু অন্যের কল্যাণে সৃষ্ট। তেমনিভাবে মুমিন জীবনের সবটাই সৃষ্টির কল্যাণে নিবেদিত।

(১৩) কথায় ও কাজে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত হওয়া :

আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (তওবা ৯/১১৯)। হূদ (আঃ) নিজ কওমকে বলেছিলেন,أُبَلِّغُكُمْ رِسَالاَتِ رَبِّي وَأَنَا لَكُمْ نَاصِحٌ  أَمِينٌ ‘আমি তোমাদের নিকট আমার প্রতিপালকের পয়গামসমূহ পৌঁছে দেই এবং আমি তোমাদের একজন বিশ্বস্ত হিতাকাংখী’ (আ‘রাফ ৭/৬৮)। ইসমাঈল (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, إِنَّهُ كَانَ صَادِقَ الْوَعْدِ وَكَانَ رَسُولاً نَبِيًّا ‘সে ছিল প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যবাদী এবং সে ছিল রাসূল ও নবী’ (মারিয়াম ১৯/৫৪)। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) তার কওমের নিকট আল-আমীন (বিশ্বস্ত) হিসাবে পরিচিত ছিলেন (ইবনু হিশাম ১/১৯৮)। আল্লাহ বলেন,قَدْ نَعْلَمُ إِنَّهُ لَيَحْزُنُكَ الَّذِي يَقُولُونَ فَإِنَّهُمْ لاَ يُكَذِّبُونَكَ وَلَكِنَّ الظَّالِمِينَ بِآيَاتِ اللهِ يَجْحَدُونَ- ‘আমরা জানি যে, তারা যেসব কথা বলে তা তোমাকে দুঃখ দেয়। কিন্তু বাস্তব কথা এই যে, ওরা তোমাকে মিথ্যাবাদী বলে না, বরং এইসব যালেমরা আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করে’ (আন‘আম ৬/৩৩)। মুসলমানদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لاَ تَفْعَلُونَ- كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لاَ تَفْعَلُونَ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল যা তোমরা কর না?’ ‘আল্লাহর নিকটে বড় ক্রোধের বিষয় এই যে, তোমরা বল এমন কথা যা তোমরা কর না?’ (ছফ ৬১/২-৩)

(১৪) আচরণ নম্র হওয়া ও হক কবুল করা :

দাঈকে অবশ্যই সত্যবাদী ও অন্যের নিকট বিশ্বস্ত হ’তে হবে। হক আক্বীদার উপর দৃঢ় থাকা এবং আচরণ নম্র হওয়া দাঈর সবচেয়ে বড় গুণ। আল্লাহ স্বীয় রাসূল-কে বলেন, وَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَلاَ تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَقُلْ آمَنْتُ بِمَا أَنْزَلَ اللهُ مِنْ كِتَابٍ ‘আর তুমি যেভাবে আদিষ্ট হয়েছ, সেভাবেই অবিচল থাক। তুমি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না। তুমি বল, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন তাতে আমি বিশ্বাস স্থাপন করেছি’ (শূরা ৪২/১৫)। তিনি বলেন,فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ ‘আর আল্লাহর রহমতের কারণেই তুমি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমলহৃদয় হয়েছ। যদি তুমি কর্কশভাষী কঠোর হৃদয়ের হ’তে, তাহ’লে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত। কাজেই তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)

তবে যদি কেউ ভুল ধরিয়ে দেয় এবং সেটি যদি হক হয়, তাহ’লে বিনা দ্বিধায় তা কবুল করে নেওয়া দাঈ-র জন্য আবশ্যক। আল্লাহ বলেন,فَبَشِّرْ عِبَادِ- الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ أُولَئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللهُ وَأُولَئِكَ هُمْ أُولُو الْأَلْبَابِ- ‘তুমি সুসংবাদ দাও আমার বান্দাদেরকে’। ‘যারা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনে, অতঃপর তার মধ্যে যেটা উত্তম সেটার অনুসরণ করে। তাদেরকে আল্লাহ সুপথে পরিচালিত করেন এবং তারাই হ’ল জ্ঞানী’ (যুমার ৩৯/১৭-১৮)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ ‘অহংকার হ’ল দম্ভভরে হক প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা’।[6] আর কোন অহংকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِى قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ- ‘যার অন্তরে সরিষা দানা পরিমাণ অহংকার আছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ (ঐ)

