ইংরেজী কোটা (Quota) শব্দের অর্থ ভাগ, নির্ধারিত অংশ, আনুপাতিক স্বীকৃত অংশ, প্রদেয় আবশ্যিক বা নির্দিষ্ট ভাগ ইত্যাদি। সাধারণত একটি গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দকৃত নির্দিষ্ট বিশেষ সুবিধাকে কোটা বলা হয়। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও প্রান্তিক সম্প্রদায়কে মূলধারায় যুক্ত করতে শিক্ষা ও চাকুরীখাতসহ আত্মোন্নতিমূলক নানা ক্ষেত্রে সমান সুযোগ নিশ্চিতের জন্য কোটা ব্যবস্থা রাখা হয়।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোটা রয়েছে। ব্রিটিশ শাসন ও স্বাধীনতাত্তোর পাকিস্তান আমলেও প্রদেশভিত্তিক কোটা পদ্ধতি চালু ছিল। কিন্তু কোন কালেই কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়নি বরং আন্দোলন হয়েছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব থেকে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের অনেকগুলো প্রেক্ষাপটের মধ্যে অন্যতম ছিল বৈষম্য। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়। বাংলাদেশ মূলতঃ দারিদ্র্যক্লিষ্ট অনগ্রসর দেশ ছিল। স্বাধীনতাত্তোর নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছালেও উন্নত জীবনধারা থেকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। নিশ্চিতরূপে ১৯৭২ সালে সে সংখ্যা আরো বেশী ছিল। তাদের আত্মোন্নতির জন্যই তখন কোটা চালু করা হয়। সেই কোটায় মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের উন্নতিকল্পে কোটার হার বেশী রাখা হয়। কেননা তাদের অধিকাংশই ছিল কৃষক, শ্রমিক, মজুর তথা দরিদ্র শ্রেণী। কিন্তু স্বাধীনতার ৫২ বছর পর একবিংশ শতকে এসে সেই কোটা আবার বৈষম্যের হাতিয়ারে পরিণত হয়।
কোটা সংস্কারের পটভূমি : ১৯৭২ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন কর্পোরেশন ও দফতর নিয়োগে কোটা বণ্টনের বিষয়ে একটি নির্বাহী আদেশ জারী করেন। এতে ২০ শতাংশ মেধা এবং ৮০ শতাংশ যেলা কোটা রাখা হয়। যেলা কোটার মধ্য থেকে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা এবং ১০ শতাংশ কোটা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৭৬ সালে এই বণ্টনে পরিবর্তন আনেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এতে ৪০ শতাংশ মেধা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারী এবং ১০ শতাংশ যেলা কোটা নির্ধারণ করা হয়। ১৯৮৫ সালে জেনারেল এরশাদের সময়ে আবারো কোটা সংস্কার করা হয়। তখন চাকুরীতে ১ম ও ২য় শ্রেণীর পদসমূহের জন্য মেধাভিত্তিক কোটা ৪৫ শতাংশ এবং যেলাভিত্তিক কোটা ছিল ৫৫ শতাংশ। যেলা কোটার ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ মহিলা এবং ৫ শতাংশ উপজাতিদের জন্য বরাদ্দ করা হয়।
১৯৯০ সালে এসে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মুক্তিযোদ্ধাদের আর কোন চাকুরীর সুযোগ থাকে না। তখন তারা দাবী করতে থাকে তাদের সন্তানদের যেন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকুরীর ব্যবস্থা করা হয়। শেখ হাসিনা সরকার ১৯৯৭ সালে চাকুরীতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত করেন। এতে ১৯৮৫ সালের কোটা বণ্টন অপরিবর্তিত রেখে কেবল ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী না পাওয়ার শর্তে মুক্তিযোদ্ধা অথবা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পুত্র-কন্যার জন্য তা বরাদ্দের আদেশ জারী করা হয়। তবে ২০০২ সালে বিএনপি সরকারের সময়ে আরেকটি পরিপত্র জারী করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ কোটা বণ্টনের বিষয়ে আগের জারী করা পরিপত্রগুলো বাতিল করা হয়।
এতে বলা হয়, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত ৩০% কোটা অন্য প্রার্থী দ্বারা পূরণ না করে সংরক্ষণ করার যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তা সংশোধনক্রমে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে, ২১তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত ৩০% কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে উক্ত কোটার শূন্যপদগুলো (ক্যাডার ও নন-ক্যাডার) মেধাভিত্তিক তালিকায় শীর্ষে অবস্থানকারী প্রার্থীদেরকে দিয়ে পূরণ করা যেতে পারে’। ২০০৮ সালে আবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে