হামদ ও ছানা পাঠের পর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। অতঃপর আয়াত পাঠ শেষে অনুবাদ করেন, ‘আর তুমি তোমার পরিবারকে ছালাতের আদেশ দাও এবং তুমি এর উপর অবিচল থাক। আমরা তোমার নিকট রূযী চাই না। আমরাই তোমাকে রূযী দিয়ে থাকি। আর (জান্নাতের) শুভ পরিণাম তো কেবল মুত্তাক্বীদের জন্যই’ (ত্বোয়াহা ১৩২ আয়াত)। অতঃপর তিনি বলেন,

(১) মানবজাতির প্রাথমিক ইউনিট হচ্ছে তার পরিবার। পরিবারবিহীন মানুষ পৃথিবীতে কোন কার্যকর সংস্থা নয়। ব্যক্তি নিজস্ব প্রতিভাবলে সমাজের অনেক উপকার করতে পারে। কিন্তু সমাজ গড়তে পারে না। মানুষের বংশবৃদ্ধির ব্যবস্থাপনা আল্লাহ পাক নিজেই দিয়েছেন। যেখানে একজন পুরুষ ও একজন নারীর ভূমিকাই প্রধান। পত্রিকায় দেখলাম, বিজ্ঞান এতদূর এগিয়ে গেছে যে, পুরুষ এখন নারীর মাধ্যম ছাড়াই সন্তান জন্ম দিতে পারবে। এটা যদি সত্য হয়, তবে ধ্বংস হৌক ঐ গবেষণা, ধ্বংস হৌক ঐ আবিষ্কার, যা আল্লাহর দেওয়া সুন্দর পারিবারিক ব্যবস্থাকে কৌশলে ধ্বংস করতে চায়। স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক প্রচেষ্টায় একটি পরিবার গড়ে উঠে এবং তাদের অপত্য স্নেহ ও নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে সন্তান প্রতিপালিত হয়। অতঃপর পিতা-মাতার আচরণসমূহ রপ্ত করেই সন্তানরা পর্যায়ক্রমে নিজেদের আচরণকে বিকশিত করে সুন্দর মানুষে পরিণত হয়।

(২) পরিবারের পরবর্তী ধাপ হচ্ছে সমাজ। সেখানে সুন্দর সন্তানদের মাধ্যমে সুন্দর সমাজ গঠিত হয়। সেকারণ মহান আল্লাহ মানব জাতিকে লক্ষ্য করে উপরোক্ত আয়াত নাযিল করে বলেন, তুমি তোমার পরিবারকে ছালাতের নির্দেশ দাও। সাথে সাথে নিজে ছালাতে অবিচল থাক’। নইলে পরিবার আপনার নির্দেশ মানবে না এবং সেখানে নৈতিকতাও থাকবে না। উপরোক্ত আদেশের মাধ্যমে পরিবারকে প্রথমেই আল্লাহভীরুতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। অতঃপর যাতে কোন সন্তান নাস্তিক ও বস্ত্তবাদী না হয়, সেজন্য আল্লাহ বলেছেন, তুমি রূযীর জন্য ব্যস্ত হয়ো না। আমিই তোমাকে রূযী দিয়ে থাকি। আর আল্লাহভীরুতাই হ’ল মূল পূঁজি। এই পূঁজি হারালে তুমি ও তোমার পরিবার দুই-ই ধ্বংস হবে।

(৩) পরিবারের পরেই আসে প্রতিবেশীর গুরুত্ব। রাসূল (ছাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! ঐ ব্যক্তি কখনোই ঈমানদার নয় (৩ বার), যার অনিষ্টকারিতা হ’তে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়’ (হাদীছ)। এর কারণ হ’ল এই যে, মানুষ কোথাও কখনো একা বাস করতে পারে না প্রতিবেশী ছাড়া। তাই তাদের মধ্যে যদি পারস্পরিক সহানুভূতি ও ভালোবাসা না থাকে, তাহ’লে সমাজ অশান্তিতে ভরে যাবে। মন্দ প্রতিবেশীর সাথে বসবাস করার চেয়ে জংগলে বসবাস করা অনেক ভাল।