(১৫) ছোট-বড় সকল বিষয়ে সংস্কারের চেষ্টা করা :

আল্লাহ বলেন,وَمَا كَانَ رَبُّكَ لِيُهْلِكَ الْقُرَى بِظُلْمٍ وَأَهْلُهَا مُصْلِحُونَ- ‘আর তোমার প্রতিপালক এমন নন যে, সেখানকার অধিবাসীরা সৎকর্মশীল হওয়া সত্ত্বেও জনপদ সমূহকে অন্যায়ভাবে ধ্বংস করে দিবেন’ (হূদ ১১/১১৭)। এখানে مُصْلِحُونَ অর্থ ‘সংস্কারক’। যারা নিজেদেরকে ও সমাজকে কল্যাণের পথে সংস্কার করেন। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ الْإِسْلاَمَ بَدَأَ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ غَرِيبًا كَمَا بَدَأَ فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ، قِيلَ: مَنْ هُمْ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ: الَّذِينَ يَصْلُحُونَ إِذَا فَسَدَ النَّاسُ- ‘ইসলাম নিঃসঙ্গভাবে যাত্রা শুরু করেছিল। সত্বর সেই অবস্থায় ফিরে যাবে। অতএব সুসংবাদ হ’ল সেই অল্পসংখ্যক লোকদের জন্য। বলা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল! তারা কারা? তিনি বললেন, যখন মানুষ নষ্ট হয়ে যায়, তখন তাদেরকে যারা সংস্কার করে’।[7] এর ব্যাখ্যায় অন্য হাদীছে এসেছে, الَّذِينَ يُصْلِحُونَ مَا أَفْسَدَ النَّاسُ مِنْ بَعْدِى مِنْ سُنَّتِى ‘আমার পরে লোকেরা যেসব সুন্নাতকে বিনষ্ট করে, সেগুলিকে যারা সংস্কার করে’।[8] হাদীছটির সনদ ‘যঈফ’ হ’লেও পূর্ববর্তী ছহীহ হাদীছের সমার্থক।

উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উম্মতের ইহকালীন ও পরকালীন প্রয়োজনীয় ছোট-বড় সবকিছু বিষয়ে অবহিত করেছেন। তিনি বলেন,

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أَيُّهَا النَّاسُ لَيْسَ مِنْ شَيْءٍ يُقَرِّبُكُمْ إِلَى الْجَنَّةِ، وَيُبَاعِدُكُمْ مِنَ النَّارِ، إِلا قَدْ أَمَرْتُكُمْ بِهِ، وَلَيْسَ شَيْءٌ يُقَرِّبُكُمْ مِنَ النَّارِ، وَيُبَاعِدُكُمْ مِنَ الْجَنَّةِ إِلا قَدْ نَهَيْتُكُمْ عَنْهُ،  ‘হে জনগণ! তোমাদেরকে জান্নাতের নিকটবর্তী করে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখে, এমন সকল বিষয় আমি তোমাদের নির্দেশ দিয়েছি। পক্ষান্তরে তোমাদেরকে জাহান্নামের নিকটবর্তী করে এবং জান্নাত থেকে দূরে রাখে, এমন সকল বিষয় আমি তোমাদের নিষেধ করেছি’।[9]

(১৬) সাধ্যমত দিন-রাত মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়া:

পৃথিবীর প্রথম রাসূল হযরত নূহ (আঃ) তাঁর উম্মতকে দিন-রাত দাওয়াত দিতেন। যার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ বলেন,قَالَ رَبِّ إِنِّي دَعَوْتُ قَوْمِي لَيْلاً وَنَهَارًا- فَلَمْ يَزِدْهُمْ دُعَائِي إِلاَّ فِرَارًا- وَإِنِّي كُلَّمَا دَعَوْتُهُمْ لِتَغْفِرَ لَهُمْ جَعَلُوا أَصَابِعَهُمْ فِي آذَانِهِمْ وَاسْتَغْشَوْا ثِيَابَهُمْ وَأَصَرُّوا وَاسْتَكْبَرُوا اسْتِكْبَارًا- ثُمَّ إِنِّي دَعَوْتُهُمْ جِهَارًا- ثُمَّ إِنِّي أَعْلَنْتُ لَهُمْ وَأَسْرَرْتُ لَهُمْ إِسْرَارًا- ‘নূহ বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমি আমার সম্প্রদায়কে রাত-দিন দাওয়াত দিয়েছি’। ‘কিন্তু আমার দাওয়াত কেবল তাদের পলায়নকেই বৃদ্ধি করেছে’।আমি যতবারই তাদের আহবান করেছি, যাতে তুমি তাদের ক্ষমা কর, ততবারই তারা কানে আঙ্গুল দিয়েছে, কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকেছে, যিদ করেছে এবং চূড়ান্ত অহংকার দেখিয়েছে’। ‘অতঃপর আমি তাদের ডেকেছি উঁচু স্বরে’। ‘অতঃপর আমি তাদের ডেকেছি প্রকাশ্যে ও গোপনে’ (নূহ ৭১/৫-৯)