এই নির্দেশনাও বাতিল করা হয়। একইসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য নির্ধারিত কোটা পূরণ করা সম্ভব না হ’লে পদ খালি রাখার নির্দেশ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারী করে তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়। পরবর্তীতে ২০১১ সালে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনীদেরও ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সর্বশেষ ২০১২ সালে ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা যুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারী করে সরকার।[1]
২০১৮ সালের জানুয়ারী মাসের শেষের দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন দানা বাধতে থাকে। তীব্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী ১১ই এপ্রিল’১৮ সংসদে দাঁড়িয়ে সব ধরনের কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। তার প্রেক্ষিতে অক্টোবর মাসে এসে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে (১ম ও ২য় শ্রেণী) সরকারী চাকুরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারী করে সরকার। ১৪তম থেকে ২০তম (৩য় ও ৪র্থ শ্রেণী) গ্রেডে কোটা বহাল রেখে কিছুটা সংস্কার করা হয়। এই পদগুলোতে কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা থেকেই নিয়োগের কথা জানানো হয়। এদিকে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। গত ৫ই জুন’২৪ তাদের পক্ষে রায় আসে অর্থাৎ আগের মতো কোটা বহাল হবে বলে জানায় আদালত।
কোটা সংস্কারের যৌক্তিকতা : ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র ২০২৩ সালের চতুর্থ কোয়ার্টার জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ৫০ হাযার।[2] শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা বেকারের সংখ্যা ছিল ৮ লাখ, যা মোট পরিসংখ্যানের প্রায় তিনভাগের একভাগ।[3] এ বছরের প্রথম প্রান্তিকের (জানু-মার্চ) জরিপ অনুযায়ী দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ ৯০ হাযার।[4] লন্ডনের ইকোনমিষ্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্য মতে, বাংলাদেশের স্নাতকধারী ১০০ জনের ৪৭ জনই বেকার।[5] এখানে লক্ষণীয় বিষয় হ’ল, মাত্র ৪৪ শতাংশ মেধা কোটায় ৪৭ শতাংশ বেকার যুবক প্রতিনিয়ত চাকুরীর জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এটা কি বৈষম্য নয়? অথচ তুলনামূলক কম মেধাবীরা ৫৬ শতাংশ কোটা পেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নামে মাত্র পরীক্ষা দিয়ে প্রায় সরাসরি নিয়োগ পায়। ফলে সুস্থ প্রতিযোগিতা না থাকায় মেধাবী তরুণরা চাকুরীর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুতরাং এই বৈষম্যের কোটা পদ্ধতি সংস্কারের আন্দোলন অবশ্যই যৌক্তিক ছিল।
১৫ বছরের স্বৈরশাসনের পতনের প্রেক্ষাপট : ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এক সেনা অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। সে সময় স্বামী, সন্তান ও বোন শেখ রেহানাসহ শেখ হাসিনা পশ্চিম জর্মানীতে অবস্থান করছিলেন। পরবর্তীতে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রদত্ত রাজনৈতিক আশ্রয়ে ভারতের নয়াদিল্লী এসে ৬ বছর নির্বাসিত জীবনযাপন করেন। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারীতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী করা হ’লে তিনি ১৭ই মে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর দীর্ঘ সময়ের পট পরিবর্তনের পর বিচারপতি মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন ৭ম সংসদ নির্বাচন হ’লে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। অতঃপর ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ৯ম সংসদ নির্বাচনে ফের আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করে এবং ৬ই জানুয়ারী ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের মাত্র ৫০ দিনের মাথায় ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬শে ফেব্রুয়ারী পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। এতে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের হৃদয়বিদারক মৃত্যু ঘটে। অনেক সেনা