(৪) এরপরে আসে সমাজ। সুন্দর পরিবার ও সুন্দর প্রতিবেশীদের নিয়ে গড়ে ওঠে সুন্দর সমাজ। অতঃপর সমাজের শৃংখলা রক্ষার স্বার্থে সকলকে জামা‘আতবদ্ধভাবে জীবন যাপন করতে হয়। সেখানে অবশ্যই একজনকে নেতা নির্বাচন করতে হয়। সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উক্ত নেতার আনুগত্য করতে হয়। ঐ নেতা যদি আল্লাহভীরু হন, তাহ’লে সমাজে শান্তি থাকে। আর যদি তার বিপরীত হয়, তাহ’লে সমাজ বিনষ্ট হয়। ইসলাম সর্বদা সর্বত্র আল্লাহভীরু নেতৃত্ব গড়তে চায়। আর সেই নেতাদের আনুগত্যের জন্য কুরআন ও হাদীছে কঠোর তাকীদ এসেছে।

(৫) বর্তমান অবস্থা : পৃথিবীর ইতিহাসে ৬টি জাতি কওমে নূহ, ‘আদ, ছামূদ, কওমে লূত, মাদিয়ান ও কওমে ফেরাঊন সবাই আল্লাহর অবাধ্যতা ও পাপাচারের কারণে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বর্তমানেও পাপাচারে সারা বিশ্ব ছেয়ে গেছে। এসব পাপাচার প্রতিহত করা একক ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিবেশী ও পরিবার সকলের সর্বমুখী প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকা আবশ্যক। নইলে আপনার ফুটফুটে সন্তানটির সুন্দর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। বরং সে অংকুরেই বিনষ্ট হবে।

গতকালের দৈনিক পত্রিকা যারা পড়েছেন, তারা অবশ্যই দেখেছেন যে, দেশের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (এটিএম শামসুল হুদা)-এর ভাইয়ের ১৭ বছরের একমাত্র সন্তান মোটরসাইকেল থাকা সত্ত্বেও পুনরায় নতুন মডেলের মোটরসাইকেল কেনার জন্য পিতার কাছে দাবী করে। পিতা তৎক্ষণাৎ রাযী না হওয়ায় ঘরের মধ্যেই তার শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে কয়েক ঘণ্টা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর তাঁর মৃত্যু হয়। সাথে মাও অগ্নিদগ্ধ হন। কি অমানবিক! এ পরিবারের অর্থ-বিত্তের কোন অভাব নেই। এক নামেই সকলে এই পরিবারকে চিনেন। দুর্ভাগ্য, যারা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নিয়েছেন, তারা নিজ পরিবারের একটি সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়তে ব্যর্থ হ’লেন!...

এর কারণ কি? সঠিক ইসলামী শিক্ষার অভাবেই পরিবারটি আজকের এই অবস্থায় পতিত হয়েছে। কয়েকদিন পূর্বে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনকালে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় দুঃখ করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন আর মানুষ তৈরী হয় না। এই খাতে সরকারের অর্থ ব্যয় করে কি লাভ? সন্ত্রাসী ও মাদকসেবী হয়ে গড়ে উঠার জন্য কি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী হয়েছে?