তাযকিয়াহ ও তারবিয়াহর বৈশিষ্ট্য সমূহ :

(১) আল্লাহওয়ালা হওয়া :

আলেম, ফক্বীহ, বিচারক, শাসক ও সমাজনেতা সকলের জন্য উক্ত গুণ থাকা অত্যাবশ্যক।

আল্লাহ বলেন,مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُؤْتِيَهُ اللهُ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُوا عِبَادًا لِي مِنْ دُونِ اللهِ وَلَكِنْ كُونُوا رَبَّانِيِّينَ কোন মানুষের জন্য এটা সমীচীন নয় যে, তাকে আল্লাহ কিতাব, প্রজ্ঞা ও নবুঅত দান করেন। অতঃপর সে লোকদের বলে যে, তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে আমার গোলাম হয়ে যাও। বরং সে বলবে যে, তোমরা সবাই আল্লাহওয়ালা হয়ে যাও’ (আলে ইমরান ৩/৭৯)

(২) মধ্যপন্থা অবলম্বন করা :

যেমন (ক) ইখলাছের ক্ষেত্রে রিয়া ও শ্রুতি এবং হক প্রকাশ ও হক দাওয়াতের মধ্যবর্তী অবস্থা অবলম্বন করা। (খ) ইবাদতের ক্ষেত্রে আত্মশুদ্ধিতার বাড়াবাড়ি ও বাহ্যিক আমলগত বিষয়ে বাড়াবাড়ির মধ্যবর্তী অবস্থা অবলম্বন করা। (গ) আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা। অথচ তাঁর জান্নাত কামনা না করা। যেমন কিছু ভন্ড ছূফীর অবস্থা। জান্নাতের সুখ-শান্তি কামনা করা, কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা না করা। যেমন কিছু কালাম শাস্ত্রবিদ ভন্ড দার্শনিকের অবস্থা। (ঘ) আবেদগণকে নিষ্পাপ মনে করা ও আলেমগণকে হীন ধারণা করার মধ্যবর্তী উভয়কে কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর মানদন্ডে মূল্যায়ন করা। (ঙ) কবীরা গোনাহগার মুমিনকে কাফের অথবা পূর্ণ মুমিন ধারণা করার মধ্যবর্তী উভয়কে ফাসেক মুমিন গণ্য করা। অর্থাৎ চরমপন্থী খারেজী ও শৈথিল্যবাদী মুরজিয়ার মধ্যবর্তী আক্বীদা অবলম্বন করা। (চ) কৃপণতা ও সংসার বিরাগ এবং দৈহিক কৃচ্ছ্রতা সাধন ও ইবাদতে অমনোযোগিতার মধ্যবর্তী স্বাভাবিকভাবে ইবাদত পালন করা।

(৩) সালাফী পথের অনুসারী হওয়া :

পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রকাশ্য অর্থের অনুসারী হওয়া এবং ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শরী‘আত ব্যাখ্যা করা।

(৪) শরী‘আতের নির্দেশ দ্রুত মান্য করায় উৎসাহী হওয়া :