সদস্যের চাকুরী চলে যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি নযীরবিহীন বিদ্রোহ ছিল। এই বিদ্রোহে সরকার দলীয় একাধিক নেতার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠে। অতঃপর ২০১১ সালের ১০ই মে সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী এনে হাইকোর্টের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে বাতিল করে নির্বাচন ব্যবস্থাকে দলীয়করণ করা হয়। ফলশ্রুতিতে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলো সবই ছিল প্রহসনমূলক। যেখানে ছিল না সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ; কারচুপি, ভোট ডাকাতি করে রাতারাতি ব্যালট বাক্স ভরে পেশীশক্তির বলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা হয়েছিল।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে ঢাকার শাহবাগে আন্দোলন করে নাস্তিক, ব্লগার ও কথিত সুশীল সমাজ। কিন্তু আন্দোলনের নামে আল্লাহ, রাসূল (ছাঃ), ইসলাম ও দাড়ি-টুপিকে কটাক্ষ করা হচ্ছিল প্রতিনিয়ত। তার প্রতিবাদে দেশের আলেম সমাজ ১৩ দফা দাবী নিয়ে ৫ই মে হেফাযতে ইসলামের নেতৃত্বে শাপলা চত্বরে জমায়েত হয়। ঐদিন সরকারের নির্দেশে দিবাগত মধ্যরাতে লাইট ও ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিয়ে নিরীহ নিরস্ত্র মাদ্রাসা ছাত্র, শিক্ষক ও আলেমদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। কত মানুষ সে রাতে মারা যায় সে তথ্য আজও উদ্ঘাটন হয়নি। ২০১৮ সালের জানুয়ারীতে কোটা সংস্কার আন্দোলন, ২৯শে জুলাই ঢাকায় দুই বাসের যাত্রী ধরার বেপরোয়া প্রতিযোগিতার কারণে দুই কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যু পরবর্তী নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ২০২১ সালে পুনরায় শিক্ষার্থী মৃত্যুর প্রতিবাদে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ছিল ছাত্রদের সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক প্রতিবাদ এবং যৌক্তিক দাবী। অথচ এই আন্দোলনগুলোকে নস্যাৎ করার জন্য প্রশাসন ও সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনকে মাঠে নামিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে, মামলা দিয়ে কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়া হয়। এছাড়াও বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন, ফাঁসিতে ঝুলানো, গুপ্ত হত্যা, গুম, মানুষের বাক স্বাধীনতা হরণ, ভোটাধিকার হরণ, দুর্নীতি, আমলাদের বিদেশে অর্থ পাচার এবং নিরাপরাধ মানুষকে ‘আয়নাঘরে’ বন্দি করে বছরের পর বছর ধরে অমানবিক নির্যাতন এই সরকারের স্বৈরাচারী কারনামা।
অতঃপর গত ৫ই আগস্ট’২৪ দীর্ঘ ১৫ বছরের অপশাসনের ফলে মানুষের ভেতরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ছোট্ট একটি ঘটনায় ৩৬ দিনের টানা আন্দোলনে স্বৈরশাসনের পতন হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারীতে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে তুমুল আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কোটা বাতিল করা হ’লেও ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানরা কোটার স্বপক্ষে উচ্চ আদালতে রিট করে বসে। এই রিটের পক্ষে রায় দিয়ে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। ৬ই জুন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এই রায় বাতিলের দাবীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সরকারী চাকুরীতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধু সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা রেখে সংসদে আইন পাস করার দাবী পূরণের আহবান জানিয়ে আন্দোলনকারীরা সরকারকে ৩০শে জুন এবং পরবর্তীতে ৪ঠা জুলাই পর্যন্ত সময় বেধে দেয়। ১১ই জুলাই শিক্ষার্থীরা সরকারের কাছে ৩ দফা দাবী পেশ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমাধান কামনা করেন। ১৪ই জুলাই গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে কটাক্ষবাণে বিস্ফোরক মন্তব্য করায় ঐদিন দিবাগত রাত থেকেই আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়ে। ১৬ই জুলাই রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরস্ত্র ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। স্বৈরশাসনকে বৃদ্ধাঙগুলী দেখিয়ে ন্যায়ের দাবীতে জীবন দিতে পুলিশের সামনে বুক পেতে দেয় আবু সাঈদ।