পত্রিকায় রাজধানীর নামকরা বিদ্যালয়গুলোর উপর প্রকাশিত সমীক্ষাতে দেখা গেছে যে, ভিকারুন্নেসা, আইডিয়াল প্রভৃতি  খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর জন্য শুধু টিউশনী বাবদই একজন ছাত্র/ছাত্রীর পিছনে পরিবার পিছু মাসিক গড়ে ৮ হাযার টাকা ব্যয় করতে হয়। যার শেষ ফলাফল হয়তোবা একটা জিপিএ-৫। অথচ হাযার হাযার জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম বর্ষ ইংরেজী সম্মান শ্রেণীর ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হ’তে পেরেছে মাত্র ৩ জন। তাহ’লে কতটুকু যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে তারা? এখন বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জঙ্গী হচ্ছে। তার কারণ একটাই। তাদের মধ্যে ইসলামের সঠিক জ্ঞান নেই। অতএব শিক্ষার সর্বস্তরে অবশ্যই সঠিক ইসলামী শিক্ষা সিলেবাসভুক্ত করতে হবে। সেই সাথে নীতিবান ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ধার্মিক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। যে সন্তানটি আগুন দিয়ে তার পিতাকে হত্যা করল, তাকে কখনই শিখানো হয়নি যে, পিতার সন্তুষ্টির উপরই আল্লাহর সন্তুষ্টি নির্ভর করে (হাদীছ)। সে জানে না যে, পিতা হচ্ছেন জান্নাতের মধ্যম দরজা। যা ভাঙলে তাকে জাহান্নামী হ’তে হবে’ (হাদীছ)। ‘মায়ের পদতলে সন্তানের জান্নাত’ (হাদীছ)। এগুলি জানলে ঐ সন্তান কখনই তার মায়ের অবাধ্য হ’তে পারত না।...

(৬) একটি সন্তান যখন নষ্ট হয়, তখন সে একা নষ্ট হয় না পুরো পরিবারের সম্মান নষ্ট হয়। তাই সন্তানকে এককভাবে দায়ী না করে আসুন নিজেরা সংশোধিত হই এবং পরিবারকে সংশোধনের চেষ্টা করি। আপনি নিজে ছালাত আদায় না করে যদি সন্তানকে বলেন মসজিদে যাও, সেটা কিভাবে সম্ভব? আপনি নিজে অন্যায় করবেন, অন্যদিকে সন্তানকে সৎকাজের আদেশ দিবেন, তাতে সন্তান কি শিখবে? আপনি যদি আপনার সন্তানকে এজন্য লেখাপড়া করিয়ে থাকেন যে, ছেলে বড় হয়ে অনেক অর্থ-সম্পদ উপার্জন করবে। আর আপনি বৃদ্ধ বয়সে নিশ্চিন্তে সেগুলি ব্যয় করবেন, তাহ’লে আপনি সন্তানকে ভুল পথে পরিচালিত করলেন। উদাহরণ স্বরূপ- ছেলেকে অধিক অর্থ আয় করার জন্য প্রবাসে পাঠিয়েছেন। এখন আপনি অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে রয়েছেন। আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া বা ঔষধ আনার জন্য প্রতিবেশীদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এমতাবস্থায় আপনার ছেলে-মেয়েরা কিন্তু কোন কাজে লাগছে না। এমনকি আপনার লাশটা কবরে নেওয়ার জন্যও অন্যের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়। অতএব কে কখন কার কাজে লাগবে, কার মাধ্যমে আপনার কল্যাণ আসবে, সেটা আপনার এখতিয়ারে নেই। সবকিছু আল্লাহর হাতে। তিনিই সবকিছুর মালিক (আয়াত)

(৭) সমাজ মাদকতা ও বেহায়াপনায় ভরে গেছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তিনজন ব্যক্তি কখনও জান্নাতে প্রবেশ করবে না। মদ্যপায়ী, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান ও পরিবারে ফাহেশা কাজের অনুমতি দানকারী ব্যক্তি’ (হাদীছ)। অর্থাৎ ‘দাইয়ূছ’ কখনই জান্নাতে প্রবেশ করবে না। অতএব পরিবারের প্রধানগণ সাবধান থাকুন।...

(৮) দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ এখন চাকুরীর জন্য প্রবাসে থাকেন। তারা তাদের পরিবারবর্গকে দেশে নিজ আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর দায়িত্বে রেখে যান। অতএব প্রতিবেশী ও নিকটাত্মীয়গণ পূর্ণ আল্লাহভীরুতার সাথে স্ব স্ব আমানতের হক আদায় করুন। প্রত্যেকে স্ব স্ব আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখুন।