কুরআন ও হাদীছের নির্দেশ মান্য করার ব্যাপারে কোনরূপ ইতস্ততঃ না করে তারা সর্বদা ছাহাবায়ে কেরামের ন্যায় দ্রুত সেটি আমল করার চেষ্টা করা। ছাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কোন কাজ দেখলে কিভাবে তা দ্রুত সম্পাদন করতেন, তার অন্যতম নমুনা এই যে, একবার জুতার নীচে নাপাকী আছে মর্মে অহি প্রাপ্ত হওয়ার কারণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত অবস্থায় নিজের জুতা জোড়া খুলে বাম দিকে রাখেন। এটি দেখে মুক্তাদী ছাহাবীগণ স্ব স্ব পায়ের জুতা খুলে ফেলেন। সালাম ফিরানোর পর তিনি মুক্তাদীদের নিকট বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন’।[10] তিনি বলেন,أَحَبُّ الأَعْمَالِ إِلَى اللهِ تَعَالَى أَدْوَمُهَا وَإِنْ قَلَّ ‘আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয়তর আমল হ’ল নিয়মিত করা, যদিও তা কম হয়’।[11] ইমাম আওযাঈ (রহঃ) বলেন,إِنَّ الْمُؤْمِنَ يَقُولُ قَلِيلاً وَيَعْمَلُ كَثِيرًا وَإِنَّ الْمُنَافِقَ يَقُولُ كَثِيرًا وَيَعْمَلُ قَلِيلاً- ‘মুমিন কথা কম বলে, আমল বেশী করে। আর মুনাফিক কথা বেশী বলে, আমল কম করে’।[12] ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘যখন ঈমানের শাখা সমূহ একত্রে জমা হয়, তখন তুমি সেটাকে অগ্রাধিকার দাও যাতে আল্লাহ বেশী খুশী হন। অনেক সময় অনুত্তম ব্যক্তি উত্তম ব্যক্তি অপেক্ষা সৎকর্মে অধিক অগ্রণী হয় এবং সে উত্তম ব্যক্তির চাইতে বেশী নেকী অর্জন করে। অতএব সর্বোত্তমটি করার চাইতে যেটি সবচেয়ে উপকারী সেটাই করা উত্তম।... যেমন কোন ব্যক্তি যদি রাত্রিতে কুরআন তেলাওয়াত ও তা অনুধাবন করায় বেশী উপকৃত হন এবং ছালাতের মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ তার জন্য ভারী হয়, তবে সে ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াত ও তা অনুধাবন করবে’।[13] অনেকের উপর আল্লাহ সৎকর্মের দুয়ার সমূহ একটির বদলে আরেকটি খুলে দেন। কারুর উপরে সবধরনের দুয়ার খুলে দেন। ফলে তিনি অধিক নেকী অর্জনের সুযোগ লাভ করেন। তিনি ক্বিয়ামতের দিন জান্নাতের আটটি দরজা থেকে আহূত হবেন। আর এটি হ’ল আল্লাহর অনুগ্রহ। যা তিনি যাকে খুশী তাকে দান করে থাকেন। উম্মতের মধ্যে আবুবকর (রাঃ) এভাবে আহূত হবেন বলে হাদীছে এসেছে। যেমন আমাদের মধ্যে কেউ সকল দরজা দিয়ে আহূত হবেন কি? এমন প্রশ্নের উত্তরে রাসূল (ছাঃ) আবুবকরকে বলেন, نَعَمْ، وَأَرْجُوْ أَنْ تَكُوْنَ مِنْهُمْ ‘হ্যাঁ, আমি আশা করি তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে’।[14]

(৫) ছোট-বড় সকল বিষয়ে সংস্কার করা :

একজন মুমিন তার জীবনের খুঁটিনাটি সকল বিষয় পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ এবং সালাফে ছালেহীনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সংস্কার করবে। যেমন প্রখ্যাত ছাহাবী সালমান ফারেসী (রাঃ)-কে জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, তোমাদের নবী কি তোমাদের সবকিছু বিষয়ে এমনকি পেশাব-পায়খানার মত বিষয়েও শিক্ষা দিয়ে থাকেন? তিনি বললেন, হ্যঁা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে পেশাব-পায়খানার সময় ক্বিবলামুখী হ’তে, ডান হাতে ইস্তিঞ্জা করতে, তিনটির কমে ঢেলা না নিতে এবং শুকনা গোবর ও হাড্ডি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করতে নিষেধ করেছেন’।[15]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, ক্বিবলার দিকে মুখ করে বা পিঠ ফিরে পেশাব-পায়খানা করা যাবে না।[16] তবে ক্বিবলার দিকে আড়াল থাকলে বা টয়লেটের মধ্যে হ’লে জায়েয আছে।[17]  পানি পেলে কুলূখের (মাটির ঢেলা) প্রয়োজন নেই।[18] কুলূখ নিলে পুনরায় পানির প্রয়োজন নেই।[19] কুলূখের জন্য তিনবার বা বেজোড় সংখ্যক ঢেলা ব্যবহার করবে।[20]