ফলশ্রুতিতে ‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’; ‘আমার খায়, আমার পরে, আমার বুকেই গুলি করে’ শিক্ষার্থীদের এসব বজ্রকঠিন শ্লোগানে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হ’তে থাকে। তীব্র আন্দোলন সামলাতে না পেরে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। আবাসিক হলগুলো খালি করে দেয়া হয়, ইন্টারনেট বন্ধ করা হয় এবং সর্বত্র সেনাবাহিনী মোতায়েন করে কারফিউ জারী করা হয়। ১৯শে জুলাই আন্দোলনের নেতারা সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণাসহ সরকারের কাছে ৯ দফা দাবী পেশ করে। কারফিউ চলা অবস্থায় ২১শে জুলাই সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ৫৬ শতাংশ কোটা বাতিল করে ৯৩ শতাংশ মেধা; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।
অতঃপর ৫ দিন পর ২৩শে জুলাই সীমিত আকারে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু করা হয়। এই ৫ দিন সারা দেশের মানুষ ইন্টারনেটহীন অন্ধকার জগতে বসবাস করে। আন্দোলনের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। মেট্রোরেল ও বিটিভি বাংলার কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারী স্থাপনা দুর্বৃত্তদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আন্দোলনের কতিপয় কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের গুম করে পিটিয়ে আধমরা অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ফেলে রাখা হয়। ইন্টারনেট চালুর সাথে সাথেই এই ৫ দিনে পুলিশের হাতে নিহত হওয়া শিশু, বেসামরিক নাগরিক ও নিরীহ ছাত্রদের নিহতের তালিকা জনসম্মুখে ওঠে আসে। দেশ অস্থিতিশীল অবস্থায় চলে যায়। সেনা বাহিনী যুদ্ধের সাজে মাঠে নামে। আকাশপথে হেলিকপ্টার থেকে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করা হয়।
এবার শত শত শিক্ষার্থী ও কিশোর হত্যার বিচারসহ ৯ দফা দাবী আদায়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য নিহতদের স্মরণে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হ’লে ২৯শে জুলাই সেটা পরিহার করে চোখে-মুখে লাল কাপড় বেঁধে অনলাইনে প্রতিবাদী কর্মসূচী দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। মুহূর্তের মধ্যে ফেইসবুক প্রোফাইলগুলো লাল রঙে ছেয়ে যায় এবং ৩০শে জুলাই মুখে লাল কাপড় বেঁধেই বিচারের দাবীতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও রাজপথে নেমে আসে। সরকার আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথা বললে শিক্ষার্থীরা সাফ জানিয়ে দেয়, ‘বন্দুকের নলের সাথে ঝাঁজালো বুকের সংলাপ হয় না’। ফলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পরিণত হয় গণআন্দোলনে এবং ৯ দফা দাবী বদলে যায় সরকার পতনের ১ দফা দাবীতে। ৩ আগস্ট সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবীতে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত হন শিক্ষার্থীসহ লাখো জনতা। ৪ঠা আগস্ট সরকারের পদত্যাগের দাবীতে অসহযোগ কর্মসূচী পালন করা হয়। এদিন ছাত্র জনতার সাথে পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের সংঘর্ষে সারা দেশে ১০৪ জন নিহত হয়। পরদিন ৫ই আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচী পালনকালে দুপুর নাগাদ লক্ষ লক্ষ ছাত্র জনতা কারফিউ ভেঙ্গে ঢাকা দখল করে ফেলে। অতঃপর বিকাল গড়াতেই স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘণ্টা বেজে যায়। বিজয় উল্লাসে মেতে উঠে সারা দেশবাসী। তরুণ-যুবক শিক্ষার্থীদের ৬৫০টি[6] লাশের বিনিময়ে কুশাসনের অবসান ঘটিয়ে অর্জিত হয় দ্বিতীয় স্বাধীনতা।
মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
[1]. তানহা তাসনীম, বাংলাদেশে যেভাবে কোটা ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, বিবিসি নিউজ বাংলা, ১৪ই জুলাই ২০২৪; www.bbc.com /bengali/articles/ cmm2ze73enqo।
[2]. কালের কণ্ঠ, ৪ই মার্চ ২০২৪, পৃ. ১।
[3]. প্রথম আলো, ২৬শে অক্টোবর ২০২৩, পৃ. ১৬।
[4]. ইত্তেফাক, ৭ই মে ২০২৪, পৃ. ১৬।
[5]. কালের কণ্ঠ, ৪ই মার্চ ২০২৪, পৃ. ২।
[6]. কালের কণ্ঠ, ১৭ই আগস্ট ২০২৪, পৃ. ১।