(৯) আমাদের সন্তান যাতে অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বড় হ’তে পারে, সেজন্য হাদীছে এসেছে ৭ বছর বয়স থেকে সন্তানকে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে অভ্যস্ত করার এবং ১০ বছর বয়স থেকে শাসন করার (হাদীছ)। এভাবে সন্তানকে গড়ে তুলতে না পারলে আমরা সকলেই ব্যর্থ হয়ে যাব। ভবিষ্যতে সন্তান দ্বারা পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্বিয়ামতের দিন তারাই আল্লাহর দরবারে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে (আয়াত)

(১০) দেশের একশ্রেণীর আলেমের দুর্দশা দেখলে হতবাক হ’তে হয়। তারা সকলের সামনে দিব্যি তামাক/জর্দা দিয়ে পান খাচ্ছেন। তাদের দেখাদেখি তাদের সন্তান ও ছাত্ররাও বাল্যকাল থেকে পানখোর হচ্ছে।... জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসে, পান-জর্দা তো হারাম নয়, মাকরূহ। মাকরূহ অর্থ অপসন্দনীয়। কিন্তু যা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট অপসন্দনীয়, তা হারাম নয় কিভাবে? উদাহরণ স্বরূপ- আপনি যদি একটি আপেল মসজিদে খান, কেউ খারাপ বলবে না। কিন্তু যদি একটা সিগারেট মসজিদে পান করেন, তখন কি সেটা কেউ মেনে নিবে? অধিকাংশ সিগারেটখোর মলমূত্র ত্যাগের স্থানে ধুমপান করে। কিন্তু সেখানে বসে কি তিনি আপেল খান?

এভাবেই আপনি বুঝে নিন হালাল ও হারামের পার্থক্যটা কেমন! এক্ষণে একজন তামাক খোরের সন্তান যদি ইয়াবাখোর হয়, তখন তাকে রুখবে কে? (হাদীছ)।... দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তামাকের চাষ হচ্ছে। আমরা এর প্রতিবাদ করছি না। উপরন্তু তামাক চাষ ও ব্যবহারের মাধ্যমে হাযার হাযার কোটি টাকা আয় করে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আয়কৃত অর্থ দ্বারা হজ্জ-ওমরা করে সমাজে ও রাষ্ট্রে স্বনামধন্য ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত হচ্ছেন।... অতএব আসুন সবাই নিজেকে সংশোধন করি। সরকারের প্রতি আহবান, তামাক ও এর ব্যবহার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিন।

(১১) সৎ আমলের মাধ্যমে আল্লাহপাক আমাদের ক্ষমা করেন। বিভিন্ন বিপদাপদ থেকে রক্ষা করেন। তাই যথাসম্ভব বেশী বেশী সৎ আমল করুন। হে যুবকেরা সাধ্যমত নেকীর কাজে প্রতিযোগিতা কর। গুনাহের কাজ ও তার উপকরণ সমূহ থেকে দূরে থাক। যত বেশী নেকী তুমি অর্জন করবে, তত বেশী আল্লাহর রহমত তোমাকে বেষ্টন করে রাখবে। যে পরিবারে তাক্বওয়া বেশী, ঐ পরিবারে আল্লাহর রহমত বেশী। আল্লাহ আমাদের কিভাবে সাহায্য করবেন, সেটা তাঁর উপরেই ছেড়ে দিন। আমাদের দায়িত্ব হ’ল, কথা ও কর্মে আল্লাহকে ভয় করে চলা। আল্লাহভীতির মাধ্যমেই আল্লাহর রহমত তালাশ করা। কেননা আল্লাহর রহমত বর্ষিত হ’লে কোন মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন হয় না’ (হাদীছে কুদসী)

(১২) পরিশেষে সন্তানকে শিশুকাল থেকেই মহান আল্লাহর একত্ববাদ, ইসলামের বুনিয়াদী বিষয়সমূহ ও আদব-আখলাক হাতে-কলমে শিক্ষা দিন। জান্নাতের অফুরন্ত নে‘মত ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন করুন। তাতেই পরিবার ও সামাজিক জীবন সুশৃংখল ও শান্তিময় হবে ইনশাআল্লাহ।






আরও
আরও
.