মোটকথা তারবিয়াহ বা পরিচর্যাই হ’ল সমাজ পরিবর্তনের মূল ভিত্তি। যা ব্যতীত শুধুমাত্র দাওয়াত কখনো ফলপ্রসু হয় না এবং সমাজও পরিবর্তিত হয় না।

তারবিয়াহর প্রকারভেদ

(১) জ্ঞানগত পরিচর্যা :

যা মানুষের মধ্যে জ্ঞান ও বুঝ শক্তি বৃদ্ধি করে সর্বদা সে চেষ্টা করতে হবে। এ কারণেই আল্লাহ পাক দো‘আ করতে বলেছেন, وَقُلْ رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا ‘তুমি বল, হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি কর!’ (ত্বোয়াহা ২০/১১৪)

(২) চেতনা সৃষ্টির পরিচর্যা :

যা মানুষের হৃদয়কে জাগিয়ে তোলে এবং তাকে আল্লাহ বিরোধিতা হ’তে ভীত করে। যেমন আল্লাহ বলেন,فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ‘অতএব যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সাবধান হৌক যে, ফিৎনা তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা মর্মন্তুদ শাস্তি তাদের উপর আপতিত হবে’ (নূর ২৪/৬৩)। এজন্য সর্বদা মানুষকে জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন মূলক আয়াত ও হাদীছ সমূহ শুনাতে হবে। সেই সাথে আল্লাহর গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের ইতিহাস বর্ণনা করতে হবে। সাথে সাথে জান্নাতের সুখ-শান্তির আয়াত ও হাদীছ সমূহ বর্ণনা করতে হবে।

(৩) কর্মগত পরিচর্যা :

এর মাধ্যমে বাস্তব সম্মত কর্মপন্থা বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। যা মুসলমানদের সমাজ ও জনপদকে অন্যায় প্রতিরোধে সক্ষম করে তুলবে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَإِنَّ جُنْدَنَا لَهُمُ الْغَالِبُونَ ‘নিশ্চয় আমাদের বাহিনীই হ’ল বিজয়ী’ (ছাফফাত ৩৭/১৭৩)। আল্লাহর এই বাহিনী ফেরেশতাগণের মধ্য থেকে হ’তে পারে। কিংবা শত্রু-মিত্র যেকোন মানুষ হ’তে পারে। বান্দার দায়িত্ব আল্লাহর উপরে ভরসা করে হক-এর বিজয়ে কাজ করে যাওয়া। আর আল্লাহর দায়িত্ব হকপন্থী বান্দাকে সাহায্য করা (রূম ৩০/৪৭)। তিনি সেটি কিভাবে করবেন, কার মাধ্যমে করবেন, সেটি তাঁর এখতিয়ার।

(৪) ঈমানী পরিচর্যা :

ঈমান যাতে তাযা থাকে এবং বিশ্বাসের দৃঢ়তা যাতে বৃদ্ধি পায়, সেজন্য নেতা-কর্মীকে সর্বদা নিজ তাকীদে নিজের ঈমানী পরিচর্যা করতে হবে। সম আক্বীদা সম্পন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকা, নিয়মিত ছহীহ আক্বীদা ও আমলের বই ও পত্রিকা পাঠ করা, নিজের গৃহ ও পরিবারকে ঈমানী দুর্গে পরিণত করা একান্তভাবেই আবশ্যক। এজন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আদর্শ নেতার অনুসারী হওয়া।

তারবিয়াহর বাধা সমূহ :

(১) আক্বীদার বিষয়গুলিকে হালকা মনে করা। (২) সুন্নাতকে ছোট-খাট বিষয় বলে হীন গণ্য করা। (৩) নিজের সিদ্ধান্তের উপর হঠকারিতা করা। (৪) ইসলাম বিরোধী নিদর্শন সমূহের সাথে আপোষ করা। (৫) অলসতা, বিলাসিতা ও অপচয় করা। (৬) আখেরাতের উপর দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দেওয়া। (৭) আমীরের নেকীর আদেশকে যেকোন অজুহাতে অমান্য করা। (৮) আখেরাতের লক্ষ্যহীন জীবন যাপন করা। (৯) নিজ পরিবার ও সমাজ গড়ে তোলার চিন্তা হ’তে দূরে থাকা। (১০) আত্মম্ভরিতা ও কৃপণতা অবলম্বন করা।

সবচেয়ে বড় বাধা হ’ল হারামকে হালাল করার প্রবণতা। যা সাধারণতঃ ব্যবসায়িক লেন-দেন ও ঋণ দানের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। যেমন নগদ বিক্রিতে কম দাম এবং বাকী বা কিস্তির বিক্রিতে বেশী দাম, বন্ধকী জমি আবাদ করে লাভবান হওয়া, বিভিন্ন অত্যাচারমূলক খাজনা ও ট্যাক্স নির্ধারণ করা ইত্যাদি। এটি আরও মারাত্মক গোনাহের কারণ হয় যখন শিরক ও বিদ‘আত সমূহকে বৈধ গণ্য করার হীলা-বাহানা করা হয়। যেমন হুলূল ও ইত্তিহাদ, অদ্বৈতবাদ ও সর্বেশ্বরবাদ, সৃষ্টিকে সৃষ্টিকর্তার অংশ সাব্যস্ত করা, আল্লাহর গুণাবলীকে অস্বীকার করা অথবা সেগুলিকে বান্দার গুণাবলীর সাথে সামঞ্জস্যশীল মনে করা, মীলাদ-ক্বিয়াম, কুলখানী-চেহলাম, স্থানপূজা-কবরপূজা, বিভিন্ন দিবস পালন প্রভৃতি। ইবাদতের নামে বিশেষ বিশেষ রাতে দলবদ্ধভাবে সরবে পূর্ণ রাত্রি জাগরণ, দেহকে অহেতুক কষ্ট দিয়ে কৃচ্ছ্রতা সাধন, যিকরের নামে ফানাফিল্লাহর কসরত ইত্যাদি। ভবিষ্যৎ বংশধরগণকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে এসব থেকে মুক্ত বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমল শিক্ষা দেওয়া সংস্কারক নেতৃবৃন্দের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য।

উপসংহার :

এভাবে তাযকিয়াহ ও তারবিয়াহ তথা আত্মশুদ্ধিতা ও পরিচর্যার মাধ্যমে নিজেকে ও নিজ সমাজকে গড়ে তুলতে পারলে জীবনের প্রতিটি শাখায়-প্রশাখায় ইসলাম ব্যাপ্তি লাভ করবে। গাছের গোড়ায় ঈমানের বারি সিঞ্চন না থাকলে এবং তার কান্ডে ও পত্রে ইসলামের সজীবতা না থাকলে, সর্বোপরি ঈমানের পবিত্র বৃক্ষটি নিখুঁত না হ’লে তা থেকে নিখুঁত ফল আশা করা যায় না। সেটি করার আগেই দ্রুত ফল লাভের আশা করলে তাতে ব্যর্থ হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেমন ব্যর্থ হয়েছেন যুগে যুগে অনেক রাজনৈতিক নেতা ও উচ্চাভিলাষী সমাজনেতা। তাই জনৈক সংস্কারক বিদ্বান বলেন,أقيموا دولة الإسلام في قلوبكم، تُقَمْ لكم في أرضكم ‘তোমরা তোমাদের হৃদয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা কর, তোমাদের জনপদে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে’। এর চেয়ে উত্তম বাণী হ’ল যা আল্লাহ বলেছেন,وَقُلِ اعْمَلُوا فَسَيَرَى اللهُ عَمَلَكُمْ وَرَسُولُهُ وَالْمُؤْمِنُونَ وَسَتُرَدُّونَ إِلَى عَالِمِ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ- ‘তুমি বলে দাও যে, তোমরা কাজ করে যাও।

অতঃপর অচিরে তোমাদের কাজ দেখবেন আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও ঈমানদারগণ। আর নিশ্চয়ই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে সেই সত্তার নিকটে, যিনি গোপন ও প্রকাশ্য বিষয়ে অবগত। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তোমাদের সকল কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন’ (তওবা ৯/১০৫)। তিনি আরও বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَجِيبُوا لِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيكُمْ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللهَ يَحُولُ بَيْنَ الْمَرْءِ وَقَلْبِهِ وَأَنَّهُ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আহবানে সাড়া দাও। যখন তিনি তোমাদের আহবান করেন ঐ বিষয়ের দিকে যা তোমাদের (মৃত অন্তরে) জীবন দান করে। জেনে রেখ, আল্লাহ মানুষ ও তার অন্তরের মাঝে অন্তরায় হয়ে থাকেন (অর্থাৎ তাঁর অনুমতিক্রমেই মানুষ মুমিন ও কাফির হয়ে থাকে)। পরিশেষে তাঁর কাছেই তোমাদের সমবেত করা হবে’ (আনফাল ৮/২৪)


[1]. মুসলিম হা/১০৬৩ (১৪২); সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ৩য় মুদ্রণ ৫৭৩ পৃ.।

[2]. কুরতুবী, সূরা তওবা ৫৮ আয়াতের ব্যাখ্যা; সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ৩য় মুদ্রণ ৫৭৫ পৃ.।

[3]. আহমাদ হা/২৫৩৪১, ২৫৮৫৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৮১১। 

[4]. বুখারী হা/২৬৫২; মুসলিম হা/২৫৩৩; মিশকাত হা/৩৭৬৭ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে।

[5]. মুওয়াত্ত্বা হা/৭৩৮, ২/৩০৬ পৃ.।

[6]. মুসলিম হা/৯১; মিশকাত হা/৫১০৮।

[7]. ছহীহাহ হা/১২৭৩।

[8]. তিরমিযী হা/২৬৩০; মিশকাত হা/১৭০, সনদ যঈফ।

[9]. বায়হাক্বী শো‘আব হা/১০৩৭৬; মিশকাত হা/৫৩০০; ছহীহাহ হা/২৮৬৬।

[10]. আবুদাঊদ হা/৬৫০; দারেমী হা/১৩৭৮; মিশকাত হা/৭৬৬।

[11]. মুসলিম হা/৭৮৩; বুখারী হা/৬৪৬৫; মিশকাত হা/১২৪২।

[12]. আবু নু‘আইম আল-ইছফাহানী, হিলইয়াতুল আওলিয়া (বৈরূত : দারুল কিতাবিল ‘আরাবী, ৪র্থ সংস্করণ ১৪০৫ হি.) ৬/১৪২ পৃ.।

[13]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৭/৬৫১ فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ ‘তোমরা সাধ্যমত আল্লাহকে ভয় কর’ (তাগাবুন ৬৪/১৬-এর ব্যাখ্যা)

[14]. বুখারী হা/৩৬৬৬, মুসলিম হা/১০২৭; মিশকাত হা/১৮৯০ ‘যাকাত’ অধ্যায়-৬, ‘দানের মাহাত্ম্য’ অনুচ্ছেদ-৬।

[15]. মুসলিম হা/২৬২; মিশকাত হা/৩৩৬।

[16]. বুখারী হা/৩৯৪; মুসলিম হা/২৬৪; মিশকাত হা/৩৩৪।

[17]. বুখারী হা/৩১০২; মুসলিম হা/২৬৬; মিশকাত হা/৩৩৫, আবুদাঊদ হা/১১; মিশকাত হা/৩৭৩।

[18]. তিরমিযী হা/১৯; মির‘আত ২/৭২।

[19]. আবুদাঊদ হা/৪০; নাসাঈ হা/৪৪ প্রভৃতি; মিশকাত হা/৩৪৯; মির‘আত ২/৫৮ পৃ.।

[20]. মুসলিম হা/২৬২; বুখারী হা/১৬১; মুসলিম হা/২৩৭; মিশকাত হা/৩৩৬, ৩৪১।





এক্সিডেন্ট - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল্লাহকে উত্তম ঋণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
কুরআন অনুধাবন (২য় কিস্তি) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মাপে ও ওযনে ফাঁকি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল্লাহ সর্বশক্তিমান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মদ, জুয়া, বেদী, ভাগ্য নির্ধারক শর নিষিদ্ধ বস্ত্ত - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আলোর পথ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
যাকাত ও ছাদাক্বার কল্যাণকারিতা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
অধিক পাওয়ার আকাংখা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইসলামে বাক স্বাধীনতা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল্লাহর আশ্রয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মুমিন অথবা কাফের - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.